প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে লজ্জায় আমার মাথা নিচু হয়ে গেল।
প্রধানমন্ত্রী তখন গুজরাটে। বরাবরের মতোই তিনি দারুন ভাষণ দিচ্ছিলেন। তাঁর আট বছর ধরে করে যাওয়া জাতির সেবাকার্যের প্রশংসা করছিলেন। তিনি বলেন, "আমি আট বছরে ভুল করেও এমন কিছু হতে দিইনি, এমন কিছু করিনি যা আপনাকে বা দেশের কোনো নাগরিকের মাথা নত করাবে"। প্রধানমন্ত্রীর এই মিথ্যেটা আগের সবকটাকে ছাড়িয়ে গেছে। কথাটা শুনে গত আট বছরের আটটি ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল।
প্রথম ছবিটি ছিল একটি স্যুটকেসের উপর এক ঘুমন্ত শিশুর, যার বাবা-মা শত শত কিলোমিটার হেঁটে বিধ্বস্ত অবস্থায় গ্রামে ফিরছে। লকডাউনের সময় এরকম শত শত ছবি দেখে প্রত্যেক ভারতীয় লজ্জায় মাথা হেঁট করেছে। লকডাউন সারা বিশ্বে কমবেশি প্রভাব ফেলেছিল, তবে এমন ভয়ঙ্কর ছবি আফ্রিকার দরিদ্রতম দেশ থেকেও আসেনি। পরিসংখ্যান দেখায় যে ভারত সরকার তাদের মধ্যে একটা দেশ যারা সারা বিশ্বে করোনা ত্রাণ প্যাকেজে মাথাপিছু সবচেয়ে কম অর্থ খরচ করেছিল। এই যন্ত্রণা নিয়ে কবিতা লেখা হয়েছে, বই লেখা হয়েছে, চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে কিন্তু সেই মাথা নিচু করা ঘটনা ভারত প্রধানমন্ত্রীর চোখে পড়েনি।
দ্বিতীয় ছবিটি করোনাকালের গঙ্গায় ভেসে যাওয়া মৃতদেহ, ধু - ধু করে জ্বলা শ্মশান, হাসপাতালের বাইরে ছটফট করতে থাকা রোগী, অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য ছুটোছুটি করতে থাকা রোগীর আত্মীয় স্বজনের। সারা বিশ্বে করোনা মহামারি এলেও এত মৃত্যু ও অব্যবস্থা খুব কম দেশেই দেখা গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সত্য উদঘাটন করে জানিয়েছে করোনার সময়কালে ভারতে মৃত্যু সংখ্যা প্রায় ৪৭ লক্ষ। করোনা সংক্রমণে মৃত্যুর হার যে দেশগুলিতে সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে ভারত একটি। সারা বিশ্বের সামনে প্রকাশিত এই খবর কি আমাদের মাথা হেঁট করে দিচ্ছে না?
তৃতীয় ছবিটি বিমুদ্রাকরণের সময় দীর্ঘ লাইনের। এখন সরকারপন্থী অর্থনীতিবিদরাও মনে করেন এই সিদ্ধান্ত ছিল তুঘলকি। খোদ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্যেই প্রমাণিত হয়েছে যে, নোটবন্দির পর সমস্ত কালো টাকা সাদা হয়ে গেছে, জাল নোটের প্রচলন আগের থেকে অনেক বেড়েছে এবং নগদ টাকার মাধ্যমে দুই নম্বরি ব্যবসা আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকে ভারত সরকারের বিমুদ্রাকরণের সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক মুদ্রানীতির মডেল হিসেবে পড়ানো হবে। এসব ভাবতেই মাথা নত হয়ে যায়।
চতুর্থ ছবিতে আমরা দেখতে পাই সরকারি চাকরির অপেক্ষায় মাইলের পর মাইল ছুটে চলা যুবকদের, নিয়োগ কারচুপির বিরুদ্ধে রেলপথে আন্দোলনরত প্রার্থীদের এবং বেকারত্বের বিরুদ্ধে যুবসমাজের নজরকাড়া বিক্ষোভ। পরিসংখ্যান দেখায় যে বর্তমানে ভারতে বেকারত্বের হার স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তরুণদের বেকারত্বের হার বিশ্বের সর্বোচ্চ। শুধু তাই নয়, কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা নিভে যেতে দেখে এখন কর্মসংস্থানের খোঁজ বন্ধ করে দিয়েছে কোটি কোটি মানুষ। এই সব মাথা নত করে দেওয়া ছবি দেখার সময় আছে মোদীজির?
পঞ্চম ছবিটি মোদীজির আট বছরের নির্বাচনী প্রচারের হোর্ডিং “বহুত হুই মেহেঙ্গাই কি মার, আব কি বার মোদী সরকার”। গত মাসে এই রেকর্ডও ভেঙেছে। এখন দেশে পাইকারি মূল্যবৃদ্ধি সূচক গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ইউক্রেনীয় যুদ্ধের আগেই এর আরোহণ শুরু হয়েছিল। আজও আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেল আট বছর আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু পেট্রোল, ডিজেল ও গ্যাসের দাম দেড় থেকে দুই গুণ বেড়েছে। এদিকে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গেছে, কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার কথা মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। হ্যাঁ আম্বানির সম্পদ বেড়েছে তিনগুণ আর আদানির সম্পদ বেড়েছে চোদ্দগুণ। ভাবছি, নিজের পুরনো হোর্ডিং দেখে প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই মাথা নত করেছেন?
ষষ্ঠ ছবি সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের দীর্ঘশ্বাস। এই ছবিটাও হতে পারত গোদি মিডিয়ার কোনো অ্যাঙ্করের। গত আট বছরে প্রতিদিনই ভারতীয় গণতন্ত্র শ্বাসরুদ্ধ হয়েছে, প্রতিটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান স্বায়ত্তশাসন হারিয়েছে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার র্যাঙ্কিংয়ে প্রতি বছরই ভারত নেমে যাচ্ছে। বিদেশী র্যাঙ্কিংয়ের উদ্বেগকে একপাশে রেখে, প্রতিটি ভারতীয়ের চোখের সামনে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি ভেঙে পড়ছে। যেহেতু এক সময় আমি সারা বিশ্বে ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রশংসা করতাম, তাই আজ অন্তত আমার মাথা নত হয়।
সপ্তম ছবি বুলডোজার, লিঞ্চিং এবং ধর্ম অবমাননার। গোটা বিশ্ব যখন এই সময়ে সংকট কাটিয়ে উঠছে, দেশবাসী তাদের খড়কুটো এক কাট্টা করছে, সেই সময়ে আমাদের দেশে সরকারের নাকের ডগায় যতসব ঘৃণা ছড়াবার সম্মেলনের আয়োজন করা হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাদের ওপর চলছে বুলডোজার। গণপিটুনি এখন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা হিংসায় উসকানি দেয় তারাই এখন বড় বড় পদে আসীন। সারা বিশ্বের সামনে ভারতের আজ মুখ পুড়লেও প্রধানমন্ত্রী নীরব। ওনার মাথা হেঁট হওয়া তো দূরের কথা বরং ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে তা আরও উঁচু হয়েছে।
অষ্টম এবং শেষ ছবিটি আসলে একটি স্যাটেলাইট ম্যাপ যা শুধু ভারতের মিডিয়া নয়, গোটা বিশ্ব দেখছে। এই স্যাটেলাইট ইমেজ দেখায় যে ১৯৬২ সালের পর প্রথমবারের মতো, চীনের সেনাবাহিনী লাদাখে ভারতের দাবিকৃত ৯০০ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকা দখল করেছে, যার উপরে চীন একটি সেতুও নির্মান করছে, অরুণাচল প্রদেশে ভারতীয় মাটিতে গ্রাম বসতি স্থাপন করছে। পাকিস্তানের উপর সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে কথা বলতে ক্লান্ত না হওয়া মোদি সরকার চীনের সাথে গন্ডগোল করতে ভয়ে নতজানু ভাষায় কথা বলে। এই সত্যের মুখোমুখি হয়ে প্রত্যেক দেশপ্রেমিক ভারতীয়ের মাথা নত হওয়া উচিত নয়?
রাজকোট থেকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শোনার পর আমি ভাবতে লাগলাম: এটা কি আমার মাথার সমস্যা যে অকারণেই মাথা নত হয়ে যায়? নাকি নির্বাচনী সাফল্য মোদীজির মাথায় চড়ে বসেছে?
আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিন।