কন্নড় লেখক দেবানুরা মহাদেব তাঁর এই ৬৮ পাতার বইয়ে চিরাচরিত নীরবতাকে ভেঙে আরএসএস-এর মুখোমুখি মহড়া নিয়েছেন। ঘৃণার রাজনীতির সত্যকে উন্মোচিত করলেও, দেবানুরা মহাদেবের আরএসএস-সমালোচনা কিন্তু একেবারেই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি-প্রতর্কের চর্বিতচর্বন নয়।
কয়েক বছর আগে, ২০১৭ সালে আমরা কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার করে ফিরছিলাম।দলের জনৈক প্রার্থীর ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট ছিলামনা। সে ব্যাপারে যে ব্যাখ্যা শুনেছিলাম, তাতেও না। ফলে আমি সোজা তাঁর কাছে গিয়ে বলি: “দেভানুরা সার (এইভাবে বললে, ‘স্যার’ একটি কন্নড় শব্দ হয়ে যায়), ব্যাপারটা কী বলবেন? কূটনৈতিক কায়দার দরকার নেই। আপনি নির্দ্বিধায় বিশুদ্ধ সত্যকথন করতে পারেন।” জবাবে গাড়ির সামনের সিট থেকে ঘুরে, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন: “আমি সত্যকথনই করি।” তিনি আর যা বলেছিলেন, তা আর মনে নেই, কিন্তু এইটুকু চিরতরে আমার অংশ হয়ে থেকে গেছে। আর বলছি না, তা আমার সাথেই থেকে গেছে। আত্মপ্রচার নয়, সওয়াল-জবাব নয়, প্রত্যাখ্যান না, শুধু এক সরল বক্তব্য: আমি সত্যবাদী। ঠিক যেমন কেউ বলে: আমি ভোরে উঠি।
এই হলেন দেবনুরা মহাদেব। এক আইকনিক কন্নড় সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব, জনসাধারণের বুদ্ধিজীবী এবং কর্ণাটকের এক শ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক কর্মী। এতই মুখচোরা এবং আত্মপ্রচার বিমুখ, যে মাঝে মাছে সন্দেহ হতে শুরু করে, যে এই লোকটি জনজীবনে করছে টা কী। জনতার মনোযোগ থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার বিশেষ প্রতিভা রয়েছে তাঁর। মঞ্চে তাঁকে হঠাৎই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা— কেউ হয়তো দয়াপরবশ হয়ে বলল: উনি ধূমপান করতে গেছেন। মহাদেব সর্বদা এবং বিরক্তিকরভাবে দেরিতে চলেন, এমনকি আমার তুলনায়ও, সবসময় একটু অপ্রীতিকর, হয়তো কিছুটা বিকৃতও। সেটা কিন্তু বোহেমিয়ান কবির যত্ন সহকারে পরিকল্পিত অসাবধানতা নয়, তাঁর জীবনের এক আলাদা ছন্দ আছে, আছে নিজস্ব পূর্বাপরবোধ, যা চিরাচরিত কোনো খ্যাতনামা ব্যক্তির ক্ষেত্রে কল্পনাই করা যায়না।
ওহ, বলতে ভুলে গেছি, তিনি দলিত। কিন্তু এখন তাঁকে দলিত লেখক বা দলিত কর্মী বলার জন্য তাড়াহুড়া করবেন না। এটি একটি গুরুতর ভুল স্বীকৃতি, একটি ভুল বিভাগ। আমরা শেখর গুপ্তকে বেনিয়া বুদ্ধিজীবী হিসাবে বর্ণনা করি না, বাজারের প্রতি তার স্পর্শকাতর, একটা ভেজাল বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও। রিজার্ভেশন বা জাতিসুমারি নিয়ে আমার কঠোর অবস্থান সত্ত্বেও আমাকে একজন ওবিসি বুদ্ধিজীবী হিসাবে বর্ণনা করা হয়নি (আশা করি)। একইভাবে, দেবানুরা মহাদেবকে একজন দলিত বুদ্ধিজীবী বললে আমরা তাঁর সামাজিক উত্স, তিনি যে সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে লেখেন এবং যে সাংস্কৃতিক সম্পদের উপর তিনি আঁকেন, তার গড়পরতা পরিচয় ছাড়া আর কিছুই জানতে পারব না। একাধিক দলিত কর্মীদের থেকে তিনি ভিন্ন, তিনি ক্ষুব্ধ দলিত চরিত্রে অভিনয় করতে অস্বীকার করেন। তাঁর দিগন্তকে মানবতার আংশিক আকাশে সীমাবদ্ধ করতে চান না। তিনি কেবল সত্যই তুলে ধরেন।
সেটি করতে গিয়ে, তিনি বৌদ্ধিক শ্রমের যুগ-পুরোনো বিভাজন মেনে নিতে অস্বীকার করেন যা আমাদের সময়ে নির্বিঘ্নে অব্যাহত রয়েছে। বহিষ্কৃত, আধুনিক দলিত এবং ওবিসিরা বড়জোর তাদের নিজস্ব উকিল, সত্যের এক টুকরোর ভারপ্রাপ্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করতে পারে।ব্রাহ্মণজন্ম নেহাৎই এক দুর্ঘটনা, কিন্তু তারপরেও ব্রাহ্মণদেরই সত্যের নিরপেক্ষ সালিশকারী, যাদের সহানুভূতি শূদ্র সহ সকলের প্রতি ব্যক্ত, এই বলে ধরে নেওয়া হয়। মহাদেব এই ভূমিকাগুলিকে অস্বীকার করে তাঁর কথাসাহিত্যে উচ্চবর্ণের চরিত্রগুলি সহ সকলের কাছে দাতব্য প্রসারিত করেন। তার রাজনীতি প্রকৃতি সহ সমগ্র মানবতা এবং তাকে পেরিয়ে আলিঙ্গন করে বৃহৎ জনসমুদ্রকে।
আজকাল দেবানুরা মহাদেব খবরের প্রথম পাতায়। কন্নড় সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিতদের কাছে তাঁর কোনও পরিচয়ের প্রয়োজন নেই — আপনার ফ্যান ক্লাবে যদি এ.কে. রামানুজন, ইউ.আর. অনন্তমূর্তি, ডি.আর. নাগরাজ এবং শেলডন পোলক থাকেন তবে আপনারও প্রয়োজন নেই। কিন্তু অবশেষে এবার তাঁর খ্যাতি হিন্দি সংবাদপত্রসহ দিল্লিভিত্তিক ‘জাতীয়’ মিডিয়াকে নাড়া দিয়েছে। তাঁর এই ছোট বইটি আমাদের সময়ের জন্য একটি ৬৪ পৃষ্ঠার দলিল, যা সমাজে সাড়া ফেলে দিয়েছে।
প্রকাশের প্রথম মাসের মধ্যে, RSS: Aaala Mattu Agala [RSS: Its Depth and Breadth] ১ লাখের বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। এর ইংরেজি, তেলেগু, তামিল, মালায়ালাম এবং আশা করছি, হিন্দি অনুবাদের কাজ চলছে। [সম্পূর্ণ তথ্য: আমি এর হিন্দি সংস্করণ প্রকাশনার সাথে জড়িত।] বিকেন্দ্রীকরণের প্রতি সত্য বিশ্বাস রেখে, তিনি ওপেন সোর্স প্রকাশনাকেই বেছে নিয়েছিলেন। কর্ণাটকের বেশ কয়েকজন প্রকাশককে একই সঙ্গে বইটি বের করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। শিক্ষার্থী এবং গৃহিণীরা দলে দলে অর্থ সংগ্রহ করে তাদের নিজেদের জন্য এই বই ছাপাচ্ছেন । লেখক কোন রয়্যালটি চাননি।
এই বইয়ের তাত্ক্ষণিক সাফল্যের পিছনে কারন টা কী? আমি আমার বন্ধু প্রফেসর চন্দন গৌড়ার কাছে গিয়েছিলাম, একজন সমাজবিজ্ঞানী যিনি কর্ণাটকের সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন, বিশেষ করে মহাদেব যে সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য থেকে এসেছেন। এখানে সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ, গৌড়া বলেছিলেন, রাজ্যে তীব্র সাম্প্রদায়িক পরিবেশ সৃষ্টির প্রধান কারণ এটাই। বিষয়টা এমন: খুব কম লেখক, এমনকি বিজেপির প্রগতিশীল সমালোচকরাও আরএসএসকে মাথা পেতে নিতে ইচ্ছুক। ক্রমে বেড়ে চলা এক নীরবতা রয়েছে এখানে। এই কারণেই আরএসএসের এই স্পষ্ট সমালোচনা নজর কেড়েছে।
সর্বোপরি, গৌড়া আমাকে মনে করিয়ে দেন, বইটি তার লেখকের কারণে চলছে। যারা কন্নড় জানেন তারা সবাই জানেন যে দেবানুরা মহাদেব সত্যবাদী। সকলেই জানেন যে তিনি ২০১০ সালে লোভনীয় নৃপতুঙ্গা পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং ১৯৯০-এর দশকে রাজ্যসভায় মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি ২০১৫ সালে তাঁর পদ্মশ্রী, এবং সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারও ফিরিয়ে দিয়েছেন। তিনি বাজারি লেখক নন। তাঁর সমস্ত সাহিত্যিক কর্মকান্ডের আয়তন ২০০ পৃষ্ঠা। তাঁর প্রবন্ধগুলি সংক্ষিপ্ত, তাঁর বক্তৃতাগুলি আরও সংক্ষিপ্ত, সাধারণত লিখিত, যা তিনি কোনও প্রভাব ছাড়াই পড়েন। কিন্তু কন্নড়ীগাস তাঁর প্রতিটি কথায় অটল থাকে। তার কথা বিক্রির জন্য নয়। আপনি তাঁকে বাঁকাতে পারবেন না। আপনি তাঁর সাথে মিষ্টি কথা বলতে পারবেন না। এমনকি তার সমালোচকরাও তাঁর দিকে আঙুল তোলেন না।
তার সত্য কোনো নিছক তথ্য-তাড়িত বা বিকৃত নয়। আরএসএস সম্পর্কে তার সমালোচনা ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শগত বিতর্কের পুনরাবৃত্তি নয়। প্রফেসর রাজেন্দ্র চেন্নি, ইংরেজি ও কন্নড় সাহিত্যের ছাত্র এবং তার পুরনো সহযোগী, আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে দেবানুরা মহাদেব তার সত্যকে উপকথা এবং লোককাহিনী, মিথ এবং রূপকের মাধ্যমে বুনেছেন, ‘বাস্তবতার’ কারাগার ভেঙে দিয়েছেন যা দলিত সাহিত্যের অনেকাংশের সমস্যা।
ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য নতুন ভাষা
উক্ত বইতে তিনি এই কাজটিই করেছেন। যদিও বইটির বেশিরভাগ অংশই ঘৃণার রাজনীতির সত্যকে উন্মোচন করেছে - আর্য উত্সের মিথ, জাতি আধিপত্যের লুকানো উদ্দেশ্য, সাংবিধানিক, প্রতিষ্ঠান এবং মৈত্রীতন্ত্রের স্বাধীনতার উপর আক্রমণ এবং পুঁজিবাদ-বান্ধব কাজ করে এমন অর্থনৈতিক নীতি - তিনি গল্পের মাধ্যমে তার বার্তা বুনে গিয়েছেন। ‘নালে বা’ [আগামীকাল আসুন] আচারের উপরেও তাঁর লেখা রয়েছে, যেখানে লোকেরা পরিচিত কণ্ঠের অনুকরণে আপনার দরজায় কড়া নাড়া ডাইনিকে তাড়াতে এই শব্দগুলি খোদাই করে। [আমি হিন্দিতে এর সবচেয়ে কাছের কথাটি ভাবতে পারি “আজ নগদ, কাল ধার” যা, ধারে খাওয়া লোকেদের তাড়ানোর জন্য দোকানের কাউন্টারে খোদাই করা থাকে]। আমাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করার জন্য উন্মুখ রাক্ষস চারপাশে রয়েছে, এবং তারা তাদের প্রাণকে সাত সমুদ্র দূরে একটি পাখির মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে (একজন রাজার গল্পের মতো যার জীবন একটি তোতাপাখির মধ্যে ছিল), বইটি আমাদের সাবধান করে। আমাদের বাড়ির সামনের দরজায় “নাল্লে বা” লিখে রাখা উচিত, ঠিক যেমন আমাদের পূর্বপুরুষরা করেছিলেন।
দেবানুরা মহাদেব ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার সাংস্কৃতিকভাবে রক্তশূন্য রাজনীতিতে একটি গভীর ও সুদূর প্রসারী নতুন ভাষা দান করেছেন। তাঁর বইটি সৃজনশীল এবং রাজনৈতিক লেখার মধ্যে বিভাজন ভেঙ্গে দেয়, যেমন তাঁর উপন্যাস কুসুমাবলে গদ্য এবং পদ্যের মধ্যে বিভাজন লঙ্ঘন করেছিল। রাজনৈতিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অনেক সাহিত্যের বিপরীতে, তিনি তার সৃজনশীল প্রতিভা রাজনৈতিক বক্তৃতার জন্য ব্যবহার করেন না, সত্যকে তিনি ফুলের অতিরঞ্জনে অলঙ্কৃত করেননি। তিনি সৃজনশীল-রাজনৈতিক লেখাকে সত্য আবিষ্কারের পথ হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য রাজনৈতিক তত্ত্ব বা উচ্চ সাংবিধানিকতার ভাষা ব্যবহার করেন না। তিনি মানুষের সঙ্গে তাদের ভাষা, তাদের রূপক এবং তাদের সাংস্কৃতিক স্মৃতির মাধ্যমে কথা বলেন। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির এটাই আজ প্রয়োজন।
দেবনুরা মহাদেবের কথা আমি প্রথম শুনেছিলাম আমার বন্ধু, প্রয়াত ডি.আর. নাগরাজের কাছে, প্রায় তিন দশক আগে। তৎকালীন মারাঠি ও হিন্দি ভাষার সাথে কন্নড়ের দলিত সাহিত্যের তুলনা করে তিনি বরং দুষ্টুমি করে বলেছিলেন: “তাদের সাহিত্যের চেয়ে দলিত বেশি, আমাদের প্রথমে সাহিত্য তারপর দলিত।” বছরের পর বছর ধরে আমি সেই মন্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থের স্তরগুলি বুঝতে পেরেছি, দেবানুরা মহাদেবের সাথে আমার বন্ধুত্ব এবং রাজনৈতিক সহবাসের জন্য ধন্যবাদ। আমি বুঝতে পেরেছি যে ‘দলিত’ বা ‘সাহিত্য’ বা এর সংমিশ্রণ রাজনৈতিক, নৈতিক এবং আধ্যাত্ত্বিক অনুসন্ধানকে ধরতে পারে না যতটা মহাদেবের লেখায় মূর্ত হয়। ভারতকে দেবানুরা মহাদেবের এই বার্তাটি আজকে আগের চেয়ে আরও বেশি করে অনুধাবন করতে হবে: “বিভক্তি একটি দানব এবং ঐক্য হল ঈশ্বর।”