দিল্লির ঐতিহাসিক রামলীলা ময়দানে ৩১ মার্চ, রবিবার "লোকতন্ত্র বাঁচাও" ব্যানারে ইন্ডিয়া জোটের সমাবেশে অভূতপূর্ব দাবিপত্র পেশ করা ভারতের গণতন্ত্রের সামনে একটি বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। এই সমাবেশে উপস্থিত দেশের সমস্ত বিরোধী দলের নেতারা সর্বসম্মতিক্রমে একটি পাঁচ দফা দাবিপত্র প্রদান করেন যা আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে যে অনিয়ম চলছে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সরাসরি এই নির্বাচনে "ম্যাচ ফিক্সিং" এর অভিযোগ করেছেন এবং বলেছেন, এই ফিক্সিং বিজেপি কিছু বড় কর্পোরেটদের সহায়তায় করছে যাতে তারা নিজেদের ইচ্ছে মতো সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে।
অভিযোগ ভীষণ গুরুতর। শুধু বিরোধী দল বা কোনও বড় নেতার কথায় তা প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু দেশের সব প্রধান বিরোধী দল যদি একত্রিত হয়ে আওয়াজ তোলে, তাহলে তা শোনা ও তদন্ত করা জরুরি হয়ে পড়ে। বিশেষ করে আমাদের দেশেও বিরোধী দলগুলোর নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার রেওয়াজ নেই। কখনও কখনও একজন বিরোধী দলীয় নেতা একটি নির্বাচনকে জালিয়াতি বলে থাকতে পারেন, তবে সাধারণত নির্বাচনের পরেও, পরাজিত দল নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত ফলাফলকে স্বীকৃতি দেয়। এই অর্থে, ভারতীয় গণতন্ত্রিক পরিকাঠামো আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের থেকে আলাদা, ওই দেশে বিরোধী দলগুলি নির্বাচনী প্রক্রিয়াটিকে জালিয়াতি বলে অভিহিত করে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফলাফলগুলিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। রামলীলা ময়দানে জারি করা প্রস্তাবপত্র একটি বিপদঘণ্টা, যেখানে প্রশ্ন উঠে আসে, আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সে দিকেই এগোচ্ছে না তো?
তবে এই প্রস্তাবপত্রের ভাষা পরিমিত, সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সাংবিধানিক পরিসরের মধ্যে। বিরোধী দলগুলির প্রথম এবং মৌলিক দাবি হল "নির্বাচন কমিশনকে লোকসভা নির্বাচনে সমান সুযোগ সুনিশ্চিত করতে হবে।" এখানে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই, তবে ইঙ্গিত স্পষ্ট। নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দেখা গেলে অবশ্যই এমন দাবি উঠত না। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। সীমা ছুঁয়ে গেল যখন সরকার, সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ সংক্রান্ত একটি আইন আনে, তারপর নির্বাচন কমিশনার অরুণ গোয়েল রহস্যজনকভাবে পদত্যাগ করেন এবং আচমকা একদিনে দুই নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করা হয়। স্পষ্টতই, নির্বাচনী খেলা শুরুর ঠিক আগে দুই রেফারি বদলানোর এই অসাধারণ পদক্ষেপ সকলের মনে সন্দেহ জাগায়। প্রশ্ন উঠেছে, ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন কমিশনকে এমন কিছু কাজ করাতে চেয়েছিল যা আগের কমিশনার পরিবর্তন না করলে সম্ভব ছিল না? এই সংশয়ের সমাধান না হলে এমনও পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে যে, বাংলাদেশের মতো ভারতেও দাবি উঠবে নির্বাচন কমিশনকে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন করাতে হবে।
দ্বিতীয় প্রস্তাব: "নির্বাচন কমিশনের উচিত নির্বাচন কারচুপির লক্ষ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে আয়কর, ইডি এবং সিবিআই দ্বারা জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থা বন্ধ করা"। এই দাবি নির্বাচনে খোদ সরকার কর্তৃক তদন্তকারী সংস্থার অস্বাভাবিক অপব্যবহারের বিষয়টি তুলে ধরে। ক্ষমতাসীন দল মোদী ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই এই সংস্থাগুলিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু এই সমস্ত সংস্থা এত নির্লজ্জভাবে বিরোধী দলগুলির নেতাদের পিছনে লেগেছে এবং নির্বাচনী আচরণবিধি জারি হওয়ার পরেও বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অভিযান, এফআইআর এবং গ্রেপ্তারের ধারাবাহিকতা চালিয়ে যাচ্ছে, ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে তা নজিরবিহীন।
এই একতরফা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সবচেয়ে বড় দু’টি উদাহরণ নিম্নলিখিত দাবিতে প্রকাশ করা হয়েছে: “হেমন্ত সোরেন এবং অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। এখানে প্রশ্ন এই নয় যে বিরোধী নেতা বা কোনও মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগের তদন্ত হওয়া উচিত কি না। স্পষ্টতই কোনও ব্যক্তি আইনের ঊর্ধ্বে হতে পারে না। মুখ্যমন্ত্রী হোক বা প্রধানমন্ত্রী, সবার ক্ষেত্রে খতিয়ে দেখা উচিত। প্রশ্ন হল, শরদ রেড্ডির মতো কারও সন্দেহজনক বক্তব্যের ভিত্তিতে কি কাউকে দোষীসাব্যস্ত করা যায়? যদি অভিযোগ থাকেও, গ্রেপ্তারের প্রয়োজনীয়তা আছে কি? যেখানে প্রমাণ নষ্ট করার কোনও সম্ভাবনা নেই? গ্রেপ্তার করতে হলেও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাঝখানে তা করার কী দরকার? যদি এজেন্সিগুলির নিয়মও থাকে যে তারা যাকে খুশি গ্রেপ্তার করতে পারে, তবে কেন শত শত বিজেপি নেতাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না যাদের বিরুদ্ধে আরও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে?
চতুর্থ দাবি এর সঙ্গে জড়িত প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের সঙ্গে সম্পর্কিত যা এই নির্বাচনে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগকে গুরুতর করে তুলেছে: "নির্বাচনের সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে আর্থিকভাবে শ্বাসরোধ করার জবরদস্তি পদক্ষেপ অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত"। নির্বাচন শুরুর মাত্র কয়েকদিন আগে আয়কর দফতর যেভাবে কংগ্রেসের পুরনো অ্যাকাউন্ট খুলে সেই অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছে এবং প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা জরিমানা করেছে তা থেকে একটাই উপসংহারে আসা যায় যে এই পদক্ষেপ দেশের প্রধান বিরোধী দলকে নির্বাচনে পঙ্গু করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। পঞ্চম দাবি হল, আসলে যেখানে তদন্ত করা উচিত সেখানে নজর দেওয়া: "বিজেপি নির্বাচনী বন্ড ব্যবহার করে প্রতিহিংসা, চাঁদাবাজি এবং আর্থিক দুর্নীতি ঘটিয়েছে, তার তদন্ত করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে একটি সিট গঠন করা উচিত"।
এই সমস্ত দাবি অত্যন্ত গুরুতর, যাকে কোনও ভাবে ভিত্তিহীন বলা যায় না। সরকার বা নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকালীন সময়ে এসব দাবির বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে বলে আপাতত মনে হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনী ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। এমন প্রশ্নও উঠতে পারে যে, নির্বাচনের ম্যাচ যদি আগে থেকেই ফিক্সড থাকে, তাহলে বিরোধীদেরও তাতে কেন অংশ নিচ্ছে? এ ধরনের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধীরা এই পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বৈধতা দিচ্ছে না তো?
বর্তমানে রামলীলা ময়দান থেকে পাস করা এই দাবিপত্রটি অত্যন্ত সংযম দেখায়। এমনকি নির্বাচন বয়কটের মতো কিছুরও উল্লেখ বা ইঙ্গিত দেয় না। বরং বুঝিয়ে দেয় "বিজেপি সৃষ্ট অগণতান্ত্রিক বাধা সত্ত্বেও, ইন্ডিয়া জোট আমাদের গণতন্ত্রকে লড়াই করতে, জয় করতে এবং বাঁচাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং আত্মবিশ্বাসী।" তবে এ কথা তো অস্বীকার করার জায়গা নেই, গোটা বিষয়টা জনসমক্ষে যখন এসেই পড়েছে তা বহুদূরে ছড়িয়ে পড়বে এটা একেবারে নিশ্চিত