১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরে, দেশে এক নতুন রাজনৈতিক বোধ দেখা দেয়। সেই দিনগুলিতে জনতা পার্টি এবং তার সমর্থকরা মনে করতেন লোহিয়া যেন একজন ঈশ্বরের দূত। তিনি বেঁচে থাকলে দেশ আরও গতি পেত। সেই সময়ে ইউরোপ থেকে একজন সমাজকর্মী দিল্লিতে এসেছিলেন, যিনি বুঝতে পারেননি লোহিয়া কে এবং কেমন! লোহিয়ার বইও ইংরেজিতে পাওয়া যেত না। অগত্যা তিনি জনতা পার্টির কিছু উচ্চপদস্থ লোহিয়াঘনিষ্ঠ নেতার সঙ্গে দেখা করেন এবং কথা বলেন। এই সব নেতাদের সঙ্গে তাঁর ওই বৈঠক ছিল খুবই হতাশাজনক, যে কারণে তিনি পরে বলেছিলেন, 'আমি যদি এঁদের কথা শুনে লোহিয়াকে বিচার করি তবে মনে করব যে তাঁর কোনও বিশেষ মৌলিক ধারণা তো ছিলই না, বরং অবশ্যই অত্যন্ত অহংকারী ব্যক্তি ছিলেন এই লোহিয়া।' তাঁর এই প্রতিক্রিয়া লোহিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, প্রযোজ্য তাঁর শিষ্যদের জন্য যাঁরা উচ্চপদে পৌঁছেছেন। গান্ধীবাদী ধারার সমস্ত মহান ব্যক্তিত্বদের এবং তাদের অনুগামীদের মধ্যে এত বিশাল ব্যবধান রয়েছে যে অনুগামীদের দেখে নেতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। গান্ধী, নেহেরু, জয়প্রকাশ (জেপি) সম্পর্কেও একই কথা বলা যেতে পারে। সম্ভবত এঁরা তাঁদের চিন্তাকে সাংগঠনিক রূপ দিতে পারেননি, যার কারণে তাঁদের উচ্চতা জীবনকাল পর্যন্ত তাঁদের অনুগামীদের প্রভাবিত করতে পেরেছিল। কিন্তু পরে সেই অনুগামীরাই ফাঁপা হয়ে তাঁদের গুরুদের নিছক অনুকরণে পরিণত হয়।
লোহিয়ার ব্যক্তিত্বে তিনটি বৈশিষ্ট্য ছিল, যা তাঁর সংগঠন এবং অনুগামীদের মধ্যে প্রতিফলিত হওয়া উচিত ছিল। সরকারের লোহিয়া আজীবন সরকারের তীব্র বিরোধিতা করে গেছেন। গান্ধীর শিষ্য এবং প্রিয় ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও, তিনি গান্ধীর সমালোচনা করা থেকে বিরত হননি এবং নেহরুর সঙ্গেও তাঁর বন্ধুত্ব ভেঙে যেতে সময় লাগেনি। যখন নেহেরু সকলের প্রিয় ছিলেন এবং সমাজের প্রভাবশালীদের উপর তাঁর জাদু ছড়িয়ে ছিল, সেই দিনগুলিতে লোহিয়াকে একজন মূর্তিভঙ্গকারীর ভূমিকা পালন করতে হয়েছিল যে কারণে তাঁকে মূল্যও চোকাতে হয়েছিল।
লোহিয়ার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য ছিল ব্যক্তি বা নেতার তুলনায় নৈতিকতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া। মারপ্যাঁচ রাজনীতির এক অপরিহার্য কৌশল। একজন বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ হওয়ায় লোহিয়াও মারপ্যাঁচ ও রণকৌশলের গুরুত্বে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু যেখানে বাস্তবতার যুক্তি দিয়ে মারপ্যাঁচ বা রণকৌশলের পাল্লা ভারি করে নীতি ও আদর্শকে দমন করার চেষ্টা হয়েছে, সেখানে লোহিয়া আপোস করেননি। লোহিয়া যে আপসের ঝুঁকি নিতে পারতেন না এমন ভাবনাটা ঠিক নয়। কিন্তু উপযোগিতাবাদী অবস্থান ছিল তার স্বভাবের বিপরীত। এর ফলস্বরূপ, তিনি কেবল নেহরুর শত্রু হিসাবেই বিবেচিত হননি, বরং জেপি এবং কৃপালানির মতো সহকর্মীদের থেকে তাকে বারবার আলাদা হতে হয়েছিল। যদিও তিনি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁদের সকলের সঙ্গেই বন্ধুতা বজায় রেখেছিলেন। আজ, লোহিয়ার শিষ্যদের মধ্যে উপযোগিতাবাদই সবচেয়ে বেশি চলে। এরা কথায় কথায় বা বক্তৃতায় লোহিয়াকে কখনওই অস্বীকার করবে না, তবে আচরণ এবং পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে তারাই লোহিয়ার বিচারের বিপরীতে কাজ চালিয়ে যায়। এজন্য তাদের কখনও বিবেকদংশনও হয় না।
রাজনীতিতে সবসময় দুই ধরনের মানুষ থাকবে- এক, যারা তত্ত্ব ও অনুশীলনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য নীতির দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে এবং দুই, যারা পরিস্থিতির যুক্তি দিয়ে নৈতিকতা ত্যাগ করতে প্রস্তুত। এখানে প্রথমটা লোহিয়া নীতি অনুযায়ী আচরণ বলে বিবেচিত হবে। আজ যত সরকারী লোহিয়াবাদীরা আছে তারা প্রত্যেকেই দ্বিতীয় শ্রেণির।
লোহিয়ার তৃতীয় বৈশিষ্ট্য ছিল তার কঠোর পরিশ্রম। তত্ত্বকে বাস্তবে প্রয়োগ করার উপর তাঁর এমন জোর ছিল যে অনেক কাজ সংগঠনের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে করা হত। তিনি ভারতীয়দের ব্যক্তিত্বের একটি দিক নিয়ে খুব অসন্তুষ্ট ছিলেন - প্রথমে আদর্শের কথা বলে পরে সেগুলি সম্পর্কে কিছু না করা বা তার ঠিক বিপরীত আচরণ করা। এটি কেবল ভারতীয় চরিত্রের দোষ নয়, ভারতের বৈদান্তিক দর্শন এই ধরণের ভণ্ডামিকে প্রশ্রয় দেয়। ভারতীয় চরিত্র থেকে এই ত্রুটি দূর করার জন্য, লোহিয়া ব্যক্তির কাজের উপর বেশি জোর দেন এবং সংগঠনের সিদ্ধান্তের অনুপস্থিতিতেও ব্যক্তিগত সংকল্পের মাধ্যমে সংগ্রামের প্রবণতা বাড়াতে চেয়েছিলেন। দ্বন্দ্ব এবং সংগ্রামই তাঁর কাছে কর্মের প্রধান রূপ ছিল।
লোহিয়ার পরে, ওঁর অনুগামীরা অবশ্যই কর্মের ঐতিহ্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন এবং আজও বেশিরভাগ লোহিয়াবাদীদের সাধারণ গুণ হল যে তারা যে কোনও সময় সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত হতে পারে। যদিও তারা ক্ষমতাযর মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছেন, তবুও তাদের মধ্যে সংঘর্ষের প্রবণতা রয়েছে। নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে লোহিয়ার পর লোহিয়াবাদীদের তৎপরতা, বিশেষ করে সত্যাগ্রহ ও বিক্ষোভ, শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক সংগ্রামের পর্যায়েই থেকে যাচ্ছে। অন্যায় ব্যবস্থা বা সামাজিক বিবেককে নাড়া দেওয়ার ক্ষমতা তাদের আর অবশিষ্ট নেই।
এই সময়ে লোহিয়াবাদীদের না আছে নৈতিক প্রখরতা আর না আছে কর্মের তীব্রতা। সাংগঠনিক প্রখরতা লোহিয়ার সময়েও ছিল না, আজও এর জন্য কার্যকরী কোনও প্রচেষ্টা করা হচ্ছে না।
লোহিয়ার ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ায় যে তীব্রতা ছিল (এই তীব্রতা অনেক সময় বিগড়েও দিত) তার ভিত্তি ছিল সংবেদনশীলতা। মনুষ্যজীবন ও তার স্বাধীনতার প্রতি লোহিয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা হয়তো আধুনিক বিশ্বে পাওয়া যাবেনা। পুলিশের গুলিতে বিক্ষোভকারীদের হত্যার ঘটনায় তাঁর দল এবং জেপির মতো সহকর্মীদের থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়েছিল। জনতা পার্টির একজন সমাজবাদী মুখ্যমন্ত্রীর শাসনকালে, ১২ মাসের মধ্যে ৪২ বার নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালায় পুলিশ এবং পান্তনগরের মতো বর্বর ঘটনাও ঘটে। কিন্তু একজনও সমাজবাদী নেতা না এই ঘটনার নিন্দা করেছেন বা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
যদি রাজনীতিতে বাস্তবতার প্রয়োজন হয়, তাহলে প্রতিবার গুলি চালানো সরকারের কাছে পদত্যাগ দাবি করা অবশ্যই অবাস্তব বলে মনে হয়। কিন্তু লোহিয়ার অনুগামী হয়েও এইসব কেলেঙ্কারিতে চুপ থাকা যায় কী করে? আনুষ্ঠানিক সত্যাগ্রহ, যা কখনও কখনও গুন্ডামির পরিমার্জিত সংস্করণ বলে মনে হয়, তা লোহিয়ার সংগ্রামের একটি বিকৃত রূপ।
শৃঙ্খলাহীনতা এবং অহংকারও লোহিয়ার মুক্তমনা ব্যক্তিত্বের বিকৃতি। ড. লোহিয়ার শৃঙ্খলা সংক্রান্ত নীতি ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। বাক-স্বাধীনতা ও কর্মের শৃঙ্খলা—এই ছিল তাঁর সংকল্প। যখন নীতি ও মূল্যবোধ বিপদের মুখে পড়ে, তখন মানুষ কথা বলা বন্ধ করে দেয় কিন্তু সংগঠন ও কর্মের স্তরে মানুষ সবসময়ই মর্যাদা ভঙ্গ করতে থাকে। এই ছিল ভারতীয় রাজনীতির ওপর তাঁর অভিযোগ।
রাজনীতিতে কেউ যখন উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হন তাঁর বক্তব্যও কর্মের সমার্থক হয়ে ওঠে। যে ক্ষমতা ও পদে আবদ্ধ নয় তাঁর বাক স্বাধীনতা বেশি হওয়া উচিত। লোহিয়া নিজে চেয়েছিলেন বাকস্বাধীনতা এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার। সে কারণে তিনি ক্ষমতা ও পদে আবদ্ধ ছিলেন না, কমিটিতেও অংশ নেননি। তাঁর অনুগামীরা ক্ষমতা ও পদ আঁকড়ে থাকতে চায়, কিন্তু কথা বলার শৃঙ্খলাহীনতাকে তাদের অধিকার বলে মনে করে। সম্প্রতি, যখন একজন সরকারী লোহিয়াবাদী নেতা দলীয় সভাপতির নরোরা শিবিরের ভাষণকে শৃঙ্খলাহীন বলে অভিহিত করেছেন, তখন তিনি আসলে তাঁর ভাষণকেই নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন এবং নিজের বাক স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন। যে কারণে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এ এক বিড়ম্বনা, বরং বলা যেতে পারে একটি বিকৃতি, যে লোহিয়ার অনুগামীরা তাঁর ব্যক্তিত্বের স্বাধীন-চেতনা অনুকরণ করে, কিন্তু ক্ষমতার অবস্থানের প্রতি লোহিয়ার অনাগ্রহ এবং উদাসীনতাকে অনুকরণ করে না। লোহিয়াবাদের পতন কেবল সরকার এবং প্রতিষ্ঠিত লোহিয়াবাদীদের কারণেই হয়নি, আমাদের মতো ক্ষমতা থেকে দূরে থাকা তথাকথিত 'কুজাত লোহিয়াবাদীদের' দ্বারাও ঘটেছে। যারা নিজেদের কুজাত লোহিয়াবাদী বলে তাদের দু’টি প্রধান দোষ রয়েছে – একটি হল গোঁড়ামি, অর্থাৎ লোহিয়ার কিছু সিদ্ধান্ত, কার্যক্রম এবং স্লোগান অনুসরণ করার চেষ্টা করা। যেখানে সঠিক ভূমিকা হওয়া উচিত ছিল এর থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আজকের পরিস্থিতি অনুযায়ী নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। আর, দ্বিতীয় ত্রুটি হল নিষ্ক্রিয়তা। আজ খুব কম লোকই আছে যারা গ্রামে সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সংগঠন তৈরি করছে বা লোহিয়ার কর্মপরিকল্পনা মোতাবেক লড়াই করছে। সে জন্য কেউ যদি কুজাত লোহিয়াবাদীদের প্রবন্ধ, বিবৃতি ও উপদেশকে একজন অলস মানুষের অভিমান বা কফি হাউসে চর্চিত আজেবাজে কথা বলে, তাহলে তা অতিরঞ্জিত হলেও খুব একটা মিথ্যে নয়।
(১৯৭৮ সালে লেখা এই প্রবন্ধটি গঙ্গা প্রসাদ সম্পাদিত কিষাণজির 'সম্ভাবনাও কি তলাশ' বইতে সংকলিত। যা সূত্রধর প্রকাশনা, কাঁচরাপাড়া, কলকাতা থেকে প্রকাশিত)