কুস্তিগীররা সেই প্রশ্নই করছেন যা আগে কৃষকরা জিজ্ঞেস করেছিল, প্রধানমন্ত্রী নীরব কেন? অপরাধমূলক রেকর্ড ও গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত একজন নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? এত কিছুর পরেও প্রধানমন্ত্রীর কী দায়বদ্ধতা থাকছে?
মহিলা কুস্তিগীরদের তোলা অভিযোগ স্বাভাবিক নয়। অভিযোগগুলো এমনই যে, তা শুনে যে কোনও সংবেদনশীল মানুষের হৃদয় যেন কেঁপে ওঠে, যে কোনও দেশপ্রেমিকের মাথা নত হয়ে যায়। এই অভিযোগ আজকের নয়, বিগত ১০ বছর ধরে মহিলা কুস্তিগীরদের যৌন শোষণ চলছে। শুধু একজন নয়, রেসলিং ফেডারেশনের একাধিক প্রশিক্ষকও এই যৌন নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ। নাবালিকা মেয়েরাও এর শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এই অভিযোগ শুধু একজন মহিলা করেননি, বহু মহিলা খেলোয়াড়ই অভিযোগ করেছেন। অভিযোগের গুরুত্ব খোদ সুপ্রিম কোর্ট মেনে নিয়েছে। ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে দু'বছর আগে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেছিলেন সাক্ষী মালিক নিজেই।
ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে এটাই প্রথম অভিযোগ নয়। ছয় বারের লোকসভা সাংসদ ব্রিজভূষণের নির্বাচনের হলফনামা তার অপরাধমূলক রেকর্ডের গল্প বলে। গত লোকসভা নির্বাচনে তার হলফনামায় ৩০৭ ধারা (খুনের চেষ্টা) সহ চারটি ফৌজদারি মামলার উল্লেখ করা হয়েছে। আরেকটি হত্যা মামলায় প্রমাণের অভাবে খালাস পান তিনি।
সাংসদ নিজেই তাঁর অপরাধ স্বীকার করেন। গত বছর লালনটপের দেওয়া একটি ভিডিও সাক্ষাৎকারে, তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘জীবনে আমার হাতে একটি খুন হয়েছে, লোকেরা যাই বলুক না কেন... আমি একজনকে খুন করেছি...’। কিন্তু ওই হত্যা মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে কোনও নথি নেই। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে, বিজেপি যখন গোন্ডা থেকে ঘনশ্যাম শুক্লাকে তাঁর জায়গায় মনোনীত করেছিল, তখন ভোটের দিন শুক্লা দুর্ঘটনায় মারা যান। আর কেউ নয়, অটল বিহারী বাজপেয়ী নিজেই এই মৃত্যুর পিছনে ব্রিজভূষণের হাত আছে এমন সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন এবং ব্রিজভূষণ ছাড়া আর কেউই "দ্য স্ক্রল"-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই কথা প্রকাশ করেননি। প্রশ্ন হলো, এমন একজনকে কেন প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তা দিচ্ছেন? আপনি যদি প্রশ্নের গভীরে যান তবে আপনি দেখতে পারবেন যে, ব্রিজভূষণও এর ব্যতিক্রম নন। বিজেপি নেতাদের একটি দীর্ঘ তালিকা তৈরি করা যেতে পারে যাদের বিরুদ্ধে মহিলাদের যৌন শোষণের গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছিল, কিন্তু বিজেপি বা প্রধানমন্ত্রী মোদীর দ্বারা কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এই তালিকায় কুলদীপ সেঙ্গার, চিন্ময়ানন্দ স্বামী, সাক্ষী মহারাজ, এম জে আকবর, উমেশ আগরওয়াল, বার্নার্ড মারাক এবং সন্দীপ সিংয়ের নাম থাকবে। অন্যদিকে তথাকথিত বাবা রাম রহিম আর আশারামের সঙ্গে বিজেপির ঘনিষ্ঠতা কারও কাছেই গোপন নয়। মনে রাখবেন, তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়, প্রধানমন্ত্রী হাথরস, কাঠুয়া বা বিলকিস বানোর মতো নারীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ বা শোষণের বড়ো ঘটনাগুলিতেও অদ্ভুত নীরবতা বজায় রেখেছিলেন।
এখানে প্রশ্ন নতুন নয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনিকে নিয়ে কৃষকরা এই প্রশ্নই করেছিলেন। প্রকাশ্য দিবালোকে কৃষক হত্যায় অভিযুক্তের পিতা এবং ষড়যন্ত্রের প্রধান অভিযুক্ত অজয় মিশ্র টেনি কেন এখনও মন্ত্রিসভায়? আজ একই প্রশ্ন উঠছে ব্রিজভূষণ শরণ সিংকে নিয়েও। নাবালিকা কিশোরীর বিরুদ্ধে যৌন শোষণের অভিযোগ উঠলেও কেন প্রধানমন্ত্রী ব্রিজভূষণকে আশ্রয় দিচ্ছেন বেটি বাঁচাও স্লোগানের অন্তরালে? রেসলিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির পদ থেকে ব্রিজভূষণ শরণ সিংকে সরিয়ে দেওয়ার মতো স্বাভাবিক পদক্ষেপ নিতে কেন মোদী দ্বিধা করছেন, যিনি এই খেলোয়াড়দের ভারতের গর্ব বলেছেন? চলতি বছরের জানুয়ারিতে কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পরও এবং খেলোয়াড়দের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়ার পরও কেন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?
এই প্রশ্নের মাত্র দু’টি উত্তর হতে পারে, হয় এটা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা বা নৈতিক দুর্বলতার বিষয়। যৌন শোষণের অভিযোগে অভিযুক্তরা সকলেই নিজ নিজ এলাকার আধিপত্য বিস্তারকারী নেতা এবং কিছু বর্ণের ভোটের ঠিকাদার। এই নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অর্থ হবে বিজেপির ভোটব্যাংক হারানোর ঝুঁকি। যদি এই কারণ সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে আরও কিছু প্রশ্ন জাগে, দেশের ‘সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং ক্ষমতাবান’ নেতা কি সকলের সামনে এতটাই নির্দোষ? সর্বোপরি ব্রিজভূষণ কীসের ভিত্তিতে হুমকি দিচ্ছেন যে আমি মুখ খুললে সুনামি আসবে? বিজেপির উচ্চপদস্থ নেতাদের পাশ কাটিয়ে নরেন্দ্র মোদী কেন এই স্বল্প পরিচিত নেতাদের সামনে অসহায়? আর তারা যদি এতই অসহায় হয়, তাহলে তারা কোন মুখ দিয়ে জাতির গর্বের কথা, কন্যাকে বাঁচানোর কথা বলেন?
নাকি প্রধানমন্ত্রী এইসব নারী নির্যাতনকে হালকাভাবে নেন? প্রধানমন্ত্রী কি সেই একই পুরুষদের মানসিকতার শিকার যারা অধিকাংশ নারীর শ্লীলতাহানি দেখে হাসে, গার্হস্থ্য সহিংসতার বাস্তবতাকে অস্বীকার করে এবং ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে ‘চলতা হ্যায়’ অবস্থান নেয়? আমরা জানি না প্রধানমন্ত্রীর মনে কী আছে এবং আশা করতেই হবে যে তা সত্য নয়। কিন্তু কোটি কোটি ভারতীয় মহিলা যারা ব্রিজভূষণের অন্যায় সাহস এবং প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা দেখেছেন তাঁরা কি সাক্ষী মালিকের কান্না একইভাবে অনুভব করবেন না? যতক্ষণ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নীরবতা না ভাঙবেন, ততক্ষণ এই প্রশ্নগুলো খোলা থাকবে।