আসামে বন্যা, বিহার ও উত্তরপ্রদেশে খরা। আর বাকি দেশ নির্বিকার। যেন এই দুর্ঘটনাগুলো সব অন্য কোনো দেশে ঘটছে। আমার আবারও একবার অনুপম মিশ্র, যিনি জলের ব্যাপারে জাতিকে একটা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ভাবতে শিখিয়েছিলেন, তাঁর একটা পঙ্কতি মনে পড়ল: "পাঁচিল খাঁড়া করলে সমুদ্র পিছিয়ে যাবে, বাঁধ তৈরি করলে বন্যা বন্ধ হয়ে যাবে, বাইরে থেকে খাবার এনে তা বিতরণ করলে দুর্ভিক্ষ কেটে যাবে। এমন বাজে চিন্তার বন্যা, এমন শুভ চিন্তার দুর্ভিক্ষ, আমাদের এই জল সংকট বাড়িয়ে দিয়েছে আরো।" এর মানে হলো বন্যা বা দুর্ভিক্ষ, শুধুমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এটা একটা মানবসৃষ্ট বিপর্যয় যা মানুষের বোধ লোপ পাওয়ার দরুন শুরু হয়। অনুপম মিশ্র বিশ্বাস করতেন যে আমরা যাকে আধুনিক উন্নয়ন বলি তার মূলে রয়েছে এই ধ্বংস।
এই বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই এবারে আপনি এই বছরের পরিস্থিতিটা দেখুন। প্রতি বছরের মতো এবারও বন্যায় ভেসেছে আসাম। দু-সপ্তাহ আগে, রাজ্যের ২৪ টা জেলার ১৪ লাখ মানুষ বন্যার কবলে পড়েছিল। প্রায় দেড় লাখ মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে ত্রাণ শিবিরে থাকতে বাধ্য হয়েছে। মৃতের সংখ্যা এখন প্রায় ২০০ তে এসে দাঁড়িয়েছে। এই সব তো পরিসংখ্যান। কিছু দিনের মধ্যেই আমরা সবটুকু ভুলে যাব। খুব বড়ো জোর বন্যা ত্রাণে আসামকে দেওয়া অনুদানের কিছু খবর বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হবে। কিছু ছবি মনে থাকে যেখানে শিশুরা বাঁশের তৈরি নৌকা বাইতে বাইতে তাদের বাড়িতে যাচ্ছে। এবং এতো কিছুর পরেও আমরা আগামী বছরের জন্য অপেক্ষা করব।
এমনিতে তো আসামের বন্যার পর প্রতি বছর বিহারে বন্যার মরশুম আসে। কিন্তু, এবার ব্যাপারটা উল্টে গেছে। যেমন, প্রতি দুই-তিন বছরে একবারই হয়। এবারে বিহারে প্রবল আকারে খরা হয়েছে। এই ২৩ জুলাই অবধি, রাজ্যের মোট ৩৮ টা জেলার মধ্যে ২২ টা জেলায় বৃষ্টির ঘাটতি হয়েছে (অর্থাৎ স্বাভাবিকের চেয়ে ২০-৬০% কম) এবং ১৩ টা জেলায় মারাত্মক ঘাটতি হয়েছে (অর্থাৎ স্বাভাবিকের তুলনায় মানে 60%-এরও বেশি হ্রাস), মাত্র ৩ টে জেলায় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা গেছে। বছরের হিসাবে এখনো পর্যন্ত ৪০% ধান রোপণ করা উচিত ছিল, কিন্তু মাত্র ১৯% ই রোপণ করা সম্ভব হয়েছে। দুর্ভিক্ষের ভয়ে দরিদ্র কৃষকরা গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেছেন।
উত্তরপ্রদেশের অবস্থাও আলাদা কিছু নয়। ২৩ জুলাই পর্যন্ত, রাজ্যের ৭৫ টা জেলার মধ্যে ৩৩ টা জেলায় বর্ষার ঘাটতি রেকর্ড করা গেছে এবং ৩৬ টা জেলায় মারাত্মক ঘাটতি রেকর্ড করা গেছে। বাকি মাত্র ৬টা জেলায় সামান্য বৃষ্টি হয়েছে। কৌশাম্বি, গোন্ডা, বান্দা এবং কানপুর গ্রামীণ জেলায় যা বৃষ্টি হয়েছে তা প্রায় না হওয়ার সমান। পশ্চিম এবং মধ্য উত্তর প্রদেশে, ধান রোপণের সময় প্রায় শেষ এবং এখনো যে পরিমাণ রোপণ হওয়া উচিৎ তার অর্ধেকও রোপণ হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের ৩ টে জেলা এবং ঝাড়খণ্ডের ২ টো জেলা বাদে অন্য সব জেলায় বৃষ্টিপাতের ঘাটতি বা তীব্র ঘাটতি রয়েছে৷ দুর্ভাগ্যবশত, এ বছর বৃষ্টি বঞ্চিত এই অঞ্চলটা দেশের সবচেয়ে দরিদ্রতম ক্ষেত্র হিসাবেও চিহ্নিত হয়েছে।
আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এই খরা দুর্ভিক্ষে পরিণত হতে পারে। এবং তারপরে, ইতিহাসের সেই চেনা পুনরাবৃত্তি যা পি সাইনাথ তার বিখ্যাত বই " এভরি ওয়ান লভস এ গুড ড্রট " (প্রত্যেকে একটি ভাল খরা পছন্দ করে) এতে বর্ণনা করেছেন। সরকারি কমিটি তৈরী হবে, ত্রাণ দেওয়া হবে, ফাইল ও অফিসারদের পেট বড় হবে, এবং সব শেষে ভাগ্যের দোহাই দিয়ে কৃষক বেঁচে থাকবে।
আমরা কি এই প্রতি বছরের চেনা ট্র্যাজেডির চক্রব্যুহ থেকে মুক্ত হতে পারি? হ্যাঁ, যদি আমরা একটা নতুন উপায়ে চিন্তা করতে পারি এবং সেই নতুন চিন্তাকে বাস্তবায়ন করার সাহস পাই। গত দুই দশকে অনেক পরিবেশবিদই বন্যা ও খরাকে নিয়ে নতুনভাবে ভাবিয়েছেন এবং সমাজের পুরনো চিন্তাধারাকে নতুনভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। কয়েক দশক ধরে বিহারে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থ চেষ্টা পর্যবেক্ষণ করার পরে, দীনেশ মিশ্র বলেছেন যে আমাদের বন্যা মুক্তির মতো বিভ্রান্তিকর স্লোগান থেকে মুক্তি পাওয়া উচিৎ। বর্ষাকালে অতিবৃষ্টি, জলাবদ্ধতা, নদীতে বন্যা এবং বাঁধ থেকে জল বের হওয়া প্রকৃতির সাধারণ নিয়ম, এটা কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা বা দুর্ঘটনা নয়। নদীগুলোকে বাঁধে বাঁধার চেষ্টা শুধু বৃথাই নয়, বিপজ্জনকও বটে। এ কারণে নিকাশি-নালার মুখগুলো বন্ধ হয়ে দুই-তিন দিনের বন্যা এখন দুই-তিন মাসের বন্যায় পরিণত হয়েছে। নদীর ধারে বসবাসকারী মানুষজন সবসময়ই জলের সাথেই বাঁচতে জানত, আমাদেরও এবার সেটা শিখে নেওয়া জরুরি। পাহাড়ের বনজঙ্গল না কাটলে, নদীর চারিদিকে বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোতে বসতি স্থাপন না করলে, জল প্রবাহের পথে রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি তৈরী না করলে বন্যার বিপুল ক্ষয়ক্ষতির কিছুটা আঁটকানো যায়।
একইভাবে, খরা মোকাবিলা করার জন্য, আমাদের প্রত্যেকটা জমিতে খালের জল বা নলকূপের জল বা সেচের জলের ব্যবস্থা হবে এই দিবাস্বপ্ন ত্যাগ করতে হবে, বৃষ্টিনির্ভর চাষের বাস্তবতা মেনে নিতে হবে এবং আমাদের সেচ ব্যবস্থার পাশাপাশি ফসল-চক্রকে বৃষ্টির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। বিজ্ঞান সব কিছু বানালেও, জল তৈরির যন্ত্র এখনো পর্যন্ত আবিস্কার করেনি। আমাদের এই প্রকৃতিতে যেটুকু পরিমাণ জল আছে সেটা নিয়েই বাঁচতে শিখতে হবে।
এই বছর, ইংল্যান্ডে, উত্তর ভারতের মতো গরম পড়েছে। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও উপরে উঠেছে। ইতিহাসে প্রথমবার এমন ঘটনা ঘটল। মানে, জলবায়ুর অকাল পরিবর্তন এখন আমাদের নাকের ডগায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখনও যদি আমরা প্রকৃতির সাথে ছেলেখেলা বন্ধ না করি, তাহলে ঈশ্বর আমাদের ক্ষমা করলেও, প্রকৃতি ছেড়ে কথা বলবে না।