অবশেষে মূল্যবৃদ্ধির বাস্তবতা মেনে নিয়েছে সরকার। এখন দেখার বিষয় সরকার কি এই মূল্যবৃদ্ধির দায় স্বীকার করছে? মূলরোগ নিয়ন্ত্রণের আগে মোদী সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে চারটি অজুহাত, যেগুলিকে হাতিয়ার করেই চলছে দায় এড়ানোর খেলা। মুদ্রাস্ফীতির এই তিক্ত সত্যের মুখোমুখি হওয়াই বর্তমানে এই সংকট সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ।
প্রথম অজুহাত: “মুদ্রাস্ফীতি কখনও বেশি কখনও কম হতে থাকে। যেমন ভাবে গ্রাফ রেখা উপরের দিকে যাচ্ছে তেমনি নেমেও যাবে। চিন্তার কিছু নেই।”
কিন্তু এখানে সরকারি পরিসংখ্যান নিজেই হাটে হাড়ি ভাঙলো। গত সপ্তাহে প্রকাশিত মুদ্রাস্ফীতির তথ্য অনুসারে, ২০২১ এবং ২০২২ সালের এপ্রিলের মধ্যে মূল্যবৃদ্ধির পাইকারি সূচক ১৫.১% এবং ভোক্তা সূচক ৭.৮% বেড়েছে। উপভোক্তা মূল্য সূচকে গৃহস্থালীর পণ্যের (খাদ্য, পোশাক, পেট্রোল, পরিষেবা, ইত্যাদি) দাম অন্তর্ভুক্ত থাকে, যেখানে পাইকারি মূল্য সূচকে শিল্প ও বাণিজ্যে ব্যবহৃত পণ্যের দাম (ইস্পাত, বিদ্যুৎ, রাসায়নিক, ধাতু, শিল্প পণ্য ইত্যাদি) পাইকারি দামের অন্তর্ভুক্ত। সরকারি পরিসংখ্যান দেখায় যে ২০১৩ সালের পর প্রথমবারের মতো গৃহস্থালির ব্যয়ে এই ধরনের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। যেখানে ১৯৯১ সাল থেকে গত ৩০ বছরে পাইকারি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এত বেশি ছিল না। সরকারের নিজস্ব আইন অনুসারে, এই মূল্যবৃদ্ধি উপভোক্তা মূল্য সূচকে সর্বোচ্চ অনুমোদিত সীমা ৬% লঙ্ঘন করে গেছে। আটা, শাক-সবজি, রান্নার তেল, কেরোসিন, গ্যাস ইত্যাদির মূল্যবৃদ্ধি দরিদ্র মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কমিটি (এমপিসি) কয়েক মাস ধরে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। বিষয়টি এখানেই থেমে থাকবে না বলেই জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। মূল্যবৃদ্ধি আরও বাড়বে।
দ্বিতীয় অজুহাত: “এই মুদ্রাস্ফীতি ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। মুদ্রাস্ফীতি সারা বিশ্বে, ভারতের ভাবনা কী?”
কথাটি সম্পূর্ন মিথ্যা না হলেও এই অর্ধ-সত্যি অনেক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। কোন সন্দেহ নেই যে ইউক্রেন যুদ্ধ সারা বিশ্বে সরবরাহ চেইন ব্যাহত করেছে এবং মূল্যবৃদ্ধি বাড়িয়েছে। কিন্তু ভারতের সরকারী তথ্য এটা স্পষ্ট করে যে ইউক্রেন যুদ্ধের অনেক আগে গত ১৩ মাস ধরে আমাদের পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির সূচক ১০%-এর চিহ্ন অতিক্রম করেছিল। যুদ্ধের কারণে বিশ্বে খাদ্য-শস্যের দাম বেড়েছে, যদিও ভারতে এর প্রভাব পড়ার কথা নয়, কারণ আমরা বিদেশ থেকে গম আমদানি করি না।
তৃতীয় অজুহাত: “আন্তর্জাতিক বাজারে হঠাৎ করে অপরিশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, যার কারণে আমাদের দেশেও ডিজেল, পেট্রোল, গ্যাস এবং অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে গিয়েছে।”
এটি একটি সরাসরি মিথ্যা। সত্য হল যে মে ২০১৪ সালে, যখন শ্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০৬ ডলার ছিল। তারপর বেশ কয়েক বছর দাম মারাত্মকভাবে কমে যায় এবং যথাক্রমে আবারও তেলের দাম বৃদ্ধি পায় । আট বছর পর, ২০২২ সালের মে মাসে, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম আবার ব্যারেল প্রতি ১০৬ ডলারের সমান। কিন্তু এরই মধ্যে পেট্রোলের দাম ৭১ টাকা থেকে বেড়ে ১০২ টাকা হয়েছে (কেটেকুটে ৯৭ টাকা), ডিজেলের দাম ৫৫ টাকা থেকে ৯৬ টাকা (কাটার পর ৯০ টাকা) এবং গ্যাস সিলিন্ডারের দাম বেড়েছে ৪১০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা। এর মানে হল পেট্রোল, ডিজেল এবং গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণ আন্তর্জাতিক বাজার নয় বরং কেন্দ্রীয় সরকার এবং কিছুটা রাজ্য সরকারগুলির বর্ধিত কর। ২০১৪ সালে, কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রোলের উপর কর থেকে ৯৯,০০০ কোটি টাকা আয় করেছিল, যা ২০২১ সালে বেড়ে ৩,৭২,০০০ কোটি টাকা হয়েছে।
চতুর্থ এবং সবচেয়ে বড় অজুহাত: “সরকার মুদ্রাস্ফীতি ঠেকাতে যা যা করা সম্ভব করেছে। সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়িয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রোপণ্যের উপর কর কমিয়েছে। সরকার এর চেয়ে আর কী করতে পারে?”
সত্য যে মোদি সরকার মুদ্রাস্ফীতিকে হালকাভাবে নিয়েছে, আগাম সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেছে এবং এটি নিয়ন্ত্রণের সমস্ত প্রচেষ্টাকে থামিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মুদ্রানীতি কমিটির কার্যকারিতা নিয়ে ‘রিপোর্টার্স কালেক্টিভ’ নামে একটি দল এক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে । তথ্যের অধিকার আইনের অধীনে প্রাপ্ত এই কাগজপত্রগুলি থেকে জানা যায় যে অর্থ মন্ত্রক ২০১৯ এবং ২০২০ সালে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ কমিটির কাজে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করেছিল এবং শিল্পপতিদের স্বার্থ রক্ষায় সুদের হার বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল। আবেদন শুধু তাই নয়, অর্থ মন্ত্রকের একটি নথিতে দাবি করা হয়েছে যে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই কারণ এটি গরীব নয়, কেবল কিছু ধনী ব্যক্তিকে প্রভাবিত করবে।
সত্যি কথা হলো, এই দৃষ্টিভঙ্গীর কারণেই সরকারের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘ সময় লেগেছে। সরকারের এই অবহেলার ফল আজ দেশ ভোগ করছে, এমনকি এখন সরকারের গৃহীত পদক্ষেপও যথেষ্ট নয়। পেট্রোপণ্যের উপর ট্যাক্স কাট গত কয়েক সপ্তাহের বৃদ্ধির সাথে খুব কমই মেলে। আজও, কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৪ সালের তুলনায় পেট্রোলের উপর দুইগুণ বেশি এবং ডিজেলের উপর চারগুণ বেশি কর ধার্য করছে। আজও সরকার পর্যাপ্ত গম কিনে আটার দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আজও সুদের হার বাড়াতে দেরি করছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। এবার দেখার বিষয়, অতিক্রান্ত এই দীর্ঘ সময় পরে সরকারের চেতনা ফিরতে ঠিক কত সময় লাগে।