ভারত জোড়ো যাত্রার জনপ্রিয়তার কোনো শংসাপত্রের প্রয়োজন হলে গত সপ্তাহে তা দিয়েছে মোদি সরকার। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনসুখ মান্ডাভিয়া রাহুল গান্ধিকে ‘কোভিড নির্দেশিকা’ অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়ে একটি চিঠি লেখেন এবং তাঁকে “কোভিড মহামারী থেকে দেশকে বাঁচাতে জাতীয় স্বার্থে ভারত জোড়ো যাত্রা স্থগিত করার” অনুরোধ করেন। ভারত জোড়ো যাত্রা বন্ধ করার তাড়ায় বেচারা মন্ত্রী ভুলে গিয়েছেন যে তিনি যখন চিঠিটি লিখেছেন তখন দেশে কোনও কোভিড নির্দেশিকা কার্যকর ছিল না। এমনকি দু’দিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ত্রিপুরায় একটি বড় জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন তাও তিনি খেয়াল করেননি। যে রাজস্থানের অছিলায় মন্ত্রী চিঠিটি লিখেছিলেন সেই রাজস্থানেই এই অজুহাতের পর্দা ফাঁস হয়ে গিয়েছিল পুরোপুরি। রাজস্থান বিজেপি ১ ডিসেম্বর থেকে সেরাজ্যে ‘জন আক্রোশ যাত্রা’ করেছে। মন্ত্রীর চিঠির পরেই বিজেপি দিল্লিতে ঘোষণা করেছিল যে তারা জাতির স্বার্থে রাজস্থানে যাত্রা স্থগিত করছে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরেই রাজস্থানের বিজেপি জানিয়েছে, এই যাত্রা নিরবচ্ছিন্নভাবে চলবে, কারণ রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার এখনও এ বিষয়ে কোনও নির্দেশ জারি করেনি! পুরো সত্য জনগণের সামনে এসেছে – কোভিড সংক্রমণ ভারত জোড়া যাত্রায় হয়, তবে বিজেপির যাত্রায় নয়।
জনসাধারণ পুরোনো ঘটনার কথাও মনে রেখেছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য আহমেদাবাদে একটি বিশাল জনসমাগম করার সময় করোনা নিয়ে কোনও উদ্বেগ ছিল না। তবে কয়েক দিন পরে শাহিনবাগ বন্ধ করার জন্য করোনা নিয়ে চিৎকার শুরু হয়। পরের বছর ২০২১ সালে বাংলায় নির্বাচনের জন্য করোনা অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু সেই দিনগুলিতে কৃষক আন্দোলন থামাতে করোনা উপস্থিত ছিল। জনসাধারণের বিশ্বাস হয়ে গিয়েছে যে ভারত জোড়ো যাত্রা এই সরকারের পক্ষে কৃষক আন্দোলনের মতোই বড় মাথাব্যথা হয়ে উঠছে। সরকার যখনই ভয় পায়, তখনই করোনাকে এগিয়ে দেয়।
ভারত জোড়ো যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে বিজেপি বুঝতে পারছে না কীভাবে এর মোকাবিলা করতে হবে। প্রাথমিকভাবে বিজেপির আইটি সেল যাত্রাকে নষ্ট করার জন্য চার থেকে পাঁচটি চেষ্টা করেছিল। প্রথমে ফাইভ স্টার কন্টেইনারের প্রসঙ্গ তোলে। কংগ্রেস অবিলম্বে সাংবাদিকদের কন্টেইনার দেখিয়ে বিজেপির আইটি সেলের ছবি মিথ্যা প্রমাণ করে। বিজেপি যখন রাহুল গান্ধির টি-শার্টে থুতু ফেলে, তখন লোকের মনে পড়ে যায় মোদিজির দশ লক্ষ টাকার স্যুটের কথা। এরই মধ্যে স্মৃতি ইরানি উজ্জয়িনীতে রাহুল গান্ধির করা আরতিকে উল্টো বলে অভিহিত করে আহত হিন্দু অনুভূতি জাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ভিডিও থেকে দেখা গেছে যে মোদিজি এবং শিবরাজ চৌহানও একইভাবে আরতি করেছিলেন। তার মানে প্রতিবারই কাদা যে ছুড়ছে তার মাথায় গিয়েই পড়ছে।
সম্ভবত এর থেকে শিক্ষা নিয়ে নীরবতার কৌশল নিয়েছে বিজেপি। ইঙ্গিত করছে যে এই সফরটি মন্তব্য করার মতো নয়। মনে করা হয়েছিল, গুজরাত ও হিমাচল প্রদেশের নির্বাচনী ফলাফলের পর যাত্রা নিজে থেকেই বৃথা হয়ে যাবে। রাজস্থানে কংগ্রেস নিজেদের দ্বন্দ্বের কারণে ভেঙে পড়বে। কিন্তু এই কৌশলও কাজে আসেনি। গুজরাতে কংগ্রেসের ব্যাপক পরাজয় সত্ত্বেও যাত্রাটি রাজস্থানে উত্সাহের সঙ্গে চলেছিল। তারপরে হরিয়ানা এবং দিল্লিতেও যাত্রা অপ্রতিরোধ্য জনসমর্থন পেয়েছে। তাই এখন নীরবতার কৌশল ছেড়ে বিজেপি নেতারা যাত্রায় সরাসরি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছেন। এখন একটি অজুহাত তৈরি করেছে, কেন পদযাত্রা ক্রিসমাসে বিরতি নিয়েছিল। মহীশূরে বিখ্যাত দশেরা উৎসবের জন্য যাত্রা বিরতি নিলে বিজেপি কোনো মন্তব্য করেনি। দীপাবলির জন্য তিন দিনের ছুটি নেওয়া হলেও তারা চুপ ছিল। বড়দিনে প্রধানমন্ত্রী যদি দেশ ও বিশ্বের কাছে যিশু খ্রিস্টের গুণাবলি বর্ণনা করে বার্তা দেন, তাহলেও ঠিক আছে। কিন্তু এই দিনে যাত্রাকে ছুটি দিলে বিজেপি নেতারা আপত্তি তোলেন। তার মানে ভারত জোড়ো যাত্রায় ক্ষুব্ধ বিজেপি এখন যতটা সম্ভব কম বক্তব্যের আশ্রয় নিচ্ছে।
অন্যদিকে, মোদি সরকারও এই সফরের প্রভাব কমাতে কিছু নীতিগত ঘোষণা করতে শুরু করেছে। ভারত জোড়ো যাত্রায় প্রতিদিনই উঠছে মূল্যস্ফীতির প্রশ্ন। এর প্রভাব হ্রাস করতে সরকার এক বছরের জন্য বিনামূল্যে রেশন ঘোষণা করেছে। বেকারত্বের যন্ত্রণায় ব্যান্ডেড দেওয়ার অভিপ্রায়ে মনরেগার বাজেটও বাড়ানো হয়েছে। আগামী বাজেটে সরকার বড় বড় কিছু ঘোষণা করবে এবং কৃষক, শ্রমিক ও দরিদ্রদের ক্ষত সারানোর চেষ্টা করবে এমন সম্ভাবনা রয়েছে। নাকি এসব বিষয় থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতে অন্য কোনো বড় কেলেঙ্কারির সাহায্য নেওয়া হবে? ডিভাইড অ্যান্ড রুলের পুরনো নীতির নতুন অধ্যায় কি খুলবে?
প্রশ্ন হল মোদি সরকার ও বিজেপি ভারত জোড়ো যাত্রাকে এত ভয় পায় কেন? এই যাত্রা যদি জনসমর্থন না পায় তাহলে বন্ধের চেষ্টা কেন? কংগ্রেস যদি অপ্রাসঙ্গিক হয় তাহলে কেন তাকে এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে? রাহুল গান্ধি যদি সিরিয়াস নেতা না হন, তাহলে কেন তাঁকে আক্রমণ করা হচ্ছে? বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী মোদি জনগণের নাড়ির ওপর হাত রাখেন। প্রতি সপ্তাহে সারা দেশের জনমত জরিপ করা হয়, সেসবের গোপন প্রতিবেদন তাঁদের সামনে তুলে ধরা হয়। স্পষ্টতই সেই রিপোর্টগুলিতে এমন কিছু রয়েছে যা প্রধানমন্ত্রীকে উদ্বিগ্ন করছে। বিজেপি নেতারা এবং মুখপাত্ররা বারবার এই যাত্রাকে ‘ভারত তোড়ো যাত্রা’ বলে অভিহিত করছেন। এটা পরিস্কার যে ‘ভারত জোড়ো’ স্লোগান তাদের বিরক্ত করছে। বিজেপির সবচেয়ে বড় কষ্টের কারণ রাহুল গান্ধির ভাবমূর্তির নাটকীয় পরিবর্তন। ভারত জোড়ো যাত্রা থেকে আর কিছু হোক বা না হোক, রাহুল গান্ধির পাপ্পু ইমেজ ভেসে গেছে। এখন অপবাদ দেওয়া যায় না যে রাহুল গান্ধি সেই ‘বাবা লোক’-দের একজন যারা এসি থেকে বের হয় না, যারা এদেশের ধুলো সইতে পারে না, যারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা করে না, তাদের কষ্ট বোঝে না। পাপ্পু ইমেজ নষ্টের কারণে নরেন্দ্র মোদির ব্রহ্মাস্ত্র হাত থেকে পিছলে যাচ্ছে। এই ভাবমূর্তির আড়ালে প্রধানমন্ত্রীর যে সব ত্রুটি-বিচ্যুতি লুকিয়ে থাকত, তা এখন সামনে আসবে। জনগণ প্রশ্ন করবে, যে ১৫ লাখ টাকা অ্যাকাউন্টে ঢোকার কথা ছিল তা কোথায় গেল? বছরে দুই কোটি চাকরি কারা পায়? কবে কৃষকের আয় দ্বিগুণ হল? করোনায় কতজন দেশবাসী মারা গেল? চিন আমাদের কত জমি দখল করেছে? যাদের কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর নেই তারা ভারত জোড়া যাত্রাকে খুব ভয় পায়। সম্ভবত ‘ভয় পেয়ো না’ স্লোগানটি তাদের খুব তাড়িত করে। তারা ভয় পায় যে লোকেরা তাদের ভয় পাওয়া বন্ধ করবে।