আমি তাঁকে বললাম, অভিনন্দন! শ্রীমতি দ্রৌপদী মুর্মু দেশের রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন। তাঁর চোখ-মুখ দেখেই আমি স্পষ্ট করে বললাম যে তিনি এখনো রাষ্ট্রপতি হননি, হতে চলেছেন। ভোট-গণনার আনুষ্ঠানিকতা বাকি থাকলেও ফলাফল নিয়ে কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই। তখন উনি বললেন, এটা ফলাফলের বিষয়ই নয়। কাউকে না কাউকে তো রাষ্ট্রপতি হতে হবে। এতে আবার আলাদা করে ভাবার কী আছে?
আমি বললাম, আলাদা করে ভাবার ব্যাপার তো আছেই। প্রথমবারের মতো আদিবাসী সমাজের একজন প্রতিনিধি দেশের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন, তাও আবার একজন নারী! এবার প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে সাব-জেনারেল এবং সেনারা এক আদিবাসী মহিলাকে স্যালুট করবেন। আপনি গর্বিত নাই হতে পারেন, আমি কিন্তু এতে ভীষণই গর্বিত। একবার ভাবুন, টিভিতে এই মহিলাকে দেখে কত মহিলা অনুপ্রেরণা পাবেন। ইনি তাঁদের শক্তির অন্যতম মাধ্যম হবেন।
তাঁর চোখে মুখে কোনোও রকম উত্তেজনা দেখলাম না। বললেন, এর আগেও তো একজন মহিলা এই দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। একজন আদিবাসী নারী হওয়ার মধ্যে কী এমন বিশেষত্ব আছে? এই প্রশ্নের জন্য আমি আঁট ঘাঁট বেঁধেই তৈরি ছিলাম। বললাম, ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ৬৪%, কিন্তু আদিবাসী মহিলাদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ৪২%... আর স্নাতকদের কথা বললে তো, সমগ্র দেশে স্নাতক ৯% এর কাছাকাছি হলেও আদিবাসী মহিলাদের মধ্যে ৩% এরও কম। আবার আপনি স্বাস্থ্যের যে কোনো মাপকাঠি দেখে নিন, সে শিশুমৃত্যুর হারই বলুন বা কন্যাশিশুর অপুষ্টিই বলুন কিংবা রক্তাল্পতায় আক্রান্ত নারীর কথাই বলুন, দেশে আদিবাসী নারীদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এদেশে সর্বশেষ কোনোও মানুষ যদি থেকে থাকেন তা’হলে, তিনি অবশ্যই একজন আদিবাসী মহিলা।
উনি চুপ করে গেলেন। ওঁর নীরবতা আমায় সাহস দিলো। আমি আলোচনাটাকে এগিয়ে নিয়ে গেলাম। দ্রৌপদী মুর্মুর রাষ্ট্রপতি হওয়া এদেশের শেষ প্রান্তে বসে থাকা ৬ কোটি আদিবাসী নারীর সম্মান বলে আমি মনে করি। ওঁর সাথে দেখা করার সৌভাগ্য তো কখনো হয়নি আমার। তবে আমি ওঁর সম্পর্কে যতটুকু পড়েছি, তা থেকে এটা ভীষণ স্পষ্ট যে উনি একজন বিচক্ষণ মহিলা। গ্রামের প্রথম স্নাতক হওয়া থেকে শুরু করে কঠিন পরিস্থিতিতেও শিক্ষা অর্জনের যে বীভৎস চাহিদা, আর তারপর সমাজসেবা করার জন্য ফিরে আসা এবং ব্যক্তিগত সমস্ত আঘাতকে উপেক্ষা করে জনজীবনের মাঝে নিজেকে সম্পূর্ণ উজাড় করে দেওয়া পর্যন্ত ওঁর এই চলার পথ মোটেই সহজ ছিলনা। রাজ্যপালের মতো ক্ষমতাশালী পদে থাকার পরেও তিনি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। দ্রৌপদী মুর্মু, ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল হওয়ার সুবাদে, সমস্ত কস্তুরবা গান্ধী বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শন করেছিলেন, যে স্কুলগুলো দলিত, আদিবাসী এবং অন্যান্য তথাকথিতভাবে পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের মেয়েদের জন্য বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত। আর এই সব কিছু মোটেই তুচ্ছ করার মতো বিষয় নয়।
উনি মন দিয়ে শুনলেন বটে কিন্তু ওঁর চোখ-মুখের ভাব বদলালো না একটুও। কিছুক্ষণ পর বললেন: রাষ্ট্রপতি তো রাবারের সিলমোহর ছাড়া আর কিছুই নয়। ওই চেয়ারটায় কেউ বসলে তাঁর সমাজের মানুষের জীবনে কী পার্থক্য আসবে? মনে নেই! যখন এদেশে শিখদের গণহত্যা হয়েছিল, সেই সময়ে এদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন জিয়ানি জৈল সিং। গুজরাট দাঙ্গার পরে আবদুল কালাম এদেশের রাষ্ট্রপতি হন। তার ফলে দাঙ্গায় যাঁরা পীড়িত ছিলেন তাঁদের প্রতি কি সত্যিই ন্যায় বিচার হয়েছে? রামনাথ কোবিন্দের রাষ্ট্রপতি আমলে দলিতদের উপর অত্যাচারের বহু ঘটনাই তো ঘটল। তাতে কী এসে গেলো?
ওঁর কথা শুনে আমার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো। ২২ জুন, দ্রৌপদী মুর্মুর এনডিএ-র রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হওয়ার খবর আসে। তার ঠিক ১০ দিন পরে, মধ্যপ্রদেশের গুনা জেলা থেকে খবর এলো যে সাহারিয়া উপজাতি সম্প্রদায়ের ৩৮ বছর বয়সি এক মহিলা, রামপ্যারিকে, জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। তাঁর পরিবারকে মধ্যপ্রদেশ সরকারের তরফ থেকে ৬ বিঘা জমি দেয়া হয়েছিল। ওঁর সঙ্গে কাগজপত্রও ছিল। কিন্তু জমি দখল করে বসেছিল আদিবাসী নন এমন সমাজের মানুষেরা। জবরদখল করার পরে তারা আবার সেখানে কৃষিকাজও করছিল। উপরন্তু, রামপ্যারির পরিবারকে হুমকিও দিচ্ছিল ওরা। এই ঘটনার ঠিক এক সপ্তা আগে, রামপ্যারি ও তাঁর স্বামী অর্জুন, পুলিশকে এই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জানায় এবং তাঁদের কাছে সুরক্ষাও চায়। কিন্তু, কিছুই করা হয়নি। রামপ্যারি যখন মাঠে গিয়ে আপত্তি জানান, তখন তারা সেখানেই ওঁর গায়ে ডিজেল ছিটিয়ে ওঁকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ঘটনার ভিডিও-ও পাওয়া যায়। এইবারে আমি ভাবতে বসলাম, যদি দ্রৌপদী মুর্মু রাষ্ট্রপতি হন তাহলে কি রামপ্যারি ও তাঁর পরিবার ন্যায় বিচার পাবেন? এটা কি তাহলে নিশ্চিত হবে যে এদেশে আর কোনো রামপ্যারিকে দিবালোকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হবে না?
চুপচাপ বসে বসে এইসব ভাবছিলাম। হঠাৎ, উনি বলে উঠলেন, দেখুন, আমিও প্রতীকের গুরুত্ব বুঝি। যদি রাষ্ট্রপতি শুধুমাত্র একটি রাবারের সিলমোহর হয়েই থাকেন, তবে আমি মুখার্জি, পাটিল, শর্মা বা অন্য কোনো সিনহা, রেড্ডি এবং যাদবের পরিবর্তে মুর্মু, সোরেন, মুন্ডা, রাথওয়া, মীনা বা অন্য কোনোও জাতব ও বাল্মীকির নাম দেখতে চাইব। যে সমাজ শত-সহস্র বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে ছিল সে সমাজ তখনই ন্যায়বিচার পাবে যখন তার প্রতিনিধিরা নিজেরা চেয়ারে বসবে।
তিনি একনাগাড়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন। এবারে আসল প্রশ্নটা হল, দলিত বা আদিবাসীরা ঠিক কোন পথ ধরে চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছবে? একটা পথ হল, বাবাসাহেব আম্বেদকর, নেলসন ম্যান্ডেলা এবং মার্টিন লুথার কিং এর দেখানো বিপ্লবের পথ। অর্থাৎ সামাজিক ন্যায়বিচারের আন্দোলনের ভিত্তিতে বিতাড়িত সমাজের লোকেরা ক্ষমতা দখল করুক। তামিলনাড়ুর দ্রাবিড় আন্দোলন এবং কাঁশি রামের বিএসপি আন্দোলনও এই পথ ধরেই হয়েছিল। এই পথ দিয়ে ক্ষমতা লাভ করলে, বঞ্চিত সমাজের মানুষেরা মৌলিক সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে। এ তো গেলো প্রথম পথ। দ্বিতীয় পথে আসি। সেই পথ দেখিয়েছেন বারাক ওবামা বা প্রেসিডেন্ট কে আর নারায়ণন। এই অত্যাশ্চর্য পথ অনুসরণ করে ক্ষমতা অর্জন সামাজিক ন্যায়বিচার আন্দোলনের মাধ্যমে হয় না। ক্ষমতা দখল করে কিছু নেতা তাদের ব্যক্তিগত প্রতিভা এবং আদর্শের অঙ্গীকার বাদ দিয়ে সমাজের কিছু স্বার্থ পরিবেশন করতে সক্ষম হয়। আর তৃতীয় পথটিকে আপনি চামচা পদ্ধতিও বলতে পারেন আবার শিখণ্ডী মার্গও বলতে পারেন। যে সমস্ত বড়ো বড়ো বিতাড়িত সমাজের নেতারা এই পথ দিয়ে আসেন, তাঁদের চেয়ারে বসানোই হয় যাতে তাঁরা তাঁদের সমাজের প্রতি হওয়া অন্যায় ও অত্যাচারগুলোকে ঢেকে রাখতে পারেন। এই শ্রেণির নেতারা যতই সক্ষম হোক না কেন, তাঁরা সরকারের সেফটি-ভালভ হিসেবে কাজ করে। যাতে প্রান্তিক সমাজের মানুষদের ক্ষোভ আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়তে না পারে। তাঁরা খুব দক্ষতার সাথে সামাজিক অন্যায় ও শোষণের ব্যবস্থাকে বজায় রাখতে পারে, যাতে এই শ্রেণিটির ভোটও পাওয়া যায় এবং প্রশাসনকে তাদের জন্য কিছু করতেও না হয়।
দ্রৌপদী মুর্মু এই পথগুলির মধ্যে কোনটিকে অনুসরণ করবেন? এ প্রশ্নের উত্তর যেদিন পেয়ে যাব সেদিন আপনার অভিনন্দনও আমি স্বীকার করে নেবো। এই খানেই তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। কথাগুলো তো সবই সত্যি, কিন্তু কেনো জানি না, আমার মন এই কথাগুলো কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। তাই তখন আমি অন্য একজনকে খুঁজছিলাম যিনি আমার অভিনন্দন গ্রহণ করবেন।