"শেষ কী কথা হয়েছিল তোমাদের?" ডাক্তার ইয়াকুব প্রশ্ন করলেন। ঋষভ পিছিয়ে গেল তিনবছর- মনশ্চক্ষে।
গোয়ার হোটেল থেকে চেকাউট করে বেরিয়ে এবার ব্যাঙ্গালোর-মুখো হবার পালা। সেখান থেকে প্লেন ধরে সান ফ্রান্সিস্কো। মাঝপথে সারথিকে নামিয়ে দেবে ঋষভ।
গোয়াতে একটা সখের জিনিসের দোকানের সামনে ঋষভ গাড়ি দাঁড় করাল।
"রেশমীর জন্য কিছু নেব। তুমিও এসো।"
সারথি দেখল ঋষভ একটা কাগজে জিনিসপত্রের তালিকা বানিয়ে এনেছে। নারকেলের দড়ির ব্যাগ আর আরও কিছু হাবিজাবি ঋষভ কিনল।
"শপিং কম্প্লিট স্যার?"
"হ্যাঁ। তবে যত কিছু কিনব ভেবেছিলাম, তার সবকিছু নেই। অনলাইনে দেখে মনে হয়েছিল ভাল হবে, কিন্তু হাবিজাবি জিনিসেই ভর্তি।"
"হুঁ। শপিং লিস্ট বানিয়ে, এটিএম থেকে টাকা তুলে ঢুকলে। টাকার দশ ভাগের এক ভাগও খরচ হল না তো।"
"টাকা পকেটে থাকলেই সব পাওয়া যায়না যে!"
"এতদিনে জানলে?"
"শুনে এসেছি। জানলাম এতদিনে। সেই হিসেবে এই ভারতবর্ষ সফরটা আমার অনেক কাজে এসেছে।"
"আশা করি তোমার কাজে আসতে পেরেছি। হয়তো কিছুটা হতাশ করেছি। কিছু ভুলভ্রান্তি হলে সেটা ভুলে যেও।"
ঋষভ গাড়ি চালাতে চালাতে সারথিকে দেখছিল। আবার ঐ এক কথা ঋষভের মাথায় খেলল- টাকা পকেটে থাকলেই সব পাওয়া যায় না। হঠাৎ তার মনে হল- অর্থের বিনিময়ে অনেক কিছু পাওয়া যায়, অনেক কিছু যায় না। আর যেগুলো পাওয়া যায়না সেগুলো পাবার জন্যই মানুষ আরও দিশাহারা বোধ করে। হঠাৎ করে মনে হয় অর্থের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত। নিজের সামাজিক অবস্থানটাকে কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু পাওয়া যায়, অনেক কিছু যায় না। হঠাৎ করে মনে হয় নিজের সামাজিক অবস্থানটাও গুরুত্বহীন। অর্থগুলো মূল্যহীন মনে হয়, আর পৃথিবীটা অর্থহীন মনে হয়।
"নেক্সট কী প্ল্যান ঋষভ স্যার?"
"লম্বা জার্নি! হাম্পিতে ব্রেক দেবো। ওখানে একরাত কাটিয়ে তারপরদিন ব্যাঙ্গালোর। শেষ পথটা একাই ড্রাইভ করতে হবে।"
"হাম্পি তো দেখেছেন। রাতটা লক্কুন্ডিতে কাটিয়ে পরদিন সকালে নাহয় আমায় হাম্পিতে ড্রপ করুন। লক্কুন্ডিতে অনেক কিছু দেখার আছে।"
দেখার আছে বটে, কিন্তু আর ঐ হাজার বছর পুরোনো ইতিহাস দেখে ঋষভ আনন্দ পেল না। একঘেঁয়ে হয়ে গেছে। ওখানে একটা ছোট লজে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে ঋষভ সারথিকে হাম্পির কাছে একটা গ্রামে ড্রপ করল। যে বাড়িটার সামনে সারথি দাঁড় করিয়েছিল, সেটা দেখে ঋষভ জানতে চাইল, "এইটা তোমার বাড়ি? দেখাবে না?"
"এইটা না তো। বাড়ি আমার গলির ভিতরে, অনেক ভেতরে, গাড়ি যায় না। খালি দু'চাকার যন্ত্র যেতে পারে।"
"আচ্ছা দেখাবে না, তাই তো?"
সারথি বিশেষ উত্তর দিল না।
"দেখিও না বেশ। আমায় মনে রাখবে তো?"
"না। ভুলবার চেষ্টা করব।"
"হুঁ।"
"সত্যি বলব স্যার? তোমায় ভালবাসতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু যাকে ভালবাসার অন্য মানুষ আছে, তাকে ভালবাসা যায় না। যায় হয়তো, সহজ নয়। তাই আর বাসলাম না। যাই এবার। বাড়িটা আর দেখানো হল না। যাবার অনুমতি দাও, আর ভুলবার অনুমতি দিও।"
"বেশ, দিলাম।"
"ভুলবার অনুমতি দিয়েছিলে- কিন্তু নিজে ভোলোনি!" ডাক্তার ইয়াকুব বললেন।
"কে জানে হয়তো শেষের দিন ঐ কথাগুলো না হলে হয়তো ভোলা সহজ হত। গোয়ায় ও আমার সঙ্গে যেমন আচরণ করছিল- সেইভাবেই বিদায় দিলে হয়তো ভুলে যেতাম। কিন্তু ঐ যে শেষের দিন ভালবাসাটাসার কথা বলে গেল..."
"ভালবাসাটাসা ছাড়ো, যে স্মৃতির দৈর্ঘ্য ছিল কয়েক সপ্তাহ তার টানে তুমি ভারতবর্ষ যেতে চাইছ! এর থেকে বেশি সময় তো তুমি এই সান্টা ক্লারা শহরের অনেক পুরুষ মানুষের সাথে কাটিয়েছ। কিছু মনে কোরো না, আই অ্যাম জাস্ট প্লেয়িং ডেভিল'স এডভোকেট!"
"দেখুন ডাঃ ইয়াকুব, সাক্ষাৎটা কয়েকদিনের হলেও আমি জ্ঞানে অজ্ঞানে বছরের পর বছর এই স্মৃতিগুলো নিয়ে কাটিয়েছি"
"সেটা আরোই চিন্তার বিষয়। যে স্মৃতির প্রকৃত অভিজ্ঞতা সামান্যই অথচ সেই স্মৃতিগুলোকে নিয়ে ফ্যাসিনেশন তার দশগুণ, সেই স্মৃতির টানে ভারতবর্ষে যাওয়া, তোমার সাইকিয়াট্রিস্ট হিসাবে আমি কখনোই অ্যাপ্রুভ করবো না!"
"আচ্ছা!"
"সারথির সাথে যোগাযোগ আছে এখনও?"
"না, সেই তিন বছর আগে শেষ দেখা, তার পরে কোনো যোগাযোগ রাখি নি! ওর ফোন নাম্বারও ডিলিট করে দিয়েছিলাম!"
"বুদ্ধিমানের কাজ করেছ…"
"কিন্তু..."
"কিন্তু কী?"
ঋষভ এবার আরেকটু খুলে বলল তার "পুরুষার্থ" থীমের ফোটোশুটটার কথা।
"জানেন ডাক্তারবাবু, আমার জীবনের সবচাইতে সৃজনশীল কাজ ছিল ঐটা। কতরকমভাবে কতদিন মনের মধ্যে লালন পালন করেছি- তার ঠিক নেই," মুখে মৃদু হাসি নিয়ে ঋষভ বলে যাচ্ছে, "অনেকদিন অনেক যত্নে বুকে আগলে রেখেছিলাম। তারপর একদিন..."
"একদিন কী?"
"একদিন একটা নিদারুণ ঘোরের অবস্থায় গিয়ে, উত্তেজনার মাথায় কম্পিউটার থেকে ডিলিট করে, মেমোরি কার্ডটা কাঁচি দিয়ে কেটে ফেললাম!"
"এই ঘোরের অবস্থাটা কতদিন আগে হয়েছিল?"
"বছর দুয়েক আগে!"
"তখনই কিন্তু আমার কাছে আসতে পারতে। থিংস কুড হ্যাভ বিন বেটার!"
ডাঃ ইয়াকুবের কাছে ঋষভ কন্সাল্টেশন শুরু করেছে গত তিন মাস হল, রেশমীর সাথে ডিভোর্সের মাস কয়েক পর থেকে।
"যাই হোক, তিন দিন অপেক্ষা করো। আমি তোমায় একটু ভেবে বলবো ভারতে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা!"
তবে তিন দিন পর ডাঃ ইয়াকুব যখন ফোন করল, ঋষভ তখন সান ফ্রান্সিস্কো এয়ারপোর্টে বসে আছে!
"ঠিক আছে, তুমি যখন এতদিন পর নিজে উদ্যোগ নিয়ে কোথাও যাওয়ার প্ল্যান বানিয়েছো, বাধা দেব না। তা ছাড়া এরই মধ্যে এয়ারপোর্টে গিয়ে বসে আছো, এখন আমার বিশেষ কিছু বলারও নেই। ওদেশে গিয়ে ফোন কোরো।"
রেশমী আর ঋষভ আগে প্রতিবছর নিয়ম করে ভারতে আসত। কলকাতায়। ঋষভের বাবা মা আমেরিকাতেই থাকে, তবে রেশমীর বাপের বাড়ি কলকাতায়। সেই সূত্র ধরে প্রতিবছর আসা হত। তবে দক্ষিণ ভারতমুখো আর হয়নি ওরা। তা প্রায় দুই বছর পর ঋষভ ভারতে যাচ্ছে। যে দেশের প্রতি ছোটবেলায় একদম টান ছিল না, সেই দেশকে এখন তার এক কল্পলোক বলে মনে হয়! সেখানে যেন জীবনের একটা অর্থ আছে। আছে মুক্তির আনন্দ- মোক্ষ!
এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে দিল্লি, তারপর সেখান থেকে বেঙ্গালুরু। সেখান থেকে ট্রেন ধরে হাম্পি। ফ্লাইটে ওঠার আগে নিজেই নিজের সাথে ডেভিলস এডভোকেট খেলছিল ঋষভ। নিজেকে বলছিল "রেশমীকে তো পেয়েও পাওনি। এই নতুন একটা লোককে পাবার সখ কেন জাগলো? কারণ একে পয়সা ছুঁড়লেই পাওয়া যায় বলে? আর কোনও দায়-দায়িত্বের ভাবনা নেই বলে? তুমি জানো তাকে এখনও পয়সা দিলেই পাওয়া যায় কিনা? সে এখনও ঐ হাম্পি শহরেই আছে কিনা?"
আরো এরকম উদ্ভট উদ্ভট ভাবনা ভাবতে ভাবতেই সে প্লেনে উঠল। তবে প্লেনটা ডানা মেলার পর যে ভারশূন্যতার অনুভূতিটা আসে, তাতে চিন্তার ভারটাও একটু কমল!
হাম্পি গিয়ে সবার প্রথমে সেই ট্রাভেল এজেন্সির খোঁজ করল, যাদের সাথে সারথি কাজ করত। যা ভেবেছিল তাই, সে এই শহরে নেই, আর কোথায় আছে কেউ জানে না। এজেন্সির মালিক ঋষভকে একজন অন্য গাইডের সাথে একটা ট্রিপ গছানোর চেষ্টা করছে, যদিও কিছুক্ষণ পর সে বুঝল ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। কী ভেবে ডেকে পাঠাল ওর একজন কর্মচারী মঞ্জুনাথকে।
মঞ্জুনাথ ঋষভকে পা থেকে মাথা অবধি মেপে দেখল, একটু বিরক্তি সহকারে!
এজেন্সির মালিক বলল "এখানে যদি কেউ সারথির ব্যাপারে জানে সে হলো এই মঞ্জু! ওরা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। বেস্ট ফ্রেন্ডের থেকেও কিছু বেশি..."
"থাক থাক..." মঞ্জুনাথকে আরোই বিরক্ত মনে হলো!
মঞ্জুনাথ কোনও হদিস দিতে পারল না। ঋষভ ঠিক করল রাতের বাস ধরে বেঙ্গালুরু ফিরে যাবে। একটা থালির হোটেলে বসে থালি খেতে খেতে হঠাৎ মনে পড়লো, সারথি ঐ বীরভদ্রস্বামী মন্দিরের খন্ডহরে ঋষভকে নিয়ে যেতে যেতে বলেছিল ওর গার্লফ্রেন্ড মঞ্জুলা কিরকম এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আসতে ভয় পায়! আর রাত্রে বলেছিল ওর কোনও গার্লফ্রেন্ড নেই! এই মঞ্জুনাথই কি সেই...
থালিতে প্রায় সাত রকমের খাবারের মধ্যে কোনটা দিয়ে শুরু করা সমীচীন হবে সেটা ভেবে ভেবে যখন ঋষভের বিপর্যস্ত অবস্থা- আর থালাটাকে একবার ঘড়ির কাঁটার দিকে, আরএকবার ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে সে ঘোরাচ্ছে- কিন্তু কিছুতেই থামতে পারছে না- মঞ্জুনাথ হঠাৎ কোথা থেকে এসে হাজির!
"অনেক লোক আসে সারথির খোঁজ করতে। বছর দুয়েক হল এই শহর ছেড়ে সে চলে গেছে, তার পরও। দিল্লি, বোম্বে, কলকাতা- সব জায়গা থেকে। এখন দেখছি আমেরিকা থেকেও আসছে! বিখ্যাত লোক ছিল! যেটা পরে বুঝেছি।" একটু শ্লেষাত্মক ভাবেই মঞ্জুনাথ বলল "এখানে একটা ব্যবসা খোলার চেষ্টা করছিল। ফেল করে যাওয়াতে ও কেরালা-মুখো হয়। ওখানে একটা আশ্রমে যেখানে খুব ফরেন টুরিস্টরা আসে, সেখানে ও যোগা ট্রেনারের কাজ নেয়।"
"আচ্ছা…"
"তারপর আরও এক বছর আমার সাথে যোগাযোগ ছিল। বছর খানেক আগে ফোনে শেষ কথা হয়। আমার ছেলে হবার খবর দিতে ফোন করেছিলাম।"
"ওর ফোন নম্বর…"
"আছে কিন্তু নিয়ে লাভ হবে না। মনে হয় নম্বর বদলে গেছে। ওর ক্লায়েন্টরা তো ঐ নম্বরে ফোন করে পায় নি!"
এই শেষ লাইনটা থেকে ঋষভের হঠাৎ মনে হলো, সেও তো ঐ 'ক্লায়েন্টরা'র মধ্যে একজন। মঞ্জুনাথ তো অনেক কাছের মানুষ, তার কাছ থেকেই সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে আর ঋষভ তো নেহাতই তার কয়েকশ ক্লায়েন্টের মধ্যে একজন। অবশ্য কাছের মানুষের থেকে পালিয়ে বেড়ানোর অনেক কারণ থাকে।
মঞ্জুনাথ যাবার আগে বলল, "তুমি ডক্টর শ্রীধরকে জিজ্ঞাসা করতে পারো। হায়দ্রাবাদে বসেন। ওর খুব পছন্দের ক্লায়েন্ট ছিল! অনেকদিন যোগাযোগ ছিল ওর সাথে।"
"ওনার নম্বর..."
"আমার কাছে নেই। তবে উনি নামকরা ই-এন-টির ডাক্তার, ইন্টারনেটে পেয়ে যাবে।"
বেঙ্গালুরুর বাসের টিকিট ক্যান্সেল করে এবার হায়দ্রাবাদ-মুখো হবার পালা! সন্ধেবেলা হেমকূট পাহাড়ের মাথায় উঠল ঋষভ। শুয়ে পড়ল একটা পাথরের উপর! এই পাহাড়ের উপরই ফোটোশুট করতে করতে ও সারথিকে বোঝাচ্ছিল পুরুষার্থ শব্দের অর্থ! জীবনের সূক্ষ্মতর ও বৃহত্তর সমস্ত জিনিসের অর্থ বুঝতে চাওয়াটা সমস্যার! এখন সে নিজেই হাসছে এই ভেবে, কেন হুট করে সে ভারতবর্ষে এলো।
পাথরের উপর শুয়ে ঋষভ প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। সামনের পাতাল ফুঁড়ে বেরোনো মন্দিরের চূড়াটা একটু একটু করে সূর্যালোকের সোনালি রং ছেড়ে বৈদ্যুতিক আলোর হলদেটে রং নিচ্ছিল। ঐ দেখতে দেখতেই কখন চোখ বুঁজে এসেছে ঠিক পায়নি। হঠাৎ পায়ে একটা নরম আদরের স্পর্শ। বেশ ভাল লাগছিল এই ছোঁয়াটা। কে পদসেবা করতে এল পাহাড়ের মাথায় এমন অসময়ে! হাতেও একটা ঠাণ্ডা সুন্দর স্পর্শ। চোখ খুলে দেখল একটা কুকুর। তারপর পিঠে একটা খোঁচা- অল্প আঘাত। পিছন ফিরে দেখল কুকুরের মালিক। পুলিশ এসেছে- সন্ধে হয়েছে- লোক তাড়াতে হবে তাই। ভাগ্যিস পুলিশ এসে লাঠির খোঁচা মেরে উঠিয়ে দিয়ে গেল, নইলে হায়দ্রাবাদের বাস ঠিক মিস হয়ে যেত!
আগে ঋষভ ভাবতেও পারত না, সময়ের ব্যাপারে এতটা বেপরোয়া সে হতে পারে। এখন অবশ্য নিজের এই অদ্ভুত আচরণগুলো আর অদ্ভুত লাগে না। এখন সে মানুষটাই এমন হয়ে গেছে- সেটা বুঝে গেছে। বাসের সিটে গা এলিয়ে এসবই মাথায় খেলছিল।
ডক্টর শ্রীধরের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেল- তবে আরও দু'দিন পর। দিন দু'য়েক হায়দ্রাবাদের হোটেলে বসে ভ্যারেন্ডা ভাজতে হবে। খুব একটা ঘুরে বেরাতে ইচ্ছে করছিল না। সন্ধেবেলা ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে একটা ছেলেকে ঋষভ ডেকে নিল। ছেলেটিকে যখন সে রিসেপশন থেকে আনতে গেল, শুরুতেই ছেলেটা জড়িয়ে ধরল- খুব গভীরভাবে। ঋষভের বেশ ভাল লাগল জড়ানোটা। মন খারাপের মধ্যে যেন একটু শান্তি। ছেলেটা জানতে চাইল, "স্যার, টুরিস্ট মনে হচ্ছে আপনাকে? কিছু ঘুরে দেখলেন? গাইড চাই নিশ্চয়ই আপনার?"
"না তো! কাজে এসেছি, ঘুরতে আসিনি।"
পরদিন সকালে বিদায় নেয়ার আগে ছেলেটা আবার ঐ একই প্রশ্ন করল, "গাইড চাইলে বলবেন স্যার। আমিই ঘুরিয়ে দেব।"
"না চাই না।"
"স্যার, এখন আমি জবলেস। কাজ নেই। একটু কাজ পেলে ভাল হয়। তাই..."
"কত নেবে ঘোরানোর জন্য?"
"তিন হাজার দেবেন? গোলকোন্ডা, লেক, সালারজঙ- সব ঘুরিয়ে দেব।"
"তুমি পেশাদার গাইড নাকি?"
"নাঃ, তবে এই শহরের গল্প আমি বলতে পারি। এই শহরের আনাচকানাচ তোমায় দেখাতে পারি। আচ্ছা, না হয় দু'হাজার দিন। টাকার একটু দরকার আছে।"
"আচ্ছা, তুমি দু'হাজার নাও। কোনো অসুবিধে নেই।"
"তাহলে বলুন কখন ঘুরতে বেরোবেন?"
"ঘুরতে তো বেরোবো না!"
"সে কী! কোনো সার্ভিস ছাড়া কীকরে টাকা নিই বলুন তো? সময়ের অভাব থাকলে না হয় হাফ'ডে ঘুরিয়ে দিই।"
ঋষভ দেখল- ছেলেটা ফোকটে টাকা নিতে দ্বিধা করছে।
"তুমি রাখো টাকাটা, কোনো অসুবিধা নেই।"
"স্যার চলুন, ভালো লাগবে আপনার। আমার এমনিও আজ বিশেষ কাজ নেই। আপনাকে দেখেও আমি বুঝতে পারছি, আপনারও কোনো কাজ নেই- নেহাত মনমেজাজ খারাপ বলে বেরোতে চাইছেন না। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি- আপনার বেরোলে ভাল লাগবে।"
ঋষভের অবাক লাগছিল- ছেলেটা নেহাত বাইশ বছরের ছোকরা, আর্থিক অসঙ্গতি আছে- কিন্তু মনটা ভাল, সংবেদনশীল। কী সুন্দর সামনের মানুষটাকে বুঝতে পারে!
"আচ্ছা, তুমি টাকাটা রাখো। বাড়ি যাও। আমি পরে ফোন করে ডেকে নেব। এখন একটা ঘন্টা দুয়েকের কাজ আছে।"
ছেলেটি বাড়ি চলে গেল।
ঋষভের ভাল লাগছিল ছেলেটিকে, বেরোতেও ইচ্ছে করছিল। দিগ্ভ্রষ্ট মানুষের বেশি কিছু দরকার হয়না- শুধু একটা গাইডের প্রয়োজন হয়। কিন্তু হঠাৎ মনে হল- যে কাজে সে এই দেশে এসেছে, তার থেকে বিচ্যুত হলে হবে না। হয়তো ছেলেটিকে তেমন ভাল না লাগলে তার সাথে সে বেরিয়ে পড়ত। কিন্তু ভাল লাগল যখন- তখন না হয় থাক। ঋষভ ছেলেটিকে মোবাইলে আর ডেটিং অ্যাপে ব্লক করে দিল, হোটেল থেকে চেকাউট করে অন্য হোটেলে চলে গেল। এক কোটি মানুষের শহরে ঋষভকে আর ছেলেটি খুঁজে পাবে না। হোটেল থেকে চেকাউট করতে করতে মনে হল- ছেলেটার নামও জিজ্ঞাসা করা হয়নি। তারপর মনে হল- থাক গে, আর একটা নতুন ভালোলাগা তার সইবে না।
ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে বসে ঋষভ ভাবছিল, আচ্ছা ডাক্তারের আগে তো জুনিয়র ডাক্তার দেখবে, তাকে কী বলবে কেন এসেছে, একটা গল্প বানাতে হবে! তাছাড়া ডক্টর শ্রীধর কি ওর গাইডের পেশার ক্লায়েন্ট, না কি অন্য পেশাটার ক্লায়েন্ট? এসব তো ভেবেই দেখেনি সে!
ভাবতে ভাবতেই ডাক এল। জুনিয়ার ডাক্তার মেয়েটি জানতে চাইল- কী সমস্যা? ঋষভ উত্তর দিতে গিয়ে মৃদু হেসে ফেলল। তারপর বলল, "না, কোনো অসুখ বিসুখ নয়, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কিছু কথা বলার ছিল। মনে হল ওনার কাছে পৌঁছানোর এটাই সবচাইতে ভাল উপায়।"
মেয়েটি খুবই কমবয়সী আর সবে এখানে কাজ করা শুরু করেছে মনে হল- ঠিক ভেবে উঠতে পারছিল না কী বলবে। মেয়েটির অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে ঋষভের মনে হল ওরই কিছু সমাধান দেয়া উচিত।
"ম্যাডাম, আপনি মেডিক্যাল রেকর্ডে গলাব্যথা লিখে দিন। বাকিটা আমি সামলে নেব।"
"ঠিক আছে। আরও ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করতে হবে।"
ঋষভ আবার ওয়েটিং হলে এসে বসল। এই ব্যাপারটা ভেবে ওর খুব হাসি পাচ্ছিল- এমনও সব জিনিসপত্র করবে ও জীবনে ভাবেনি। ভাগ্যিস জুনিয়ার ডাক্তার মেয়েটি ওকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে রেফার করে দেয়নি।
ঘন্টা খানেক অপেক্ষার পর দেখা পাওয়া গেল ডক্টর শ্রীধরের! কাঁচা-পাকা চাপ দাঁড়ি, বয়স পঁয়তাল্লিশের কিছু বেশি হবে বলে ঋষভ আন্দাজ করল, অর্থাৎ সারথির থেকে প্রায় বছর বারো-তেরো বড় তো হবেই! তবে বয়সের অনুপাতে বেশ সুঠাম চেহারা, ফর্সা গায়ের রঙ এবং যাকে বলে সুপুরুষ চেহারা তাই।
"ছ'মাস আগে শেষ কথা হয়। বলছিল ও বিয়ে করতে যাচ্ছে, পাত্রী এবং তারিখও ঠিক হয়ে গেছে। সেই হিসাবে এতদিনে বিয়ে হয়েও গেছে নিশ্চয়ই! মেয়েমানুষে ওর কোনোকালে আগ্রহ ছিল বলে তো শুনিনি। যাই হোক, তার পর আর কথা হয়নি। তা আপনি এতদূর আমেরিকা থেকে এখানে কী করে?"
অপ্রস্তুতকর প্রশ্ন! "না মানে, ওকে নিয়ে একটা ফোটোগ্রাফির প্রোজেক্ট করছিলাম, সেটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে, তাই খোঁজ করছি!"
ডাক্তারবাবু বেশ মৃদুভাষী মানুষ, তবে ঋষভ যখন সারথির ফোন নম্বর চাইল, একটু কড়া ভাবেই উত্তর দিলেন "সারথির একজন শুভাকাংক্ষী হয়ে, আমি কখনোই ওর একজন পুরোনো 'ক্লায়েন্ট' যাকে আমি চিনি না, জানি না, তাকে দুম করে ওর নম্বর দেব না, বিশেষ করে যখন ও একটি মেয়েকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে!"
'ক্লায়েন্ট' কথাটা ডাক্তারবাবু বেশ জোর দিয়ে বললেন- সেটা ঋষভেরও কানে লাগল। ঋষভের ভাবতে অবাক লাগছে, অনেকের চোখেই সে একজন 'ক্লায়েন্ট' যে দূর আমেরিকা থেকে উড়ে এসেছে এক দেহোপজীবীর সন্ধানে! আমিরপেটের গলিতে ঘুরতে ঘুরতে এই সব ভেবেই সে আপন মনে হাসছে! মনে মনে বলছে, হোক না পাগলামি, পুরোপুরি পাগল হয়ে যাবার আগে এইটুকু পাগলামি করে নেয়া ভাল!