ঋষভ পরদিন সকালে আউটহাউসের কাছে জঙ্গলের মধ্যে বসেছিল। হাড়-কাঁপুনি ঠান্ডা, কিন্তু ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। কোথা থেকে কৃষ্ণা এসে এক কাপ চা ধরিয়ে দিল। তার নিজের হাতেও চায়ের গ্লাস। ঋষভের দিকে তাকিয়ে হাসলও। কৃষ্ণার মেজাজ ঠিকই লাগল। অন্ততঃ রান্নার তারিফ শুনে খুশি হয়েছে বলেই ঋষভের মনে হল। ঋষভ ইচ্ছা করেই রান্নাঘর থেকে দেখা যায় এমন একটা দূরত্বে বসে ছিল।
"বসো একটু।", সারথির মত কৃষ্ণার সঙ্গেও তার ইংরাজি-হিন্দি মিশিয়েই কথা হচ্ছে।
"তাড়া আছে যে।"
"কৃষ্ণা, দ্যাখো কী সুন্দর চায়ের ধোঁয়াটা কুয়াশার ধোঁয়ায় মিশে যাচ্ছে। এর মধ্যে তোমার একটা ছবি তুলব। বসবে?"
"আচ্ছা।"
কৃষ্ণা এবার মৃদু হাসল। ছবি তোলা হয়ে গেলে কৃষ্ণা উঠবে উঠবে করছিল। ঋষভ জিজ্ঞাসা করল,
"দেখে মনে হচ্ছে তুমি কিছু জানতে চাও।"
কৃষ্ণার চলনে বলনে তাড়া কম, বরং কথা বলার আগ্রহটাই বেশি, কিন্তু না বলার ভান করছে- সেরকমই মনে হল ঋষভের।
কৃষ্ণা প্রশ্ন করল, "সারথিকে কীভাবে চেনো?"
"বিয়ে করেছি, যৌতুক দিয়ে।"
উত্তরটা কৃষ্ণার খুব একটা মজার বলে মনে হলনা। ঋষভ বলল, "গাইডের কাজ করেছিল একসময় আমার জন্য।"
"আচ্ছা, মানুষের দাম দেওয়া যায়?"
"না, তবে সময়ের আর কাজের দাম হয়। আমরা সবাই পাই, না পেলে দাবি করি। আমিও পাই।"
ঋষভ নিজের মনেই বলল- এটা কোনো অর্থলিপ্সা নয়, বরং নিজের অর্থ, অর্থাৎ নিজের মানেটাকে আর সবাইকে বোঝানো। তবে এত কথা সে কৃষ্ণাকে বোঝানোর প্রয়োজন বোধ করল না।
কৃষ্ণা বলল, "বেশ।"
"সারথির দুসপ্তাহে গাইডের কাজ করে যা রোজগার করার কথা, আমি দিচ্ছি।"
"ওহ।"
"তোমাকেও দিতে পারি। রাঁধুনির কাজের মাইনে। দশদিন বাকি আছে আমাদের ট্রিপের। যাবে?"
"ও ফ্রিল্যান্সার। আমি চাকরি করি। মালিক পেটাবে।"
"যদি মালিক না পেটায় যাবে?"
"আপনার ট্রিপে রাঁধুনির তো কোনও প্রয়োজন নেই?"
"রাঁধুনির প্রয়োজন নেই ঠিক, কিন্তু তোমার প্রয়োজন থাকতেই পারে। আমার কাছে না হোক, সারথির কাছে।"
"বিশেষ প্রয়োজন নেই বলেই মনে হয়। আর থাকলেও প্রয়োজনটুকুনই আছে। তার অতিরিক্ত কিছু নেই।"
"আবার বলছি। এই কদিনের রোজগারের ডবল পাবে।"
"আমার টাকারও বিশেষ দরকার নেই।"
ঋষভ দেখল অদ্ভুত কঠিন লোক এই ছেলেটি।
"অনুরোধ করছি আজ রাতে এসো। কাল হয়তো ব্যস্ত ছিলে- আসতে পারোনি। সব কাজের শেষে এসো। দেরি হলে ক্ষতি নেই। হয়তো সারথি কিছু বলতে চায় তোমায়।"
কৃষ্ণা চলে যাবার পর, নরম পাতার উপর দু'হাতের কব্জিকে বালিশ বানিয়ে ঋষভ শুয়ে পড়ল। কখন ঘুম এসেছে টের পায়নি। অবশ্য মানুষ ঘুম আসা টের পায় ঘুম ভাঙার পর। হঠাৎ করে কুয়াশা কেটে গিয়ে রোদ এসে পড়েছে চোখের উপর। এবার ঘরে ফেরার পালা।
দুপুরে দুজনে বাবাবুদানগিরি ঘুরতে গেল। সেযুগে ইয়েমেনের আরবরাই একমাত্র কফি চাষ করত, ওরাই একমাত্র কফি রপ্তানি করত। ওখান থেকে পৃথিবীর কোনও প্রান্তে কফি বীজ নিয়ে আসা যেত না। ধরা পড়ে গেলে কঠিন শাস্তি। বাবা বুদান নামে এক সুফি সাধক মক্কা থেকে হজ করে ফেরার সময় লুকিয়ে কিছু কফির বীজ লুকিয়ে নিয়ে আসার ধৃষ্টতা করে আর এই পাহাড়ে পোঁতে। সেই থেকে ভারতবর্ষে প্রথম কফি চাষ শুরু। সারথি এইসব গল্প ঋষভকে বলছিল পাহাড়ের ঘাসে শুয়ে দূর-দূরান্তের উপত্যকাগুলো দেখাতে দেখাতে।
"ঐ পাহাড়ের নিচে বাবাবুদানের দরগা। হিন্দুদের কাছে দত্তাত্রেয়পীঠ। দত্তাত্রেয় নাকি অবতার হয়ে জন্ম নিয়েছিল- বাবা বুদানের রূপে।"
ঋষভ এত গল্প শুনছিল না। সে খালি পাহাড়ের উপর থেকে মেঘের আনাগোনা দেখছিল। মেঘের নয়, মেঘের ছায়ার- একেকটা বড় মেঘ আসছে, আর নিচের উপত্যকার একটা বড় অংশ কালচে সবুজ হয়ে যাচ্ছে, আবার মেঘ সরে যাচ্ছে- উপত্যকার রংও বদলাচ্ছে। মেঘ যাচ্ছে উপর দিয়ে, কিন্তু তাদের পায়ের ছাপগুলো যাচ্ছে নিচের উপত্যকাটা বেয়ে বেয়ে। এইসব দেখতে দেখতে ঋষভ খালি একবার জিজ্ঞাসা করল- "আজকের প্ল্যান নিয়ে কোনো প্রশ্ন আছে তোমার?"
"নাঃ। খালি একটা জিনিস বলতে ইচ্ছে করছে।"
"কী?"
"গতবছর বলেছিলাম না, তুমি মানুষটা খুব নতুন নতুন। আজকেও সেরকমই মনে হচ্ছে। দেখে মনে হয় না- কিন্তু বেশ মজার লোক তুমি।"
বাবাবুদানগিরি ঘুরে এসে, ঋষভ সারথিকে মনে করিয়ে দিল কৃষ্ণাকে রাতে আসার ব্যাপারে নিজে গিয়ে বলতে।
"কী বলতে হবে বুঝেছ তো? পরিপাটি করে বলবে।"
"ও.কে. স্যার।"
ঋষভের বেশ উত্তেজনা হচ্ছে আবার আরামও লাগছে। এদের মশলার বাগানে গিয়ে নানারকম পাতা আর বীজ- খুলে খুলে হাত দিয়ে পিষে পিষে তাদের গন্ধ শুঁকছে। কৃষ্ণা কোথা থেকে এসে তার হাতে এক কাপ চা ধরিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে তড়িঘড়ি করে আবার রান্নাঘরের দিকে ফিরে চলে গেল। ঋষভ কিছুক্ষণ জঙ্গলে দাঁড়িয়ে শুকনো পাতার উপর মড়মড় শব্দে পা ফেলে ফেলে কৃষ্ণার ফিরে যাওয়াটা দেখল। কৃষ্ণা মিলিয়ে যাবার পর ঋষভ আবার যে কাজ বা অকাজ এতক্ষণ করছিল তাতে মনোনিবেশ করল।
আজ রিসর্টে অতিথি বিশেষ নেই। উইকেন্ড চলে গেছে, অতিথিও কমে গেছে। ঋষভ জানিয়ে দিয়েছিল- রাতে বেশি কিছু রান্নার দরকার নেই। একটা বিসিবেলেভাত রান্না করলেই হয়ে যাবে। সেটাই আজকে কৃষ্ণা বেশ যত্ন নিয়ে পরিবেশন করল। ভাল করে টেবিল সাজিয়ে- অন্যদিনের মত তাড়াহুড়ো করে সশব্দে নয়। কৃষ্ণা যে চটেমটে নেই - সেটা দেখেও ঋষভ কিছুটা শান্তি পেল।
"তুমিও বসো আমাদের সাথে, কৃষ্ণা।"
"তোমরা খাও ভাল করে। আমি আর শিবা পরে শান্তিতে বসে খাব।"
আমরা থাকলে কি অশান্তিতে খাবে?- এরকম একটা প্রশ্ন ঋষভের মাথায় এল, তবে করল না।
রেশমীকে আজ একটু তাড়াতাড়ি ফোন করল ঋষভ,
"আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘুমোতে হবে। কাল আর্লি মর্নিং মিটিং আছে তো।"
"ঘুমোও না তাড়াতাড়ি। এভাবে সাত সকালে ঘুম ভাঙাতে আছে?"
সান ফ্রান্সিস্কোতে এখন ভোর।
"সরি রেশমী।"
"তুমি দিনকে দিন মানুষটা খুব পাগলাটে হয়ে যাচ্ছ। যাও ঘুমোও। আমাকেও ঘুমোতে দাও।"
ফোনটা বন্ধ করে ঋষভ একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল- বেশ নিশ্চিত বোধ হচ্ছে। আবার একটু অনিশ্চিত বোধ হচ্ছে- ওদের অনুরোধটা কৃষ্ণা রাখবে তো? না কি...
রাত হল। কৃষ্ণা এসেছে। না, সেজেগুজে আসেনি। উল্টে দিনের শেষের ক্লান্তি চোখেমুখে মেখে সে এসেছে। কিং সাইজের বেডের এক কোণে বসে সারথি- তার চোখ কৃষ্ণার দিকে। অন্য কোণে কৃষ্ণা- কে জানে মেঝের কার্পেটে অত কী দেখার জিনিস পাচ্ছে। তবে সে চোখ তুলছে না।
খাটের সামনের সোফায় পা তুলে দু'হাত ছড়িয়ে বসেছে ঋষভ। এই কাজ সে কখনও করেনি, বইএতেই পড়েছে। সারথিকে যখন সে প্রস্তাবটা দিল, সারথি জানতে চাইল,
"কাক... হোয়াট?"
"আচ্ছা, তুমি কখনও শোনোনি?"
"কাকোল্ড্রি। ভালবাসার মানুষকে অন্যের সাথে প্রেম করানো। আর সেটা দেখে উপভোগ করা।"
"আমি আবার কবে থেকে তোমার ভালবাসার মানুষ হলাম?"
ঋষভ নিজের মনেই বলল- "সত্যিকারের কাকোল্ড্রি হত রেশমীর সাথে কাউকে...", তারপর নিজেকেই তিরস্কার করল। রেশমীকে এসব বলার কথা সে ভাবতেই পারে না। সম্পর্কটা যেন একটু বেশীই পবিত্র! ভাড়া করা মানুষকে এগুলো বলতে বাধে না।
ঋষভের হঠাৎ হঠাৎ করে মনে হয়- সারথি তার কে হয়? কেউ তো হয়না। অথচ মনে হয় অনেক কিছু হয়, অনেক কিছু করা যায় তাকে নিয়ে, অনেক কিছু ভাবা যায় তাকে ঘিরে। সারথি তার কেউ হয়না বলেই হয়তো ভাবা যায়।
কিন্তু ঋষভ যেভাবে ভেবেছিল সেভাবে তো এগোচ্ছে না! কিছুই যে এগোচ্ছে না। বিছানার দুইপ্রান্তে কৃষ্ণা আর সারথি। কৃষ্ণা মাথা নিচু করে আছে, কিন্তু সেটা লজ্জা নয় সেকথা ঋষভ স্পষ্ট বুঝতে পারছে। সারথিও এগোতে পারছে না, কিন্তু সেটাও লজ্জা-সংকোচ নয়- সেটাও ঋষভ বুঝতে পারছে। সারথি চোখের ইশারায় ঋষভকে ডাকল। ঋষভ ইশারায় উত্তর দিল, "আজ তোমাদের খেলা, আমি শুধু দেখব।"
ঋষভ দেখল এই স্থিতাবস্থা কাটাতে তাকেই কিছু করতে হবে। খালি চিত্রনাট্য লেখা যথেষ্ট নয়, পরিচালনার দায়িত্বটাও তাকে নিতে হবে। সে ফ্রিজ থেকে হুইস্কির বোতল বার করল। কৃষ্ণাকে বলল, "সারথি বলছিল, তোমার খুব ইচ্ছে ওর সাথে বসে হুইস্কি খাবার। আমার জন্যই সেটা হচ্ছিল না। এবার আমি তোমাদের হুইস্কির পেগ বানাবো- বেশ?"
এক পেগ হুইস্কি খেয়ে সারথি কিছুটা চাঙ্গা হল, কিন্তু কৃষ্ণা এক চুমুকের বেশি খায়নি। ঋষভ সারথিকে কলার ধরে টেনে তুলে কৃষ্ণার সামনে এনে মাটিতে বসাল। সারথি কৃষ্ণার সামনে হাঁটু মুড়ে বসল, বলল, "দ্যাখো কৃষ্ণা, আমরা বন্ধু ছিলাম, খুব ভাল বন্ধু ছিলাম, তাই না?"
"হুঁ।"
"তুমি তখন রেস্তোরাঁয় রান্না করতে। মাংস কাটার ছুরি নিয়ে মাংস কাটতে কাটতে আমায় ভয় দেখিয়েছিলে- তাও তো কতবার তোমার কাছে এসেছি- আসিনি?"
"তো?"
"যেদিন জঙ্গলে ঘোরাতে নিয়ে যাবার আব্দার করতে, নিয়ে যেতাম, যেতাম তো?"
"তো?"
"কত ভালবেসেছি, আবার তো বাসতে পারি?"
"তা এটা ভালবাসার জায়গা?"
"এই ঋষভ স্যার খুব ভাল মানুষ। তোমার আমার ভালবাসা দেখতে চায়। মানুষ কীভাবে ভালবাসে দেখতে চায়।"
"তোমার স্যার পয়সা দিয়ে বাঁদরের খেলা দেখতে চাইলে, তুমি তাকে বাঁদর নেচেও দেখাবে?"
এক এক শব্দে উত্তর দিতে দিতে হঠাৎ করে কৃষ্ণা এত কিছু বলে বসবে ঋষভ আশা করেনি।
"ভালবাসার স্থান-কাল হয় না কৃষ্ণা।"
সারথি কৃষ্ণার হাত চেপে ধরল।
"হারামজাদা, তোকে পয়সা দিয়ে নাচাচ্ছে বলে আমাকেও নাচতে হবে নাকি?"
সারথির গায়ে হুইস্কিটা ছুঁড়ে কৃষ্ণা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল, সশব্দে দরজা বন্ধ করে।
কৃষ্ণার জন্যই মনে হয় সারথি আজ একটু ভাল দামি শার্ট পরে বসেছিল। সেটা হুইস্কিতে ভিজে যাওয়াটা মনে হয় একটু বেশি বিরক্তিকর। হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে সারথি বলল, "দেখলে ঋষভ স্যার, দেখলে? কী মেজাজ? আমি রোজগার করি বলে এদের সয় না। রয়ে তো গেল ঐ এক রাঁধুনি হয়ে। এরা সারাজীবন গরিব হয়েই কাটাবে।"