ডক্টর শ্রীধর ফোন নম্বরটা না দিলেও কথায় কথায় বলেছিলেন কেরালায় কোচিনের কাছে কুজিপল্লি বলে একটা গ্রামে সারথি থাকে। ঋষভ কুজিপল্লির ব্যাপারে পড়াশুনো করে দেখল যে, জায়গাটা খুব বড় নয়! সেখানে সারথিকে খুঁজতে গিয়ে সে নিজে হারিয়ে যাবে না! কিন্তু কুজিপল্লি জায়গাটা অত ছোটও নয়। নানারকম ভাবে খোঁজার চেষ্টা করল – যোগা স্কুল, ট্রাভেল এজেন্সি, আশ্রম, ডেটিং অ্যাপ – যেখানে যেখানে সারথির থাকার সম্ভাবনা আছে। সারাদিন ঘুরেও বিশেষ লাভ হল না।
রাতের বেলা হোটেলের ভেতর ভালো লাগছিল না, বিচের বালিতে গা এলিয়ে দিল। কয়েকটা কুকুর এই রাতের আরব সাগরকে পাহারা দেয়, তবে ঋষভকে ওরা তাড়িয়ে দিল না। আরব সাগর শান্ত সমুদ্র, আর মরা জোয়ারের গর্জন কম, বেশ ঘুমপাড়ানি শব্দ তার। ঋষভ ঘুমিয়েই পড়ল। কিন্তু ঘুমের মধ্যে এ কী স্বপ্ন! কৈ, আজ তো মায়ালোকে পৌঁছানোর সাদা পাউডার সে নাক দিয়ে টানেনি! তাহলে এমন স্বপ্ন কেন? এত জীবন্ত স্বপ্ন কেন?
ঋষভ স্বপ্নটাকে সত্যি বলে বিশ্বাস করে নি, কারণ হ্যালুসিনেশন তার নিত্যসঙ্গী। স্বপ্নটার উপর ঋষভ যতই অবিশ্বাস দেখাতে থাকল, তত স্বপ্নটা নিজের সত্যতা জানান দেয়ার জন্য বেশি বেশি করে আগ্রাসী হতে থাকল! স্বপ্নটা নিজেকে জলজ্যান্ত সত্যি বলে না প্রমাণ করে ঋষভকে নিজের নাগপাশ থেকে মুক্তি দেবে না। ঋষভের শরীর থেকে সব রস শুষে নিয়ে রিক্ত করে সে তার অস্তিত্বের জানান দেবে। কারণ সেটা স্বপ্ন নয়, জলজ্যান্ত মানুষ, আর ঋষভ নিজের চোখকে এখনও বিশ্বাস করতে পারেনি!
“খবর পেয়েছি- সারা গ্রাম জুড়ে কেউ আমায় খুঁজছে! আর দূর থেকে দেখে ঠিক চিনেছি সেটা তুমি!”
পরদিন যেখানে ঘুম ভাঙল, দেখল ঘরের মাথায় তেরছা কাঠের চাল, তাতে বিশাল বিশাল কাঠের কড়িবর্গার সাপোর্ট, জানালা দিয়ে ব্যাকওয়াটার দেখা যাচ্ছে, তলায় হাঁস মুরগি চরে বেড়াচ্ছে, প্রচুর নারকেল গাছ যাদের কোনো-কোনোটা নুইয়ে পড়ে জল ছোঁয়ার চেষ্টা করছে! একটু দূরে দেখতে পেল, সারথি ব্যাকওয়াটারের জল দিয়ে গাড়ি ধুচ্ছে। দূর থেকে সে সেলাম করল। একটু পরে ঘরে এল। সাদা শার্ট, গোল করে পরা সাদা ধুতি, আর কোঁকড়ানো চুল তো ওর ছিলই – সব মিলিয়ে ওকে কেরালারই লোক মনে হচ্ছে!
“সাহস তো কম নয়! অত রাত্রে বিচে গিয়ে শুয়েছিলে! জানো ওখানে এক তান্ত্রিক বাবা আসেন! ভয়ঙ্কর তান্ত্রিক! হিপনোটাইজ করে, যার শরীরের যেটা ভালো লাগে, কাঁচি দিয়ে কট করে কেটে নিয়ে চলে যান!”
ঋষভ শুনে হেসেই ফেলল- “সবই তো অক্ষত আছে দেখছি!”
“তা কোলে করে তুলে নিয়ে এলাম তাই। যা ওজনটা বানিয়েছ, গায়ে ব্যথা হয়ে গেল!”
“তা নিয়ে এলে টা কোথায়? তোমার বাড়ি না কি এটা?"
“সে ভাগ্য আর কোথায় সাহেব? এটা স্লিপিং রিভার হোমস্টে। আমি এখানকার ম্যানেজার। তিনটে কটেজ জুড়ে খান দশেক রুম আছে আমাদের। পাঁচ হাজার টাকা পার নাইট, তবে তোমায় ডিসকাউন্ট অফার দিচ্ছি, তিন হাজার।”
“আমার হোটেলে দুরাতের অগ্রিম বুকিং করা আছে যে!”
“অতশত জানি না। বলো তো আর কিছু ডিসকাউন্ট দিতে পারি। তাছাড়া এটা হেরিটেজ সোঁকাস্টে, কেরালার কালচার অনেক ভালো বুঝতে পারবে এখানে থাকলে। এছাড়া এখানে কিছু বাড়তি সার্ভিস পাবে যা ওখানে নেই!”
“তা পাবো খন। এক কাপ কফি তো খাওয়াও!”
“অবশ্যই পাবে। সঙ্গে ব্রেকফাস্টও পাবে। তবে এখন গল্প করতে পারছি না, মালিক, মানে এই হোমস্টের মালিক, বিনোদ স্যার এখন এখানে আছেন। বুঝতেই পারছ, যদি দেখে কাজ না করে গল্প করছি, ধরে পেটাবে। লাঞ্চের পর তোমার সাথে বসে একটু চা খাব। ততক্ষণ আশপাশটা ঘুরে দেখো।”
সারথির চেহারায় কী যেন একটা বদলে গেছে ঋষভের মনে হল। সম্ভবত চুলটা। আগে এত বড় চুল সে রাখত না – বিদেশি টুরিস্টদের গাইডের কাজ করার জন্য আরও পরিপাটি থাকতে হয়।
ডাঃ শ্রীধর কথাপ্রসঙ্গে এটাও বলেছিলেন, যে সারথি অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিল গত কয়েক বছরে। গাইডের কাজ তার একঘেঁয়ে মনে হচ্ছিল, আর শরীরের ব্যবসায় অনেক প্রতিযোগিতা। এখন অনেক ভালো ভালো দেখতে মডেলরা এই পেশায় আসে, কারণ মডেলিংয়ে সবার খুব ভালো আয় হয় না, অথচ প্রলোভন প্রচুর – সবাই ভালো জীবন কাটাতে চায়। একজনকে ভালো মডেল হতে গেলে প্রচুর ইনভেস্ট করতে হয়। বডি বিল্ডিং, স্কিন পলিশিং, ওয়াক্সিং, শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আলাদা করে যত্ন নেওয়া, ভালো প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার এবং মেকআপ আর্টিস্ট দিয়ে নিজের পোর্টফোলিও বানানো, নেটওয়ার্কিং। অনেক সময় অত ভালো রিটার্ন হয় না, আর ভালো জীবনযাত্রার মান সবাই চায়। অতএব অনেক মডেলই এই কাজ করে। সারথিও নিজের শরীরের যত্ন নেয়, শরীরচর্চা ভালমতই করে – নিজেকে সুন্দর রাখে, কিন্তু এই মার্কেটে খুব বেশি দাম পাওয়া মুশকিল। ওর বয়সও প্রায় তেত্রিশ বছর। তাই অন্য জীবিকা হিসাবে যোগা ট্রেনিং, স্পা-সার্ভিস – এগুলোর চেষ্টা করছিল ও।
একবার ঋষভ ভেবেছিল, যে সারথিকে জিগ্যেস করবে – সে বিয়ে করেছে কি না। ডাঃ শ্রীধরের হিসাব অনুযায়ী, এতদিনে বিয়ে হয়ে যাবার কথা! তারপর ভাবল জিগ্যেস করে লাভটা কী, এমনিতেই কারণে –অকারণে তার মিথ্যে বলার অভ্যাস, এবারও একটা কিছু বলে দেবে, আর পরেরদিন বক্তব্যটা বদলেও যেতে পারে। বৌয়ের নামও দুম করে বদলে যেতে পারে, হঠাৎ বাচ্চাও হয়ে যেতে পারে! তাছাড়া সে বিয়ে করেছে কি করেনি, তা নিয়ে ঋষভের মাথাব্যথা থাকার কোনও সঙ্গত কারণ নেই!
ঋষভ ভাবছিল, এই মিথ্যাবাদী লোকটার টানে এতদূর আসা কেন? নাকি এই মিথ্যা দিয়ে তৈরি কল্পলোক বাস্তব জগতের থেকে তাকে বেশি আকৃষ্ট করে?
সারথির কথা শুনে ঋষভ ভেবেছিল, এই হোম-স্টের মালিক বিনোদ স্যার খুব রাশভারি রাগী একজন মানুষ হবেন। যখন দেখা হল দেখল উনি মোটেই ওরকম নন, আবার খুব আলাপি মানুষও নন। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। রিসেপশনে ম্যানেজারের চেয়ারে ম্যানেজার অর্থাৎ সারথির বদলে বিনোদ স্যার বসে, একটা অনেক ছবি-টবি আঁকা চকচকে টি-শার্ট পরে – মানে ঐ বয়স হয়ে গেলে লোকের খুব রঙিন হবার সখ হয় – আর সারথি ওঁর ঘাড়ে-কাঁধে-পিঠে ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। ঋষভ মনে মনে বলল – আমেরিকায় মালিক যদি ম্যানেজারকে দিয়ে এই কাজ করায়, ওখানকার লেবার আইন অনুযায়ী রীতিমতো কোর্টে একটা মামলা হয়ে যেত! সারথি অবশ্য কাজটা হাসিমুখে করছে!
কথায় কথায় জানা গেল বিনোদ স্যার দুবাইয়ে থাকেন। বোঝা গেল ওদেশে অনেক পয়সা করেছেন, এখানে অনেক জমিজমা কিনেছেন। মাসে একবার করে কোচিন ঘুরে যান, হোমস্টের তদারকি করেন। আর কয়েকমাস পর দুবাইয়ের পাট চুকিয়ে পাকাপাকিভাবে এদেশে চলে আসবেন।
বাইরে একটা কোলাহলের শব্দ পেয়ে ঋষভ বেরিয়ে এল। এই হোমস্টের সঙ্গে পাশের বাড়ির লোকের কিছু ঝগড়া। ভাষা বোঝা তার পক্ষে সম্ভব নয়। খালি দেখল দুই-হাতে দু’টো নারকেল নিয়ে অন্য বাড়ির ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। ঋষভের ভয় লাগছিল দেখে – ছুঁড়ে না মারে। পরে, যে হেল্পার চা দিতে এসেছিল, তাকে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল, “আমাদের নারকেল গাছগুলো ও বাড়ির দিকে হেলে গেছে তো – তাই সব নারকেলই ও বাড়িতে পড়ে। ওরাই নিয়ে নেয়। নারকেল কার সেই নিয়ে ঝগড়া।”
“তা নারকেল শেষ অবধি কার দাঁড়াল?”
“গাছ আমাদের, তা হওয়ার কথা আমাদেরই। ও বুড়ি বলে কিনা – গাছ তোদের, তো তোদের দিকেই পড়ুক না, কোনোদিন আমাদের মাথায় পড়লে, মাথা ফাটলে তার দায় তোরা নিবি?”
“ভুল বলেনি তো!”
“বিনোদ স্যার আমাদের ডেকে বললেন – গঙ্গা হিমালয়ের বরফ থেকে তৈরি হয় মানে তো এই নয়, যে হিমালয় তার জল আটকে বসে থাকে। গঙ্গা যেখানে যেখানে যায় – তার জল সবাই পায়। নারকেল গাছ যদি নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে হেলে দুলে ওদিকে যাবে আর ওদের জমিতেই নারকেল ফেলবে – আমরা কী করতে পারি?”
নারকেল গাছ নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছে শুনে ঋষভের হাসি পেল।
“বাহ, বড় মনের মানুষ উনি।”
“সেটা আমাদের ঠান্ডা করার জন্য। আমরা ঠান্ডা হতে, উনি নিজে বেরোলেন বুড়ির সাথে কথা বলতে। ফিফটি – ফিফটিতে মিটমাট হল।”
“বেশ।”
“বিনোদ স্যার বলেন, সবকিছু ভাগাভাগি করে নেয়া উচিত। এভাবে উল্টে অনেক বেশি জিনিসের মালিকানা পাওয়া যায়। নইলে মানুষ একটা জিনিসের পিছনেই পাগলের মত ছুটতে থাকে। উনি কী যে বলেন- সব মাথামুন্ডু বুঝি না।”
বিকেলে সারথি এল।
“অপেক্ষা করছিলে?”
ঋষভ কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই সারথি একটা ঝুলি থেকে গাদাখানেক সাবান, শ্যাম্পু, লোশন বার করল। গায়ে অর্গানিক লেখা।
“ঋষভ স্যার, এগুলো হ্যান্ডমেড। আমরা বাড়িতে বানাই। শ্যাম্পুটা আমার তৈরি। আয়ুর্বেদিক।”
ঋষভ জানে এগুলো লোক ঠকানো জিনিস, সব রিসর্টেই অরগানিক-আয়ুর্বেদিক এসব নাম দিয়ে বিক্রি হয়। সারথির নিজের হাতে তৈরি নয় – সেটাও জানা কথা। তবু ঋষভ না জানার ভান করল। এই সুযোগে সারথির দুটো রোজগার হলে ক্ষতি কী! আর সেই সুযোগে সারথির সঙ্গে দুটো কথা বলার সুযোগ হলেই বা ক্ষতি কী। কিন্তু কথা আর হল না। কটা জিনিস ঋষভের হাতে হস্তান্তরিত হতেই, সারথি কাজের অজুহাত দেখিয়ে পালিয়ে গেল।
সন্ধেবেলা বিনোদ স্যার নিজে ডেকে নিয়ে গেলেন পাশের গ্রামে কলারিপায়ট্টু অর্থাৎ কেরালার নিজস্ব মার্শাল আর্টের শো দেখাতে। উনি বললেন, সারা পৃথিবীতে মানুষ ভারতকে চেনে যোগা, গৌতম বুদ্ধ আর মহাত্মা গান্ধীর দেশ হিসাবে। কিন্ত অনেকেই জানে না, কলারিপায়ট্টু, যোগার মতোই বিশ্বের দরবারে ভারতবর্ষের একটা বড় অবদান। চীনের শাওলিন মন্দিরে বোধিধর্ম দক্ষিণ ভারত থেকে গিয়েছিলেন বৌদ্ধধর্মের প্রচার করতে, সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন কলারিপায়ট্টুর শিক্ষাও। পরে শাওলিন মন্দির থেকেই কুংফুর জন্ম। কলারিপায়ট্টু ও যোগার একে অপরের প্রতি অনেক অবদান আছে।
প্রথমে বাদ্যযন্ত্র সহকারে কলারিপায়ট্টু হলো, তারপর ঐ একই জিনিস নাচের আকারে। মার্শাল আর্ট এবং মার্শাল ডান্স। অনেক কিছুই হল সারাদিন ধরে। আর বিনোদ স্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন ঋষভকে সকালের ফ্রেস তোলা চিংড়ি মাছই যেন খাওয়ানো হয়, ওদের নিজেদের গাছের লাল নারকেল দিয়ে রান্না করে। এত কিছু হল, কিন্তু ঋষভের সারথির সাথে বসে দুটো কথা বলা হল না! সারাদিনই সে ব্যস্ত হোমস্টের কাজ আর বিনোদ স্যারকে নিয়ে!
প্রায় রাত্তির সাড়ে বারোটা, হঠাৎ একটা শব্দে হকচকিয়ে ঋষভের ঘুম ভাঙল। তার ঘরে কে যেন এসেছে।
“চল…”
“কোথায়?”
“বিচে! এতক্ষণে বুড়োর কাছ থেকে ছুটি পেয়েছি।”
“কী বলে এলে ওনাকে?”
“ঘুম পাড়িয়ে এসেছি!”
“দাঁড়াও, জামাটা পরে নিই।”
“না পরলেও চলবে। এত রাতে এদেশে কেউ জেগে থাকে না।”
ঋষভ জামাটা পরেই নিল। বাইকে যেতে যেতে সে সারথিকে বলল, “চার বছর আগেও এভাবে আমায় কিডন্যাপ করেছিলে।”
“একটাই পার্থক্য! তখন আমি সিঙ্গল ছিলাম, তুমি ডবল। এখন উল্টোটা!”
“মানে?”
“মানে কিছু না! তুমি এখনও ঘুমে ঢুলছো, ভালো করে জড়িয়ে ধরো, নইলে বাইক থেকে পড়ে যাবে!”