আগের রাতে বিচের মধ্যে পুরো ঘুমে ঢুলে পড়ার আগে, যেটুকু বাক্যালাপ ঋষভের মনে আছে, তা হল,
“খুব ভালোবাসো তোমরা দু’জন দু’জনাকে?”
“কেন, হিংসে হচ্ছে?”
“হিংসে কেন হবে?”
“বিনোদ স্যার যখন নিজে খাবার বেড়ে খাওয়াচ্ছিল আমায়, আর দইয়ের ঘোল বোতলে ভরে দিচ্ছিল, আমি ঠিক জানি তোমার হিংসে হচ্ছিল!”
“না না, সে দেখে তো আমার খুব ভালো লাগছিল। হিংসে কেন করব?”
“না, তোমার হিংসে হচ্ছিল!” সারথি পাশে শুয়ে থাকা ঋষভের পায়ে নিজের তাগড়াই পা দিয়ে বার কয়েক জোর ধাক্কা মেরে বলল, “বলো হচ্ছিল, খুব হিংসে হচ্ছিল!”
“ঠিক আছে বলছি...”
“আরে তুমিও না! তবে আমি জানি সবার হিংসে হয়! আর আমি চাইও সবার হিংসে হোক! ওনার আর সব কর্মচারীরা আমায় হিংসে করে। আমার পুরনো খদ্দেররা আমাদের দু’জনকে হিংসে করে! এটাই চেয়েছি সারা জীবন। আর সবার ভালবাসা দেখে যেমন লোকের হিংসে হয়, আমারটা দেখেও সবার হোক!”
“পুরনো খদ্দেরদের সাথে যোগাযোগ রাখো?”
“কাটিয়ে দিচ্ছি এক এক করে। কাউকে কাউকে কাটানো মুশকিল। আর কোনো ব্যবসায় সোজাসুজি না বলতে নেই! একজনকে মাস ছয়েক আগে বলে দিলাম বিয়ে করছি। বিয়ের একটা তারিখও বানিয়ে বললাম, না হলে ছাড়তো না!”
এটা ডক্টর শ্রীধর? জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও ঋষভ প্রশ্নটা করল না। ঋষভ ভাবছিল, ডক্টর শ্রীধর আর বিনোদ স্যার একই বয়সী। প্রথমজনের চেহারা সুন্দর টান টান, পেশায় নামকরা ডাক্তার, অনেক শিক্ষিত। দ্বিতীয় জনের চেহারা তাঁর বয়সেরই মতো, একটু আলুথালুই চেহারা, নেহাতই গ্রামের মানুষ, দুবাই গিয়ে ভাগ্যলক্ষ্মীর কৃপা পেয়েছেন। প্রথমজন সারথির কথা বলতে গিয়ে বার পাঁচেক প্রস্টিট্যুশন কথাটা বলেছিলেন, যেন ওটাই সারথির সবচেয়ে বড় পরিচয়! দ্বিতীয় জন দিয়েছেন সেই বস্তু, যা সবাই ঈর্ষা করে। ঋষভ অবাকই হয়েছিল প্রথমে, যখন দেখেছিল বিনোদ স্যারের জন্য সারথি ডক্টর শ্রীধরকে জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। এখন বুঝল অবাক হবার কোনো যুক্তি ছিল না। আসলে সে সব কিছুই সামাজিক শ্রেণীর আতস কাঁচ দিয়ে দেখেছে। ঋষভ নিজে আর ডক্টর শ্রীধর একটা শ্রেণী, বিনোদ স্যার আর সারথি আরেকটা! তাই তার কাছে ব্যাপারটা আশ্চর্যের ছিল।
ঋষভের রাগ হচ্ছে নিজের উপর। বিনোদ স্যার খুব শান্তমুখে গাড়ি চালাচ্ছে, আর ঋষভ পিছনের সিটে বসে বসে ভাবছে – সারথির কথা শুনে সে যদি বাধ্য ছেলের মতো ভোরের আগেই ঘরে চলে আসত, এই পরিস্থিতি হত না। না জানি এখন কি চলছে বিনোদ স্যার আর সারথির মধ্যে। যদি একটা সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় সে-ই দায়ী হবে। আচ্ছা, যদি বিনোদ স্যার বেচারা সারথিকে তাড়িয়ে দেন? ব্যবসা থেকেও আলাদা করে দেন? নিরাশ্রয় সারথিকে সে আশ্রয় দেবে! কিন্তু এই ভাবনার পর ঋষভ নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিল এই বলে, “কেন সারথিকে একজন আশ্রয়প্রার্থী জীব বলে ভাবছো? সারথিকে আশ্রয় দেবার তুমি কে? সারথি একজন স্বনির্ভর লোক, যে নিজের ভাল-মন্দ নিজে সামলাতে পারবে। কেন এই অহংকার তোমার? নিজের সম্পর্ক বাঁচাতে পারলে না, আর নিজেকে অন্যের রক্ষাকর্তা বলে ভাবতে চাও!” তার নিজেরই তো এখন পরজীবীর মতো অবস্থা। প্রতিদিনই রাতে কেউ না কেউ তাকে বিচ থেকে তুলে নিয়ে আসছে আর অন্যকে সে পরজীবী ভাবতে চায়!
কৃষ্ণা আর সারথির মধ্যে যখন ঝগড়া হয়েছিল – তখন তেমন অপরাধবোধ ঋষভের হয়নি। তার নিজের সম্পর্ক ভাঙল রেশমীর সাথে – বিশাল ধাক্কা লেগেছিল, কিন্তু তার জন্য সে অনেকদিন ধরে প্রস্তুত ছিল – ভাঙাটা অবশ্যম্ভাবী ছিল। কিন্তু আজ তার জন্য এই সম্পর্কটা ভেঙে গেলে সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না মনে হল।
ঋষভ উঠোনে গিয়ে ব্যাকওয়াটারে নামার সিঁড়িতে গিয়ে বসল। একটু অবাক হয়েই দেখল, এখন এগারোটা বাজে, অথচ সারথি আজ অন্য বাড়িটায় কাজে যায়নি। অন্তত ওর বাইকটা এখানেই রয়েছে। সারথির বাইকটার কাছে গিয়ে সে আশেপাশে দেখল, সারথিকে খুঁজে পাওয়া যায় কি না। পাওয়া গেল না। একজন কর্মচারী তাকে বলল, “সারথি স্যার এখনো ঘুমোচ্ছে! ডেকে দেব?”
“না থাক!”
পাশের কটেজের ঘরটা থেকে সারথির জড়ানো গলা শোনা গেল, “ভেতরে এসো।”
ঋষভ ঘরে ঢুকল। বেশ সুন্দর কাঠের আসবাব-অলা একটা ঘর। কেরালা সূক্ষ্ম কাঠের কাজের জন্য বিখ্যাত, কাল প্যালেসেও এরকম আসবাব সে দেখেছে। এছাড়া সুন্দর একটা অগরু কাঠের গন্ধ, জলে ভেজানো গোলাপ আর জুঁই ফুল। একটা কাঠের পেডেস্টালের উপর বিনোদ স্যার আর সারথির একটা বুর্জ খলিফার সামনে তোলা ছবি। একটা কাঠের পালঙ্কে সারথি একা শুয়ে ছিল। দিনে প্রচুর খাটালেও রাতে বেশ রাজার হালেই সারথিকে রাখেন বিনোদ স্যার।
“বিনোদ স্যারের সাথে আমার কথা হয়েছে। চিন্তা কোরো না। সব ঠিক আছে।” সারথির সত্যি-মিথ্যে বোঝার সাধ্য ঋষভের নেই। সব ঠিক থাকলেই ভালো।
“উনি এখন কোথায়?”
“রিসেপশন সামলাচ্ছেন।”
“ভাবছি আজকেই চেকাউট করে, কলকাতায় চলে যাবো। আমার মামাবাড়ি ওখানে। আমেরিকায় যাবার আগে একবার দেখা করতে চাই ওনাদের সাথে।”
“ঠিক আছে। নো প্রবলেম!”
সারথি বাইরের কর্মচারীটিকে বলে দিল ঋষভের জন্য এয়ারপোর্টের গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে। ঋষভ স্নান সেরে প্যাকিং করে রিসেপশনে চাবি দিতে এল। বিনোদ স্যার তাকে দেখে খুশি হলেন না অখুশি বোঝা গেল না, খালি বললেন, “সারথির সাথে দেখা করতে চাও? ও কাজে বেরিয়ে গেছে।”
“ঠিক আছে। আমি রওনা দিচ্ছি। অনেক ধন্যবাদ এই তিনদিনের এত সুন্দর আতিথেয়তার জন্য।”
“সাবধানে যেও।”
গাড়িতে উঠতে উঠতে ঋষভ ভাবছিল, হয়তো সব ঠিকই আছে। হয়তো বিনোদ স্যার সারথির প্রেমিক নন, হয়তো দু’জন শুধুই বিজনেস পার্টনার। হয়তো মানুষ হিসাবেই তারা একে অপরকে ভালবাসে। সারথি অনেক কিছুই তো মিথ্যে বলে, অনেক কিছুই তো বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলে।
অথবা বিনোদ স্যার চুপ করে থাকার কারিগরিটা জানেন, যেমন জানতো রেশমী!
ঋষভের গাড়িটা স্টার্ট দেবার মুহুর্তে হঠাৎ ঋষভ গাড়ির জানালায় দেখতে পেল বিনোদ স্যারকে। বিনোদ স্যার তাকে আলাদা করে ডেকে নিলেন – একটু দূরে – ব্যাকওয়াটারের চাতালে।
“মিস্টার ঋষভ, আপনার হাতে একটু সময় আছে?”
“বলুন না।”
“মনে হল আপনি কিছু বলতে চান।”
ঋষভ বুঝতে পারল – আসলে বিনোদ স্যারই কিছু বলতে চান, কিন্তু কথাটা ঋষভকে দিয়ে পাড়াতে চান।
“নাহ, বিশেষ কিছু না। সব ঠিক আছে তো?”
“হ্যাঁ ঠিকই আছে। ঠিক না থাকার কোনও কারণ নেই।”
“আশা করি আমি আপনাদের কোনও ক্ষতি করিনি। করলে ক্ষমা চাইছি।”
“না না, সে ঠিক আছে। ক্ষমা চাইবার কোনও প্রয়োজন দেখিনা।”
“অনেক বড় মন আপনার।”
“কে জানে! আচ্ছা তোমাকে একটা ঘটনা বলি। তুমি অল্পপরিচিত, বিদেশি, হয়তো তোমাকে বলাটা বেঠিক হবে না। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছিল। তখন আমার অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্টের একটা সমস্যা ছিল। রাগের চোটে সারথিকে ধাক্কা মেরেছিলাম। এখনও ওর কপালে সেই দাগ আছে।”
“ওহ!”
“তারপর নিজের উপরই রাগ হল। ভেবেছিলাম সারথি আমায় ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু পরদিন ও আমায় এসে বলল – বিনোদ স্যার, খুব খারাপ ছেলে আমি, আমায় একটু শিখিয়ে দিও কীভাবে ভাল হওয়া যায়।”
ঋষভ গাড়িতে বসে বসে ভাবছিল- সারথি আর বিনোদ স্যারের কথা। সারথি কী সুন্দর মিথ্যে বলল কপালের চোটটা নিয়ে! ভালই করেছে।
ব্যাকওয়াটার আর সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে যে রাস্তা চলে গেছে, সেই রাস্তা দিয়ে কয়েক কিলোমিটার গেলে ব্যাকওয়াটার পেরিয়ে মেইনল্যান্ডে যাবার ব্রিজ। এই ব্রিজটা পেরিয়ে গেলে কুজিপল্লির সাথে সব যোগাযোগ শেষ। ব্রিজ পেরোনোর সময় ঋষভ একবার পিছন ফিরে দেখে নিল কুজিপল্লিকে শেষ বারের মত, মনে মনে বলল, “ভালো থেকো তোমরা দু’জন। সারথি, যদি মিছিমিছি স্বপ্ন দেখিয়েও ওনাকে খুশি রাখা যায়, রেখো তাই! তুমি স্বপ্ন দেখানোর কারিগরি জানো, দেখিও। কত সুন্দর সুন্দর মিথ্যে বলেছ আমায়, তা বেশ করেছ, বোলো। .... আর বিনোদ স্যার, আপনিও ভালো থাকুন। খালি ভালোবাসা দিতে দিতে মানুষ অনেক সময় উল্টোদিক থেকে ভালবাসা চেয়ে নিতে ভুলে যায়, সেটা করবেন না!”
*****
প্লেন ছাড়ার কথা রাত্রে। ঋষভের কুজিপল্লিতে আর ভালো লাগছিল না বলে দুপুরেই চলে এল। ওয়েটিং হলে বসে সাত-পাঁচ ভাবছিল। গাড়ি থেকে নামার সময় সে লক্ষ্য করেছিল, সারথির কাছ থেকে ওর ফোন নম্বর চেয়ে নেওয়া হয়নি। এখানে আসার আগেও সে সারথির ফোন নম্বর জানত না, ফিরে যাবার সময়ও তা অজানাই আছে! শুধু ফোন নম্বর কেন, সারথি মানুষটাই – আগেও অজানা ছিল, এখনও অজানাই আছে!
একবার ভেবেছিল গাড়ির চালকের কাছ থেকে সারথির ফোন নম্বর চেয়ে নেবে। গাড়ির চালক ঐ হোম-স্টেরই কর্মচারী। কিন্ত চাইল না! হোটেলের রিসেপশনের খাতায় ঋষভের ফোন নম্বর আর ইমেল আছে, সেই দেখে যদি সারথি কোনদিন যোগাযোগ করে!
মোবাইলে দেখল তার সাইকিয়াট্রিস্ট ডঃ য়াকুবের মেসেজ “এভরিথিং অলরাইট?”
“ইয়েস” ঋষভ উত্তর দিল।
প্লেন একটু একটু করে রাতের আকাশে উঠল। আজ পূর্ণিমা। রাত্রি আটটার ধূসর কমলা রঙের একথালা চাঁদ আকাশে! তলায় দেখতে পেল, সমুদ্রের পাড় দেখা যাচ্ছে, আর আলো-অন্ধকারের বিন্যাসটা দেখে ব্যাকওয়াটারের অস্তিত্বটাও বোঝা যাচ্ছে। সমুদ্র আর ব্যাকওয়াটারের মাঝে কত কত গ্রাম। কোনও একটা গ্রাম হয়তো কুজিপল্লি। তলার কোনও একটা বিচে শুয়ে আছে সে আর সারথি! বালির মধ্যে থেকে ঝিনুক কুড়িয়ে কুড়িয়ে সে মালা গাঁথছে একের পর এক, আর পড়িয়ে দিচ্ছে সারথির বুকের উপর। পূর্ণিমার চাঁদে জল চকচক করছে, সেই জলে ওরা ভেসে বেড়াচ্ছে – না, শান্ত তুঙ্গভদ্রা নদীর কোরাকল ভেলা নয়, দোল খাওয়া সমুদ্রের মাঝে মেছো নৌকায়। প্রতিবারই সারথি তার হাতে একটা জিনিস তুলে দেয়, কল্পনার রসদ, নতুন নতুন কল্পনার রসদ। কল্পনা কল্পনাই, কল্পনা সারথির মতনই মিথ্যা বলে, কল্পনা সারথির মতনই মন ভোলানো গল্প বলে, কল্পনাই তাকে বাঁচিয়ে রাখে!
তিনদিন পর ঋষভের ফিরে যাবার পালা নিজের দেশে – আমেরিকায়। আমেরিকাই তার নিজের দেশ থাকুক, জীবনের অর্থ না হয় সে সেদেশেই খুঁজুক, ভারতবর্ষটা না হয় থেকে যাক কল্পলোক হয়ে। সেই কল্পলোকে বেঁচে থাকুক সারথিরা, যেদিন আবার কল্পনার রসদে কমতি পড়বে, আবার সে ফিরে আসবে এই মায়াবী দেশে!
উপসংহার
ঋষভ প্লেন থেকে নেমে ফ্লাইট মোড অফ করার পর দেখল একটা মেসেজ এসেছে, “সেদিন ওভাবে পালিয়ে গেলেন কেন বলুন তো? অনেক কষ্ট করে আপনার নম্বর জোগাড় করলাম। লাঞ্চের টাকা বাঁচিয়ে, হোটেলের বয়কে ঘুষ দিলাম, যাতে লুকিয়ে চুরিয়ে হোটেলের রেজিস্টার থেকে আপনার নম্বর জোগাড় করে দেয়। এইটা আমার নম্বর। কখনও হায়দ্রাবাদ এলে দেখা করবেন স্যার, আপনাকে শহরটা দেখানো বাকি রইল।”