ঋষভ বিছানায় নিজের কুণ্ডলী পাকানো শরীরটাকে আরোই কুঁকড়ে নিল, বালিশটাকে নিল আরো কিছুটা বুকের কাছে। কাউন্সেলরের সঙ্গে ও কথা বলেছে কিছুদিন আগে। কাউন্সেলরের পরামর্শ অনুযায়ী যদি চলতে হয়, এখন ওর বিছানায় থাকার কথা নয়, কিন্তু নিজেকে তোলা যদি অতো সহজ হত। শরীরের ওজন সত্তর কেজি, যে কেউ তুলতে পারে, কিন্তু ভেতরে জমে থাকা পাথরটার ওজন অনেক বেশি। কিন্তু ঐ পাথরটা কী এবং কোথা থেকে এসেছে সে নিজেও ভাল করে জানে না। পাথরটা স্রেফ এসে বসে আছে- তাকে সরানো যায় না।
ঋষভ লক্ষ্য করেছে, ভাল স্মৃতি মন ভাল করে। ভাল স্মৃতির অভাব তার পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে নেই। প্রয়োজনের থেকে বেশিই আছে। তবে সব ভাল স্মৃতিকে রোমন্থন করতে ইচ্ছা হয় না। খালি একটা স্মৃতি আছে যেটাকে মন্থন করা যায়, যার সবটা মনে নেই, হয়তো সবটা সে বোঝেনি। হয়তো একটু ধোঁয়াশা ছিল, অতএব সেই ধোঁয়াশার পিছনের বস্তুটিকে নিজ মাধুরী দিয়ে সাজানো যায়। যা করার সময় বা সাহস সেই চারবছর আগে হয়নি, এখন করা যায়, কল্পনায়। সেইজন্য হয়তো এই ধোঁয়া ধোঁয়া স্মৃতিটার রোমন্থনযোগ্যতাটা একটু বেশি!
রেশমী হোটেলের ঘরে জামাকাপড়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলছিল "যা ধুলো এই হাম্পি শহরে। আর একটু বৃষ্টি হতেই প্যাচপ্যাচে কাদা!"
রাত্রে ঋষভের বিছানায় শুয়ে বেশ হাসি-ই পাচ্ছিল, যখন ও বালিশে মুখ-বুক গুঁজে দিনের বেলার কথা ভাবছিল। কণ্ঠাস্থির তলার দাগটাতে হাত বোলাতে বোলাতে আরোই মজা পাচ্ছিল সে। তড়িঘড়ি করে নেমে আসতে হয়েছিল বীরভদ্রস্বামী মন্দির থেকে, কারণ তখন পৌনে চারটা বাজে। আর সারথিটা কী মিথ্যুক, ঋষভ যখন জিজ্ঞাসা করল, গলায় বুকে কোনো দাগ আছে কিনা, ও দিব্যি বলে দিল- নেই! পরে হঠাত বাইকের আয়নায় দেখে টের পেল।
"তুমি মিথ্যে বললে কেন?"
"আমি ভাবলাম তোমার বৌ কাল রাতে ওটা দিয়েছে!"
"ঠিক আছে, আমায় ওষুধের দোকানে নিয়ে চলো, ব্লাড ক্লটে লাগানোর মলম কিনে নেবো!"
এক তো এখানে ওষুধের দোকানই নেই বিশেষ, যেটা পাওয়া গেল, তাতেও ব্লাড ক্লটের ওষুধ নেই।
"জঙ্গলে গেছিলে যখন, বনবিড়াল খামচে দিয়েছে কি মৌমাছি কামড়েছে, অমন কিছু একটা হয়েছে! কৈ আমার গার্লফ্রেন্ড তো ঐ নিয়ে অতো মাথা ঘামায় না?"
"আর এত খড়বড়ে রাস্তা বলোনি তো!"
"অ্যাডভেঞ্চারে যাচ্ছি বলেছিলাম তো! তুমি অ্যাডভেঞ্চার বলতে কী ভেবেছিলে?"
অ্যাডভেঞ্চারশেষে হাতে পায়ে চোট বা কাটাছেঁড়া নিয়ে ফিরলে ঠিক ছিল- কিন্তু গলার দাগটানিয়ে ফেরাটা একটু বেশিই অ্যাডভেঞ্চারে হয়ে গেল- ঋষভের মনে হল। সারথিই বলে গেল, "রাস্তা খারাপ বলোনি কেন? গলায় দাগ বলোনি কেন? এত প্রশ্ন করলে কি আর জীবনটা চলে স্যার? মাঝেমধ্যে প্রশ্নোত্তরের বাইরে বেরোতে হয় তো!"
ঋষভের ঝোপ ঝাড় কাদার মধ্যে দিয়ে ঐ পোড়ো মন্দিরে যেতে গা ছমছম করছিল, আর সারথি বলছিল, ওর গার্লফ্রেন্ড মঞ্জুলারও নাকি ওখানে আসতে প্রথম প্রথম ভয় করত। জন্তু জানোয়ারের শব্দ করে সে আরো ভয় দেখাতো।
"ভাই সারথি, মেয়েরা অত ভয় পায়না যতটা ছেলেরা ভাবে। আসলে ওদের ভয় পাবার অভিনয়টা ছেলেরা দেখতে ভালবাসে তো, তাই..."
"কত কী জানো! ঘর-সংসার করা মানুষ তো.."
"শেষ কবে এসেছিলে এখানে?"
"এই দিন তিনেক আগে। গার্লফ্রেন্ড নিয়ে। বেচারি অনেক সাহস নিয়ে এসেছিল, বলেছিল জন্তু জানোয়ারের ভয় এখন আর পায় না। কিন্তু জানোয়ার তো ওর সঙ্গে এসেছিল, যে পশুরক্ত-মাংস খায় না, শুধু শরীরটাকে নিংড়ে নিংড়ে খায়। শরীর থেকে রস শোষে, ড্রাকুলার মতো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে!"
"সাংঘাতিক জানোয়ার তো!"
"তোমার ভয় করছে না ঋষভ স্যার? জানোয়ারের ভয় পাও না?"
"সব খাবার কি আর জানোয়ারের মুখে রোচে?"
নিজেকে সেই জানোয়ারের হাতে সঁপে দেবার আগে নেহাতই একটা মৃদু প্রতিবাদ ঋষভ করেছিল,
"সারথি, এ যে মন্দির, এ তো দেবস্থান!"
"ধরে নাও আমি কন্দর্প আর তুমি দেবাদিদেব! ধরে নাও এই মন্দির খাজুরাহো! কল্পনা করো ঋষভ, কল্পনা! কল্পনায় সত্য-অসত্যের ভেদ থাকে না!"
সারথির জীবনে সত্য-অসত্যের ভেদ সত্যিই নেই, ঋষভ পরে বুঝতে পেরেছিল। সারথি নেহাত গাইড নয়, যেন বহুরূপী- অভিনয় করে!
"রঞ্জনা যখন দোনামনা করছিল, ওকেও একই কথা বলেছিলাম।"
গার্লফ্রেন্ডের নাম দুম করে মঞ্জুলা থেকে রঞ্জনা হয়ে গেল! ঋষভ একটু পরে সুযোগ করে জিজ্ঞেস করেছিল, "মঞ্জুলা না রঞ্জনা- নামটা কী?"
"নাম কি আর মনে থাকে স্যার? সংখ্যাই মনে থাকেনা। চারটে গার্লফ্রেন্ড, তিনটে বয়ফ্রেন্ড- বুঝতেই পারছেন!"
ঋষভ হিসাব করল- পুরো সপ্তাহের জোগান আছে, কিন্তু গার্লফ্রেন্ডের থেকে বয়ফ্রেন্ড কম কেন? একটা কি ভ্যাকেন্সি আছে?
এই সব ভেবে ঋষভের প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছিল, রাত্রে বিছানায় শুয়ে। মন উত্ফুল্ল থাকলে আনন্দটা ভাগ করে নেয়া উচিত। ঋষভ রেশমীর গায়ের উপর উঠে ঠোঁটটা রেশমীর গলায় রেখে বলল,
"রেশু, রাগ করলে নাকি?"
"রাগ করব কেন?"
"এই তোমায় ঘরে রেখে দুপুরে চলে গেলাম!"
"আমার এমনিও রেস্ট নিতে ইচ্ছে করছিল, মাথাও ধরেছিল।"
"সে কী! তুমি আগে বললে মাথাটা একটু টিপে দিতাম!"
"হ্যাঁ, কত যেন মাথা টিপে দাও। আর আমার ওভাবে মাথা ব্যথা সারেও না!"
"এইভাবে সারে?"
"আঃ কী করছো, কী অসভ্য দেখো তো!"
"কী করবো রেশু? আজ যে খুব অসভ্য হতে ইচ্ছে করছে!"
রাত সাড়ে বারোটায় হঠাত ঋষভের মোবাইলে মেসেজ: "ঘুমোলে হবে?"
"ঘুমোচ্ছি না।"
"উত্তর যখন করলে তখন ঘুমোচ্ছ না- জানি।"
"তা, আমার ঘুম মাটি করা কেন? গার্লফ্রেন্ডের কী হল?"
"গার্লফ্রেন্ড নেই স্যার, আমি যে তোমার মত নই গো। মেয়েমানুষে টান নেই, কী করি? ভাল লাগে শুধু পুরুষদেহগুলো।"
অদ্ভুত মিথ্যাবাদী তো, গার্লফ্রেন্ডের সংখ্যা এক থেকে দুই, দুই থেকে চার, আর এখন সোজা চার থেকে শূন্য হয়ে গেল! ঋষভ টাইপ করল,
"তুমি কী করছ?"
"অপেক্ষা।"
"কার?"
"কার নয়, কীসের। ঘুমের অপেক্ষা করছি। কী ভাবলে? মানুষের অপেক্ষা করছি এই মাঝরাতে?"
"বেশ, তবে আমায় ঘুমোতে দাও এবার।"
"দেব না। তোমায় নিদ্রাহীন রাতের অভিশাপ দিলাম, যাও! আর, তুমি তো জেটল্যাগে ভুগছ। ঘুম কীসের?"
"ছাড়ো।"
"এই যে, অত ঘুমোনোর ইচ্ছে হলে, নিজেই ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমিয়ে পড়া যায়।"
"এই যে, আমি তোমার ক্লায়েন্ট। রাতবিরেতে বিরক্ত করলে তোমার মালিককে কম্প্লেন করে দেব।"
"কম্প্লেন! বড় ভয় করে কম্প্লেন শুনলে। আমি নাহয় এখন তোমার দরজায় এসে কান্নাকাটি করি-স্যার কম্প্লেন করবেন না আমার নামে, আপনিই আমায় শাস্তি দিন। নিজের হাতে শাস্তি দিন, কম্প্লেন করবেন না। কঠিন শাস্তি দিন, তবু কম্প্লেন করবেন না।"
"কী শাস্তি দেব?"
"মশাই, শাস্তিটা কী হবে, সেটা যে শাস্তি দেয়- সে ঠিক করে। যে নেয় সে করে না।"
ঋষভ নিজের মনেহাসছিল। সারথির বলা দৃশ্যগুলোসে মানসচক্ষে দেখার চেষ্টা করছিল, আর ভাবছিল- কল্পনার জগৎকে রসদ দিতে পারে এমন একটা মানুষ থাকা ভাল- বিশেষ করে সারথির মত কেউ যার সত্যি-মিথ্যের ঠিকঠিকানা নেই। রেশমী ঘুমের মধ্যে অন্য পাশ ফিরে শুলো। রেশমীকে দেখতে দেখতে ঋষভ টাইপ করছিল।তার সাময়িক অনুপস্থিতি দেখে সারথি আবার মেসেজ করল, "বলুন স্যার! কী শাস্তি দেবেন? বলবেন না? বলতেই হবে কিন্তু। ভেবে পাচ্ছেন না? তাহলে ভাবার জন্য দু'মিনিট দিলাম। ভাবুন ভাবুন, আমাকে ভাবুন, নিজেকে ভাবুন। ভাবার ক্ষমতা থাকলে ভাবুন।"
কখন ঘুম এসেছে ঋষভ টের পায়নি!
সারথি নিতে এল ঋষভ আর রেশমীকে। আগের দিনের মত আজও ঋষভই আগেভাগে রিসেপশনে এসে ধরা দিল। ঋষভ লক্ষ করেছে যখনই তার সঙ্গে সারথির দেখা হয়, সারথি কী যেন একটা মেপে নেয়। শান্তভাবে- সামনের লোকে যাতে বুঝতে না পারে- কিন্তু মুখে হাল্কা হাসি নিয়ে। মাথা থেকে পা অবধি মেপে নেয়। ঋষভ ঠিক বুঝতে পারে না- হয়তো তার অস্থিরতা আর অপেক্ষাটাকে মেপে নেয়। কাল রাতে তার কতটা ঘুম কম হয়েছে- সেটা হয়তো মাপছে। ঋষভের এটা ভালই লাগে। আগে কেউ এভাবে তাকে মেপে দেখেনি। এত আগ্রহ নিয়ে কেউ দেখেনি। তাই সারথির উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন- ঋষভের এই ব্যাপারটা ভাল লাগে।
আজকের প্রোগ্রামে সবার প্রথমে পট্টাভিরাম মন্দির। বিশাল কম্প্লেক্স- কিন্তু প্রায় জনমানবশূন্য। প্রাঙ্গণের বিস্তার আর কম্প্লেক্সের ভেতরে স্থাপত্যের সংখ্যা দেখলে বোঝা যায়- বেশ জমজমাট ব্যাপার ছিল এখানে। মন্দিরের একপ্রান্তে অনেক থামআলা একটা হল- কল্যাণমণ্টপ। আগেরদিনের বিট্ঠলমন্দিরের মতনই- তবে কাজের সূক্ষ্মতা কিছুটা কম। ওখানে সিংহ, ঘোড়া, ময়ূর- সব জন্তু জানোয়ারেরা দাঁড়িয়েছিল থাম হয়ে, এখানে তারা বসে আছে থামের গায়ে। গতকাল মিউজিকাল পিলার হল বন্ধ থাকায় ওরা আশাহত হয়েছিল- এখানে খোলা আছে। ঐ কল্যাণমণ্টপের এক কোণে সারথি কয়েকটা পাথরের থাম বাজিয়ে বাজিয়ে দেখাল। মিউজিকাল পিলার! কিন্তু ঋষভ বাজাতে গেল- বেসুরো হয়ে বাজল।
"এগুলো টুরিস্ট ঠকানো জালি জিনিস মনে হচ্ছে।"
"স্যার, বাজানো শিখতে হয়- এই দেখুন আমি বাজাচ্ছি- সাতশো বছরের শিক্ষা!"
"তুমি মানুষটা অত বুড়ো তো মনে হও না।"
"দাঁড়াও, তোমায় শেখাচ্ছি।"
সারথি যত্ন নিয়ে হাত ধরে শেখাল।
"স্যার, এগুলো টুরিস্টদের শেখানোর কথা নয়। লোকাল নলেজ, লোকাল মানুষের নলেজ। আপনারা ভালমানুষ- তাই শেখালাম।"
"হ্যাঁ, এটা শিখে তোমার ব্যবসায় ভাত মারব তো!"- এটা বলতে গিয়েও ঋষভ বলল না।
"স্যার, ম্যাডাম। এবার ভিডিও। স্যার পিলার বাজান, আপনি নাচুন ম্যাম। আমাকে ভিডিও ক্যামেরাটা দিন।"
"আমি নাচতে পারি না।"
"তাহলে স্যার নাচুন, আপনি পিলার বাজান- ম্যাম।"
"আরে আমিও ওসব নাচতে পারি না। আর এখানে নাচলে ভারতনাট্যম নাচতে হবে।"
"ওহ! তাহলে আমিই নাচছি। স্যার পিলার বাজান। ম্যাম- আপনি ভিডিও করুন।"
দু'জনেরই বেশ মজা লাগল এটা শুনে।
"এই বেশ! লেট'স ডু ইট!"- রেশমী বলল।
"আরে আপনারা হাসছেন কেন? আমি সত্যি নাচতে পারি। ট্রেইন'ড ডান্সার। কুচিপুরি, মোহিনীঅট্টম- সব শিখেছি।" সারথি সশব্দে এক এক দুই পা ফেলল, পাথরের মেঝেতে বেশ আওয়াজ হল- আর হলটাও সেভাবেই বানানো। সারথি হাতে নাচের মুদ্রা ধরল। "ম্যাডাম, ভিডিও নেবার সময় খেয়াল রাখবেন- এখানে সবাই নাচছে- আমি একা নই- দেখুন ঐ পিলারের ময়ূরটা, এই পিলারের নর্তকী, আর এইবসে থাকা সিংহটাও। এটা নাচেরই ঘর। সবাইকে নিয়ে ভিডিওটা তুলবেন।"
রেশমী দেখল, সত্যিই তো- সবাই কমবেশি নাচের মুদ্রায়।
"এটা লাস্য ছিল, এবার তাণ্ডব!"
তবে তাণ্ডব শুরু হবার আগেই, মন্দিরের সিকিউরিটির লোকেরা এসে থামার ইঙ্গিত করল। সারথির চেনা- তবে এত নাচগান মনে হয় সইছিল না।
"স্যার, তাণ্ডবটা বাকি রইল। অন্য কোনো মন্দিরে হবে, অন্য কোনোদিন।"
"অপেক্ষা করব!" ঋষভ বলল।
"ভাল নাচো তুমি।" রেশমী বলল।
"এই নাচ দেখলে সে যুগের রাজারা গলার হার খুলে দিয়ে দিত।" সারথি বলল।
সন্ধেবেলা মলয়বন্ত পর্বত থেকে সূর্যাস্ত দেখা। ওপারে আঞ্জনেয় পর্বত, হনুমানের জন্মস্থল, আর এপারে মলয়বন্ত পাহাড় আর তার চুড়োয় রামের মন্দির। হনুমান আর রাম- মাঝে বয়ে যাচ্ছে তুঙ্গভদ্রা। পাথর কেটে কেটে। যে সে পাথর নয়। এ হচ্ছে রামায়ণের কিষ্কিন্ধ্যা। যে সোনালি হলুদ রঙের গ্র্যানাইট পাথর বা বোল্ডার থেকে হাম্পির সমস্ত স্থাপত্য তৈরি হয়েছে, সেই পাথরই দূর দূরান্ত অবধি দেখতে পাওয়া যায় মলয়বন্ত পর্বত থেকে। সূর্যাস্তের সময় সোনা রঙ গোলাপি হতে থাকে। রেশমী যখন ডিএসেলার হাতে এই স্বর্গীয় রঙের খেলাকে এক সামান্য পার্থিব ক্যামেরায় বন্দি করার অহেতুক প্রচেষ্টায় ব্যস্ত, ঋষভ একঝলক তাকিয়ে দেখে নিল সারথির মুখে পড়া শেষ সূর্যের আলোটা। সারথির সূর্য ওঠা-নামা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই, মোবাইল নিয়েই ব্যস্ত!
রেশমী পাহাড়ের আরেকটু নিচের ঢালে নেমে গেছে উপর থেকে হাম্পির কোনও পুরোনো ধ্বংসস্তূপের ছবি তোলা যায় কিনা- খুঁজতে। ঋষভ দেখল খুব পরিচিত একটা ডেটিং অ্যাপে সারথি কীসব চ্যাট করছে, মাথা চুলকে চুলকে হিসাব করছে।
"আমি পাঁচ হাজার চাইছি, আর এ আড়াইয়ের উপরে উঠবে না! ভারতীয় লোকজন ঐ জন্য আমার পছন্দ নয়!"
"তুমি পয়সার বিনিময়ে করো নাকি?"
"করি তো! শরীরের দাম আছে, আর সময়েরও! পুরুষের সঙ্গে করি, মহিলাদের সঙ্গেও। ফরেনার মেয়েগুলো ব্যাপক!"
ঋষভ ভেবে দেখল সে যদি তার সিলিকন ভ্যালির জবের মাইনে অনুযায়ী প্রতি ঘণ্টার হিসাবে সময়ের দাম নেয়, কোনো ক্লায়েন্টই তার সঙ্গে শুতে আসবে না! কিন্তু কাল যে সারথি বলল মেয়েমানুষে ছিটেফোঁটা আগ্রহ নেই ওর!
"তোমার হোটেলেই থাকে এ, তুমিই নিয়ে নাও না। হাজার তিনেকে রাজি হয়ে গেলে, দেড় হাজার তোমার, দেড় আমার কমিশন!"
ঋষভ মনে মনে বলল, দেহব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে দালালির কাজটাও করো না কি? তারপর ভেবে দেখল, গাইডের কাজ থেকে আর কতো আয় হয়? তাছাড়া সারথি প্রতিদিন ভাল জুতো পরে, জামায় কাফলিঙ লাগিয়ে, দামি সেন্ট মেখে আসে, একেকদিন একেক রঙের নেহরু জ্যাকেট আর ট্রাউজারের কম্বিনেশন পরে, তাদের সঙ্গে মানানসই ঘড়ি পরে আসে। নিজেকে একটু ভাল রাখার জন্য বাড়তি রোজগার দরকার!
"আমার বোনের একটা হার্টের চিকিত্সা চলছে, বুঝতেই পারছ!"
ঋষভ ভেবে দেখল- গতকাল বলেছিল, ওর বাবা-মা ওকে ব্রাত্য করে দিয়েছে, আর ভাই-বোন কেউ নেই, প্রচণ্ড একা। আজ আবার বোন জন্মে গেল। এই মিথ্যাটা না বললেও সে সারথির এই কাজটাকে অশ্রদ্ধা করত না।
"তোমার বয়ফ্রেন্ডরা এই নিয়ে কিছু বলে না?"
"বয়ফ্রেন্ডরা? একটা বয়ফ্রেন্ড থাকলে তো!"
"সত্যি নেই?"
"জানো ঋষভ স্যার, পুরোনো সিনেমায় যখন কোনো বেশ্যাবাড়ি দেখানো হত সেখানে একজন গার্জিয়ান মহিলা থাকত। সে খেয়াল রাখত বাড়ির মেয়েরা কারও সঙ্গে প্রেম করছে কিনা। যে সার্ভিসের জন্য মোটা টাকা চার্জ করার কথা, সেটাই ফ্রি-তে বিলিয়ে দেয়া হয়ে যায় যদি ওরা প্রেম করে বসে। এটা মার্কেটের পক্ষে ঠিক না। হয় বাড়ি নিয়ে গিয়ে বৌয়ের সম্মান দাও, নয়তো দাম দাও।"
"আর কেউ প্রেম করে বসলে?"
"যে গণিকারা নিজের পেশা ভুলে গিয়ে কোনো সুদর্শন পুরুষের রূপে মত্ত হয়ে…" সারথি চোখ দিয়ে ঋষভের মাথা থেকে পা অবধি মেপে বলল- "…নিজেকে বিনামূল্যে সমর্পণ করত তাদের শাস্তি হত।"
"কেমন?"
"পেশা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হত, ট্রাফিক সিগনালের গণিকাবৃত্তি করতে হত। আজ থেকে দু'হাজার বছর আগে হলে হয়তো কোনো মঠের ভিক্ষুণী হয়ে যেত।"
"ওহ, তোমারও অমন একটা গার্জিয়ান বাড়িওয়ালি আছে নাকি?"
"আছে!"
"কোথায়?"
"আমি নিজে। নিজের গার্জিয়ানগিরি করি।"
"ঐজন্য বয়ফ্রেন্ড পাতাও না?"
"ছাড়ো! আর বয়ফ্রেন্ড পাতাতে চাইলেই যেন হয়ে যাবে!"
"আমায় যে ফ্রি-তে প্রেম বিলোলে? তোমার গার্জিয়ান বাড়িওয়ালি বকল না?"
"তুমি মানুষটা বেশ নূতন নূতন- তাই সুযোগ ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না। আর ভিনদেশি মানুষের সঙ্গে নূতন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়।"
ঋষভ ভাবল- তার নিজের কাজে ভিনদেশিদের সঙ্গে কাজ করলে অভিজ্ঞতা বাড়ে- এই কাজেও এমন হয় নাকি!
ঋষভের মাথায় খেলল- হয়তো যেটা ও ফ্রিতে ভাবছে সেটা ফ্রি নয়। কখন কোথায় কীসের দাম কীভাবে দিতে হয় কে জানে! ঋষভ দেখল রেশমী আশেপাশে আছে কিনা। তারপর সারথির কাঁধে মৃদু ধাক্কা মেরে বলল,
"তোমার সঙ্গে তিনবছর আগে দেখা হলে, আর তোমার জীবনদর্শনে পাণ্ডিত্যলাভ করলে, তখন হয়তো এই কাজটা শুরু করে দিতাম। তখন গতরটাও ভাল ছিল, আর আমার কোম্পানিটার অবস্থাটাও খারাপ যাচ্ছিল। লাখখানেক ডলার জমিয়ে নিতাম।"
"কিন্তু আমার তো জমে না। ডলার কেন টাকাতেও জমে না। টাকাও জমে না, বয়ফ্রেন্ডও হয়না।"
"ওহ।"
"যাই হোক, কী আর বলি! বেশ্যার জীবনে কিছু হয় না গো! বয়ফ্রেন্ড হয় না, ঘর হয় না, বর হয় না, আপন হয় না, পর হয় না, শুধু ক্লায়েন্ট হয়।"