ইজরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত তিনযুগে তিনবার হয়েছে। এই সমস্যাগুলোর একটার থেকে অন্যটা পুরোপুরি স্বতন্ত্র, তাদের কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। কিন্তু একটার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব অন্যটার উপরে ব্যাপকভাবে পড়েছে - তাও কয়েক হাজার বছরের ব্যবধানে। ইতিহাসের আসল মজাটা এখানেই। শুধু নামকরণ বা নাম বদল থেকেও অদ্ভুত ঐতিহাসিক জটিলতা সৃষ্টি হয়।
প্রথম সংঘাতগুলির বিবরণ আছে ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ তানাখ-এ। অনুমেয় যে প্রথম খৃষ্টপূর্ব সহস্রাব্দে এই সংঘাতগুলি হয়। তবে এই ফিলিস্তিন জাতির সঙ্গে আধুনিক ফিলিস্তিন জাতির কোনো সম্পর্ক নেই। ঐ ফিলিস্তিন জাতি কারা ছিল তাও স্পষ্ট জানা নেই- তবে অনুমেয় যে তারা গ্ৰিক ছিল- অন্ততঃ তাদের উৎস ছিল গ্ৰিসে। তাহলে বর্তমান ফিলিস্তিন জাতির নাম ঐ জাতির নামে কী করে হল? তার জন্য বুঝতে হবে দ্বিতীয় সংঘাতের কাহিনী।
দ্বিতীয় সংঘাত হয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে। তবে এই সংঘাত দুই জাতির মধ্যে নয়। এখানে ইহুদীদের বিরোধ একটা নামের সাথে।
রোম সম্রাট হেদ্রিয়ান ইহুদীদের হেনস্থা করতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেন-
এক, পুরুষের খতনা দেয়া নিষিদ্ধকরণ। খতনা ছিল ইহুদীদের ধর্মীয় আচার, প্রায় ট্রাইবাল আইডেন্টিটির মতো- এতে তারা চটে যাবে স্বাভাবিক।
দুই, জেরুজালেমে তিনি রোমান সনাতনী দেবদেবীদের মন্দির স্থাপন করেন - যার মধ্যে জুপিটার ও টাইকির মন্দির উল্লেখযোগ্য। একেশ্বরবাদী ইহুদীদেরকে রাগানোর এটা একটা পদ্ধতি ছিল। ইহুদীদের মন্দিরস্থলে তিনি জুপিটার এবং নিজের মূর্তি বসান।
তিন, উপরের ঘটনাগুলোর ফলশ্রুতি হিসেবে ইহুদীরা রোমসম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে যা বার কোখবা বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এর ফলশ্রুতি হিসেবে হেদ্রিয়ান জেরুজালেমে ইহুদীদের প্রবেশ নিষেধ করেন, যা কয়েক শতাব্দী ধরে নিষিদ্ধ থাকে।
চার, সবচেয়ে মোক্ষম পদক্ষেপ। ঐ বিদ্রোহ দমন করার পর হেদ্রিয়ান উদ্যোগী হন ইজরায়েল বা ইহুদী নামের সব স্মৃতি মুছে দেয়ার। সেইজন্য তিনি ঐ অঞ্চলের নূতন নাম দেন "সিরিয়া প্যালেস্তিনা"- ইজরায়েলের পুরোনো শত্রু ফিলিস্তিনের নাম অনুসারে। তার আগে ঐ অঞ্চলের নাম ছিল ইউদাইয়া (বা উচ্চারণভেদে জুডিয়া বা য়হুদ) - ইহুদী জাতির নামানুসারে।
এই ফিলিস্তিন কারা ছিল সেযুগের ইহুদী বা রোমানরা কেউই স্পষ্ট জানত না- কারণ সেটা আরো হাজার বছর পুরোনো গল্প! কিন্তু এই নামকরণ ইহুদীদের আবেগকে চাগাড় দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল- যেটা হেদ্রিয়ান চেয়েছিলেন।
তৃতীয় সংঘাত, উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে। তার আগে মাঝখানের দেড় হাজার বছরের ইতিহাস জানা জরুরি।
সেই যে ফিলিস্তিন বা প্যালেস্তাইন নামকরণ হয়েছিল ১৩৪ সাল নাগাদ, সেই নাম সরকারিভাবে ব্যবহার হয়েছে রোমের পতনের এক হাজার বছর পরেও। রোমানরা যে বিভিন্ন প্রদেশের রাজনৈতিক সীমানা তৈরি করেছিল সেই সীমানাগুলো রোমের পতনের পরও ব্যবহার হয়েছে- কিছু অদলবদল করে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে, তারপর খিলাফত সাম্রাজ্যে আর মামলুক সাম্রাজ্যেও।
বাইজান্টাইনরা এই অঞ্চলকে তিন ভাগে ভাগ করে প্যালেস্তাইন এক, দুই, তিন নাম দিয়ে শাসন করত। ৬৩৮ সালের পর থেকে খিলাফতের আমলে এই অঞ্চলকে প্যালেস্তাইন (ফলস্তিন) আর জর্ডান (উর্দুন) দুই নামে ভাগ করে শাসন করা হত। একাদশ শতাব্দীর পরে মামলুকরাও এই নামই ব্যবহার করেছে।
ষোড়শ শতকে ওটোমান তুর্কী শাসন শুরু হয়। ওটোমানরা সরকারি ভাবে ফলস্তিন নাম ব্যবহার করেনি। এই অঞ্চল ওটোমান যুগে প্রথমে বিলায়েত সিরিয়া আর পরে বিলায়েত বেইরুটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে বেসরকারিভাবে প্যালেস্তাইন বা ফিলিস্তিন নাম প্রচলিত থাকে। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর বিভিন্ন সাহিত্যে ফলস্তিন নামের প্রয়োগ দেখা যায়। ১৮৯৮ সালের পর নূতন করে ফিলিস্তিন নামের বহুল প্রয়োগ শুরু হয়- জাতীয়তাবাদী ভাবনা থেকে।
এতো গেল ভৌগোলিক অঞ্চলের নামের কথা, এবার মানুষের নাম বা আত্মপরিচয়ের দিকে তাকানো যাক।
হেদ্রিয়ানের করা ঐ নামকরণের ফলে ওখানকার স্থানীয় সেমেটিক জনগোষ্ঠীদের নামও ভবিষ্যৎ কালে ফিলিস্তিন হয়ে যাবে- যদিও তাদের সঙ্গে তিন হাজার বছর আগের ফিলিস্তিনদের কোনো সম্পর্ক নেই। হেদ্রিয়ানের সময়কার ফিলিস্তিনবাসীরা নিজেদের পরিচয় দিত আরামাইক, ইহুদী, সামারিটান, নাবাতিয়ান, সিরিয়ান ইত্যাদি নামে- এদের নিজেদের নিজেদের পারম্পরিক ধর্মবিশ্বাস ছিল- এর পাশাপাশি খৃষ্টান ধর্মের বহুল প্রসার হচ্ছিল। ছিল অন্যান্য আব্রাহামী ধর্ম - সামারিটানিজম, ম্যানডেইজম- এগুলো এখনও টিকে আছে খুব অল্প সংখ্যায়।
রোম সম্রাট কনস্টান্টাইন ৩১৩ অব্দে খৃষ্টান ধর্মের প্রতি সহনশীলতা ঘোষণা করার পর এবং তাঁর মা হেলেনা জেরুসালেমে পবিত্র ক্রস আর যিশুর কবর খুঁজে পাবার পর জেরুসালেমে চার্চ অফ হোলি সেপালকার প্রতিষ্ঠিত হয়- জুপিটারের মন্দির ধ্বংস করে। এর ফলে প্যালেস্তাইন অঞ্চলে খৃষ্টান ধর্মের প্রসার আরো বৃদ্ধি পায়। তবে এই সময়ে ইহুদীদের প্রতি রোমের সহনশীলতাও বৃদ্ধি পায়, আর কনস্টান্টাইন জেরুসালেমে ইহুদীদের প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আংশিকভাবে তুলে নেন, তবে সরকারি পেশায় ইহুদীদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি থাকে। তাছাড়া জেরুসালেমের সমাধিক্ষেত্রগুলো থেকে অনুমান করা যায় চতুর্থ শতকের শেষভাগে জেরুসালেমের জনসংখ্যার একশ শতাংশ খৃষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিল, অর্থাৎ যে ইহুদীরা খৃষ্টান হয়নি তারা শহরে ঢুকতে পারত কিন্তু বসত গড়তে বা কবর দিতে পারত না। পরে খিলাফত ও মামলুক যুগে জেরুসালেমে ইহুদীদের প্রবেশাধিকার ছিল, কিছু পরিমাণ বসতও ছিল।
সপ্তম শতকে ইসলামের আবির্ভাবের পর ও খিলাফত সাম্রাজ্যের প্রভাবে, আগামী তিন শতাব্দীতে ঝেঁটিয়ে সব ফিলিস্তিনবাসীর নাম হয়ে যায় আরব। আরামাইক, নাবাতিয়ান, সিরিয়ান প্রত্যেকেই নিজেদের সত্তা বিসর্জন দিয়ে ধীরে ধীরে আরব পরিচয় গ্ৰহণ করে। আরামাইক এবং সিরিয়াকের মতো ঐতিহ্যবাহী ভাষাগুলো বিলুপ্ত হয়। তবে ইহুদীরা নিজেদের চিরকাল ইহুদী বলেই পরিচয় দিয়ে এসেছে- ফিলিস্তিন বা আরব নামে পরিচিত হয়নি। সামারিটানরাও নিজেদের পরিচয় ও ধর্ম বজায় রাখে- খুব ছোট সংখ্যায় হলেও। অন্যদিকে ওখানকার মুসলিম এবং খৃষ্টানরা গত এক হাজার বছর ধরে নিজেদের আরব নামে পরিচয় দিয়ে এসেছে এবং তারা এই মুহুর্তে নিজেদের ফিলিস্তিন আরব বলে। খৃষ্টানদের একটা বড় অংশ এবং ইহুদীদেরও একটা অংশ ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়। আরামাইক ভাষার ছোট ছোট কিছু শাখা এখনও টিকে আছে - মূলতঃ সিরিয়ান অর্থোডক্স আর মালকাইট গ্ৰিক চার্চের মাধ্যমে। এই ভাষাগুলোর খুব সামান্য মুসলিম বক্তাও এখনও আছে।
এছাড়া, বাইজান্টাইন ও খিলাফতের আমলে ইয়েমেন ও আরব উপদ্বীপ থেকে অনেক জনগোষ্ঠী ওখানে আসে, তারাও পরে আরব নামে পরিচিত হয়ে যায়।
মামলুক ও ব্রিটিশ যুগের মাঝে ওটোমান যুগে দীর্ঘকাল ফিলিস্তিন নামটা ব্যবহার হয়নি এবং এই সময়ে এখানকার আরব খৃষ্টান ও মুসলিমরা নিজেদের হয় আরব হিসেবে চিহ্নিত করেছে, নয়তো খৃষ্টান বা মুসলিম হিসেবে, নয়তো নিজেদের ট্রাইব বা ধর্মীয় শাখার নামে আত্মপরিচয় দিয়েছে। ১৮৯৮ সালের পর থেকে এবং বিশেষ করে ১৯১১ সালে "ফলস্তিন" সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠার পর ফিলিস্তিন আত্মপরিচয় জোরদার হতে থাকে। প্রথমদিকে খৃষ্টানদের মধ্যে ফিলিস্তিন আত্মপরিচয় আর মুসলিমদের মধ্যে আরব আত্মপরিচয় বেশি বলিষ্ঠ ছিল।
ফিলিস্তিন বা প্যালেস্তাইন কারা বোঝা গেল। এবার দেখা যাক ইজরায়েল কারা। ইজরায়েল বলতে আব্রাহামিক নবী ইয়াকুব বা জেকবকে বোঝায়, এবং তাঁর উত্তরসূরিদের। ইজরায়েল বলতে মোট বারোটা ট্রাইবকে বোঝাতো- যার মধ্যে একমাত্র য়হুদ (বাংলায় ইহুদী, ইংরাজিতে জুডিয়ান) ট্রাইব টিকে আছে। বেঞ্জামিন ট্রাইব ইহুদীদের মধ্যে মিশে গেছে, বাকি দশটি জনগোষ্ঠী হারিয়ে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন নিজেদেরকে এই হারিয়ে যাওয়া দশখানা ট্রাইবের একটা বলে দাবি করে- তবে এগুলোর কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই আর ইজরায়েল সরকার থেকেও মান্যতা দেয়া হয়নি। যেহেতু অন্য দশটি জনগোষ্ঠীর বর্তমানে অস্তিত্ব নেই, তাই ইজরায়েল আর ইহুদী প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে।
ওটোমান সাম্রাজ্যের শেষ যুগে ও তার পতনের পর বিংশ শতকে যে ইজরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যা শুরু হয়েছে সেটা এই আলোচনার বিষয় নয়। আর প্রথম দুটো সংঘাতের সঙ্গে বর্তমান সংঘাতের কোনো সম্পর্ক নেই। তানাখ অনুযায়ী ইহুদীদের সবচেয়ে বড় শত্রুদের একটি হল ফিলিস্তিন। ঐ ফিলিস্তিনের থেকে এই ফিলিস্তিন সম্পূর্ণ আলাদা, তবে কিংবদন্তী আর নামের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয়।