একটা সংস্থার কথা জানি, যেখানে সর্বোচ্চ পদাসীন ব্যক্তির একটি দুর্নীতি, যা সিসিটিভিতে ধরা পড়েছে সেই কারণে তাঁকে যখন বহিষ্কার করা হচ্ছে বা অন্যভাবে বলতে গেলে তাঁকে যখন পদত্যাগ করতে বলা হচ্ছে, তখন কার্যকরী সমিতির বেশ কিছু সদস্য সিসিটিভি ফুটেজ কে জনসমক্ষে এনেছে এবং তার উদ্দেশ্য কী সেই নিয়ে মাথা ঘামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের মাথায় সংস্থার সম্মানের থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব পেতে শুরু করে কে ভিতরের দুর্নীতি বাইরে এনেছে!
বস্তুত আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও বারবার এটা দেখতে পাই। কৃষকরা যখন ন্যায্য দুরভিসন্ধিমূলক কৃষিবিলের প্রতিবাদে ধর্ণায় বসে মাসের পর মাস তখন আমাদের দেশের সেলিব্রিটিদের মাথাব্যথা থাকে না। কিন্তু যেই রিহানা বা গ্রেটা থর্নবার্গ এই বিষয়টি নিয়ে ট্যুইট করেন তখনই তাঁরা ‘রে রে’ করে ওঠেন। সে সচিন তেন্ডুলকরই হোক, অমিতাভ বচ্চন বা স্বর্গীয় লতা মঙ্গেশকর। দেশের সম্মান তখন বড় হয়ে দেখা দেয়। ঘোমটার তলায় খেমটা চললে ক্ষতি নেই, কিন্তু সামনে আসবে না।
ঠিকই একই ব্যাপার পরিলক্ষিত হচ্ছে বর্তমানে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কুস্তিগিরদের ধর্ণা উপলক্ষ্যে আইএর চেয়ারপার্সনের মন্তব্যে। বর্তমানে ইন্ডিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন বা আইওএর সর্বময় কর্তা হচ্ছেন পি টি ঊষা। ঊষা, সেই আমাদের ছেলেবেলার হিরো, পায়োলি এক্সপ্রেস পিলভুলাকান্দি থেকেপরমপিল ঊষা। ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের অন্যতম বৃহত্তম তারকা। অথবা ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদ। আমরা অনেকেই নাচানাচি করি, যখন কোনও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব নিয়মক সংস্থার মাথায় বসেন। সে সেবাস্তিয়ান কোই হন বা সৌরভ গাঙ্গুলি, প্লাতিনিই হন বা নওয়াল এল মৌতাওয়াকেল। মনে করি যে এদ্দিন ধরে যে সমস্ত দুর্নীতি খেলাটিকে পিছনে বেঁধে রেখেছে তিনি পয়গম্বরের মতো এসে সমস্ত অন্ধকার দূর করবেন এবং ‘সিস্টেম’কে পরিষ্কার করবেন!
কিন্তু কোনোভাবে যেন কখনও না কখনও আমাদের প্রিয়তম ক্রীড়া ব্যক্তিত্বকে সিস্টেমের দাসে পরিণত হতে দেখি। ঊষার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে না।
কিন্তু ঊষা কী মন্তব্য করেছেন? ধর্ণায় বসা কুস্তিগিরদের উনি বলেছেন যে কুস্তিগিররা সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করলেই পারতেন, পথে নেমে ধর্ণায় নাকি দেশের ছবি খারাপ হচ্ছে। এ নাকি নিয়মানুবর্তিতার পরিপন্থী।
কুস্তিগিররা ধর্ণায় বসেছেনই বা কেন? আসুন সে নিয়ে মন্তব্য করার আগে দেখে নিই ঘটনাটা কী!
তারও আগে জেনে নিই ব্রিজভূষণ সরণ সিং-এর বিষয়ে। ব্রিজভূষণ কে? ব্রিজভূষণ উত্তর প্রদেশের গোন্ডা জেলার কাইজারগঞ্জ থেকে শাসকদলের সাংসদ। কুস্তি নিয়ে বরাবরের একটা আগ্রহ ছিল, তাই বিভিন্ন আখড়ায় স্থানীয় কুস্তির প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে করতে সর্বভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি হয়ে গেছেন সে প্রায় এক দশক হল। তবে তাঁর বায়োডেটার দুটি উল্লেখযোগ্য অঙ্গ হল, ১৯৯২তে দায়ুদ ইব্রাহিমকে সাহায্য করার অভিযোগে টাডায় গ্রেফতার হন, ছাড়া পান ১৯৯৯তে। আর অবশ্যই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অভিযোগে সিবিআই দ্বারা অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত। যদিও ২০২০তে সুপ্রিম কোর্ট থেকে ক্লিন চিট পেয়ে গেছেন। তবুও অভিযোগগুলো ছিল।
সে যা হোক, গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিনেশ ফোগট, সাক্ষী মালিক, অংশু মালিক, বজরং পুনিয়া সহ ৩০জন কুস্তিগীর দিল্লির যন্তর মন্তরে ধর্ণায় বসেন। অভিযোগ, ২০১২ থেকেই মহিলা কুস্তিগীরদের উপর যৌন শোষণের। অভিযোগ, কুস্তিগীরদের শাসানোর, মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য করার।
বেশ কিছুদিন ধর্ণা চলার পর কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রক হস্তক্ষেপ করে এবং ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর কথা দেন যে সঠিক তদন্ত হবে। সেই মতো কুস্তিগীররা তাঁদের ধর্ণা তুলে নেন এবং অলিম্পিয়ান মেরি কমের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। ব্রিজভূষণ সিঙ্গকে কুস্তি ফেডারেশনের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখা হয়। তদন্ত হয়, রিপোর্ট জমা পড়ে ৫ই এপ্রিল, ২০২৩। কিন্তু তারপর কুড়ি দিন কেটে গেলেও কেন্দ্রীয় সরকার কোনও ‘অ্যাকশন’ নেয়নি। ব্রিজভূষণ সিং বহাল তবিয়তে সভাপতির দায়িত্ব ফিরে আসেন এবং কাজ করতে শুরু করেন। এর মধ্যে ২১শে এপ্রিল, ২০২৩ সাতজন মহিলা কুস্তিগীর ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট দায়ের করতে গেলে দিল্লি পুলিশ প্রাথমিক তদন্ত না করে এফআইআর নিতে অস্বীকার করে।
কুস্তিগীররা চারদিক থেকে চাপে কোণঠাসা হতে শুরু করে, উপায়ান্তর না দেখে বিনেশ, সাক্ষী, বজরংরা আবার জনপথে ফিরে আসেন ধর্ণায়।
এইবারেই শুরু হয় মজা। বিনেশ অভিযোগ করেন যে তাঁর জাঠতুতো বোন ববিতা কুমারীর পরামর্শে তাঁরা ধর্ণায় বসেন, ববিতা বললেন যে কোনও রাজনৈতিক নেতা, বিশেষতঃ বিরোধীরা যেন ধর্ণা মঞ্চে না আসেন। তাহলে এই ধর্ণায় রাজনীতির রঙ লেগে যাবে। এই বলে নিজের গুরুত্ব বাড়িয়ে নেন। কিন্তু যখন কুস্তিগীরদের জন্য ন্যায় বিচার আসে না, তখন ববিতা কোনও হেলদোল দেখাননি। তাঁর শাসক দলে নিজের গুরুত্ব বাড়ানোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে ব্যাস।
পিটি ঊষার কথা শুরুতেই বললাম। তিনি তো নিয়ম কানুনের কথা শুনিয়ে দিয়েছেন প্রতিবাদী কুস্তিগীরদের। কুস্তিগীরদের নাকি আইওএ-র অভিযোগ প্রতিকার কমিটির কাছে যাওয়া উচিত ছিল, তা না গিয়ে পথে নেমে আন্দোলনকারীরা দেশের ছবি তো খারাপ করছেনই, সঙ্গে অনুশাসনহীনতার কাজ করছেন। দেশের ক্রীড়া নিয়ামক সংস্থার প্রধান দিনের পর দিন খেলোয়াড়দের শোষণ করে চলবেন, তাতে দেশের সম্মানহানী হচ্ছে না, কিন্তু প্রতিবাদে যদি খেলোয়াড়রা পথে নামেন তাহলেই হচ্ছে!
কেন বলুন তো? কর্তাভজা সংস্কৃতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে নিজের অতীত ভুলে দ্রুত উপরে ওঠা যায়, সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে। কিন্তু মানুষ হিসাবে কি নিচে নেমে যাওয়া হয় না? নাকি স্বল্পকালীন সাফল্যে চোখ এমন ধাঁধিয়ে গেছে যে বিবেকের ডাক শুনতেই পান না!
আশার কথা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে দিল্লি পুলিশ এফআইআর নিতে সম্মত হয়েছে এবং এবারে সত্যিকারের তদন্ত শুরু হবে হয়তো। হয়তো বললাম কারণ শিব ঠাকুরের আপন দেশে শেষ পর্যন্ত যে কোন গনেশ উলটে যায় সেটা বোঝাও যায় না।
কুস্তিগীর বা যেকোনও ক্রীড়া ব্যক্তিত্বরা আমাদের গর্ব। বিশ্বমঞ্চে দেশের নাম উজ্জ্বল করেন। কিন্তু তাঁদেরই যখন অন্ধকার পথে হেঁটে হেঁটে কাদা ঘাঁটতে হয় তখন ক্রীড়া দেবতা অপ্রসন্ন যে হন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গোদের উপর বিষফোঁড়া প্রাক্তন বা বর্তমান খেলোয়াড়দের শিরদাঁড়ার অভাব। যতক্ষণ না পর্যন্ত নিজের গায়ে আঁচ আসছে, ততক্ষণ পিপুফিসুর দল চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভাণ করতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে। আর নিজের গায়ে আঁচ এলে?
তবে বলতেই হয়, ক্রীড়াবিদদের মধ্যে সবার আগে জ্যাভেলিন থ্রোয়ার নীরজ চোপড়া কুস্তিগীরদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এরপর আস্তে আস্তে কপিল দেব, বীরেন্দ্র শেহওয়াগ প্রমুখ। আর বাকিরা?
তাদের জন্য শেষ করি মার্টিন নিম্যোলারের কবিতা ‘ফার্স্ট দে কেম’ দিয়ে:
“যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিল, আমি কোনো কথা বলিনি,
কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।
তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল, আমি নীরব ছিলাম,
কারণ আমি শ্রমিক নই।
তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে,আমি তখনও চুপ করে ছিলাম,
কারণ আমি ইহুদি নই।
আবারও আসল ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে,আমি টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করিনি,
কারণ আমি ক্যাথলিক নই।
শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কেউ কোন কথা বলল না, কারণ, কথা বলার মত তখন আর কেউ বেঁচে ছিল না।”