SIR বলে যে জিনিসটি বর্তমানে চলছে সেটি কেবলমাত্র প্রহসনই নয়, একটা রাষ্ট্র তথা রাজ্যের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন যে কতটা অস্বচ্ছ, নোংরা এবং শয়তান হতে পারে তার দৃষ্টান্তও বটে। এবং এই জিনিসটা বুথ লেভেল অফিসাররা যতটা ভালো বুঝছেন ততটা সম্ভবত আর কেউই বুঝছেন না। অবশ্য এখানকার জনসাধারণের মেজরিটিই পাঁঠা, আপন আপন রুচি অনুযায়ী চটি চাটা থেকে নাগরা (অবাঙ্গালীদের চটিজুতো) চাটা, এবং অবশ্যই apathetic এবং হিংসুটে — সুতরাং তারা যে বুঝবে না সেটা খুবই স্বাভাবিক। যাইহোক, কেউ বুঝুক বা না বুঝুক, আসলে যে কি চলছে তার একটা ছবি একজন বিএলও হিসেবে সময়ের অভাব সত্ত্বেও অল্প দু'এক কথায় পেশ করার প্রয়োজন বোধ করছি।।
প্রথমত, খুব সচেতনভাবে এডমিনিস্ট্রেশনের পক্ষ থেকে সব ব্যাপারে একটা অদ্ভুত অস্বচ্ছতা বজায় রেখে চলা হচ্ছে একেবারে শুরুর দিন থেকেই। কেবলমাত্র BLOদের ডিউটির চিঠিটা ছাড়া প্রায় কোন অর্ডারই যথাযথ চ্যানেলে পাঠানো হয়নি। এতটা অসংগঠিতভাবে গোটা কাজটা করা হচ্ছে যে দেখে মনে হবে যে একটা মানুষের ভোটাধিকার থাকবে কি থাকবে না নিশ্চিত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যাপার নয়, বুঝি পাড়ার ক্লাবের সরস্বতী পুজোর মহড়া চলেছে! ট্রেনিং, টার্গেট, ডেডলাইন - সমস্ত কিছুই BLOদের বিলানো হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে। এবং, অবশ্যই কোন অফিসিয়াল প্রমাণ না রেখে। এই ধরনের administrative deniabilityর প্রয়োজনীয়তা কি, তলায় তলায় কোন দু নম্বরী করবার চলছে কিনা - এই জাতীয় প্রশ্ন যে কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মনেই আসতে বাধ্য। কিন্তু, মজার কথা হলো, CEO West Bengal এবং ECIকে অজস্রবার জানিয়েও ফল হয়েছে লবডঙ্কা। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমি নিজেই এই নিয়ে অভিযোগ করে তাদেরকে দু-দুখানি মেইল পাঠিয়েছি। এবং, বলাই বাহুল্য যে, তার জবাব আসেনি।
অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের উদ্দেশ্য যাই হয়ে থাক না কেন,এই অস্বচ্ছতার মূল্য চোকাতে হয়েছে বুথ লেভেল অফিসারদের। BLOদের বেশিরভাগকেই (সম্ভবত ৯০% এর বেশি) নেওয়া হয়েছে প্রাইমারি, সেকেন্ডারী এবং হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলগুলি থেকে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষেত্রে অর্ডার সবসময় আসে DI এর পক্ষ থেকে। কিন্তু ঘটনাচক্রে ঠিক এই এসআইআর এর সময়ই যত রাজ্যের ব্যতিক্রম দেখা গিয়েছে। ফলে হামেশাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রধানরা BLOদের সঙ্গে সহযোগিতা করেননি। উল্টোদিকে, এই গন্ধমাদন পরিমাণ কাজের বোঝা BLOদের ঘাড়ে চাপানো সত্বেও যথাযথ অন ডিউটি লিভ দিতে অন্তত উত্তর চব্বিশ পরগনায় এমন টালবাহানা করা হয়েছে যে BLOরা দিনের পর দিন ধরে কার্যত ডবল ডিউটি করে যেতে বাধ্য হয়েছেন (পৃথিবীর কোন লেবার আইন এটিকে অনুমোদন করে জানবার আগ্রহ রইলো)। একটিমাত্র অর্ডার, যার দ্বারা অন্তত এরকম বোঝানো যায় যে এই সময়ে বুথ লেভেল অফিসাররা কাজের জায়গায় অনুপস্থিত থাকতে পারবেন, বের করতে উত্তর ২৪ পরগনার কর্তৃপক্ষ সময় নিয়েছেন টানা ন'দিন! Memo No. SDO/BDN/Elec/1001 প্রকাশ হয়েছে ১২ তারিখে, যেখানে এসআইআর শুরু হয়েছে চার তারিখ থেকে।
অজস্রবার বলা সত্ত্বেও BLOদের কাজের জায়গায় যথাযথ অন ডিউটি লিভের ব্যাপারে গড়িমসি করে নির্বাচন কমিশন-এর মাথায় থাকা কর্তাব্যক্তিরা যে administrative impasse এর জন্ম দিয়েছেন তারই বলি হাজার হাজার বিএলও। একদিকে তাদের সুপারভাইজার এবং AEROরা তাদের তাড়া দিয়েছেন, অন্যদিকে স্কুলের দায়িত্ব থেকেও তারা নিষ্কৃতি পাননি। চাপ সামলাতে না পেরে যারা সুইসাইড করেছেন যারা তাদের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু এদের বাইরেও প্রচুর আছেন যারা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, নার্ভাস ব্রেক ডাউন-এর শিকার হয়েছেন, কিংবা মানসিকভাবে যথেষ্ট ড্যামেজড হয়েছেন। আমি নিজেই যথেষ্ট আর্জেন্সি সত্ত্বেও আমার বাবার পেসমেকার বসাতে পারছি না এর কারণে।
এডমিনিস্ট্রেশনের পক্ষ থেকে নিজের দায়িত্ব স্বীকার না করে BLOদের উপর দায় চাপানোর উদাহরণ রয়েছে ঝুড়িঝুড়ি। এর মধ্যে অন্যতম হলো BLO app। এত বড় একটা কাজের জন্য তার উপরে যে প্রচুর চাপ পড়বে, এবং শুরু থেকেই বিশেষ ব্যবস্থা না নিলে সেটি যে আর্ধেক সময় কাজ করতে পারবে না - এটা বোঝার জন্য নিশ্চয়ই রকেট সাইন্টিস্ট হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু, যেখানে শুরুতেই উচিত ছিল টেলিকম কোম্পানিগুলির সঙ্গে কথা বলে নেওয়া, সেখানে তারা এই বিষয়ে বৈঠক করতেই বসলেন ডিজিটাইজেশন যখন প্রায় শেষের পথে তখন। এদিকে সুপারভাইজার এবং AEROদের পক্ষ থেকে ক্রমাগত বুথ লেভেল অফিসারদের তাড়া দেওয়া হয়ে চলেছে টার্গেট পূরণ করার জন্য!
এবার আসা যাক কেন্দ্রের কার্যকলাপের ব্যাপারে। সত্যি বলতে কি, SIR এর মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ যে এতটা দিশাহীনভাবে চলতে পারে সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না! তাদের কীর্তিগুলির বর্ণনাও একে একে দিচ্ছি।
প্রথমত, একেবারে শুরু থেকেই নির্বাচন কমিশন এমন ছুট লাগিয়েছে যে মনে হবে তার পেছনে পাগলা কুত্তায় তাড়া করেছে বুঝি! যেটা ছমাসের কাজ সেটাকে এরা করাতে চাইছে এক মাসে। এদিকে, এই যে ভোটারকে গরুখোঁজা করে খুঁজে বের করে সেলসম্যানের মতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফর্ম দিয়ে আসার আইডিয়াটা যে ঠিক কাদের মাথা থেকে বের হয়েছে আমার জানার আগ্রহ আছে — কারণ শুধুমাত্র এটার কারণেই প্রচুর মানুষ দিনের শেষে ইনিউমারেশন ফর্ম পাবেন না! এটা আশাকরি অতি বড় নির্বোধও বুঝবে যে, পাড়ায় কে কোথায় থাকেন সেটা জানাটা স্কুল শিক্ষকদের প্রফেশনাল কোয়ালিফিকেশনের মধ্যে পড়ে না। উল্টোদিকে, দ্রুত আরবানাইজ হওয়া অঞ্চলগুলিতে এমনকি রাজনৈতিক দলের এজেন্টরাও প্রত্যেককে ট্রেস করতে পারেননা। ফলে প্রচুর মানুষ জেনুইন ভোটার হওয়া সত্বেও দিনের শেষে ফর্ম পাননি (এবং সময়সীমা সাত দিন বাড়ালেও পাবেন না)। বদলে, নির্বাচনের সময় যেমন হয় তেমনভাবে যদি কোন একটি নির্দিষ্ট জায়গা থেকে প্রতিটি মানুষকে নিজের সচিত্র পরিচয়পত্র দেখিয়ে ইনিউমারেরেশন ফর্ম সংগ্রহ করতে বলা হতো, তাহলে হয়তো ব্যাপারটা দুপক্ষের কাছেই অনেক বেশি সহজসাধ্য হতো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফর্ম বিলি করার এই বিচিত্র আইডিয়ার কল্যাণে BLO এবং তাদের এজেন্টরা যেমন হয়রানির একশেষ হয়েছেন, তেমনি সাধারণ মানুষদের মধ্যেও একটা বড় অংশ এখনো কেন ফর্ম পাচ্ছেন না ভেবে দিনের পর দিন আতঙ্কে থেকেছেন।
উল্টোদিকে, কাজ করতে গিয়ে প্রচুর BLO পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন যে রাজ্যের অজস্র বুথের অবস্থা কার্যত শোচনীয়! একই বাড়ির চারজন সদস্য চারটে পার্টের ভোটার — এমন কেস গাদা গাদা দেখলাম। ফলে, একটা ৮০০+ সদস্যের পার্টের সকলের বাড়ি ইনিউমারেশন ফর্ম পৌঁছানোর জন্য যেখানে তাত্ত্বিকভাবে আন্দাজ দেড়শ থেকে দু'শো বাড়ি ভিজিট করার প্রয়োজন, সেখানে সংখ্যাটা কার্যত গিয়ে পৌঁছাচ্ছে সাড়ে তিনশ কি চারশো'য়। [প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমার এক কলিগের অবস্থা আরো চমৎকার! তার এগারো শ' ভোটার, এবং তাদের অর্ধেকই থাকেন দূর-দূরান্তে! নিতান্ত বাসে-ট্রামে ছাড়া সেসব জায়গায় পৌঁছানো আদৌ সম্ভব নয়। এদিকে, মাননীয় নির্বাচন কমিশনের বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এদের প্রত্যেকের বাড়ি BLO সশরীরে ভিজিট করে ফর্ম পৌঁছে দেবেন এস আই আর শুরু হবার দিন দশেকের মধ্যেই। ব্যাপারটা কি সুন্দর না?]
এদিকে শুধুমাত্র ডিস্ট্রিবিউশন নয়, কালেকশন এবং ডিজিটাইজেশনের বোঝাও সানন্দে চাপানো হয়েছে বিএলওদের ঘাড়ে। কালেকশন অব্দি না হয় তাও বোঝা গেল, কিন্তু তাই বলে ডিজিটাইজেশনও? আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে, কিছু কিছু লোকের ধমনীতে কোন প্রাণীর রক্ত বইছে এবং শরীরে কোন প্রাণীর চামড়া আছে সেটি জানলে পরে খুশি হব।
তবে সব থেকে বড় অপরাধটা হল বুথ লেভেল অফিসারদের সুরক্ষার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের হাত ঝেড়ে ফেলা। SIR এর ব্যাপারে যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অবস্থান যখন পারস্পরিক শত্রুতার, তখন তারা যে নিজেদের মতো গায়ের জোর খাটিয়ে BLOদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে সেটা একেবারে গুহাবাসী আদিম মানুষও বুঝবে আশা করি। নির্বাচন কমিশনের মাথায় থাকা লোকজনও যে বোঝেনা এমনটা হতে পারে না। কিন্তু, প্রবাদ তো আছেই যে, যে জেগে ঘুমায় তাকে জাগানো ভগবানের অসাধ্য!
এখানেই শেষ নয়। বুথ লেভেল অফিসারদের থেকে অনুমতি নেওয়া দুরস্থান, তাদেরকে বিন্দুমাত্র ইনফর্ম না করেই নির্বাচন কমিশন সর্বত্র তাদের ফোন নম্বর দিয়ে বেরিয়েছেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই ফোন নম্বরগুলি কিন্তু আমাদের অফিসিয়াল নম্বর। এবং অনেকের ক্ষেত্রেই এটি লিংক করা রয়েছে ব্যাংকের সাথেও। ফলে, অনেকেই আছেন যারা এই নম্বরটা খুব বেশি লোককে দিতে চান না। কারণ সে ক্ষেত্রে অনলাইন ফ্রডের সম্ভাবনা থেকে যায় প্রচুর। কিন্তু বর্তমানে ইলেকশন কমিশনের দৌলতে সেই নম্বর জনগণের প্রপার্টিতে পরিণত হয়েছে।
তবে যাইহোক, আমাদের এখানকার জনতাও বলিহারী। তাদের বেশিরভাগই অশিক্ষিত এবং হিংসুটে, তৎসঙ্গে শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্নও বটে। শিক্ষকদের এই দুর্গতি দেখে তাদের অনেকের মনেই বেশ পুলক জাগছে যে, বোঝা যাচ্ছে। শিক্ষকরা যে অত্যন্ত অসম্মানজনক হওয়া সত্ত্বেও সেলসম্যানের মতো তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফর্ম বিলি করে বেড়াচ্ছেন, তাতে অনেকের খুশির অন্ত নেই। এদের বোধহয় এই বোধটাও নেই যে, বিএলওরা যে তাদের বাড়ি যাচ্ছেন সেটা মোটেই তাদের পক্ষেও সম্মানজনক নয়। কারণ এই হাউস-ভিজিটের উদ্দেশ্যই হচ্ছে তারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী কিনা চেক করা। অর্থাৎ, মূলত তারা চোরছ্যাঁচ্ছর কিনা সেটা দেখা। এই কথাটা বললেই দেখেছি লোকজনের মুখ থেকে আত্মতৃপ্তির হাসি মিলিয়ে যায়।
যাইহোক, চারজনের কাজ একজনের ঘাড়ে চাপিয়ে তাড়া দিতে থাকলে খাতায় কলমে কাজটা উঠে যেতে পারে ঠিকই, কিন্তু সেটা যে নির্ভুল হবে এমনটা নিশ্চিত করা যায় না। সুতরাং, অন্তত খসড়া ভোটার তালিকায় প্রচুর গরমিল থাকবেই। প্রচুর মানুষকে (যাদের মধ্যে চলচ্ছক্তিহীন বৃদ্ধবৃদ্ধারাও পড়েন) নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে দৌড়াতে হবে হিয়ারিং এর জন্য। এদের মধ্যে অনেকেই আবার বৈধ ভোটার হওয়া সত্ত্বেও ঠিকঠাক কাগজপত্র নেই বলে হয়রানির একশেষ হবেন। এবং, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা দায়টা পুরোপুরি বিএলওদের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেদের হাত ঝেড়ে ফেলবেন। বলাই বাহুল্য যে, এখানকার ফালতু জনতা ওপরের তলার কর্তাদের নাগাল পাননা বলে তাদের যাবতীয় দুর্নীতি দেখেও না দেখার ভান করবে, এবং বুথ লেভেল অফিসারদের উপর মনের ঝাল ঝাড়বে। এই পরিস্থিতিতে BLOরাও স্বাভাবিকভাবেই ক্রুদ্ধ হয়ে থাকবেন — এবং তাদের একাংশ কাগজপত্রের ছোটখাটো ভুলত্রুটিকেও সহজে ক্ষমার চোখে দেখবেন না। কেবলমাত্র নির্বাচন কমিশনের মাথায় থাকা রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অপদার্থতার কারণেই একটা পরস্পরিক বৈরিতার পরিবেশ তৈরি হবে। এবং ফলটা ভুগবে BLO এবং সাধারণ মানুষ — উভয়েই।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।