
কোভিডের দৌলতে হাসপাতালের ‘বেড’ শব্দটা বেশ বিভ্রান্তিকর এখন।
এমনিতে ‘বেড’ মানে খাট, কিন্তু হাসপাতালের ক্ষেত্রে খাট + অনেক কিছু।
একটা বেডকে ঘিরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স, প্যারামেডিক্যাল কর্মী, নানা যন্ত্রপাতি সব মিলে হাসপাতালের ‘বেড’।
ইন্ডিয়ান পাবলিক হেলথ স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বেড বলতে যা বোঝাবে, জেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তা বোঝাবে না, মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল এবং সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে তো আরও অন্যরকম। যত ওপরের স্তর, ‘বেড’ ঘিরে উপকরণ ও মানবসম্পদ তত জটিল ও দুর্মূল্য।
মনে পড়ছে, সেবার জাপানিজ এনকেফালাইটিস ছড়াচ্ছিল রাজ্যের কয়েকটা জেলায়। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকে বেশ কয়েক দফা ধস্তাধস্তি করে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলির জেলা হাসপাতালে আইসিইউ তৈরির বরাদ্দ জোগাড় করে ফিরে এসে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা, কলকাতা মেডিকেল কলেজের ওই বিভাগের বিভাগীয় প্রধানকে জানাতে তিনি মুচকি হেসে বলেছিলেন, “আপনি যুদ্ধটা জেতেননি এখনও, সবে শুরু করেছেন।”
ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিট তৈরি করার সময়ে আন্দাজ পেয়েছিলাম এটা সরকারি সদিচ্ছা এবং অর্থ জোগাড় করে ফেললেই তক্ষুনি করে ফেলা যায় না। এমবিবিএস ডিগ্রি থাকলেই যে এটা সামলাতে পারবেন যে-কোনো ডাক্তার এমন নয় ব্যাপারটা। এখানে কাজ করতে হলে পাস করার পর অন্তত বছর দুয়েক ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকা চাই তাঁর, বয়স হতে হবে পঞ্চাশের নীচে, কারণ শারীরিক পরিশ্রমও প্রচুর একাজে, সবকটা ইন্দ্রিয় সজাগ রেখে কাজ করতে হয়। প্রয়োজনে রোগীকে অজ্ঞান করে, তাঁর ফুসফুসে টিউব ঢুকিয়ে, ভেন্টিলেট করার দক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে এই চিকিৎসকের। সামান্য এদিক-ওদিক হলেই প্রাণসংশয় হবে রোগীর। অতএব এ কাজ ডাক্তার মাত্রেই করতে পারবেন, এমন নয়।
ডা. দেবী শেট্টির হিসেবে, ২০০ বেড-বিশিষ্ট একটি কোভিড হাসপাতাল এক বছর ধরে তিন শিফটে চালাতে অন্তত ৫০-৭৫ জন এই ধরনের বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন প্রশিক্ষিত চিকিৎসক এবং ৫০০ নার্স, অন্যান্য উপকরণ আর প্যারামেডিক্সদের দরকার। এই হিসেব করা হয়েছে ৬ ঘণ্টার শিফট, সাপ্তাহিক ছুটি এবং অসুস্থতাজনিত ছুটির হিসেব ধরে। (৬ ঘণ্টার শিফট শুনে চোখ কপালে তুলবেন না দয়া করে, ভারতীয় গরমে আমাকে ৬ ঘণ্টা পিপিই পরে থাকতে হলে চাকরি ছেড়ে দিতাম।)
একটা আইসিইউ-তে কমপক্ষে ২০ শতাংশ চিকিৎসকের ক্রিটিকাল কেয়ার/অ্যানাসথেসিয়া/ ইমারজেন্সি কেয়ার বিশেষ প্রশিক্ষণ দরকার। বাকি ৮০ শতাংশ চিকিৎসকের কার্ডিয়াক মনিটর, বায়োকেমিক্যাল রিপোর্ট, হেমাটোলজিক্যাল রিপোর্টের ব্যাখ্যা করার দক্ষতা অবশ্যই প্রয়োজন। এগুলো অভিজ্ঞতা + প্রশিক্ষণসঞ্জাত বিদ্যা, টাটকা মেডিকেল গ্রাজুয়েটদের থাকার কথা নয়। এই হিসেব অনুযায়ী ১০০০ টা ২০০ বেড-বিশিষ্ট কোভিড হাসপাতাল চালাতে ৫০০০০ থেকে ৭৫০০০ প্রশিক্ষিত চিকিৎসক দরকার। কোথায় পাওয়া যাবে?
যাবে, যদি লাল ফিতে একটু আলগা করা যায় বাস্তবসম্মত ভাবে।
ডিএনবি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি ডা. মনোজ গুপ্ত জানাচ্ছেন ২৫০০০ মেডিকেল গ্র্যাজুয়েট বিভিন্ন এমসিআই অথবা ডিএনবি স্বীকৃত টিচিং হসপিটালে তিন বছরের পাঠক্রম শেষ করে ফাইনাল ডিগ্রির জন্য অপেক্ষমান। স্বীকৃতি দিলে এঁরা নামতে পারেন আইসিইউ-তে।
ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ক্রিটিকাল কেয়ার মেডিসিনের প্রেসিডেন্ট ডা. ধ্রুব চৌধুরীর মতে প্রায় তিন হাজার ডাক্তার বেসরকারি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ২ থেকে ৩ বছরের ইন্টার্নশিপ সমাপ্ত করে বসে আছেন। একই ভাবে এঁদেরও ব্যবহার করা সম্ভব।
সোসাইটি অফ ইমার্জেন্সি মেডিসিন ১২০০ তরুণ মেডিকেল স্পেশালিস্ট, যাঁরা তিন বছরের ওপর ইমার্জেন্সি তথা ক্রিটিকাল কেয়ারে ইন্টার্নশিপ করেছেন, তাঁদের ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল স্পেশালিস্ট-এর সার্টিফিকেট দিয়েছেন। এঁদেরও ব্যবহার করা যায় যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্বীকৃতি দেন।
অ্যাসোসিয়েশন অফ ক্লিনিকাল কার্ডিওলজির চেয়ারম্যান ডা. রাজেশ রাজন জানাচ্ছেন যে ১৭০০ তরুণ চিকিৎসক দু-বছরের বেশি ইন্টার্নশিপ করেছেন বড়ো কার্ডিয়াক হাসপাতালে। এঁরা অনেকেই কোভিড হাসপাতালে কাজ করবেন সাগ্রহে যদি সেই কাজ সরকারের স্বীকৃতি পান।
৯০ হাজার ডাক্তার, যাঁরা চিন এবং রাশিয়ার ডাক্তারি পাঠক্রম শেষ করে এসে ভারতের ‘এক্সিট একজামিনেশন’ ক্লিয়ার না করতে পারার দরুন নানা ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে ফিজিসিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে কাজ করছেন, এঁদের মধ্যে উজ্জ্বলতম ২০,০০০-কে এই দুঃসময়ের কোভিড ক্রিটিক্যাল কেয়ারের জন্য বেছে নেওয়া খুব কঠিন কাজ কি?
পাঠক্রম শেষ করে ফাইনাল পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করেছেন প্রায় দু-লক্ষ নার্সিং শিক্ষার্থী। হাতেকলমে কোভিড আইসিইউ-তে কাজ করার সুযোগ পেলে এঁরা অনেকেই সেই সুযোগ নেবেন, যদি চিকিৎসা-শিক্ষাব্যবস্থা তথা স্বাস্থ্যব্যবস্থা এঁদের সেই অভিজ্ঞতাকে আইসিইউ বিশেষজ্ঞ নার্স-এর স্বীকৃতি দেয়।
ভারতের চিকিৎসা-শিক্ষাব্যবস্থা ভারী বিচিত্র। এখানে হাতেকলমে শেখার চাইতে কাগুজে বিদ্যার দাম অনেক বেশি।
মনে পড়ছে যখন সদ্যনির্মিত স্পেশাল নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট (এসএনসিইউ) তৈরি হয়েছে জেলায় জেলায়, টাটকা পাস করে বেরোনো একঝাঁক তরুণ ডাক্তার নিযুক্ত হয়েছেন সেগুলো সামলাতে। তাঁদের বিশেষ প্রশিক্ষণ চলছে। প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন প্রবাদপ্রতিম সদ্যজাত-শিশু বিশেষজ্ঞ পিজির তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান ডা. অরুণ সিং ও তাঁর সহ-অধ্যাপকেরা। অনধিকারী হয়েও সময় পেলেই সেই ক্লাসে আমিও মাঝে মাঝে বসে পড়তাম অধ্যাপক সিং-এর পড়ানোর আকর্ষণে। একদিন দেখি পেছনের সারিতে এক তরুণ চিকিৎসক এই গোবদা একটা বই খুলে কোলে রেখে পড়ে যাচ্ছেন, ক্লাসে মন দিচ্ছেন না। একদম পেছনে বসে আমি যে সেটা লক্ষ করছি সেটা বুঝতে পেরে তিনি বই বন্ধ করে ক্লাসে মন দিলেন।
তখন কিছু না বলে, ক্লাস শেষ হবার পর তাঁকে একান্তে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপারটা কী? সত্যি কথাই বললেন তিনি, “স্যার এই ক্লাস, যতই ভালো হোক, মেডিকেলের স্নাতকোত্তর পাঠক্রমের ভরতির পরীক্ষায় উতরোতে গেলে আমাকে এমসিকিউ মুখস্থ করতেই হবে! ভারতীয় চিকিৎসা-শিক্ষাব্যবস্থা আমার এসএনসিইউ-র অভিজ্ঞতার কোনো দাম দেবে না!”
একই কথা বলছেন ডা. দেবী শেট্টিও। দশ বছর অ্যানাসথেসিয়া বিভাগে কাজ করা কিন্তু এমডি পাস না করা ডাক্তারকে ভারতীয় চিকিৎসাব্যবস্থা অ্যানাসথেটিস্টের স্বীকৃতি দেয় না। আমার সুযোগ হয়েছিল মেডিসিন নোবেল পুরস্কার যাঁরা দেন সুইডেনের সেই ক্যারোলিন্সকা ইন্সটিটিউটে স্বল্পকালীন পাঠক্রম নেবার। সেখানেই দেখেছিলাম দুই চিকিৎসা-শিক্ষাব্যবস্থার তফাত। ওখানকার পাঠক্রমের সিংহভাগ হাতেকলমে শিক্ষার।
বাণিজ্যিক স্বার্থ আর আমলাতান্ত্রিকতার বিচিত্র বেড়াজাল থেকে স্বাস্থ্য-শিক্ষাব্যবস্থাকে বার করে এনে, অভিজ্ঞদের যথোপযুক্ত স্বীকৃতি দিয়ে কাজে না লাগালে নানা অতিমারি/মহামারি আমাদের নাকের জলে চোখের জলে করতেই থাকবে। এমসিআই-এর নানা কেলেঙ্কারি আমরা দেখেছি। এর প্রতিকারও চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের আন্দোলনের মধ্যে থেকেই বেরিয়ে আসতে হবে।
হালকা সুরে, গোপাল ভাঁড়কে স্মরণ করে বলাই যায়, এই ‘খট্টাঙ্গ পুরাণ’ অন্যভাবেও লেখা সম্ভব।
Dipankar Dasgupta | 202.142.***.*** | ২৬ জুলাই ২০২০ ১৩:৩৫95546একটি গুরুতর বিষয় নিয়ে আদ্যন্ত সুখপাঠ্য রম্যরচনা!
স্বাতী রায় | 117.194.***.*** | ৩০ জুলাই ২০২০ ১১:২৯95681সমাধান কি আদৌ হবে? বা কেউ কি করতে চায়?
স্বাতী রায় | 117.194.***.*** | ৩০ জুলাই ২০২০ ১১:৩০95682সমাধান কি আদৌ হবে? বা কেউ কি করতে চায়?