দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে পড়শি দেশ বাংলাদেশে সম্প্রতি যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে গেল, তা শুধুমাত্র নিন্দনীয়ই নয়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে ছিন্নভিন্ন করার নিগুঢ় চক্রান্ত ও চরম অসহিষ্ণুতার কদর্য নিদর্শনও বটে। মানুষের নিজ নিজ ধর্ম স্বকীয় বিশ্বাসকে আধার করে তাঁর আত্মার অন্তঃস্থলে বিরাজ করে। কিন্তু নিজ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার ঔদ্ধত্যে ভিন্ন মতাবলম্বীদের হেয় করার উন্মত্ততায় বর্বরোচিত আক্রমণ নিজ শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণ তো করেই না, বরং তাতে নিজ দীনতাই প্রবলভাবে প্রকট হয়ে ওঠে। এ কথা হাজার হাজার বছর ধরে এই উপমহাদেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতি, সহাবস্থান আমাদের হাতে ধরে শিখিয়েছে। তবু এতদিনেও আমরা আর শিখলাম কই!
সমস্যাটা যতটা না ধর্মীয় বিশ্বাসকে নিয়ে, তার থেকে ঢের বেশি ধর্মীয় মৌলবাদের আস্ফালিত বহিঃপ্রকাশকে ঘিরে। কারণ মানুষ মানুষে প্রত্যক্ষ বিভাজন টানার জন্য সবচেয়ে ধারালো অস্ত্রটি হল সমাজের অলিগলিতে ধর্মীয় পরিচিতির সুকৌশল প্রয়োগ। তাতে মানুষের মধ্যে বিভাজনের সীমারেখা প্রকটভাবে দৃশ্যত হয়। আর সেই বিভাজিত সীমারেখার উন্মুক্ত রাজপথ ধরে প্রশস্ত হয়ে যায় মতলবি রাজনীতির প্রবেশদ্বার। সামাজিক আঙ্গনে কিলবিল করে ওঠে অসহিষ্ণুতার বিষাক্ত শ্বাপদেরা। সেটা যেমন বাংলাদেশে, পাকিস্তানে বা আফগানিস্তানে, তেমনি সাম্প্রতিক কালে আমাদের দেশেও। তাই যারা আফগানিস্তানের বামিয়ানে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি নিমেষে ধূলিসাৎ করে। অথবা পাকিস্তানে যারা গুরুদ্বার বা মন্দির তছনছ করে ফেলে। কিংবা আমাদের দেশে মহামান্য আদালতের আদেশকে হেলায় অবজ্ঞা করে যারা চিৎকৃত উল্লাসে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়, গুনগত ভাবে তাঁরাই নিশ্চয় বাংলাদেশে দুর্গা মণ্ডপে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে উন্মত্ত আক্রমণ করে।
সামাজিক মাধ্যমে লক্ষ্য করা গেল, আমাদের দেশের কতিপয় সুধী নাগরিক বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সেই বর্বরোচিত ঘটনার নিন্দা করার ফাঁকে ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো এবং ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা সম্পন্ন মানুষদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মায় আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ দেশে যদি প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় ভরে যেত, তাহলে এমন কদর্য ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ভুরি ভুরি উদাহরণে ইতিহাসের পাতা রক্তস্নানে থিকথিক করত না। কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতা কোন ধর্মেরই একচ্ছত্রবাদের আস্ফালনকে প্রশ্রয় দিতে শিক্ষা দেয় না। বরং, ধর্মীয় সহিষ্ণুতাকে হৃদয়কুম্ভে লালন করার চেতনায় উদ্ভূত করে। তাই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় দীক্ষিত মানুষেরা মন্দির, মসজিদ, গুরুদ্বার বা গির্জা ভেঙে চুরমার করেছে এমন উদাহরণ মেলা ভার। কিন্তু উন্মত্ত ধর্মীয় দীক্ষায় দীক্ষিত অসহিষ্ণু মানুষেরাই পৃথিবী জুড়ে বারংবার এ কাজ অবলীলায় করে আসছে।
ঘটনা যতই কদর্য হোক না কেন, প্রতিটি ঘটনা থেকেই অনেকগুলো বহির্মুখ নির্গত হয়। তেমনি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া এই ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঐ দেশের উদারমনস্ক, প্রগতিশীল, শান্তিপ্রিয়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ রাখার প্রতি দায়িত্বশীল নাগরিক সমাজের ভাবনায় একটি পুরাতন দিগন্ত আবার নতুন করে উস্কে দিয়েছে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষণা করেন এবং ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রণয়ন করেন। ইতিহাস সাক্ষী আছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে ১৯৭৮ সালে, জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনকালে বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি ছেঁটে ফেলা হয়। এরপর ১৯৮৮ সালে, জেনারেল হুসেন মহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনকালে বঙ্গবন্ধু প্রণীত ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে সংশোধন করে দেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করা হয়। সেই থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলামই হয়ে রয়েছে। সেই অর্থে হয়তো বাংলাদেশ ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ বা ‘ইসলামিক এমিরেটস’ নয়। অর্থাৎ, শরিয়া আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালিত হয় না। কিন্তু দেশের সংবিধান স্বীকৃত রাজধর্ম হিসেবে শুধুমাত্র ইসলামকেই মান্যতা দেওয়া হয়েছে। আর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে মূল সমস্যার বিষবৃক্ষটি প্রোথিত হয়ে রয়েছে এইখানেই। যে দেশের সংবিধান স্বীকৃত একটি নির্দিষ্ট রাজধর্ম রয়েছে, সেই দেশে অন্যান্য ধর্মালম্বী মানুষেরা, কিংবা কোন ধর্মেই বিশ্বাস নেই এমন মানুষেরা, তাঁদের মতপ্রকাশ, ধর্মচারণ ও মুক্ত চিন্তার প্রসঙ্গে সবসময়ই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য হয়ে থাকেন। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ কোন দেশে রাষ্ট্রের নিজস্ব কোন নির্দিষ্ট ধর্ম না থাকলেও, সকল ধর্মালম্বী মানুষেরা তাঁদের নিজ নিজ ধর্মপালন ক্ষেত্রে সমানাধিকার পেয়ে থাকেন। এমনকি যাঁদের কোন ধর্মেই বিশ্বাস নেই, এমন মানুষেরাও কোন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অনায়াসে তাঁদের স্বাধীন মতপ্রকাশ করতে পারেন।
সুতরাং, প্রাথমিকভাবে এই ঘটনা ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুর বিবাদের আবর্তে ঘুরপাক খেলেও, ঘটনা পরম্পরার প্রবাহ কিন্তু ইতিমধ্যেই অন্য খাতে বইতে শুরু করেছে। তাই বর্তমান ঘটনার পরম্পরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু, কিংবা হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দের সীমারেখাকে ছাপিয়ে রাষ্ট্রের ধার্মিক চরিত্রের মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তাকে ভীষণভাবে উস্কে দিয়েছে। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বর্বরোচিত হিংস্রতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের দায়িত্বশীল নাগরিক সমাজ বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় উদ্দীপ্ত হয়ে পুনরায় ‘রাজধর্মহীন’ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। শাহবাগ স্কোয়ারের সমবেত সুধী নাগরিকেরা এমন এক রাষ্ট্রের দাবীতে সোচ্চার হয়েছেন, যে রাষ্ট্র কোন নির্দিষ্ট ধর্মীয় আভরণে নিজেকে মুড়ে রাখবে না। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র হোক সবার। রাষ্ট্রের নিজস্ব কোন ধর্ম থাকবে না। সোনার বাংলায় রাষ্ট্র বিরাজ করবে তার ধর্মনিরপেক্ষ সত্ত্বা বহন করে।
আমরা, আপামর বাঙালীরা, পরদেশ হলেও বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। কারণ, আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, লোকাচার অভিন্ন এবং মাত্র কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশ আমাদেরই দেশের অন্তর্গত ছিল। আমাদের অনেকেরই পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি পড়ে রয়েছে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে। তাই বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ের উত্তাল তরঙ্গ আমাদের মননের ঐকান্তিক প্রান্তে এসে সজোরে ধাক্কা মারে। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের উদারমনস্ক, প্রগতিশীল, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখার প্রতি দায়িত্বশীল সুধী নাগরিক সমাজও নিশ্চই কায়মনোবাক্যে চাইবে, পড়শি দেশটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবেই বিশ্ব দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক। যে কারণে প্রগতি মনস্ক নাগরিক সমাজ ভারতবর্ষকে ‘হিন্দুরাষ্ট্রে’ পরিণত করার দুষ্ট রাজনৈতিক অভিসন্ধিকে চরম ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে আসছে, ঠিক একই কারণে তাঁরা পড়শি দেশ বাংলাদেশেও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রেরই প্রতিষ্ঠা চাইবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর বাংলাদেশ যদি একবার ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ফেলে, তবে গোটা দুনিয়ার ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং রাষ্ট্রশক্তির চালচলনে ধর্মীয় ভাবনার প্রভাবকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দেবে। দেবেই।
ভারতীয় সংবিধানের ৪২ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৬ সালে ভারতবর্ষের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি ভারতীয় সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে যে যুগান্তকারী দিশা দেখাতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে অপেক্ষা করছে হুবহু একই অগ্নিপরীক্ষার অনুকৃতি। সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক অশান্তির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী মাননীয় মাসুদ হাসান দেশের রাষ্ট্রধর্ম থেকে ইসলামকে বাদ দেওয়ার বিষয় নিয়ে ইতিমধ্যেই সোচ্চার হয়েছেন। সেই দেশের মাননীয়া শিক্ষামন্ত্রী দীপু মণির গলাতেও একই সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, হাসিনা সরকার বঙ্গবন্ধু প্রস্তাবিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র’ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে অদূর ভবিষ্যতে সংবিধান সংশোধনী বিল আনতে চলেছে। ভারতবর্ষের একপ্রান্তে আফগানিস্তানে যখন শরিয়া আইনে রাষ্ট্র চেতনা মুড়ে ফেলা হচ্ছে, তখন অন্যপ্রান্তে বাংলাদেশে ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আলোড়ন চলছে। এমনই এক সন্ধিক্ষণে, চক্রব্যূহে আটকে পড়তে চলেছে ভারত রাষ্ট্র পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দল, যাদের আস্তিনে লুক্কায়িত ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ গড়ার বীজমন্ত্র। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা থেকে যারা ভারতবর্ষে ভোটের লভ্যাংশ খুঁড়ে আনতে চাইছিল, বাংলাদেশ ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আগুয়ান হওয়ায় তাদের লাভের গুড় পিঁপড়ে খেয়ে নেবে বলেই মনে করা হচ্ছে। এমন আলোড়িত পরিস্থিতিতে, ভারতবর্ষের সামাজিক–রাজনৈতিক মস্তিষ্কে একটি অতি সরল প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে বাধ্য। বাংলাদেশ যদি কোন নির্দিষ্ট রাষ্ট্রধর্মের খোলস ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে অগ্রণী হতে সচেষ্ট হয়, তবে কেনই বা পেছনের দিকে হেঁটে ভারতের মতো মহামানবের দেশ ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিসর্জন দিয়ে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ গঠনের উস্কানিকে আমল দিতে যাবে? থাক না ধর্ম নিজ নিজ আত্মার অন্তঃপুরে পরম যত্নে। বন্ধ হোক ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের কুরুচিকর উগ্র আস্ফালন। সর্বত্র। নিজ দেশে কিংবা পরদেশে। বাকিটা বলে দেবে অমোঘ সময়।
মূল ছবি - KM L (Pexels)
Most of the 43 countries with state religions are in the Middle East and North Africa, with a cluster in northern Europe. Islam is the official religion in 27 countries in Asia and sub-Saharan Africa as well North Africa and the Middle East.
Thirteen countries – including nine in Europe – are officially Christian, two (Bhutan and Cambodia) have Buddhism as their state religion, and one (Israel) is officially a Jewish state.