তখন তুমি টিভি দেখছিলে। আফিস থেকে ফিরে বড়জোর দু ঘন্টার বিশ্রাম। তারপরেই কর্মস্থল থেকে ল্যাপটপে ভরে আনা কাজের বোঁচকা খুলে বসতে হবে। বসের দেওয়া একটা আর্জেন্ট কাজের যতটা আজ রাতে পারা যায় এগিয়ে রাখতে হবে। ফোরটিন্থ ফ্লোরে অবস্থিত তোমার সুসজ্জিত ফ্ল্যাটের প্রশস্ত ড্রয়িং-কাম-ডাইনিং-এর সব জানালা দরজা বন্ধ। দিন তিনেক হল বেশ ঠান্ডা পড়েছে I
একটু আগেই ঘরে ছিল তোমার স্ত্রী স্নিগ্ধা। একটা গেলাসে দ্য গ্লেন্লিভেট ১৮-এর অভিজাত দর্শন বোতল থেকে একটা লার্জ পেগ ঢেলে, তাতে তিনটে বরফ ঘনক ফেলে তোমার সামনে রেখে দিয়ে এখন কিচেনে গেছে স্ন্যাক্সের তদারক করতে। তুমি পানীয়ের গেলাসে চুমুক দিলে। চোখ রাখলে টিভির দিকে। পানীয়ের স্বাদ আর মাদকতা তোমার জিভ, মন আর মগজে ছড়িয়ে পড়ে ওদের তৃপ্ত করতে লাগল।
একটা দুর্দান্ত ছবি দেখাচ্ছে। তোমাদের কলেজ-জীবনের সময়কার নায়ক সিলভেস্টার স্ট্যালোন। এই ছবিটা তুমি সুদীপ আর উদয়ন মিলে নিউ এম্পায়ারে দেখেছিলে I তোমার প্রিয় নায়ক এখন বীর বিক্রমে, কঠোর হাতে দুষ্টের দমন করছেন।
পনির পকোড়ার থালাটা জাহানারা টেবিলে রেখে যাওয়ার পর স্নিগ্ধা নিজের জন্য় একটা পানীয় বানিয়ে নিয়ে তোমার গা ঘেঁষে বসল। গেলাসে চুমুক মেরে, তোমার হাত থেকে রিমোটটা নিয়ে চ্যানেল বদলাতে শুরু করল, নিজের পছন্দের চ্যানেলটা খুঁজে পাবার জন্য়। টেবিলে রাখা তোমার ফোনটা বেজে উঠল। ভুরু জোড়া ঈষৎ কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে ফোনটা উঠিয়ে নিলে। সুদীপের ফোন। ব্যাটা এখন বেশ বড় মাপের বিজনেসম্যান। উইকএন্ডে ক্লাবে দেখা হয়। তুমি ফোন তুললে।
– বল
– কী করছিস ?
– তেমন কিছু না ; একটু আগে ফিরলাম। এখন টিভি দেখছি।
– ভাইরাল ভিডিও রিলটা দেখেছিস ?
– কোন রিলটার কথা বলছিস ?
– আরে, জ্যান্ত জ্বালানোর ঘটনাটার লাইভ ভিডিও …
– হ্যাঁ ; সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখে পড়েছিল, কিন্তু বেশিক্ষণ সহ্য করতে পরি নি।
– এক্সাক্টলি ! ইউ নো ? ইট ওয়াজ সো হরিব্ল্ দ্যাট সুনেত্রা গট সিক !
– তাই নাকি ! ডাক্তার দেখিয়েছিস ? এখন কেমন আছে ?
– না, না, তেমন সিরিয়াস কিছু ঘটে নি। ইন ফ্যাক্ট, ও এখন এডভান্স স্টেজে তো – পুরো ভিডিওটা দেখে শক পেয়ে শরীরটা খারাপ লেগেছিল আর কি… কোয়াইট্ ন্যাচারাল… একটু পরে নিজেই সুস্থ হয়ে ওঠে। এনিওয়ে, শনিবারে ক্লাবে দেখা হচ্ছে তো ? তোর সঙ্গে একটু কথা আছে একটা ব্যাপারে। সে জন্যই ফোনটা করলাম। একটা ভালো প্রজেক্ট আছে। দুজনে মিলে কাজ করা যেতে পারে। ক্লাবে এলে ডিটেলে বলব। আসছিস তো ?
– ও ইয়েস। বাট সাড়ে আটটার পর।
– ও কে। স্নিগ্ধা ভালো আছে তো ?
– হ্যাঁ, ভালো আছে।
– আর মধুরা ?
– হ্যাঁ, ও-ও ভালো আছে।
– ও কে। হ্যাভ আ নাইস ইভনিং … সী ইউ অন্ স্যাটারডে … গুড নাইট ...
তুমি ফোন রাখলে। তোমার স্ত্রী এতক্ষণ এক চিত্রাভিনেত্রীর সাক্ষাৎকার দেখছিল যিনি দ্বিতীয়বার মা হতে কেমন লাগছে , সেই অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছিলেন। স্নিগ্ধা এক্ষণে তোমার দিকে ফিরে বলল – এই স্যাটারডে তে কোনো প্রোগ্রাম রেখো না কিন্তু। আলিম্পনার ম্যারেজ অ্য়ানিভার্সারি আছে হায়াৎ-এ। মৈনাকের সঙ্গে তো তোমার আলাপ হয় নি। খুব ভালো ছেলে। আলিম্পনাকে সুখে রেখেছে।
তোমার পানীয় শেষ হওয়ায় এবারে তুমি নিজেই আর একটা তৈরি করলে নিজের জন্য়। স্নিগ্ধা কে জিজ্ঞেস করলে – মধু কোথায় ?
স্টাডিতে – স্নিগ্ধার জবাব এল। এগরো বছর বয়সী, তোমাদের একমাত্র সন্তান মধুরা কে দেখতে হঠাৎই তোমার খুব ইচ্ছে করল। বাড়িতে ফেরবার পর ওকে একবারও দেখনি। গেলাসটা টেবিলে রেখে, ড্রয়িংরুম ছেড়ে স্টাডির দিকে যাবার জন্য় উঠেছ , আর অমনি তোমার ফোন বাজল। বিরক্ত মুখে ফোনটা হাতে তুলে নিলে। তোমার বসের ফোন। পানীয়ের প্রভাবে শিথিল হয়ে আসা শরীর আর মগজকে সতর্ক করে তুলে তুমি বললে – গুড ইভনিং , স্যার…
– গুড ইভনিং , শোভন। বিশেষ কারণে কল করতে হল। যে কাজটা বাড়িতে নিয়ে গেলেন সেটার স্কেজিউলে একটু চেঞ্জ হয়েছে। ওটা আপনি আজ রাতেই কমপ্লিট করে আমাকে পাঠিয়ে দিন। বায় ঠুওক্লক পাঠাতেই হবে।
– বাট স্যার… – তুমি কিছু বলতে চেষ্টা করলে।
– এটা আর্জেন্ট, শোভন। দুটোর মধ্যে কাজটা আমার কাছে পৌছানো চাই , ও কে ? সিইউ ঠোমোরোও …
ফোনটা টেবিলে রেখে তুমি মনে মনে একটা অকথ্য শব্দ উচ্চারণ করলে। তারপর আবার বসে পড়ে গেলাসে একটা বড় চুমুক মেরে পকোড়া চেবাতে চেবাতে ভাবলে, যত উচ্চপদ ততই দায়িত্বভার ; এটাই তো স্বাভাবিক। তোমার সুন্দরী স্ত্রী তোমার গায়ে গা লাগিয়ে বসে, তোমার ক্যারোটিড ধমনীর ওপরের চামড়ায় আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে আদুরে স্বরে বলল – আজ রাতেও বুক্ড্ হয়ে গেলে ? স্নিগ্ধার মাদকতা মাখানো স্বরের প্রশ্ন, আর ওর পেলব আঙ্গুল আর ত্বকের সান্নিধ্য় তোমার শরীরে এতটুকুও উষ্ণতা জাগাতে পারল না। ব্যাজার মুখে তুমি উত্তর দিলে – গ্লোবাল ভিলেজে ‘রাত’ বলে কোনো শব্দ নেই , বেবি। এ গ্রামে সূর্যাস্ত হয় না। স্নিগ্ধা টিভিতে মন দিল। তুমি মেয়েকে দেখবার জন্য় উঠলে।
স্টাডিতে ঢুকে দেখলে, মধুরা তার ড্রয়িং খাতার ওপরে ঝুঁকে পড়ে কী যেন এঁকে চলেছে। পাশে ছড়ানো কয়েকটা প্যাস্টেল স্টিক। তুমি পা টিপে টিপে কন্যার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালে। সে তখন মগ্ন হয়ে ছবিতে প্যাস্টেল ঘষে চলেছে। তুমি তোমার মেয়ের ঘাড়ের পাশ দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখবার চেষ্টা করলে, এত মন দিয়ে কী আঁকছে ও। মধুরা ঘাড় ঘুরিয়ে তোমাকে একবার দেখল তারপর আবার তার ছবিতে প্যাস্টেল ঘষতে লাগল। তুমি দেখলে, তোমার মেয়ে তার আঁকার খাতার একটা পাতা ভরিয়ে একটা ছবি আঁকছে। অনেকটা, প্রত্ন-মানবদের গুহায় আঁকা ছবির স্টাইলে এই ছবিটা আঁকছে মধুরা। পেন্সিলে আঁকা হয়ে গেছে। এখন চলছে রং ভরাবার কাজ। ছবিটা আরো মনোযোগ দিয়ে দেখলে তুমি, আর সেইসঙ্গে, দু দুটো লার্জ গ্লেন্লিভেট ১৮ অন দ্য রক্স্-এর নেশা কে ছাপিয়ে তোমার মনকে দ্রুত গ্রাস করতে লাগল এক অবাক ভয় আর বিস্ময়।
একটা মানুষকে খুঁটিতে বেঁধে, নীচে আগুন জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। আগুনের শিখা মানুষটার শরীরের নীচের দিকটা পোড়াতে শুরু করেছে। আকাশের দিকে মাথা তুলে মানুষটা চিৎকার করছে। তার শরীর আর বিশাল হাঁ করা মুখটার চারপাশ ঘিরে ধোঁয়ার উদ্দাম নাচ ক্রমশ ওপরে উঠে আকাশটাকে ঢেকে দিচ্ছে। একপাশে, কয়েকজন মানুষ আর একটা মানুষকে বেঁধে নিয়ে আসছে , প্রাগৈতিহাসিক যুগে শিকার করা পশুকে যেভাবে নিয়ে আসা হতো। কয়েকটা গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে চাদ্দিকে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য় দেখছে। একটা গাছ ফোনে সেই দৃশ্যের ভিডিও তুলছে। একটা রক্তলাল প্যাস্টেল স্টিক ঘষে ঘষে বন্দী, আহত লোকটার ক্ষতচিহ্নগুলোকে আরো বেশি — আরো বেশি লাল বানিয়ে চলল মধুরা। লোকটার আশেপাশের সবুজ জমিতেও ছিটকে থাকা কিছু রক্তচিহ্ন এঁকে দিল।
এটা তুই কেমন ছবি আঁকছিস মা ? তোমার নিজের কন্ঠস্বর নিজের কানেই কেমন বিকৃত শোনাল। কেনই বা আঁকছিস তুই এমন ভয়ঙ্কর ছবি ? ভয় পাওয়া কন্ঠস্বরে প্রশ্ন করলে তোমার মিষ্টি, শান্ত, নিরীহ স্বভাবের কন্যাকে। যদিও সেই মুহুর্তে ওকে আর ততটা নিরীহ বলে মনে হচ্ছিল না তোমার।
মধুরা তার নবতম সৃষ্টিতে রং লাগাতে লাগাতে উত্তর দিল – আমাদের হিস্ট্রি বইতে কেভ পেইন্টিং-এর ছবি আছে। সেখানে লিখেছে , ও গুলো এঁকেছিল ছাব্বিশ হাজার বছর আগেকার মানুষরা। ঐ সব ছবি থেকে তখনকার মানুষদের জীবনযাত্রা, সভ্যতা, সংস্কৃতি এসব বিষয়ে একটা ধারণা করা যায়।
এবারে তোমার চোখের দিকে সরাসরি নিজের নিস্পাপ চোখ দুটো রেখে, একটু হাসির শব্দ কথার সঙ্গে যোগ করে দিয়ে তোমার এগারো বছরের কন্যা তোমাকে বলল – আসলে, এই ছবিটা আমি তোমাদের জন্য আঁকছিনা। পাঁচ হাজার বছর পরের মানুষদের জন্য় আঁকছি। ওরা হয়তো একদিন এই ছবি দেখে আমাদের সময়কার মানুষদের সভ্যতা, সংস্কৃতি এসব বিষয়ে একটা ধারণা করতে পারবে ...
স্তম্ভিত, নিরুত্তর তুমি শুনতে পেলে ড্রয়িংরুম থেকে ভেসে আসা স্নিগ্ধার ডাক – শোভন, তোমার ফোন …
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।