সবচেয়ে আনন্দে আছে মাহিরা। যে যা কিছু দেখে তাতেই অবাক হয়, তাই তার ভালো লাগে। গাঁয়ে থাকতে খাবারের কষ্ট ছিল, এখন সেটা নেই তাতে তার ভালো লাগে। দৌড়াদৌড়ি, ছুটোছুটি করার উপায় নেই অথবা সমবয়সী কারো সাথে খেলার উপায় নেই দেখে কখনো মন খারাপ হলেও পরক্ষণে রাস্তায় গাড়ি দেখে, অথবা বাড়ির দরজায় কোনো ভিখিরিকে দেখে, অথবা কোনো ফেরিওয়ালার হাঁক শুনে তার মন ভালো হয়ে যায়। জানালার শিকে মুখ চেপে ধরে বাইরের পৃথিবীটাকে দেখতে, নাজির খাঁ’র মাথা চুলকে দিতে বা পা টিপে দিতেও তার ভালো লাগে। কাজের চাপে সায়েরার মন খারাপের সুযোগ হয় কম। তাছাড়া গাড়ি দেখা, ভিখিরি দেখা, ফেরিওয়ালা দেখা এসব সেও করে। কখনো দু’বোন মিলে মাটিতে ছক কেটে ষোলগুটি বা বাঘবন্দি খেলা খেলে। আলীর দাদীর কাছে লেখাপড়া শেখার কথা মনে হলে তার সবচেয়ে খারাপ লাগে। বুঝতে পারে তার আর কোনোদিন লেখাপড়া হবে না। যা কিছু শিখেছে সেটা যেন ভুলে না যায়, তার জন্য কোনো কোনো দিন ফজরের পরে কোরান পড়তে বসে, অথবা আরও দুয়েক ওয়াক্ত নামায পড়ে নেয়, মনে মনে আগে শেখা দোয়াগুলো পড়ে। এভাবে দ্বীনি এলেমের কিছুটা চর্চ্চা হয়, কিন্তু বাংলা পড়ার কোনো উপায় হয় না—এই বাড়িতে লেখাপড়ার কোনো চর্চা নেই। নিজে যেটুকু বাংলা জানে, সেটুকু যেন ভুলে না যায়—তাই মুখে মুখে আর কয়লা দিয়ে দেয়ালে লিখে মাহিরাকে শেখায়। একদিন কয়লা দিয়ে সিঁড়িঘরের দেয়ালে সে লেখে—
সায়েরা খাতুন
মাহিরা খাতুন
পিতা: শ্রী রুস্তম শেখ
মাতা: জাহেরা বিবি
সাকিন + ডাকঘর: মুন্সীডাঙ্গা
থানা: ডোমজুর
জিলা: হাওড়া
এইটুকু লিখে তার মনে হয় আব্বার নামের শুরুতে শ্রী না লিখে আসলে ‘মরহুম’ লেখা উচিত, আর আম্মার নামের শেষে ‘বিবি’ না লিখে বেওয়া লেখা উচিত, কিন্তু সেসব লিখতে সায়েরার মন সরে না। তার মন মানতে চায় না যে আব্বা আর নেই, এবং আম্মা আসলেই বেওয়া হয়ে গেছেন।
নাজির খাঁ কোনো কোনো দিন মাহিরার হাতে করে জাহেরার জন্য এক কৌটা হিমানী স্নো বা সুর্মা, অথবা একটা মার্গো সাবান, অথবা এক বোতল জবাকুসুম তেল পাঠান। জাহেরার সেটা ভালো লাগে, আবার অস্বস্তিও লাগে। মেয়েরা সেসব পেয়ে বেজায় খুশি। একদিন সন্ধ্যায় জাহেরা নাজির খাঁ’র ঘর গোছানোর সময় তিনি চলে আসলেন। জাহেরা একটু ব্যস্ত হাতে কাজ সারতে সারতে একটু মৃদু কণ্ঠে বলেন,
- আপনি আর ফুলেল তেল আর গন্ধ সাবান পাঠাবেন না, আমি বেওয়া মানুষ আমার ভালো লাগে না।
নাজির খাঁ বলেন,
- ওসব তোমাদের তিন জনের জন্যই দেই। আর তেল সাবান সবার ব্যবহারে লাগে, তা তার খসম থাকুক আর না-ই থাকুক।
এরপর থেকে ওসব তো বটেই তার সাথে দাঁতের মাজন, মিশি, কুমকুম, কাজল অথবা পান খাবার জন্য কিমাম বা দোক্তা এসব পাঠানোও চলল।
একদিনের ঘটনা, সকাল থেকে খালিপেটে কাজ করার জন্য হোক অথবা ছাদের রোদে অনেকক্ষণ ধরে ডালের বড়ি শুকোতে দেয়ার জন্য হোক—জাহেরার দুর্বল দুর্বল লাগছিল। এতগুলো মানুষের জন্য ভাত রান্না করার হাড়িটা খুব ছোটো না, ওজনও কম না। মাড় গালতে গিয়ে তাঁর মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল, হাত ফসকে ভাতের হাড়ি মেঝেতে উপুর হয়ে পড়ল, গরম মাড়ে পা পিছলে তিনি পড়ে গেলেন। সে খবর দুপুরেই নাজির খাঁ’র কানে গেল। সন্ধ্যায় তিনি জাহেরাকে ডেকে পাঠালেন। কী করে কী হয়েছে সেসব কিছু জানতে না চেয়ে জাহেরা কোথায় কোথায় ব্যথা পেয়েছে তা জানতে চাইলেন। জাহেরা জানালেন এমন কিছু হয়নি, ঝি লালুর মা কাছেই ছিলেন তিনি সব সামলে নিয়েছে। নাজির খাঁ তাঁকে এক বোতল ঢাকার শক্তি ঔষধালয়ের মৃতসঞ্জীবনী সুরা দিয়ে বললেন,
- রোজ দুপুর আর রাতে খাবারের পরে এই দাওয়াইটা একটা ছোটো বাটিতে সমপরিমান পানি মিশিয়ে খাবে, তাহলে ছোটোখাটো সব বিমারী আর কমজোরী দূর হয়ে যাবে। দাওয়াই শেষ হবার আগে আমাকে জানাবে তাহলে নতুন বোতল কিনে দেবো।
জাহেরা সঙ্কোচে কুঁকড়ে গেলেন, কিন্তু খাঁ সাহেবের কথার ওপরে আর কিছু বলতে পারলেন না।
জাহেরা ভেবেছিলেন ওষুধটা তিনি খাবেন না। এভাবে দু’তিন দিন ফেলে রাখার পরে একদিন দুপুরে ভাত খাবার পরে খেয়ে দেখলেন ওষুধটা খেতে বেশ লাগে। অতএব জাহেরা নিয়মিত দিনে দুইবেলা জল মিশিয়ে মৃতসঞ্জীবনী সুরা খেতে থাকলেন, নাজির খাঁ’ও মাসে দুই বোতল করে যোগান দিতে থাকলেন। ফলে তিন মাস যেতে না যেতে জাহেরার গালে লাল আভা ফুটে উঠল। এক দিন নাজির খাঁ’র ঘর গোছানোর সময় বড় আয়না মুখ দেখতে গিয়ে এটা আবিষ্কার করে জাহেরা মনে মনে খুশি হয়ে উঠলেন, একটু লজ্জাও হয়তো পেলেন। সেদিন রাতে জাহেরার রুস্তমকে খুব মনে পড়ল। উদরের নিবৃত্তির নিয়মিত সংস্থান হওয়ায় তাঁর শরীরও যে জেগে উঠেছে সেটা ঠিক বুঝতে না পেরে তাঁর খুব কাঁদতে ইচ্ছে করল। অতএব মেঝেতে উপুর হয়ে শুয়ে একটা বালিশ চেপে জাহেরা অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। কান্নার শব্দে সায়েরা ঘুম ভেঙে উঠে মাকে কাঁদতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। সে জিজ্ঞেস করল, আম্মা! কী হয়েছে? রোরুদ্যমান জাহেরা উত্তর দিলেন, কিছু না, তুই ঘুমো।
তার কিছু দিন পরের কথা, এক গাঢ় সন্ধ্যায় জাহেরা নাজির খাঁ’র ঘর গোছানোর সময় খিল আটকানোর শব্দ পেলেন। চকিতে ফিরে তাকাতে দেখেন নাজির খাঁ দরজা আটকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাঁর দিকে আগাচ্ছেন। জাহেরা শঙ্কিত কণ্ঠে বললেন,
- এ’কী করছেন খাঁ সাহেব!
নাজির খাঁ কাছে এসে জাহেরাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
- যা করা দরকার, তাই করছি।
নাজির খাঁর বাহুবন্ধনে ছটফটিয়ে উঠে জাহেরা বললেন,
- এসব ঠিক না। আমি একজন বেওয়া মানুষ। বাচ্চা নিয়ে আপনার আশ্রয়ে আছি বলে আমার এই সর্বনাশ করতে পারেন না। খোদার দোহাই লাগে!
জাহেরাকে এক ধাক্কায় বিছানায় ফেলে চেপে ধরে নাজির খাঁ বললেন,
- সর্বনাশের কিছু নেই। আমি তোমার পেটের ভুখ মেটাচ্ছি, তুমি আমার বুকের তিয়াস মেটাবে। আমি লাবুজ বুড়ো না, তুমিও বুড়ি না।
জাহেরা শেষ চেষ্টা করে বললেন,
- খোদার দোহাই লাগে আপনার। এসব জানাজানি হলে আমাকে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে। আমার মেয়েরাসুদ্ধ আমাকে ঘেন্না করবে।
ব্যস্ত দু’হাতে জাহেরাকে নিজের সুবিধায় নিতে নিতে নাজির খাঁ নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বললেন,
- কেউই কিছু জানবে না। আর জানলেও এই বাড়িতে আমার ইচ্ছার ওপরে কারো কথা চলে না। আমি যতদিন আছি কেউ তোমার চুলের ডগাটাও ছুঁতে পারবে না।
জাহেরা কসাই বাড়ির মেয়ে। তাঁর হাঁকডাক কম নয়, দরকারে ছুরি-চাপাতিও চালাতে পারেন। চাইলে তিনি প্রবল প্রতিরোধ করতে পারতেন, হৈচৈ করতে পারতেন, কিন্তু তিনি সেসবের কিছুই করলেন না। তাঁর সকল প্রতিরোধের শক্তি গত কয়েক মাসে একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে গেছে। যেদেশে নারীর পরিধেয় ব্লাউজ, পেটিকোট বা শেমিজ বিহীন শাড়ি আর পুরুষের পরিধেয় ধুতি বা লুঙ্গি—সেদেশে তাদের যৌনকর্মে লিপ্ত হতে বেশি আয়াসের দরকার হয় না, সম্পূর্ণ বিবস্ত্রও হতে হয় না। নাজির খাঁ’র ভারি দেহের নিচে নিষ্পেষিত হতে হতে জাহেরা ভাবলেন, উদয়াস্ত পরিশ্রম করলে তাঁদের তিন জনের দু’বেলার খাবার হয়তো জোটানো যাবে, কিন্তু সবার নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বাড়তি কিছু মূল্য দিতে হবে। বাইরের দুনিয়ায় শেয়াল শকুনের খাবার হবার চেয়ে এটা হয়তো মন্দের ভালো হল।
এরপর থেকে কোনো কোনো সন্ধ্যায় নাজির খাঁ’র ঘরে যাবার জন্য জাহেরার ডাক আসতে থাকে। জাহেরা একবার বলেছিলেন,
- আপনি আমাকে শাদী করেন।
নাজির খাঁ একটু হেসে বললেন,
- আমরা তো এক সংসারেরই মানুষ, মৌলভী ডেকে শাদী পড়ানোর আর দরকার কী!
জাহেরা বুঝলেন নাজির খাঁ তাঁকে ভোগ করবেন, কিন্তু কখনো বিয়ে করবেন না। গর্ভসঞ্চার ঠেকানোর জন্য নাজির খাঁ নিয়মিত হেকিমী দাওয়াই এনে দেন, জাহেরা সেগুলো চুপচাপ নিয়ম করে সেবন করে যান। জাহেরা মানেন— ব্যাপারটা তাঁর নেহাৎ খারাপ লাগে না। তাঁর এখনো ভরা যৌবন, বয়ঃসন্ধিকাল থেকে কিছুদিন আগে পর্যন্ত নিয়মিত স্বামীসঙ্গ করেছেন, তাই চাইলেও শরীরের চাহিদাটিকে নিজের কাছে অস্বীকার করতে পারেন না। নাজির খাঁ তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেননি ঠিকই, কিন্তু তাঁদের মত পরিবারে স্বামীরা যেভাবে স্ত্রী-কন্যাদের প্রতিপালন করেন, সেভাবেই রেখেছেন।
১৩৫০ সনের চৈত্র মাসে যখন জাপানিরা ইম্ফল আর কোহিমা আক্রমণ করে বসে তখন যুদ্ধ একেবারে দোরগোড়ায় চলে আসে। যুদ্ধ যেমন বাড়তে থাকে তার মধ্যে স্বদেশিদের কাজকর্ম বাড়তে থাকে, হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসও বাড়তে থাকে। কলকাতা মহানগর লালমুখো গোরা আর বিশালদেহী কালো আমেরিকান সৈন্যে ভরে যায়। দু’বছর আগে থেকে এরা অল্প স্বল্প আসা শুরু করেছিল বটে তবে ইদানীংকালে এরা পিল পিল করে করে আসছে। ব্রিটিশ গোরা সাহেব তো এদেশে সবসময়ে ছিল কিন্তু এই আমেরিকানগুলো তাদের মত না। তাদেরকে, বিশেষ করে তাদের মধ্যে কালো জিআই-গুলোকে দেখলে লোকে ভয়ে পালাতে চাইত। এরা ব্রিটিশ গোরা সাহেবদেরকে কোনো পাত্তা দিত না। কিছু মানুষ এদেরকে দেখলেই ‘বখশিস, সাহেব’ বলে ছুটে যেত। কখনো সখনো এরা তাদের দিকে এক আধটা পয়সা ছুঁড়ে মারতো। ১৩৫১ সনে দুর্ভিক্ষের প্রকোপ কিছুটা কমে আসলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বিশেষ একটা কমে না। যুদ্ধে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়লে বাজার থেকে সেসব উধাও হয়ে যায়। বাজার মূল্য বেশিরভাগ ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, এবং বাস্তবে তাই হয়েছে। পেট বসে যাওয়া, হাড়চামড়া এক হয়ে যাওয়া কঙ্কালসার মানুষে রাস্তাঘাট ভরে যায়। রাস্তার ধারে যারা পড়ে ধুঁকতে থাকেন, তাঁদের অনেককে দেখে বোঝা মুশকিল তাঁরা আদৌ বেঁচে আছেন কিনা। জীবন বাঁচানোর জন্য আবশ্যক প্রতিটি জিনিসের দাম বাড়লেও সেই জীবনের দাম সবচেয়ে কমে গেছে। চুরি ডাকাতি বেড়েছে, সামান্য জিনিস নিয়ে খুনোখুনি বেড়েছে, রাস্তাঘাটে ক্ষুধার তাড়নায় শরীরবেচা মেয়ে আর তাদের দালালদের সংখ্যা বেড়েছে, সেই সাথে বেড়েছে মানুষ চুরি। ঠিকেদারেরা কয়লাখনি, কনস্ট্রাকশন সাইট, লোড-আনলোড, স্বল্প দূরত্ব বা দুর্গম জায়গায় পরিবহনের জন্য সস্তার শ্রমিক খোঁজে। তাদের আড়কাঠিরা গ্রামগঞ্জ থেকে ক্ষুধার্ত মানুষদের ভুলিয়ে ভালিয়ে যে দিনমজুরিতে লাগিয়ে দেয় সেটা আসলে দাসত্ব। ঠিকেদারদের লক্ষ্য থাকে মেয়েদের প্রতি। এদেরকে কম মজুরি দিয়ে বেশি খাটানো যায়, এরা ফুঁসে ওঠে না, হাঁকডাককে ভয় পায়, প্রয়োজনে এদেরকে ভোগ করা যায় বা বেচে দেয়া যায়। মিলিটারি সাপ্লাইয়ের কাজ পেতে, অর্ডারের মাল জোগাড় করতে, মালামাল নিরাপদে পরিবহন করতে পদে পদে ভেট দিতে হয়। সেই ভেট কেবল নগদ অর্থ, মদ বা দামি পণ্য নয়, কখনো কখনো নারীমাংসও বটে। পাঠানদের মত ‘বাচ্চা বাজি’র অভ্যাস নাকি কোনো কোনো বিদেশি সৈন্যেরও আছে। ফলে সেসব প্রয়োজন মেটাতে রাতের আঁধারে বা দিনের আলোয় নারী আর শিশু চুরি হয়ে যায়।
সার্বিক পরিস্থিতি যেমন দাঁড়াল, তাতে নাজির খাঁ মনে মনে হিসেব করলেন—যুদ্ধ যতদিন আছে, আশা করা যায় সাপ্লাইয়ের কাজ মোটামুটি চলবে। চোরাচালান বেড়ে যাওয়ায় আর প্রকাশ্য বাজারে চোরাচালানের জিনিস বেচাবিক্রি শুরু হওয়ায় এই দিক থেকে লাভ কমে গেছে। সস্তার শ্রমিক বেড়ে যাওয়ায় আগের অনেক লোককে ছাঁটাই করতে হয়েছে। হাবিব লস্কর কখনো সরাসরি নাজির খাঁ’র কর্মচারী ছিলেন না। এই ডামাডোলে প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা অনেক হয়ে যাওয়ায় হাবিব লস্করের কাজকর্ম বাড়ার বদলে কমে গেল। নাজির খাঁ’ও আর তাঁকে কোনো কাজ দেন না। নাজির খাঁ হাবভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন—তিনি চান না হাবিব তাঁর বাড়িতে আসা যাওয়া করুন। হাবিব মরিয়া হয়ে একবার জাহেরাদেরকে নিয়ে কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাবার কথা বলেছিলেন। নাজির খাঁ এসব প্রচ্ছন্ন হুমকি বোঝেন। তিনি সোজা বললেন,
- দেখ, তোমার বোনকে বলে সে গাঁয়ে যেতে চায় কিনা।
জাহেরাকে গাঁয়ে যাবার কথা জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন,
- সে আর হয় না দাদা! আমাদের ফিরে যাওয়া তো দূরে থাক, বেড়াতে যাবার উপায়ও আর নেই। আর যাবোই বা কার কাছে? এই যুদ্ধের সময়, আকালের দিনে কে আমাদেরকে দু’দিন ঠাঁই দেবে? ওসব বাদ দাও। যেমনটা আছি, বেশ ভালো আছি।
জাহেরা না করে দেয়ায় হাবিবের হাতে আর কোনো অস্ত্র থাকল না, ফলে তাঁকে নাজির খাঁ’র সাম্রাজ্য ছাড়তে হল। নাজির খাঁ’র মনে যে চিন্তাটা বেশ কিছু দিন ধরে দানা বাঁধছিল হাবিবকে দূর করার পরে সেটার পালে হাওয়া লাগল। তিনি ভাবলেন সায়েরা আর মাহিরাকে চুরি করে দালালদের কাছে বেচে দেবেন। সায়েরার বয়স ষোল, আর মাহিরার বারো। বেচার জন্য এটা বেশ মোক্ষম বয়স। ঠিকঠাক দালাল ধরতে পারলে বেশ ভালো টাকা পাওয়া যাবে। এই দুই বোনকে বেচে দিতে পারলে কেবল কিছু টাকা আসবে তা নয়, সংসার থেকে দু’জন মানুষের খরচ কমবে। মেয়ে দুটো না থাকলে জাহেরার জোরও কমে যাবে। আকাল আরও লম্বা হলে অথবা প্রয়োজন ফুরোলে এক সময় জাহেরাকেও বেচে দেয়া যাবে।
মেথর, ধোপা, ঘুঁটেওয়ালীর মত কেউ কেউ সদর দরজা দিয়ে না এসে পেছনের দরজাতে কড়া নাড়তেন। অমন কেউ এলে মোটামুটি নিশ্চিতভাবে সায়েরা, মাহিরা দুই বোনই ছুটে যেত। আগত জনের সাথে তারা খামোখাই কিছুক্ষণ গল্প করত, তাঁদের ঘরের খবর নিত। আগতজনেরাও আগ্রহের সাথে সেসব গল্প করতেন, সায়েরাদের ঘরের খোঁজ নিতেন। একদিন বিকেল থেকে মাহিরার গা’টা বেশ গরম থাকায় সে বিছানায় কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিল, সায়েরা তার পাশে বসে টুকটাক কথা বলছিল। অবশ্য মাহিরা উত্তর দেবার মত অবস্থায় ছিল না, সে একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে ছিল। ঝি লালুর মা চলে গিয়েছিলেন, জাহেরা রান্নাঘরে কিছু একটা করছিলেন। সন্ধ্যে হতে জাহেরা মালপোয়া আর শরবত নিয়ে নাজির খাঁ’র ঘরে গেলে তিনি জাহেরাকে বসতে বললেন। এই বসার মানে কী সেটা জাহেরা জানেন, তাই তিনি ঘরের দরজার খিল এঁটে খাটে উঠে বসলেন। নাজির খাঁ মৃদু হেসে মালপোয়া খেতে লাগলেন। তার বেশ কিছুক্ষণ পরে কেউ বাড়ির পেছনের দরজার কড়া নাড়ল। সায়েরা উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
- কে?
পুরুষকণ্ঠে কেউ বলল,
- ধোবী মাঈজী!
সায়েরা দরজা খুলে দেখে একজন অপরিচিত লোক দাঁড়িয়ে। সায়েরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে সে বলল,
- হরি ধোবী ঔর উনকে বেটা কানু কো বহুত বুখার হুয়া। ইসলিয়ে ওহ আজ নহী আ সাকে।
- আহা রে! বেশ জ্বর বুঝি? দু’জনেরই একসাথে কী করে হল? ওষুধ খেয়েছে কিছু?
- ওহ মুঝে নহী জানতা। খোকীজী তুম কাপড়ে লে আও।
সায়েরা ‘আচ্ছা’ বলে কাপড় আনার জন্য ঘুরতেই পেছনে থেকে লোকটা তাকে জাপটে ধরে তার নাকে-মুখে রুমাল চেপে ধরল। সায়েরা হাঁকুপাকু করে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করলে একটা মিষ্টি গন্ধে তার মাথা ঝিম ঝিম করে উঠল, সে আস্তে নেতিয়ে পড়ল। কোথা থেকে আরেকটা লোক এসে খুব দ্রুত সায়েরার হাত-পা বেঁধে তাকে ময়লা কাপড় নেবার বড় বস্তাটাতে ভরে ফেলল। এমন সময় বা’র বাড়ি থেকে কেউ ভেতরের দিকে আসছে বলে মনে হওয়ায় লোকদুটো মাহিরাকে খুঁজতে আর ভেতরে ঢুকল না। খুব দ্রুত দু’জনে মিলে বস্তাটা ধরাধরি করে গলির মুখে রাখা একটা ঢাকাদেয়া জুড়িগাড়িতে তুলে সরে পড়ল। গোটা ব্যাপারটি এত দ্রুত এবং নিঃশব্দে ঘটল যে বাড়ির কেউই টের পেলেন না কোথা থেকে কী হল। এভাবে ১৩৫১ সনের এক শীতের সন্ধ্যায় জাহেরা-মাহিরার জীবন থেকে সায়েরা হারিয়ে গেল।
ফজর = প্রত্যুষের নামায
ওয়াক্ত = নামাযের সময়
মরহুম = প্রয়াত
বেওয়া = বিধবা
লাবুজ = অক্ষম
শাদী = বিবাহ