রুস্তমের দোকানে বেচাবিক্রি কখনোই বিশেষ ভালো ছিল না, ফলে তাঁর পরিবারে অভাব নিত্যসঙ্গী ছিল। বৌ জাহেরা তাঁকে প্রায়ই বলতেন,
“এই শেখপাড়ার দোকান ছেড়ে শিবপুর, সাঁতরাগাছি না হোক অন্তত ডমজুর, মাকড়াদহ বাজারে দোকান দিলেও তো পারেন”।
কিন্তু রুস্তমের মধ্যে কোনো উচ্চাশা ছিল না। অভাবের মধ্যে বেড়ে ওঠায় অভাবটাকে তিনি বড় কোনো সমস্যা মনে করতেন না। কালীপূজোর সময় পাঁঠা বা ঈদুজ্জোহার সময় গরুর একটু বাড়তি চালান এনে বলি বা ক্বোরবানির জন্য বেচার ইচ্ছে তাঁর কখনো হয়নি। ঋষিপাড়ার কানু রুইদাস তাঁকে অনেকবার বলেছিলেন, কাঁচা চামড়া ট্যাংরার ট্যানারিতে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে পারলে কত লাভ, কিন্তু রুস্তমের সেসব ঝামেলা করার কোনো ইচ্ছে ছিল না। কোনোরকমে দিনের তিন বেলার খাবার জুটলে আর সন্ধ্যায় বাজারের কামার শুকুর আলীর হাপরের পাশের আড্ডায় গাঁজার কলকেতে বুক ভরে টান দিতে পারলেই তিনি খুশি ছিলেন। গাঁজার নেশা মাথায় চড়লে রুস্তম খোলা গলায় গেয়ে উঠতেন —
মাথায় রঙীন টুপি, কাঁধে জাম্বিল
হাতে লয়ে আসা বাড়ি ফেরে মানিক পীর।
সেই জনে দিব আমি দুনিয়ার ভার
কলিকালে মানিক হবে অবতার।
বাংলা ১৩৪৬ সনে ভারত যখন মহাযুদ্ধে জড়াল, তখন থেকে একটু একটু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আক্রা হতে শুরু করল। ‘জাপানিরা বর্ম্মাতে এসে গেছে, দু’দিন পরে কলকাতায় চলে আসবে’। ‘জাপানি বিমান দুমদাম বোমা ফেলে সব শেষ করে দিচ্ছে’। এমনসব কথা যত বাড়তে থাকল, বাজার থেকে চাল-ডাল ততই উধাও হতে থাকল। বর্ম্মা থেকে আসা গরিবের খাবার ‘পেগু চাল’ একেবারেই মিলল না। মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘায়ের মত ১৩৪৯ সনের আশ্বিন মাসের ঘূর্ণিঝড়ে বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো তছনছ হয়ে গেল। ঘুর্ণিঝড়ের পরে ধানের রোগবালাই আর পোকার আক্রমণ বেড়ে আমন ধান মার খেয়ে গেল। সে আমলে বোরো নয়, আমনই মূল ফসল ছিল। ফৌজি লোকজন বড় বড় নৌকা পুড়িয়ে দিতে আর গরুর গাড়ি ভেঙে দিতে থাকলে গাঁ থেকে ধানের চালান আর শহরে বা অন্যত্র যেতে পারল না। ১৩৪৮ সনের শীতকালে মোটা চালের দাম ছিল সাড়ে পাঁচ টাকা ছ’টাকা মণ, সেই চালের দাম এক বছরের মাথায় ১৩৪৯ সনের চৈত্র মাসে গিয়ে দাঁড়ায় ১৫ টাকা মণ দরে। সেই বছর শীতে জাপানিরা বিমানে করে খিদিরপুর ডকে আর ময়দানে বোমা ফেললে মহাযুদ্ধ একেবারে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। নিয়মিত সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় চালের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে, এবং বাড়তে বাড়তে ১৩৫০ সনেই সেটা ১০০ টাকা মণ দর ছাড়িয়ে যায়। গ্রামে গ্রামে মানুষ পালে পালে না খেয়ে মরতে লাগলেন। কেউ কেউ ভিটেমাটি ছেড়ে ভিক্ষার আশায় শহরের দিকে বা অন্য জেলার দিকে যেতে লাগলেন বটে, কিন্তু ভিক্ষা দেবে কে! ভাগ্যবানদের কপালে লঙ্গরখানার খাবার মিলল। পেটের অসুখে ভুগে লঙ্গরখানাতেও মানুষ মারা যেতে থাকলেন। দু’বেলা ভাত দূরে থাক ভাতের মাড়ও যখন জোটে না তখন মাংস খাবে কে! অতএব রুস্তমের বেচাবিক্রি তলানিতে ঠেকল। আগে দিনে একটা পাঁঠা বিক্রি হলেও এখন দু’দিনেও তা বেচা হয় না। মাংস তো চাল নয় যে সেটা ধরে রেখে বেচা যাবে, কাটার পরে দ্বিতীয় দিনেই মাংস পচা শুরু করে। ফলে রুস্তমের পরিবারে তো বটেই, সব কসাই পরিবারেই উপোসের কাল শুরু হয়ে গেল।
উপোসের দিন যে কেবল কসাইদের জন্য শুরু হয়েছিল তা নয়। কৃষক, ক্ষেতমজুর, অন্যান্য দিনমজুর, ছোটো দোকানদার, জেলে, কামার, কুমোর সব পেশার মানুষকেই উপোস দিতে হচ্ছিল। ফলে ছিঁচকে চুরি, সিঁদেল চুরি বেড়ে গেল। ডাকাতির খবর খুব একটা শোনা না গেলেও রাহাজানির খবর শোনা যেত। বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে হাটফেরত লোকজন রাহাজানদের কবলে পড়ে সর্বস্ব খোয়াতে লাগলেন। এক মঙ্গলবার রুস্তম গিয়েছিলেন ধুলোগরীর হাটে। তাঁর ইচ্ছে ছিল যা টাকা আছে তা দিয়ে কয়েকটা পাঁঠা বা ছাগী যাই হোক কেনার, তারপর বাজারের হাবভাব বুঝে একটা দুটো করে কেটে বিক্রি করা। কিন্তু হাটে গিয়ে তাঁর মাথায় হাত। হাটে ছাগল নেই বললেই চলে, ব্যাপারিরা সব ছাগল নাকি কলকাতা নিয়ে গেছে। সেখানে যুদ্ধের বাজারে মাংসের চাহিদা অনেক, তুলনায় সরবরাহ কম। ফলে ধুলোগরীর হাটে যে অল্প কিছু ছাগল ছিল, সেগুলোর দাম কলকাতার দামের চেয়েও বেশি হাঁকছিল। কেউ কেউ রুস্তমকে বীরশিবপুরের হাটে চলে যেতে বলছিল, কিন্তু অতদূর হেঁটে যেতে তাঁর ইচ্ছে করছিল না। তাছাড়া তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে ধুলোগরী থেকে বীরশিবপুর যেতে যেতে হাট আর থাকবে না। অতএব বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ রুস্তম কিছু না কিনেই বাড়ি ফেরার পথ ধরলেন। তিনি যখন জঙ্গলপুর পৌঁছুলেন তখন চারদিক গাঢ় অন্ধকার হয়ে গেছে। এমনিতেই এই এলাকাটা একটু বেশি জংলা, রাস্তাঘাটের অবস্থাও সুবিধার না। দিনকালের কথা ভেবে রুস্তম কোমরে গরু জবাই করার লম্বা ছুরি আর হাতে গরু তাড়ানোর ‘পান্টি’ নিয়েই বের হয়েছিলেন কিন্তু আক্রমণটা আসলো পেছন দিক থেকে। একটা বাঁশঝাড় পেরোনোর সময় হঠাৎ করে পেছন থেকে পায়ে সপাটে লাঠির আঘাত লাগল। তীব্র ব্যথা উপেক্ষা করে রুস্তম ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে একটা ভারি লাঠি মাথায় আঘাত করল। অন্ধকারে কিছু বোঝা যাচ্ছিল না কিন্তু জায়গাটা আততায়ীদের পরিচিত বলে তারা এক একটা আঘাত করেই সরে পড়তে পারছিল। তবু এর মধ্যে রুস্তম কোমর থেকে লম্বা ছুরি বের করে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন,
- আয় দেখি কোন্ মাই কা লাল! আজ এই ছোরা দিয়ে তোদের জান নিকলে দোবো!
ছুরির কথা শুনে আততায়ীরা সতর্ক হয়ে গেল। একটু দূর থেকে তারা বড় বড় পাথর ছুঁড়তে লাগল। অন্ধকারে নিশানা ঠিক না থাকলেও একটা পাথর ঠিকই রুস্তমের মাথা ফাটিয়ে দিতে পারল। রুস্তম ‘আল্লাহ্ গো’ বলে দু’হাতে মাথা চেপে পড়ে গেলেন। এইবার আততায়ীরা কাছে এসে ভারি, মোটা, কাঠের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে রুস্তমের মাথা থেঁতলে দিল। কোমরের গেঁজ থেকে ছাগল কেনার টাকাগুলো নিয়ে রুস্তমকে কাছের একটা ডোবায় ফেলে দিল।
হাটে ছাগল কিনতে গিয়ে রুস্তমের সারা রাতে ফিরে না আসার মানে কী হতে পারে সেটা জাহেরা আঁচ করতে পারছিলেন না, কারণ এমনটা কখনো হয়নি। একটা সন্দেহ করলেন বেশি নেশা করে শুকুর আলীর কামারখানায় ঘুমিয়ে আছেন কিনা। তাই ভোরে একবার শুকুর আলীর বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিয়েছিলেন। জানা গেল আগের দিন রুস্তম শুকুর আলীর কামারখানায় আসেনইনি। জঙ্গলপুর থেকে প্রায়ই গরু-ছাগল কিনতেন বলে সেখানকার অনেকেই রুস্তমকে চিনতেন। মাথা থেঁতলানো হলেও রুস্তমকে চিনতে তাঁদের বিশেষ অসুবিধা হয়নি। তাঁদেরই একজন শেখপাড়া বাজারে এসে খবর দিয়ে যান। খবরটা শুনে জাহেরা বা তার মেয়েরা প্রথমে বুঝতেই পারলেন না যে আসলে কী হয়েছে। কোনো শত্রু নেই, কোনো মারামারির ঘটনা নেই হাট করতে যাওয়া একজন মানুষ রাতারাতি লাশ হয়ে ডোবার জলে ভাসছেন – এটা কী করে সম্ভব! পড়শিদের নানা মন্তব্যে তাঁরা আস্তে আস্তে উপলব্ধি করলেন কী ভয়ঙ্কর ঘটনা তাঁদের জীবনে ঘটে গেছে। মাহিরা তার বুবু সায়েরাকে জড়িয়ে ধরে প্রথম চিৎকারটা দেয়। মাহিরার কান্না সায়েরাকেও সংক্রমিত করে, কিন্তু জাহেরা হতবাক হয়ে নিশ্চল বসে থাকেন। কিছুক্ষণ পরে পাড়ার মুরুব্বি ইয়াকুব শেখ জাহেরাকে বললেন,
- বৌ, জঙ্গলপুরে গিয়ে তো লাভ নেই লাশ পুলিশে নিয়ে যাবে। তারচে’ চল ডোমজুর থানায় গিয়ে দারোগা বাবুর হাতেপায়ে ধরে কাটাকুটি করার আগে লাশ নিয়ে আসি। মৈয়তকে খামোখা কষ্ট দেবার মানে নেই।
জাহেরা উত্তরে কিছুই বলেন না। ঘর থেকে সামান্য টাকা আর ইয়াকুব শেখের বিবির কাছ থেকে একটা বোরখা নিয়ে পরে বললেন,
- চলুন কাকা।
থানার দারোগা নিতাই রায় ইয়াকুব শেখ আর জাহেরাকে দেখে বুঝতে পারলেন এরা ভিখিরি পার্টি, এদেরকে কচলাকচলি করে লাভ নেই। তবু ময়নাতদন্তের কথা বলে কিছু আদায়ের চেষ্টা না করলে চলে না। অতএব গরুর গাড়ির ভাড়া বাবদ ইয়াকুব আর জাহেরার কাছে যা কিছু আছে নিয়ে রুস্তমের মৃত্যুকে ইউডি মামলা হিসাবে রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করলেন। মৃত্যুর কারণ লিখলেন ‘জলে ডুবে মৃত্যু’। নিহত ব্যক্তি মুসলমান বলে একটা বিষয়ে তিনি চিন্তামুক্ত, যদি কেউ পরবর্তীতে ঝামেলা পাকায়, তাহলে কবর খুঁড়ে লাশ তুলে ময়নাতদন্ত করা যাবে। নিহত ব্যক্তি হিন্দু হলে পরবর্তীতে ময়নাতদন্তের দরকার হলে একটু ঝামেলা হয়ে যায়। অবশ্য রুস্তমের মৃত্যুর কারণ নিয়ে কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করবে বলে মনে হয় না।
দাফন শেষ হবার পরে জাহেরার ভাবনা দাঁড়াল কী করে তাঁর স্বামীর কুলখানি আর চেহলাম আয়োজন করবেন। যেহেতু সামর্থ্য নেই, তাই চেহলামের দিন নিজেরা নিজেরা ফাতেহা পড়ে নিলেই চলবে, কিন্তু কুলখানি তো করতেই হবে সেখানে মৌলুদ শরীফ পড়াতে হবে, মিসকিন খাওয়াতে হবে। এসবের জন্য ইমাম সাহেব আর তাঁর তালিবে ইলমদেরকে ডাকতে হবে, প্রতিবেশীদেরকে দাওয়াত দিতে হবে—মানে বেশ খরচ আছে। কুলখানির আগে পর্যন্ত মৃতের ঘরে উনুন জ্বালানো হয় না, তাই এই কয়দিন প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে দুই বেলা খাবার আসছে। রান্নাবান্না নেই, গরু-ছাগল পালার ব্যাপার নেই, উজুরি পরিষ্কার করার ব্যাপার নেই। তাই সারাদিন কোরান শরীফ তিলাওয়াত আর তসবিহ্ পড়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। তৃতীয় দিন মাগরেবের নামাযের পরে ইয়াকুব শেখ জাহেরাদেরকে দেখতে এলে তাঁর কাছে কুলখানির কথাটা তোলা হয়। যেহেতু অভাবের কাল তাই প্রতিবেশী কারো পক্ষে আসলে এই ব্যাপারে কোনো সাহায্য করা সম্ভব না। তাই যেটুকু না হলেই নয়, সেটুকু আয়োজনের কথা ভাবা হল। কুলখানির দিন সকালে প্রতিবেশীরা এসে কর্পূর জলে ভেজানো আড়াই সের ছোলার প্রতিটি তুলে তুলে ‘কলেমা তৈয়্যব’ পড়বেন; যোহরের নামাযের পরে শুধু ইমাম সাহেবকে এনে মৌলুদ শরীফ পড়ানো হবে। কোনো মিসকিনকে ডাকা হবে না। মৌলুদের পরে সবাইকে ভাত, উচ্চে ভাজি, উজুরি ভুনা আর লাউ দিয়ে মাষকলাইয়ের ডাল রান্না খাওয়ানো হবে। লাউ নাকি বেহেশতী সবজি, তাই কুলখানির ভোজে সেটা থাকা ভালো। শেষ পাতে একটু মিষ্টান্নের কথা উঠেছিল, কারণ মিষ্টি রাখা নাকি সুন্নত, কিন্তু বাজারে চিনি বা গুড় দুটোরই আকাল চলছে বলে সুন্নত পালন করা সম্ভব হল না। ভোজের সব সামগ্রী প্রতিবেশীরা দেবেন, রান্নাও প্রতিবেশী নারীরাই এসে করবেন। এটা আসলে কোনো নিমন্ত্রণ নয়—একজন প্রতিবেশীর বাড়িতে এসে সবাই মিলে একবেলা নিজেরা রান্না করে খাওয়া মাত্র।
কুলখানির দিন মাগরেবের পরে ইয়াকুব শেখের নেতৃত্বে পাড়ার মুরুব্বিরা আসলেন। জাহেরা বুঝতে পেরেছিলেন তাঁরা কেন এসেছেন। তাঁরাও কোনোপ্রকার ভাণভনিতা ছাড়া সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন জাহেরা এখন তাঁর মেয়েদের নিয়ে কোথায় যাবেন বা কী করবেন। বেলডুবিতে জাহেরার বাপের বাড়ি আছে বটে তবে তাঁর বাবা-মায়ের কেউ বেঁচে না থাকায় সেখানে ভাইয়েরা তাঁদেরকে কোনো ঠাঁই দেবেন না। এককালে মনসিংহপুরে রুস্তমের বাপের বাড়ি ছিল, কিন্তু সেই পাট বহু আগে চুকেছে। রুস্তমের মা ইন্তেকালের পরে তাঁর বাবা এক বিহারী মেয়েকে নিকে করে লক্ষ্মৌ না এলাহাবাদ কোথায় যেন চলে গেছেন। তাঁর সাথে পরিবারের কারো কোনো যোগাযোগ নেই। রুস্তমের ভাইবোনেরা নানাদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছেন সুতরাং তাঁদের কারো কাছে আশ্রয় পাওয়ার কোনো উপায় নেই। আসলে তাঁদের মত হতদরিদ্রদের পক্ষে চাইলেই তিনজন মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব না। জাহেরারা এখন যে ঘরে থাকছেন, সেটা তাঁদেরই বটে। এই মালিকানার সীমা থাকার ঘর, সামনে ছোটো উঠোন আর গোয়াল, পেছনে রান্নাঘর, কুয়োতলা আর কাঁচা পায়খানা পর্যন্ত – সব মিলিয়ে দুই কাঠা হয় কিনা সন্দেহ। থাকার ব্যবস্থা না হয় আছে কিন্তু খাওয়ার উপায় কী? কসাইয়ের কাজ এমন একটি পেশা, যেটিতে অদ্যাবধি এদেশের কোনো নারী সরাসরি যুক্ত হননি। জাহেরার পক্ষে তাই তাঁর স্বামীর পেশা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এক পাটকরুনি ঝিয়ের কাজ ছাড়া তিনি এমন কোনোকিছু করতে পারেন না, যা দিয়ে সংসার চালাতে পারেন। এখন অভাবের কাল, মধ্যবিত্তরা খরচ সামলাতে ঝি ছাড়িয়ে দিচ্ছেন। ধান-পাট-সর্ষে তোলার কাজ না জানলে গৃহস্থ বাড়িতে ঝিয়ের কাজ মেলে না। ছোটোবেলা থেকে ছুরি-চাপাতি নাড়াচাড়া করা কসাইবাড়ির মেয়েদের হাঁকডাক একটু বেশি। একারণে এদেরকে কেউ ঝিয়ের কাজে রাখতে পছন্দ করেন না। জাহেরা ভরযুবতী মেয়ে, তিনি নিজে এবং তাঁর মেয়েরা দেখতে বেশ সুন্দরী। অভাবের সংসারে থাকলেও তাঁদের রূপ-লাবণ্যে ঘাটতি পড়েনি। এমন জ্বলন্ত আগুনকে ঝিয়ের কাজে রাখতে বাড়ির গিন্নিরা দশবার ভাববেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে কাজে রাখবেন না। এসব সত্য জাহেরা এবং আগত মুরুব্বিদের সবাই বোঝেন। একটা সহজ সমাধান হচ্ছে জাহেরাকে আবার নিকে দেয়া। তবে দুটো মেয়েসমেত জাহেরাকে কে বিয়ে করবেন সেটা একটা প্রশ্ন। এদিকে বড় মেয়ে সায়েরার বয়স চৌদ্দ—মানে সে নিজেই বিয়ের বয়সে পৌঁছে গেছে। জাহেরাকে নিকে দেবার আগে ইদ্দত পালনের ব্যাপার আছে, উপযুক্ত পাত্র খুঁজে বের করার ব্যাপার আছে। ততদিন পর্যন্ত জাহেরারা খাবে কী? আর কে পারবে উপযুক্ত পাত্র খুঁজে দিতে! মুরুব্বিরা কোনো ফয়সালা করতে পারলেন না। খোদার ওপর ভরসা রাখতে বলে তাঁরা চলে গেলেন।
কুলখানির কয়েকদিন পরে কোথা থেকে যেন হাবিব লস্কর এসে হাজির হলেন। হাবিব সম্পর্কে জাহেরার মামাতো ভাই। এক সময় এই বাড়িতে তাঁর অনিয়মিত যাতায়ত ছিল। দুটো কারণে রুস্তম তাঁকে বিশেষ পছন্দ করতেন না। প্রথমত, হাবিব একটু চালিয়াৎ স্বভাবের মানুষ; দ্বিতীয়ত, রুস্তমের বদ্ধমূল ধারণা ছিল হাবিব আসলে জাহেরাকে দেখতে এ’বাড়িতে আসতেন। পারিবারিক পদবীকে সার্থক করতে এক সময় হাবিব কলকাতা থেকে মাদ্রাজ, বম্বে পর্যন্ত মালটানা ছোটো জাহাজের খালাসি হয়েছিলেন। জাহাজী জীবনে আয় ভালো হলেও জীবনের ঝুঁকি কম না। ঝড়ে পড়ে সমুদ্রে জাহাজ ডোবে এমন ঘটনা বেশি না, কিন্তু মাঝসমুদ্রে নেশার ঘোরে মারামারি, জুয়ার টাকা নিয়ে দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিগত রেশারেশি মেটানোর সহজ সমাধানের কারণে তাঁর মত মানুষের জন্য পেশাটা ঝুঁকিপূর্ণ। হাবিব জাহাজের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে বন্দর সংশ্লিষ্ট নানা কাজে যুক্ত হবার চেষ্টা করলেন। যেহেতু মানুষ মরলেও তার স্বভাব পাল্টাতে পারে না, তাই মাটিতে নেমে অল্প দিনের মধ্যে হাবিব বন্দর সংশ্লিষ্ট বেআইনি কাজে জড়িয়ে পড়লেন। রাতের অন্ধকারে ডায়মন্ড হারবারের বহির্নোঙ্গরে থাকা জাহাজ থেকে উচ্চ শুল্কের অথবা অবৈধ পণ্য ছোটো ছোটো নৌকায় করে আনা-নেওয়া করা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও, বেশ লাভজনক কাজ। বন্দর-পুলিশের হাতে ধরা পড়লে কপালে উত্তম-মধ্যম খাওয়ার এবং শ্রীঘর বাস আছে—সেটা ভয়ের কিছু নয়—কিন্তু যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে রয়েল ইন্ডিয়ান নেভির আনাগোনা বেড়ে গেছে। তাদের কবলে পড়লে স্রেফ মাঝদরিয়ায় প্রাণ হারাতে হবে। তাই হাবিব জলে চোরাচালানের কাজ ছেড়ে দিয়ে স্থলের চোরাচালানের সাথে যুক্ত হলেন।
এভাবে একসময় তাঁর ওয়াটগঞ্জের নাজির খাঁ’র সাথে পরিচয় হয়। নাজির খাঁ নিজেকে চাঁটগাঁয়ের মানুষ বলে দাবি করলেও সবার ধারণা তিনি বর্ম্মী। নাজির খাঁ যে হালকা আঞ্চলিক টান সহযোগে কলকাতার বাংলায় কথা বলেন, তাতে কারো পক্ষে বোঝা কঠিন আঞ্চলিক টানটা চট্টগ্রামের, নাকি বর্ম্মার। ওয়াটগঞ্জে তাঁর বাড়ি বাইরে থেকে দেখলে কিছু বোঝা যায় না। অন্দরমহলে ঢুকলে বোঝা যায় এটা আসলে মালখানা। এই বাড়িতে নাজির খাঁ’র পরিবারের কেউ থাকেন না। তাঁর পরিবারে আসলে কারা আছেন, এবং তাঁরা কোথায় থাকেন সেটা কেউ নিশ্চিত জানেন না। পরিচয় পর্বে কেউ তাঁকে বিবি-বাচ্চা বা আব্বা-আম্মা-ভাই-বোন সংক্রান্ত প্রশ্ন করলে এক কথায় উত্তর দেন, ‘সবাই দেশের বাড়িতে আছেন, তাঁরা দেশের বাড়ি ছেড়ে কলকাতাতে থাকতে পছন্দ করেন না’। তিনি মাঝে মাঝে কয়েক মাসের জন্য লাপাত্তা হয়ে যান। ফিরে আসলে বলেন, “দেশের বাড়িতে গিয়েছিলাম”। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, দেশের বাড়ি টাড়ি ওসব কিছু না, পুলিশী তৎপরতা বেড়ে গিয়েছিল বলে নাজির খাঁ একটু লম্বা সময়ের জন্য গা ঢাকা দিয়েছিলেন। হাবিব লস্কর নাজির খাঁ’র স্থায়ী কর্মচারী নন। হাবিব কোনো মালের খোঁজ পেলে নাজিরকে জানান, মাল সরাতে সাহায্য করেন। যুদ্ধের বাজারে নানা প্রকারের মালের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নাজিরের সাথে সাথে হাবিবের ব্যস্ততা বেড়েছে। মিলিটারি সাপ্লাইয়ের কন্ট্রাক্টরদের সাথে নাজিরের খাতির জমে ওঠায় তাঁর ব্যাবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছে।
যেহেতু হাবিবের বিবি-বাচ্চা গ্রামের বাড়ি বুড়িখালীতে থাকে, তাই তিনি কিছুদিন পরপর গ্রামে যান। তাছাড়া একটু করে বিরতি দিয়ে কর্মস্থল থেকে সরে না থাকলে পুলিশের নজরে পড়ে যেতে হয়। সে’কারণে হাবিব ছুটি কাটাতে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। রুস্তমের পক্ষ থেকে অপমানের ভয় থাকলেও তিনি ভাবলেন ফেরার সময় জাহেরাকে একবার দেখে যাবেন। রুস্তম যে খুন হয়েছেন—এই খবর তিনি জানতেন না। বস্তুত হাবিবদের বাড়িতে এই খবর দেবার কথা কেউ ভাবেনওনি। হাবিব জাহেরাদের বাড়িতে এসে একটা মিশ্র মানসিক অবস্থার মধ্যে পড়লেন। রুস্তম আর নেই একথা শুনে তিনি প্রথমে একটু স্বস্তি বোধ করলেন, কিন্তু জাহেরা যে অকূল সাগরে পড়েছেন, সেটা তাঁকে স্বস্তি দিল না। একবার তিনি ভাবলেন, কাঁধে ঝামেলা না নেয়াই সঙ্গত। এখান থেকে দ্রুত কেটে পড়ে জাহেরার বিষয়টি স্থায়ীভাবে ঝেড়ে ফেলতে হবে। কে চায় দুই বাচ্চাসহ বিধবা নারীর বোঝা বইতে! আবার ভাবলেন বিষয়টা নিয়ে নাজির খাঁ’র সাথে একবার আলাপ করে দেখা যেতে পারে। কে জানে, হয়তো খাঁ সাহেব জাহেরাদের এমন কোনো ব্যবস্থা করতে পারবেন, যাতে জাহেরা হাবিবের কব্জায় চলে আসবে, কিন্তু কোনো দায় নিতে হবে না। এসব ভেবে হাবিব জাহেরাদেরকে সান্ত্বনা দিলেন, অল্প কিছু টাকা জাহেরার হাতে দিয়ে বললেন,
— দেখি, খাঁ সাহেবকে বলে কলকাতায় কোনো কাজ জোটানো যায় কিনা। যদি ঝিয়ের কাজই করতে হয়, তাহলে কলকাতাতে করাই ভালো। সেখানে অন্তত এই গাঁয়ের চেয়ে বেশি মাইনে পাওয়া যাবে।
জাহেরার কাছেও কথাটা যুক্তিযুক্ত মনে হয়। তিনি মিনতি করে বলেন,
— দেখো না দাদা তোমার খাঁ সাহেবকে বলে, কোনো মুসলমান বাড়িতে কাজ জোটানো যায় কিনা। হিন্দু বাড়িতে তো আমাদেরকে ঢুকতে দেবে না। নয়তো মেয়েদেরকে নিয়ে আমি যাব কোথা, খাবই বা কী!
হাবিব তাঁকে আশ্বস্ত করে কলকাতা ফিরে যান।
হাবিব একটু দ্বিধা নিয়ে খাঁ সাহেবকে গোটা ব্যাপারটা খুলে বলেন, শুধু জাহেরার ব্যাপারে তাঁর নিজের দুর্বলতার কথা ছাড়া। খাঁ সাহেব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জাহেরার বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি, তাঁদের সবার বয়স, শরীর স্বাস্থ্যের খোঁজ জেনে নেন। তারপর হাবিবকে অবাক করে দিয়ে তিনি বলেন,
— হাবিব মিঞা, তোমার বোন-বোনঝিদেরকে এখানে নিয়ে এস। অন্য কার না কার বাড়িতে থাকবে, কাজ করবে—তার চেয়ে এই বাড়িতে থাকুক। এখানে থাকার জায়গার অভাব নেই। বাড়িতে মানুষও খুব কম নেই, তাদের রান্নাবান্না, ঘর-গেরস্থালীর কাজও অনেক। মাইনে করা অচেনা ঝি রাখার চেয়ে তোমার বোন থাকুক, বিশ্বস্ত মানুষ। তুমি এখানে যাওয়া-আসার মধ্যে আছ, সুতরাং তুমিও ওদের ওপর চোখ রাখতে পারবে। সমস্যা একটাই, এই বাড়িতে ঝি লালুর মা ছাড়া কোনো মেয়েছেলে নেই। সেই ঝিও আবার রাতে থাকে না। তোমার বোন যদি নিজের বাড়ি মনে করে বাচ্চাদের নিয়ে এখানে থাকতে পারে, কাজ করতে পারে—তাহলে এসব কোনো সমস্যা না। আর একটা ব্যাপার, তিনজন মানুষকে আমি মাথা গোঁজার ঠাঁই, ভাত-কাপড়-তেল-সাবান-ওষুধপত্র দেব, তাই আমার পক্ষে কোনো মাইনে দেওয়া সম্ভব না। তোমার বোন এতে রাজি থাকলে কাল-পরশুই তুমি ওদেরকে নিয়ে আসতে পার।
নাজির খাঁ’র প্রস্তাবে জাহেরার আপত্তি করার কোনো উপায় ছিল না। এই কসাইপাড়ায় থাকাটা আপাত নিরাপদ মনে হলেও, দু’দিন পরে যে তা নিরাপদ থাকবে না—সেটা জানা কথা। চারপাশের অগণিত লোক যুবতী বিধবা বা তাঁর সোমত্ত মেয়েকে ভোগ করতে চাওয়ার জন্য লালায়িত হয়ে আছে। এছাড়া ‘প্রয়াত স্বামীর ভিটে’—শুধু এই যুক্তিতে এখানে থেকে অনাহারে দিন কাটানো সম্ভব না। তবু প্রতিবেশীদের এতদিনকার ভালোবাসা আর অনুগ্রহের কথা ভেবে একবার ইয়াকুব শেখকে কথাটা জানিয়ে তাঁর অনুমতি চান। ইয়াকুব শেখের অনুমতি দেবার কিছু ছিল না, বিকল্প কোনো প্রস্তাবও ছিল না। তাই তিনি দুর্বল কণ্ঠে বলেন,
— দেখো, তুমি যা ভালো বোঝ। তাহলে এই বাড়িঘর, রুস্তমের ভিটে—এসবের কী করবে?
এর উত্তর জাহেরা নিয়েই এসেছিলেন,
— এ’সব আপাতত আপনি ব্যবহার করুন। খোদা যদি কখনো অমন দিন দেন, তাহলে এখানে ফিরে এসে গরু পালব, দুধ বেচব, ফসলী জমি কিনে চাষীদের কাছে বর্গা দেব।
না চাইতেই ঘরসুদ্ধ জমি পেয়ে ইয়াকুব শেখ আর আপত্তি করলেন না। কথা রইল, ছুটিছাটায় জাহেরারা অথবা হাবিব এসে বাড়িঘর দেখে যাবেন।
তার দু’দিন পরে সকালে নিত্য ব্যবহার্য কিছু জিনিস দুটো চটের বস্তায়, ব্যবহারের কাপড়চোপড় একটি কাপড়ের বস্তায় ভরে শেখপাড়া ঘাট থেকে একটা মালটানা নৌকায় করে হাবিবের সাথে জাহেরা আর তার দুই কন্যা অজ্ঞাতকালের জন্য অজ্ঞাত গন্তব্যের পানে রওনা দিলেন। ঘরের সামান্য আসবাব আর গৃহস্থালী কিছু জিনিস যেগুলো নিয়ে আসা গেল না, সেগুলো ঘরেই তালাবদ্ধ করে রেখে যাওয়া হল। ঘরে পালা হাঁস-মুরগিগুলো তার আগের দিন প্রতিবেশীদের কাছে বেচে দিয়ে অতি সামান্য কিছু নগদ অর্থ মিলেছে। জাহেরা বা তাঁর প্রতিবেশীদের কান্নার ভাঁড়ার আগেই ফুরিয়ে গিয়েছিল, তাই বিদায়বেলায় কেউ বিশেষ কাঁদলেন না। চার-পাঁচ জন ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে এলেন। এমন সময় কোথা থেকে যেন আলী ছুটতে ছুটতে এল।
— মাহিরাবু’, তোমরা নাকি বিদেশে চলে যাচ্ছ?
— হ্যাঁ রে!
— কেন যাচ্ছ?
— বাবা এন্তেকাল করার পরে আমাদের দেখার কেউ নেই যে!
— রুস্তম কাকা কি এন্তেকালের পরে বিদেশে গিয়ে থাকছেন?
— আরে বোকা! এন্তেকাল মানে খোদার কাছে চলে যাওয়া। সেখান থেকে কেউ ফিরতে পারে না। আমরা অন্য কোনো দেশে যাচ্ছি না। কলকাতায় যাচ্ছি। সেখানে এক সওদাগর কাকার কাছে থাকব।
— তাহলে তোমরা আর ফিরে আসবে না?
— তা তো জানি না রে!
আলী কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। গোটা ব্যাপারটা তার অভিজ্ঞতার বাইরে। তাই কী বলা উচিত সেটা বুঝতে না পেরে শুধু বলল,
— আমি বড় হলে কলকাতা যাব। তোমাদের সওদাগর কাকার বাসায় গিয়ে তোমাদের সাথে দেখা করব।
জাহেরা-সায়েরা-মাহিরা নৌকার ছৈয়ের নিচ থেকে উঁকি দিয়ে শেখপাড়া ঘাটের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, যতক্ষণ না নৌকাটা বাঁয়ে বাঁক নেয়ায় ঘাটটা দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। বাঁকড়া খাল ধরে দক্ষিণ-পূর্বগামী নৌকাটার দিকে আলীও তাকিয়ে ছিল। আলী তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি, এই ক্রমাগত দক্ষিণ-পূর্বে, বা আরও ভালো করে বললে পূর্বদিকের অজ্ঞাত বিদেশের দিকে যাওয়া কেবল মাহিরাদের নয়, তারও নির্বন্ধ। সেসব আরও পরের কথা, সেগুলো যথাসময়ে ঘটবে।
কলকাতা যে এত কাছে, সেটা জাহেরাদের ধারণাতে ছিল না। বাঁকড়া খাল বেয়ে আসতেই যতটা সময়। বড় নদীতে পড়ার পরে পূর্বদিকে ঘণ্টাখানেক যেতে অপর পাড়ে দইঘাটে আসা মানে কলকাতায় চলে আসা, সেখান থেকে ওয়াটগঞ্জে নাজির খাঁ’র বাড়ি হাঁটা দূরত্ব। সে বাড়িতে তাঁরা যখন পৌঁছলেন, নাজির খাঁ তখন বাড়িতে ছিলেন না। হাবিব তাঁদেরকে ভেতর বাড়ির একটা ঘরে বসিয়ে বাইরে থেকে খাবার আনতে গেলেন। এর মধ্যে তাঁরা সবাই পাকা ইঁদারা থেকে বালতি করে জল তুলে মুখ-হাত-পা ধুয়ে বেশ খানিকটা করে ঠান্ডা জল খেয়ে নিয়েছিলেন। হাবিব শালপাতার ঠোঙায় করে লুচি আর আলুর তরকারি নিয়ে আসলেন। দোকানের খাবার খেয়ে সায়েরারা দুই বোন তো মহাখুশি। এত মজার খাবার তারা আগে কখনো খায়নি। তার কিছু পরে নাজির খাঁ আসলে তাঁদের ডাক পড়ল। সায়েরা আর মাহিরাকে দেখে নাজির খাঁ একটু ধাক্কা খেলেন। বাচ্চাগুলো দেখতে এত সুন্দর হলে তাদের মায়ের রূপের অবস্থা কী! তিনি জাহেরাকে সোজাসাপটা বললেন,
— ঘোমটা কমিয়ে মুখ তুলে তাকাও মেয়ে। নিজের ঘরে কাকে ঠাঁই দিচ্ছি দেখা দরকার। আর এক বাড়িতে বাস করে এত পর্দা করলে কাজ করা যাবে না।
জাহেরা মাথার ঘোমটাটা একটু কমিয়ে কানের পেছনে ঠেলে দিলেন। নাজির খাঁ তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেলেন। মনে মনে বললেন, সুবহান আল্লাহ্! যাক, বাজি যেটা ধরেছিলাম সেটা সুদাসল সমেত দশগুণ হয়ে ফিরে এসেছে দেখছি! সাব্যস্ত হল—ঠিকে ঝি লালুর মা বহাল থাকবেন বটে, তবে বাড়িঘর সামলানোর মূল দায়িত্ব জাহেরার হাতে থাকবে। হেঁসেল-ভাঁড়ার সামলানো, তিন বেলা রান্না করা, সবাইকে খাওয়ানো, ঘর গোছানো জাহেরার কাজ। সায়েরা কুটে বেছে, এগিয়ে দিয়ে মা’কে তাঁর কাজে সাহায্য করবে। ঝি ঘরদোর পরিষ্কার রাখবেন, কাপড়চোপড় ধোবেন, দোকানসদাই করবেন। মূল বাজারসদাই পুরুষ কাউকে দিয়ে করানো হবে। মাহিরাকে আপাতত কিছু করতে হবে না, তবে বা’র বাড়ির সাথে অন্দরমহলের যোগাযোগটা তার মাধ্যমে হবে। মেয়েরা নাজির খাঁ’কে হাবিবের মত ‘মামা’ ডাকা শুরু করলেও মনিব বিবেচনায় কেন যেন জাহেরার তাঁকে ‘দাদা’ বা ‘ভাই’ বলে ডাকতে বাধল। জাহেরা হাবিবের মত তাঁকে ‘খাঁ সাহেব’ বলে ডাকতে লাগলেন। নাজির খাঁ তাঁকে জাহেরা বলেই ডাকতেন।
জাহেরা ভেবেছিলেন, জীবনে কখনো শহরে থাকার অভিজ্ঞতা নেই বলে শহরে বুঝি তাঁরা হাঁপিয়ে উঠবেন, কিন্তু প্রতিদিনকার কাজের চাপে তাঁর সে’সুযোগ বিশেষ হল না। নাজির খাঁ’র নিজের পরিবারের কেউ না থাকলে কী হবে, দুপুরে বা রাতে পাত পেড়ে খাওয়ার মত তাঁর কাজের লোকের অভাব নেই। দুপুরে প্রায় কুড়ি জনের মত লোকের রান্না রাঁধতে হয়, সকালে আর রাতে জনা দশেকের জন্য। জাহেরাকে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আগের রাতে ভেজানো চিঁড়ে-গুড় দিয়ে মেখে নাশ্তার ব্যবস্থা করতে হয়। কোনো কোনো দিন ভেজা চিঁড়ের বদলে মুড়ি-গুড় খেতে হয়। সকালের নাশ্তা পর্ব শেষ হতে না হতে হাড়ি-বাসন ধুয়ে সবজি কাটাকুটি শুরু করতে হয়, মশলা বাটতে হয়। এর মধ্যে বাজার থেকে মাছ চলে আসলে সেটা কুটতে হয়। তারপরে লাকড়ির উনুন ধরিয়ে রান্না শুরু করতে হয়। দুপুরে সাধারণত ভাত, ডাল আর সাথে একটা সবজি অথবা মাছ অথবা মাংস রান্না করা হয়। যেদিন সবার জন্য মাছ বা মাংস রান্না হয় না, সেদিনও নাজির খাঁ’র জন্য মাছের বা মাংসের একটা পদ রান্না করতে হয়। রাতের বেলার জন্য হয় রুটি অথবা ছাতু। যেদিন রাতে রুটি গড়তে হয়, সেদিন আটা মেখে দিস্তা দিস্তা রুটি বেলতে আর সেঁকতে হয়। রুটি যেদিন গুড় দিয়ে খাওয়া হয়, সেদিন খাটুনি একটু কম, নয়তো পাতলা ছোলার ডালও রাঁধতে হয়। ছাতু সাধারণত নুন-লঙ্কা দিয়ে মেখে খাওয়া হয়। যে রাতে সবার জন্য ছাতুর মণ্ড বানানো হয় সেরাতেও নাজির খাঁ’র জন্য রুটি গড়তে হয়। দুপুরে খাবার পরে একটু গড়িয়ে নিয়ে চাল বাছা, যাঁতায় ডালের খোসা ছাড়ানো অথবা গম পিষে আটা অথবা যব পিষে ছাতু বানাতে হয়। এক নাজির খাঁ ছাড়া অন্য কারো ঘর জাহেরাকে গোছাতে হয় না। নাজির খাঁ যখন সচরাচর বাড়িতে থাকেন না জাহেরা তখন সে’ঘর গোছান। বা’র বাড়ির ঘরগুলো ঝি ঝেড়ে মুছে দেন। সারা দিনে ঝি, ফেরিওয়ালা আর ভিখিরি ছাড়া কারো সাথে দেখা হয় না, কথা হয় না। শহর বলে এ’পাড়া ও’পাড়া বেড়ানোর উপায় নেই। প্রতিবেশী নারীদের সাথে জাহেরাদের মাখামাখি নাজির খাঁ’র পছন্দ নয়। সে’কথা তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েও দিয়েছেন। অবশ্য প্রতিবেশীরাও কসাই বাড়ির মেয়ে শুনে একটু আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন। এসব নিয়ে জাহেরার মন খারাপ করার উপায় নেই। গ্রামে থাকতে দুর্ভিক্ষের ছায়া দেখার দুর্ভাগ্য তাঁদের হয়েছিল, তাই চারপাশ থেকে যখন দুর্ভিক্ষে মানুষ মরার খবর পাওয়া যায় অথবা রাস্তা থেকে দিনমান ‘ফ্যান দে’ বলে মিনতি শোনা যায় জাহেরা তখন ভাবেন, বড্ড বাঁচা বেঁচে গেছেন। গাঁয়ে থাকলে মেয়ে দুটোকে নিয়ে স্রেফ না খেয়ে মরতে হত।
ইদ্দত = স্বামী বিয়োগের পর স্ত্রীর পর পর তিনবার রজঃদর্শনের সময়কাল। সদ্য বিধবা গর্ভবতী কিনা সেটি নির্ণয়ের জন্য এই কাল পর্যন্ত তাঁর জন্য পুনর্বিবাহ নিষিদ্ধ, যাতে ভবিষ্যত সন্তানের পিতা আসলে কে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ না থাকে। তিনি গর্ভবতী হলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পরে পর পর তিনবার রজঃদর্শনের সময়কাল পর্যন্ত তাঁর জন্য পুনর্বিবাহ নিষিদ্ধ। তখন এই পুরো সময় ইদ্দত কাল বলে বিবেচিত হবে।
ঈদুজ্জোহা = ঈদ-উল-আযহা
আসা = বেড়ানোর ছড়ি
মৈয়ত = মৃতদেহ
মামলা = অস্বাভাবিক মৃত্য
দাফন = মৃতদেহ কবরস্থ করা
কুলখানি = মৃত্যুর চতুর্থ দিনে কৃত শ্রাদ্ধ
চেহলাম = মৃত্যুর চল্লিশতম দিনে কৃত আদ্যশ্রাদ্ধ
ফাতেহা = সম্মিলিত প্রার্থনা
মৌলুদ শরীফ = নবীর উদ্দেশ্য যুথবদ্ধ প্রশংসা পাঠ ও প্রার্থনা করা
মিসকিন = ভিখিরি
তালিবে ইলম = ছাত্র
দাওয়াত = নিমন্ত্রণ
তিলাওয়াত = পাঠ
তসবিহ্ পড়া = জপ করা
মাগরেবের নামায = সান্ধ্যকালীন প্রার্থনা
১ সের = ৯৩৩ গ্রাম
যোহরের নামায = দ্বিপ্রাহরিক প্রার্থনা
বেহেশতী = স্বর্গীয়
সুন্নত = নবীর বিধান
লাকড়ি = জ্বালানী কাঠ