থাপ্পড়
ভুনিয়া রাগে উত্তেজনায় পছিম হাওয়ায় যেমন
গাছের পাতা কাঁপে তেমন থর থরিয়ে কাঁপতে
লাগল। হাতের দা খানা ছুঁড়ে ফেলে দিলো
দরিয়ার মাঝ বরাবর। ঝপাৎ আওয়াজ করে
সেটা অদৃশ্য হল জলের গভীরে। পিছন ফিরে
বাঁশ ঝাড়ের দিকে একবারতাকিয়ে স্বস্তির
নি:শ্বাস ফেলল সে। কার্ত্তিকের মুখটা মনে
পড়ে যাচ্ছে। ইস শেষে কিনা ম্লেচ্ছর হাতে......
বাঁশ বাগানের মাথার ওপর থালার মতো
গোল চাঁদখানা শুধু নীরব সাক্ষী হয়ে
রইল আজকের ঘটনার। নীচু জাত
বলে চিরকাল বাবুদের অবহেলা সইতে
সইতে মনের ভেতর কখন জানি এত
বড় একটা আগুনের পাহাড় তৈরি
হয়েছিল। ভুনিয়া নিজেই কি টের
পেয়েছিল এতকাল? আজ সেই পাহাড়ের
বুক চিরে বেরিয়ে এল তরল লাভা,
চারপাশটা যেন পুড়িয়ে খাক করে দিতে চাইল।
ঘটনার সূত্রপাত দু'দিন আগে।
সামনে ভোট। পার্টির লোকেরা এই সময়টায়
ওদের মতো ম্লেচ্ছদের নিয়ে খুব মাতামাতি
করতে থাকে। কিন্তু ভুনিয়া জানে ওসব
লোক দেখানো আদিখেত্যা। তবু পরখ
করে দেখতে সাধ যায় মাঝে মাঝে। সেদিনও হয়েছিল।
পার্টির অফিসে ডাক পড়েছিল ওর।
দিল্লি থেকে মন্ত্রী আসবে। তিনি নাকি
ম্লেচ্ছ পাড়ায় গিয়ে ওদের বাড়িতে বসে পাত
পেড়ে ভাতখাবেন। ভুনিয়াকে ডেকেছিল সে
কথাটা বলবে বলে। ভুনিয়া অফিস ঘরে ঢুকে এক কোণে দাঁড়িয়ে শুনছিল সব। হঠাৎ কি খেয়ালহতে
জাতে ওঠার আনন্দে নাকি পরখ করার
ইচ্ছাতে পাশের একটা খালি চেয়ার টেনে
নিয়ে বসেছিল তাতে। ব্যস যেই না বসা
কার্ত্তিক বলে যে ছেলেটা পার্টির বড়ো মুনীশ
সে হঠাৎ সটান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে
কলার ধরে টেনে তুলল ভুনিয়াকে। সপাটে
একটা থাপ্পড় মারল ভুনিয়ার গালে।
ছোটলোক হয়ে চেয়ারে বসবি? এত সাহস!
তারপর এলোপাথাড়ি চড় থাপ্পড় কতক্ষণ
জানেনা , মনে নেই ভুনিয়ার। টলতে টলতে
ঘরে ফিরেছিল ও। ঠোঁটের কোণে লেগে
থাকা রক্তের দাগ মুছিয়ে দিতে দিতে মা-ও
একটা থাপ্পড় কষিয়েছিল গালে। টলটলে
জলভরা চোখে বলেছিল, "বেশরম তুই কি
ভুলঞ গেইছিলি আমরা হলাম গিয়ে অচ্ছুৎ!
আমাদের জায়গাটো হইল গিইয়া ওই ভাগাড়েঞ!"
ভুনিয়া ভোলে নি। ওই থাপ্পড় ভুনিয়া ভুলতেই
পারল না।দিনে রাতে চোখ বন্ধ করলেই সেই
দৃশ্য ভেসে ওঠে। কানে ভেসে আসে ,
"ছোটলোকের আস্পদ্দা দ্যাখ....
শালাটো চেয়ারেঞ বসবঞক...
"ছোটলোক হয়ে বাঁচতে বাঁচতে
ভুনিয়া ভুলে গেছিল সেও কোপ
বসাতে পারে।
এক কোপ।
থাপ্পড়
ভূত ও ভবিষ্যৎ
বেলা তিনটের নাগাদ মধু এসে খবরটা
দিল। খবরটা শুনে আমোদ পোমোটারের
মনে আমোদ আর ধরে না। এতদিনে
তা'লে বুড়ি টাঁসলো। উফ কবে থেকে চোখ
দিয়ে বসে আছে বাড়িটা হাতাবে বলে।
বুড়ি শালা কিছুতেই টপকাতে চায় না।
আজ তিনবছর ধরে এই যায় সেই যায়
হচ্ছে তবু যেতে যেতেও বুড়ি আবার নেচে
ওঠে। এইটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল
মানে বেঁচে ওঠে আরকি!
বুড়ির তিন কূলে কেউ নেই। এক ছেলে ছিল
সেও আজ বছর পাঁচেক হল গাড়ির ধাক্কায়
পটলডাঙার টিকিট কেটেছে। বুড়ো গেছে
তারও আগে। বুড়ির পাসপোর্ট রেডি কিন্তু
পটলডাঙ্গার ভিসা আর হচ্ছিল না। যাক
আর চিন্তা নেই। এখন শুধু ধৈর্য ধরে
ক'টাদিন থাকতে পারলে ব্যাস কেল্লা
ফতে। মানে তিন তলা কেল্লাখান হাতে।
বুড়িকে তো আমোদ বোঝাবার কম চেষ্টা
করে নি।মাসীমা মাসীমা করে কতো
আধো আধো স্বরে ডেকেছে, কত চিন্তা
প্রকাশ করেছে, এত বড় বাড়ি কেউ দেখার
নেই। ভয় দেখিয়েছেচোর ডাকাত এসে খুন
করে দিলেও তো কেউ জানতে পারবে না...
কিন্তু বুড়ির এক কথা এই বাড়িতে তার
বাপির স্মৃতি আছে তাইএ বাড়ি সে প্রাণ
থাকতে আমোদের হাতে তুলে দিতে পারবে না। অগত্যা আমোদকে অপেক্ষা করতে হলো। আর
দেরি করা চলেনা। আমোদ মুখে
শোকের প্লাকার্ড ঝুলিয়ে, সাদা পাঞ্জাবী
পাজামা পরে রং করা গোঁফ আর চুল
আঁচড়ে তড়িঘড়ি রওনা দিলবুড়ির
বাড়ির উদ্দেশ্যে। পুরো কেসটাকে
নিজের হাতে নিয়ে নিতে হবে। ওদিকে
টোটাও বাড়িটার দিকে চোখ দিয়ে
বসে আছে।টোটা এন্ট্রি নেওয়ার আগে
আমোদের ঢোকা জরুরী। হন্তদন্ত হয়ে
বুড়ির বাড়ির কাছে এসে দেখল টোটার
মোটর সাইকেল দাঁড়িয়েআছে। বাব্বাঃ
এ যে দেখছি আমোদের আগে ঢুকে
পড়েছে।" মাসীমা গো- ও-ও তুমি আমাদের
রেখে কোথায় গেলে গো-ও-ও..." গো এর
ওপর জোর দিতে দিতে ঢুকে পড়ল আমোদ।
পাড়ার দু'চার জন এদিক ওদিক জটলা করে আছে।
আমোদ মাতব্বরী চালে বলে
উঠল, "ভিড় করবেন না, ভিড় না"...
টোটার সাথে একচোট ঝামেলা টামেলা
করে অবশেষে ঘাটের কাজ শেষ করে
ফিরতে সন্ধ্যা হল। মুখাগ্নি করল বুড়ির
এক দু:সম্পর্কের ভাইপো। সব খরচ
আমোদই করেছে। বড় কিছু পেয়ে গেলে
ছোট কিছু তো ছাড়তেই হয়।সেই সময়
ফিরে এলেও সে রাতে অন্ধকারে পাঁচিল
টপকে আমোদ ফের ঢুকল বুড়ির বাড়ি।
টিম টিম করে একটা আলো জ্বলছে
দোতলায়। বুড়ির ঘর চিনে ঢুকতে অসুবিধা
কিছু হল না। এ ঘরে আমোদ অনেক বার
এসেছে। ঘরের মেঝেতে জ্বালানো আছে
একটা প্রদীপ। প্রদীপের আলোয় ঘরের
অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়েছে।
বড় মেহগনীকাঠের কারুকার্য করা
পালংকটার পেছনে কাঠের সিন্দুকখানা রাখা। আমোদ জানে ওর ভেতরেই বাড়ির দলিলটা আছে।
আমোদের গাটা ছম ছম করে উঠল।
সিন্দুকের কাছে কে যেন দাঁড়িয়ে ছায়া
ছায়া মতো। ধুস ওসব মনের ভুল।
ছোটবেলায় শেখা ছড়াটা মনে মনে
আওড়াতে লাগল আমোদ,
"ভুত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি, রাম লক্ষণ.... "
সিন্দুকের হাতলে হাত লাগাতেই গালের
ওপর মোক্ষম এক থাপ্পড়। আর কিছু মনে
নেই আমোদের। সেই থেকে আমোদ ওই
বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁসে নি আর।
লোক মুখে শুনেছে ওখানে
আট তলা "টোটা মঞ্জিল" উঠেছে।
উঠুক তাতে আমোদের কি?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।