এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  ইদের কড়চা  ইদের কড়চা

  • শেষ অভিষেক

    স্বাতী রায়
    ইস্পেশাল | ইদের কড়চা | ২১ মে ২০২১ | ৩২০২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • সিঁড়ি ধুচ্ছিল মানোয়ারা। পাথর বসানো সিঁড়ি। ছোট ছোট হাত দিয়ে ঘষে ঘষে তুলছিল আগের দিনের পায়ে পায়ে আসা ধুলো। গোল গোল আঙ্গুলে সাবান তুলে নিয়ে লাগাচ্ছিল নাছোড়বান্দা দাগের গায়ে। ন্যাকড়া দিয়ে ঘষছিল। মগে করে জল ঢালছিল। একদম ঝাঁ চকচকে হওয়া চাই। নাহলে দাদাজান রাগ করে। গজর গজর করতে থাকে সারাদিন ধরে। আর সেই চিৎকারে দাদিজানের মেজাজ বিগড়ায়। ঝাঁঝ এসে পড়ে মানোয়ারার উপরে। রুক্ষ চুলের বিনুনি ধরে টানও পড়ে। রুটির সঙ্গে ভাজি দিতেও ভুলে যায় সেই দিনগুলোতে। তাই মানোয়ারা মন দিয়ে কাজ করে। মাঝে মাঝে একটু উঠে দাঁড়িয়ে, দূরে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দেখে, দাগ কি আর দেখা যায়? আর একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এত লোক যে কেন আসে এ বাড়িতে!

    লোক আসা যেন আরও বেড়েছে। এই কদিন ধরে। শুরুটা মইন চাচা মারা যাওয়ার পর থেকেই। দফায় দফায় লোক আসে - শুধু কথা, আর কথা, আর কথা। কত শলা পরামর্শ। মাঝে মাঝে তাদের গলা নেমে যায়। গুজুর গুজুর, ফিস ফাস। কীসব নাকি অসুখ হচ্ছে। আগে শুধু শহরে হচ্ছিল, এখন গ্রামে গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। শয়ে শয়ে লোক মরছে। দাওয়াই নেই। হাসপাতালে গেলেও কিছু চিকিৎসা হচ্ছে না। ডাক্তাররা হাত তুলে দিচ্ছে। তাদেরও কিছু করার নেই। লোকজন দম নিতে না পেরে খাবি খেতে খেতে মরে যাচ্ছে। মইন চাচাও তো সেভাবেই মরল। বুখার হয়েছিল। মানোয়ারাও গিয়েছিল দাদিজানের সঙ্গে। চাচিকে ঘিরে বসে ছিল সব মেয়েরা। গুনগুনিয়ে কাঁদছিল সবাই। বাইরের দাওয়ায় ছেলেরা সব আলাপ করছিল। মানোয়ারা দেখেছে, চাচা কেমন শ্বাস নেওয়ার জন্য আকুলি বিকুলি করছিল। মুখটা বেঁকে বেঁকে যাচ্ছিল। সপ্তাহ না পেরোতেই চাচীও বেহস্তে চলে গেল। দাদিজান বলল, আল্লা মেহেরবান। তারপরই সবার কপালে ভাঁজ পড়ল। গলায় চিন্তার দানা।

    বাড়িতে লোক এলে মানোয়ারার কাজ বাড়ে। দাদিজান উনুন থেকে কড়া নামায়। চায়ের ডেকচি চাপায়। দুধ, মশল্লা, চা পাতা। খানিক জলও। নাহলে এত চা হবে কি করে! দুধটা প্রথমে কেমন শান্ত থাকে, তারপর একটা একটা করে বুড়বুড়ি জাগে। এই একটা, ওইখানে আরেকটা, ওই যে ওইখানে আরেকটা... ভারি ভাল লাগে দেখতে। কিন্তু সে দেখার সময় পেলে তো! রান্নাঘরে চুলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই ফরমায়েস উড়ে আসে, এটা কর, ওটা কর – আর সবকিছুর শেষেই জোড়ে, “দের মত করনা! জলদি লৌট আনা!” মানোয়ারাও জানে, জলদি ফিরতে হবে। চা নামলেই বৈঠকখানায় পৌঁছান চাই। মেহমানদের ঠান্ডা চা দিলে দাদাজান রেগে যাবে। তাই ছুটে যায় মানোয়ারা, ফেরেও ছুটতে ছুটতে। স্টিলের কানা ওঠা বগি থালায় গ্লাসে গ্লাসে চা ঢেলে দেয় দাদিজান। মানোয়ারা ওড়না জড়িয়ে নেয় সারা গায়ে। সব চুল যেন ঢাকা থাকে। পুরোহাতা কামিজের হাতা আরও টেনেটুনে নামিয়ে নেয়। তারপর ধীর পায়ে দুহাতে স্টিলের থালা ধরে এগিয়ে যায় বৈঠকখানার দিকে। একটুও যেন চা চলকে না পড়ে। প্রচণ্ড মনোযোগে ছোট্ট জিভটা বেরিয়ে আসে।

    চা দিয়ে বেরোতেই মাথায় গাঁট্টা একটা। মুখ তুলে দেখে রমিজভাইয়া। মাথায় হাত বুলিয়ে মনে মনে গালি দেয় মানোয়ারা। মুখে কিছু বলার সাহস নেই। শুধু চোখ নামিয়ে বলে, জি।
    “সেদিন সাহেবুলরা যে মুর্দাটার থেকে জেবর পেল , সেটা তুই প্রথমে দেখেছিলি? ”

    ভারী গলার সরাসরি প্রশ্নে আরও ভয় পায় শরীরটা। রমিজের রাগ বাড়ির সবাই জানে। থালা বাটি ছুঁড়ে মারা তো আছেই, সেবার ছোটুকে তুলে কুয়োয় ফেলে দিতে গিয়েছিল। শেষমুহূর্তে দাদাজান আটকায়। কেঁদে কেঁদে নীল হয়ে গিয়েছিল ছোটু। কুঁকড়ে দেওয়ালের দিকে সরে যেতে যেতে মাথা নাড়ে মানোয়ারা। হ্যাঁ, দেখেছিল। সেই তো ছুটতে ছুটতে এসে বাড়িতে খবরটা দিয়েছিল। নদীর বাঁকের মুখে আটকে ছিল শরীরটা। শাড়িটা তখনও গায়ে জড়ানো। পাটা অনেকটা ফাঁক হয়ে আটকে গিয়েছিল রাইমুনিয়া ঝোপের মধ্যে। শুধু মাথাটা আধা ডোবা জলে। কালো চুলগুলো ভাসছিল জলে। মানোয়ারা পাটা টেনে একজায়গায় করতে চেষ্টা করছিল। যতই মুর্দা হোক, মেয়েমানুষ তো! এমন বেহায়ার মত পড়ে থাকলে লাজ লাগে না! কিন্তু অত গায়ের জোর কি আর ওর আছে। নড়াতেই পারল না। তারপরেই তো বাড়ির দিকে ছুটল। দাদাজানের বৈঠকখানায় তখন অনেকের জটলা। ওর মুখে শুনেই তো তারা সবাই গেল নদীর ধারে। মেলা বসে গেল প্রায়। সাহেবুলরা টেনে তুলল জল থেকে, আর তখনই তো ওটা দেখা গেল। মুর্দার নাকে ঝিকঝিকাচ্ছে বেশরটা। আর সেদিন দাদিজান খুব মেরেছিল। কেন সে বারণ করা সত্ত্বেও নদীর ধারে গিয়েছিল! বলেছিল, “মর, মর, মায়ের মত তুইও মর ।” দাদাজান রাগে গরগর করছিল। বলছিল, “বেশরম আওরত। রাস্তায় ল্যাংটা হয়ে নাচবে এরপর এই মেয়ে। যে মেয়ে নিজের ধর্ম ছাড়ে, তার রক্তে বেইমানি আছে। তার আওলাদও নিমকহারাম হবে।”

    ভারী গলাটা আবার বলল, “দাদিজানকে বলে দিয়েছি। নদীর ধারে গেলে তোকে বকবে না আর। ভাল করে চোখ চেয়ে দেখবি। যদি আবার কিছু দেখিস, আমাকে এসে বলবি। নিজে এসে বলবি, বুঝেছিস। আর কেউ যেন না জানতে পারে। যদি অবাধ্য হয়েছিস তাহলে তোকে কোঠাবাড়িতে বেচে দিয়ে আসব।” ভয়ে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মানোয়ারা। পাথরের মত। ঘাড় শক্ত করে তাকিয়ে থাকে মাটির দিকে। দেখে ছায়াটা উঠোন পেরিয়ে চলে গেল গোসলঘরের দিকে। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ কানে আসার পর আবার নড়তে চড়তে পারল। বারান্দা ধরে এক ছুটে গিয়ে আম্মির ঘরে ঢুকে পড়ল।

    ***


    আব্বুকে দেখেনি মানোয়ারা। কোনদিনই দেখেনি। আম্মিকেই দেখেছে। তাও ক’বছর আর হবে! আম্মি বেহেস্তে গেল সেও প্রায় দু বছর হবে। আম্মি’র গায়ের গন্ধটাও আর নেই। আম্মির বাক্সের মধ্যে রাখা গন্ধের শিশিটাও প্রায় শূন্য। আম্মির থেকে শিশিটা চেয়ে নিয়ে গিয়েছিল নাজনিন খালা । অনেকদিন পরে আম্মি ফেরত চাইতে গেল নিজেই। মানোয়ারাও ছিল সঙ্গে। নাজনিন খালা যখন গায়ে মোচড় দিয়ে বলল, সে তো সেই কবেই প্রায় ফুরিয়ে গেছে, মানোয়ারা স্পষ্ট শুনল, আম্মি ফিসফিসিয়ে বলল, কুত্তি। তারপর তলায় কয়েক ফোঁটা তরল পড়ে থাকা শিশিটা খালার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হনহনিয়ে ফিরে চলে এল নিজের ঘরে। আম্মির রাগ দেখে খালা খিলখিলিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ল। আম্মি কিন্তু হাসল না মোটে। মানোয়ারা আম্মিকে হাসতে দেখেও নি কখন। মুখটা শক্ত হয়ে থাকত। সবসময়। আর খুব বেশি রাগ হলে, ঠোঁটটা টিপে থাকত। সাদা হয়ে যেত মুখটা। ঠিক সেদিন প্রায়-শূন্য শিশিটা বাক্সে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে যেমন সাদা হয়ে ছিল মুখটা। আরেক দিন, কবে যেন নাজনীন খালা কাকে যেন হেসে হেসে গল্প করছিল, মায়ের বাক্সের শিশিটার গল্প। হেসে হেসেই বলছিল, মুর্দার গায়ে ঢালার আতর, তারও আদর কত। রাতে নাকি বুকের মধ্যে শিশিটাকে জড়িয়ে ঘুমায় আপা। ঘরের বাইরের বারান্দায় মানোয়ারার চুলে তেল ঘষছিল আম্মি। কথাটা কানে যেতেই মানোয়ারা ছটফটিয়ে ওঠে। কি মিথ্যে কথা, রাতের বেলা আম্মি ওকেই জড়িয়ে ঘুমায় তো। বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল। হঠাৎ মাথায় হাতটা থেমে গেল। অবাক হয়ে মুখ ফিরিয়ে মানোয়ারা দেখেছিল, আম্মির মুখটা আবার সাদা পাথর হয়ে গেছে। লাল ঠোঁট আর দেখা যাচ্ছে না। আম্মিকে এমন দেখলে খুব ভয় পেত মানোয়ারা। ভয়ে কাঁপত। দমবন্ধ হয়ে যেত। সেদিনও তাই হয়েছিল। তখন আম্মি আবার হুঁশে ফিরেছিল। ওকে কোলে টেনে নিয়েছিল, কেমন একটা ধরা গলায় বলেছিল, আতর না রে, মুন্নি, অগরু। ওটাকে অগরু বলে।

    আম্মির যখন মন ভাল থাকত, তখন আম্মি মানোয়ারাকে নিয়ে পড়ত। কাজ করতে করতেই মানোয়ারাকে দিয়ে মুখে মুখে ছড়া বলাত। দুপুরে পুরোন কাগজ দেখিয়ে পড়তে শেখাত। আর যেদিন দিনটা একেবারে অন্য রকম হত, সেদিন দুপুরে আম্মি ঘরে ঢুকে দরজায় হুড়কো তুলে দিত। তারপর বাক্স খুলে শাড়ি, জামা সরিয়ে বার করে আনত একটা মোটা বই। আর ফিসফিসিয়ে বলত, “ তোর আব্বু আচ্ছা আদমি ছিল। আমাকে খুব পেয়ার করত। অন্য লোকেরা যাই বলুক, বিশ্বাস করবি না যেন।” কি যে বলছে ঠিক বুঝতে পারত না মানোয়ারা। তাই মন দিয়ে হাতের বইটা দেখত। কিসের বই তা জানে না মানোয়ারা, শুধু তার প্রথম পাতায় লেখা ‘আশিস চৌধরি’। এই নামটা আম্মি বারে বারে লেখাত। নামটা যে আব্বুর, সেটা মানোয়ারা জেনে ফেলেছিল। আম্মিকে আর জিজ্ঞেস করার দরকার পড়ে নি। আম্মির কথায় ও শুধু বড় বড় অপটু হরফে লিখত, আশিস চৌধরি। একটা কুড়িয়ে আনা পেন্সিল আঁকড়ে। হলদেটে কাগজের উপর আবছা লেখা। আম্মি মারা যাওয়ার পর আবার একদিন কাগজের তাড়াটা নিয়ে বসেছিল মানোয়ারা। আগের লেখাগুলো আর পড়াই যায় না, এতই আবছা।
    আম্মি মারা যাওয়ার পর এই ঘরটার অলিখিত মালিক হয়ে গেছে মানোয়ারা। কে যেন একবার বলেছিল, বাচ্চা মেয়ে, একা থাকলে জিন-পরিতেও ধরতে পারে, নাজনিনের ঘরের মেঝেতে শুক বরং ও। তাতে খালা ভাগ্যিস রাজি হয় নি। খুব কেঁদে কেঁদে বলছিল, “কী দোষ করেছি আমি যে আমার ঘরে ওই বেজন্মা বাচ্চাটাকে ঢোকাতে বলছ?” এসব শুনে অভ্যেস আছে মানোয়ারার। তাই কষ্ট পায় নি, বরং হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। ঘরটা ছাড়তে হল না। সে আর আম্মির বাক্স - দুই-ই রয়ে গেল সেই ঘরে। বাক্সটাও এখন তার হেফাজতে। আম্মির কটা জামা কাপড়, আর আব্বুর শুধু ওই বইটা। আর ওই ফাঁকা শিশিটা। সেই সঙ্গে থাকে নাজনিনের বলা টুকরো টুকরো কেচ্ছাসমূহ। শূন্য ঘরের অদেখা তৃতীয় বাসিন্দা হয়ে। সে গল্পে আশিস চৌধরি বাজে লোক। কথাবিষ জমা হয় ঘরের বাতাসে। আম্মির বলা কথাগুলোর প্রতি বিশ্বাসটা কি কমে আসে একটু? আম্মিই যদি ঠিক হবে, তাহলে বাড়ির সবাই আব্বুকে দুশমন ভাবে কেন?

    আজও রমিজভাইয়া ভয় দেখানোর পরে সেই ঘরেই ছুটে এসে ঢুকল। বুকটা এখনও ধুকপুক করছে। ভয় কাটাতে খানিক ঘরের জিনিসপত্র গোছগাছ করল। তারপর ছোট হাতে টেনে টেনে বালিশ বিছানা বারান্দার রোদে দিয়ে এল। আম্মির কাছেই শেখা এসব। তারপর সেই পুরোন কাগজের তাড়াটা টেনে নিয়ে এল। স্কুলে যায় না ও। আম্মির ইন্তেকাল হওয়ার পরে কেউ আর সেকথা ভাবে নি। আম্মির কাছে শেখাটুকুই সম্বল। তেঁড়াবাঁকা হরফে লিখতে বসল। আশিস চৌধরি। আনোয়ারা বেগম। ওইটুকুই দৌড়। লেখে আর দেখে। দেখে আর লেখে। ক্রমে ভয়টা কাটল। ঘরে বসে থাকলে তো আর চলবে না। এই যে বেসময়ে ঘরে এসে বসে রইল, এর জন্যই কপালে আজ কি আছে কে জানে! বেলা হল, স্নান সেরে এসে খাওয়ার যোগানে লাগতে হবে। উর্ধ্বশ্বাসে খিড়কির দিকে ছুটল মানোয়ারা। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথটা এঁকে বেঁকে চলে গেছে নদী অবধি। এ জমিনও দাদাজানের। জঙ্গলের দুধারে টানা তারজালের বেড়া। নদী অবধি প্রায়। বাইরের লোক কেউ থাকেই না। তাও যে কেন দাদিজান নদীতে গেলেই গালি দেয়!

    ***


    তবে বলে না, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যে হয়। নদীর ধারা এখানে তেমন তেজালো না। মাঝে মাঝেই চরও আছে। ও যেখানে জলে নামে, তার ডানহাতে একটু দুরেই তেরচা করে একটা চর। সেই চরের গায়েই ঠেকে আছে দেহটা। দেখেই শিউরে উঠল মানোয়ারা। রমিজভাইকে খবর দেওয়ার সময়টা এত তাড়াতাড়িই আসতে হল! একটুও ভাল লাগে না রমিজভাইয়াকে। ভয় লাগে। তবু বাড়ি ফিরতে হল, চুপচাপ বাড়ি এসে রমিজভাইয়ার ঘরের দরজায় দাঁড়াতে হল। অমান্য করলে কি হবে সেটা এখনও কানে বাজছে।
    খবরটা শুনেই লাফিয়ে উঠল রমিজ। জান্তব বেপর্দা উল্লাস! দেখে অবাক হয় মানোয়ারা। তখুনি তাকে টানতে টানতে নদীর দিকে ছুটল রমিজভাইয়া। তার আগে অবশ্য নিজের ইয়ারদোস্তদের খবর দিতে ভোলে নি। মানোয়ারাকে সঙ্গে আনা জায়গাটা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। সেটা দেখিয়ে দেওয়া হয়ে গেলেও অবশ্য মানোয়ারা সরতে পারে না। কি করবে ওরা মুর্দা দিয়ে? জেবর খুঁজবে? কৌতুহল প্রবল, তাই একটু দূর থেকে দেখতে থাকে। কাছে যাওয়ার সাহস নেই।

    লাশটা পরে ছিল উপুড় হয়ে। মাথাটুকুই চরে। বাকি প্রায় পুরো শরীরটাই জলের মধ্যে। কাদা মাখা। এরা হইহই করতে করতেই লাশটা টেনে তোলে জলের থেকে। তারপর চিত করে শুইয়ে দেয়। সবাই মিলে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। তারপর একসময় ‘মিল গ্যয়া’ জান্তব উল্লাসে ফেটে পড়ে দলটা! এক কানে একটা মাকড়ি রয়েছে। সেইটা ছিঁড়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর তখনই একজন বলে ওঠে, “আবে, ইয়ে শম্ভুকা লাশ হ্যায় ক্যা?”
    “শম্ভু? কৌন শম্ভু?”
    “উয়ো যো বাজারমে আতে থে না, শরাব পিকে পুরা টং হোকে, উস দিন জমিলকে সাথ পাঙ্গা লিয়া থা, ইয়াদ আয়া?”
    “ হাঁ ইয়াদ আয়া, শ – ম - ভু – চৌ – ধ – রি, হাঁ ... শালে ইয়ে মর গিয়া, অব জমীল বদলা ক্যায়সে লেগা ..” . হাসির হররা ওঠে দলটার মধ্যে। দলের একজন বলে ওঠে “লেকিন উও ডোম থা না – দেখ আভি খুদ হি মুর্দা বন গ্যয়া – জ্বালানেকা ভি কোই নেহি মিলা” - চুক চুক শব্দ ওঠে। সে শব্দে যতটা দু;খ, তার থেকে মৃতের অসহায়ত্বে মজা বেশি। মুসলমান হলেও লাশ নিয়ে একটা মাথা ব্যথা থাকত হয়ত। এতো হিন্দুর মুর্দা! কাজেই আর কোন চক্ষুলজ্জা থাকে না রমিজ আর তার দোস্তদের। নদী এনে ফেলেছে, নদীই টেনে নিয়ে চলে যাবে। গয়নাটা সযত্নে পকেটে পুরে লাশটা ঠেলে সরিয়ে দেয়। তারপর আবার হাসির হররা তুলে রমিজের দলবল ফিরে যায় গ্রামের দিকে। মানোয়ারার দিকে ফিরেও তাকায় না।
    নামটা শুনে কেমন যেন লাগে মানোয়ারার। শম্ভু চৌধরি? চৌধরি! চলে যেতে গিয়েও পায়ে পায়ে ফিরে আসে মানোয়ারা। লাশটার দিকে চেয়ে থাকে। এ কি মানোয়ারার আব্বুর কেউ হয়? ভারি কৌতূহল হয়। আব্বুকে কেমন দেখতে ছিল মানোয়ারা জানে না। আম্মির বাক্সে একটা ফটোও নেই আব্বুর। একদিন জানতে চেয়েছিল, খালার কাছে। সে কথা শুনে খালা হেসেই অস্থির, বলে, কেমন দেখতে ছিল আবার কী! হিন্দুদের মত দেখতে ছিল! কথাটা বিশেষ বোঝে নি মানোয়ারা। এখন সেটা বিদ্যুৎ চমকের মত মাথায় ঝলসায়। এই লোকটাও তো হিন্দু, আবার চৌধরিও - তাহলে কি আব্বুকে খানিকটা এই লোকটার মতই দেখতে ছিল? লোকটাকে দেখতে চেষ্টা করে। ভাল করে দেখতে পায় না। বড্ড কাদা লেগে আছে। একটু একটু করে কাছে আসে। একটু জল দিয়ে ধুতে পারলে ভাল হত। কিন্তু মুর্দা ছোঁবে? চুপ করে বসে থাকে। তারপর একসময় হাতটা এগিয়ে যায়। লোকটার গায়ে লাগে। ঠাণ্ডা, শক্ত শরীর। চট করে সরিয়ে নেয় হাতটা। একটু দূরেও সরে যায়। তবু শেষে কৌতূহল জয়ী হয়। আবার কাছে আসে। ছোট ছোট হাতে কাদা সরাতে থাকে শরীর থেকে। নদীর জলে নেমে যায় । আঁজলায় করে জল এনে এনে গায়ে ঢালে। ওড়না ভিজিয়ে আনে নদীর থেকে। গা-হাত-পা-মুখ মুছিয়ে দিতে চেষ্টা করে। গঙ্গার জলে ধৌত হয় শম্ভু ডোমের শরীর। একটু একটু করে নাক-মুখ-চোখের আদল স্পষ্ট হয়। মানোয়ারা চোখ দিয়ে শুষে নিতে থাকে – কানের খোঁজ, থুতনির ভাঁজ, নাকের গড়ন... সব সব। আব্বুর মতন কী? কোন জায়গাটা আব্বুর মতন? কেই বা বলে দেবে! কেউ বলে দেয় না। তবু মানোয়ারার মনে হতে থাকে, তার আব্বুকে বোধহয় এমনই দেখতে ছিল। যত দেখে ততই বদ্ধমূল হয় ধারণা। এমনই হাট্টা-কাট্টা সা-জোয়ান। এমনই নাক-মুখ-চোখ! আব্বু! আমার আব্বু! কখনও না-পাওয়া আব্বুর আদরের জন্য মন আকুল হয়। টলটলে মুক্তো দু এক ফোঁটা ঝরে পড়ে শম্ভু চৌধরির মৃতদেহের গায়ে। পিতৃস্নেহকাতর অনাথ কচি হাতটা রাখে ঠান্ডা, শক্ত, মৃত গালের উপর। মায়া জড়িয়ে যায়। বড় আপনার মনে হয় অচেনা মানুষটাকেও। আহারে এভাবে পড়ে থাকল, কেউ মানুষটাকে গোরও দেবে না? আর তখনই নিজের মনেই জিভ কাটে, হিন্দুদের তো গোর দেয় না, পোড়ায়। আবার চিন্তায় পড়ে, পোড়াতে তো অনেক কাঠ লাগে, আগুন লাগবে – সে আর পাবে কোথায়! বাড়িতে মোটে এসব কথা বলা যাবে না। দাদাজান শুনলে চ্যালাকাঠ দিয়ে ওকেই পেটাবে। ঝিমিয়ে পড়ে একটু। তবে কি কিছুই করা যাবে না? আব্বুর মতন দেখতে লোকটা এইভাবে পড়ে থাকবে? তারপর কি যেন মনে পড়ে, মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আতর, হ্যাঁ আর কিছু না হোক একটু আতর তো ঢালতে পারে মানোয়ারা মানুষটার গায়ে। হিন্দুদের মুর্দার গায়ে গন্ধ ঢালে তো। ফের বাড়ির দিকে ছোটে মানোয়ারা। আম্মির বাক্সের থেকে গন্ধের শিশিটা নিয়ে আসতে হবে। হাওয়ায় হাওয়ায় আম্মি ফিসফিসিয়ে ওর কানে কানে বলে, আতর না রে মুন্নি, অগরু।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ২১ মে ২০২১ | ৩২০২ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ঘন্টাঘর - একক
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ২১ মে ২০২১ ১৮:০৬106233
  • এই সময়ের গল্প। হিংস্রতার গল্প,  অসহায়তার গল্প। খুব খুব  ভাল লাগল স্বাতী। 

  • রুনা মুমুখার্জি | 182.66.***.*** | ২১ মে ২০২১ ২৩:১২106258
  • অদ্ভুত কষ্ট হল গল্পটা পড়ে। 

  • Prativa Sarker | ২২ মে ২০২১ ১৭:৩২106287
  • খুব সাহসী গল্প। সমসাময়িকতার চিহ্ন সর্বাঙ্গে বহন করা গল্প। 

  • সম্বিৎ | ২৪ মে ২০২১ ০৯:৪৬106386
  • এই গল্পটার ডিটেলের জন্যেই গল্পটা মনে থাকবে। চাক্ষুস করা যাচ্ছে।

  • ইন্দ্রাণী | ২৪ মে ২০২১ ১৪:৫৮106395
  • লেখার উদ্দেশ্য মহান। গল্পের ভাল মন্দ বিচার অর্থহীন। সমালোচকের চশমা খুলে রেখে পড়েছি।
    একটি সিরিজ করার অনুরোধ রইল।

  • স্বাতী রায় | 117.194.***.*** | ২৬ মে ২০২১ ১৫:১৩106433
  • সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। 


    @ইন্দ্রাণী সমালোচনা পেলে খুশিই হতাম। নিজের লেখার কিছু ত্রুটি বোঝা গেলেও সব তো আর যায় না। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন