এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  গপ্পো

  • জোম্বিদ্বীপের কথকতা (পর্ব ২)

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | গপ্পো | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৯৬১ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • | |
    পাপীজনশরণ প্রভু !

    আচ্ছা, বয়স্ক লোকগুলো কি একটু বোকা হয়? সবার কথা বলছি না, আমার বাবা মোটেই বোকা ছিলেন না। মঙ্গলা পঞ্চায়েতের কত লোকজন ওনার কাছে পরামর্শ নিতে আসে। কিন্তু যারা একটু ফ্রাস্টু গোছের? যেমন ধরুন গ্রামীণ ব্যাংকের সকরী শাখার হেড ক্যাশিয়ার বিনোদ আংকল? আমি ওনার ব্যাংকে একটা রেকারিং ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট খুলেছি। প্রতি মাসে দশ তারিখে গিয়ে একশ টাকা জমা করে আসি। উনি আমাকে লাইনে দাঁড়াতে দেন না। পাশের চেয়ারে বসিয়ে চা খাওয়ান, বাড়ির সবার কুশল মঙ্গল জিজ্ঞেস করেন। অন্য একজন সব কাজ করে পাশবুকে এন্ট্রি করে আমার হাতে ধরিয়ে দেয়। আমি নমস্তে বলে চলে আসি। উনি নাকি আমার বাবার ব্যাডমিন্টন খেলার পার্টনার।

    কিন্তু ইদানীং আংকলের কথাবার্তা কেমন যেন অচেনা লাগছে। আমাকে কথায় কথায় বলেন আমি নাকি হঠাৎ বড় হয়ে যাচ্ছি। খুব সুন্দর হয়ে উঠছি! বাবার বন্ধুর মুখে এসব কথা যে আমার ভাল লাগছে না তা’ কি উনি বুঝতে পারেন না।

    লোকে কিন্তু আমাকেই বোকা বলে। কারা বলে? অনেকেই, যেমন আমার বন্ধুরা, ওদের বিশেষ চুটকুলা শুনে আমার হাসি পায় না বলে। মা বকে - তুই বড় হচ্ছিস, এখন অমন মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়িয়ে পাড়ার যত বখাটে বাপে-খেদানো মায়ে-তাড়ানো ছেলেগুলোর সঙ্গে ডান্ডা-গিল্লি খেললে চলবে? আর দ্যাখ, বাইরের লোকজনের সামনে অমন হ্যা-হ্যা করে মুখ খুলে হাসতে নেই।

    মুখ বন্ধ করে আবার হাসা যায় নাকি?

    বোকা মেয়ে, বুঝতে পারিস না কি বলছি? তোর জন্যে আমার যে লজ্জায় মাথা কাটা যায়।

    মা’র ওই এক কথা। বোকা মেয়ে, তোর জন্যে আমাদের নাক কাটা যাবে।

    একদিন বললাম — মাথা আর নাক তো কাটা হয়েই গেছে। এবার গলা আর কানের কথা ভাব। এসব বলার ফল যে ভালো হয়নি সেটা না বললেও চলে।

    সেবার স্কুলের মাঠে টিফিন খাওয়ার সময় অনিতা নতুন চুটকুলা শোনাচ্ছিল।

    ‘এক বোকাসোকা গাঁয়ের ছেলে সুহাগরাতে বৌকে দেখে চোখ বড় বড় করে বলল — তোমার বুকে ওদুটো কী? বৌ লজ্জা ঢাকতে বলল - ফোঁড়া বেরিয়েছে। ওর বর অবাক হয়ে বলল - ফোঁড়া তো বুকে বেরিয়েছে, ফোঁড়ার মুখ নীচে খুলল কী করে’?

    ব্যস, সবাই হা-হা, হি-হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ল। আমি কিছু বুঝতে না পেরে জানতে চাইলাম এতে এত হাসির কী হল? সবাই আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। আমি এত বোকা যে ওদের নাকি ‘মজা কিরকিরা’ করে দিয়েছি। আমি বললাম - ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি। ফোঁড়ার গল্পে হাসির ব্যাপারটা তো বলে দাও। ওরা বলল - এখন যা, বাড়ি গিয়ে তোর মাকে জিজ্ঞেস করিস।

    রাত্তিরে হোমটাস্ক হয়ে গেলে রান্নাঘরে মাকে রুটি সেঁকতে সাহায্য করতে গেলাম। মা বেলে দিচ্ছে, আমি তাওয়ায় গরম করে তারের জালিতে দিয়ে ফুলে উঠলে থালায় নামিয়ে ঢেকে রাখছি।

    মা, একটা কথা। ক্লাসে বন্ধুরা আমাকে একঘরে করে দিয়েছে। ওদের একটা হাসির গল্পে আমার হাসি পায়নি বলে। আমি নাকি খুব বোকা। তোমায় বলি?

    তারপর গল্পটা মাকে শোনালাম।

    এবার বল এতে হাসির কী হয়েছে।

    মা ব্যাজার মুখে আমাকে দেখল। তারপর রুটি বেলতে বেলতে বলল — তোর হাসতে হয় হাসিস, কাঁদতে হয় কাঁদিস, আমাকে জ্বালাস নে। এমন হদ্দ বোকা মেয়ে আমার ঘরেই –।

    কিন্তু আমার জিদ চেপে গেছল। তাই আনোয়ারকে ধরলাম। অ্যাই, এই চুটকুলায় হাসির কী আছে বল দিকি? আর যদি তুইও আমাকে ‘বেওকুফ লড়কী’ বলেছিস তো আজ তোরই একদিন কী আমারই! আমি স্কুল লেভেলে কাবাড্ডি আর ভলিবলের ক্যাপ্টেন। এক হাত যদি ধরে দিই না, গালে পাঞ্জা-ছাপে-ভোট হয়ে যাবে।

    বিলাসপুর শহরের পশ্চিমে আমাদের মঙ্গলা গাঁয়ের পেছনভাগে অরপা নদীর নতুন পুল। এখান দিয়ে এখনও গাড়ি চলাচল শুরু হয় নি। সূর্যডোবার একটু আগে আমরা ওখানে পুলের রেলিঙয়ে চড়ে বসলাম।

    আনোয়ারের বাবা আরিফ চাচার আমাদের গাঁয়ে সবচেয়ে পুরনো টায়ার পাংচার সারাবার দোকান, বাস স্টপের পাশে। ওর বোন সাকিনা আমার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। দুই বাড়িতে আমাদের অবাধ যাতায়াত, সেই বচপন থেকেই। ঈদের দিনে ফিরনী ও সেমাইয়ের পায়েস, হোলির মিঠাই। আমরা জানি যে ওরা মুসলিম, আমরা হিন্দু। কিন্তু এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই জেনেছিলাম, যেমন আমি ও সাকিনা মেয়ে, আনোয়ার ছেলে।

    একদিন কানে এল দাদিমা আমার মাতারামকে বলছেন — বহু, সুনীতা বড় হচ্ছে। কিছুদিন পরে বিয়ে দিতে হবে। এখন থেকে চোখে চোখে রাখতে হবে। ওকে আটকাও, যখন তখন ম্লেচ্ছদের বাড়ি যেতে দিও না।

    মা নীচু গলায় কী যে বলল শুনতে পাইনি। তবে এরপর থেকে যেন মায়ের মুখে ‘নাক কাটবি, কান কাটবি’ অভিযোগ বেশি বেশি শুনতে পাচ্ছিলাম।

    আনোয়ার আমার চেয়ে তিন বছরের বড়, একই স্কুলে উঁচু ক্লাসে পড়ে। আগে যখন আমি ও সাকিনা একসঙ্গে স্কুলে যেতাম তখন ও আমাদের গার্জেনের মত আগলে রাখত। ইদানীং আগলানোর দরকার না থাকলেও কোন সমস্যা হলে আমি ওকেই সব খুলে বলি। আগে ‘ভাইয়া’ বলতাম, গতবছর থেকে বড়দের সামনে বলি, আড়ালে নাম ধরে ডাকি। আর রাখি বাঁধার প্রশ্নই ওঠেনি। ঠোঁটের উপর গোঁফের রেখা দেখা যাচ্ছে। একদিন জিজ্ঞেস করেছিল কেমন দেখাচ্ছে? আমি বলেছিলাম — মনে হচ্ছে নাকের নীচে এঁটো ডাল শুকিয়ে আছে। খেপে গিয়ে যা তাড়া করেছিল না, আমি পালাতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেলাম। হাঁটুর কাছটায় ছড়ে গেছল।

    আনোয়ার টেনে তুলে যেই দেখল রক্ত বেরিয়েছে অমনই ঘাবড়ে গিয়ে কাছের আরএমপি ডাক্তারখানায় নিয়ে ব্যান্ডেজ করে টিটেনাস লাগিয়ে সে এক কান্ড। তারপর থেকে মাঝে মধ্যেই আমরা দু’জন অরপা নদীর পুলের কাছে সপ্তাহে এক-আধ দিন ‘মিট’ করতাম। প্রথম প্রথম সাকিনাও সঙ্গে আসত, আজকাল আর আসে না।

    সে যাই হোক, আনোয়ার নদীর পুলে চড়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা সিগ্রেট ধরাল। তারপর মুরুব্বির ঢঙে বলল — কই, শুনি কিসের হাসির গল্প?

    তারপর বুকে ফোঁড়া বেরোনোর চুটকুলা শুনে ওর রেলিং থেকে নদীতে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। সেকী হাসি, হেঁচকি তুলে হাসছে তো হাসছেই।

    আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। শেষে জিদ করলাম — ঝেড়ে কাশো দিকি। এত হাসির কী আছে?

    - সে তোকে বলতে পারব না। এসব মেয়েদের বলা যায় না।

    - বলা যায় না, কিন্তু হাসা যায়? আরে এটা তো মেয়েদের আড্ডারই জোকস? তুমি তো আচ্ছা বোকা!

    - আসলে আমি ভাবতাম এসব কথা খালি ছেলেরাই বলে। মেয়েরা অনেক সভ্যভব্য হয়।

    আমি একটা ইঁটের টুকরো কুড়িয়ে নিই। আমরা সভ্যভব্যই, কিন্তু খুলে না বললে ইঁট মেরে ওর মাথা ফাটিয়ে দেব। একটা চন্ডাল রাগ আমার ভেতরে দলা পাকিয়ে উঠছে।

    শেষে ও গল্পটার ভেতরের ব্যাপারটা খুলে বলল। তারপর আমরা দুজনেই চুপ। এরকম কথাবার্তা আগে কারও সঙ্গে বলিনি। সাকিনার সঙ্গেও না।

    তারপর অস্বস্তি কাটাতে আমি বললাম — জান, মেয়েরাও ছেলেদের সম্বন্ধে ওরকমই ভাবে।

    - মানে?

    - আমাদের বন্ধুদের মধ্যে আরও একটা হাসির কথা চলে, শুনবে? ধর একজন বলল, “লড়কে লোগ আপস মেঁ ইতনী ক্যা বাত করতে হ্যায়”? অন্যজন বলবে, “ওহি, যো হমলোগ করতে হ্যায়”।

    তারপর সবাই বলবে, “ছি, কিতনে বেশরম হ্যায়”। ব্যস, হাহা-হিহি শুরু।

    ছেলেরা নিজেদের মধ্যে এত কী কথা বলে রে? আরে, আমরা যা বলি তাই।

    ছিঃ, কী অসভ্য রে বাবা!

    এভাবেই কী করে যেন আমরা কখন সচেতন হয়ে উঠলাম যে আমি এক ‘অওরত’ আর আনোয়ার হল এক হাট্টাকাট্টা ‘জোয়ান-মর্দ’। পাড়া-প্রতিবেশিদের জিভ নড়তে শুরু করল। দুইবাড়ির বাবা মায়ের টনক নড়ল। বাবা ওদের বাড়িতে ধমকাতে গেল। আরিফ চাচা বাবাকে বলল — নিজের মেয়েকে সামলান জনাব।

    ও বাড়িতে আনোয়ার আর এ বাড়িতে আমি বেধড়ক ঠ্যাঙানি খেলাম। দু’বাড়ির সম্পর্ক তেতো হল।

    আমার ঘর থেকে বেরোনো বন্ধ হল। তখন বুঝতে পারলাম আমি আর আনোয়ার দুজনে দুজনার জন্যেই জন্মেছি। আমরাই অ্যাডাম ও ঈভ। আনোয়ার আমাকে শুধরে দিল — অ্যাডাম ও ঈভ তো সায়েবদের ব্যাপার। আমরা হলাম বাবা আদম ও বিবি হবা।

    গোপনে ঠিক করলাম এখানে আর না। আমরা নাগপুরে পালিয়ে গিয়ে ঘর বাঁধব। আনোয়ার টায়ার পাংচার সারানো কোল্ড ও হট ট্রিটমেন্ট এবং খানিকটা ইঞ্জিনের কাজ জানে। কোনও গ্যারেজে ঠিক কাজ পেয়ে যাবে। ওর বয়েস আঠেরো পেরিয়ে চার মাস। আমি তো পনের পেরিয়েছি। খালি স্কুলের মার্কশীট সঙ্গে নিতে হবে। ট্রেনভাড়া ও কিছু টাকা পয়সা আনোয়ার ম্যানেজ করবে। ওর বন্ধুরা আছে। নাগপুরে ওর এক বন্ধুর মামা আছেন। প্রথমে ওখানে গিয়ে ওঠা হবে।

    এখন বুঝতে পারি সত্যি কত বোকা ছিলাম। হ্যাঁ, মা যেমন বলত — হদ্দবোকা।

    নাগপুরে বন্ধুর মামুজানের বাড়িতে গিয়ে পাঁচটা দিনও কাটেনি, ভোরবেলা পুলিশ এসে হাজির, সঙ্গে আরিফ চাচা ও আমার বাবা। টের পেলাম মামুজানই ফোন করে বিলাসপুর পুলিশকে খবর দিয়েছিলেন। আরও জানলাম যে আমি ও আনোয়ার দুজনেই আইনের চোখে মাইনর, বিয়ে করার যোগ্য নই। আমি তো জানতাম, মেয়েরা চোদ্দ বছর হলেই বিয়ে করতে পারে। কিন্তু আইন নাকি বদলে গেছে। এখন মেয়েদের আঠেরো আর ছেলেদের একুশ। আচ্ছা, আঠেরো বছর বয়সে ভোট দিতে পারবে, দেশের হয়ে বাইরে গিয়ে খেলতে পারবে কিন্তু নিজের গাঁয়ে বিয়ে করতে পারবে না? এ কেমনধারা আইন? সত্যি, সবাই বোঝে, শুধু আমার মত বোকারাই বুঝতে পারে না।

    আরিফ চাচা দেখলেন যে যা ঘটেছে তা পুলিশের চোখে গুরুতর অপরাধ। এতে আমার কিছু হবে না, কিন্তু আনোয়ারের উপর নাবালিক অপহরণ, ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ম পরিবর্তনের জন্যে জোর করা এবং গাঁয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ বাড়িয়ে শান্তিভঙ্গের ষড়যন্ত্র—এইসব চার্জ লাগানো হয়েছে। এতে দশবছর অবধি জেল হতে পারে।

    আমি বাবার কথায় চারপাঁচটা হাতে লেখা ও টাইপ করা কাগজে সই মেরে দিয়েছি। ওসব নাকি বিনা ঝামেলায় বাড়ি ফেরার জন্যে দরকার। আনোয়ারকে দেখলাম দুজন পুলিশ শক্ত করে চেপে ধরে রয়েছে। ওর দিকে তাকালাম। ও পাথর মুখ করে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ।

    আরিফ চাচা বাবার পা’ জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন - বাচ্চা হ্যায়, গলতি কর ডারে। বহুত বড়ী গলতি। গুণাহ কবুল। কিন্তু এতবড় সাজা দেবেন না। আপনাদের নুন খেয়েছি, সকরি গ্রামে তিনপুরুষের বাস। সুখে দুঃখে কেটে গেছে এত বছর। কেস তুলে নিন। আমি সাতদিনের মধ্যে পরিবার নিয়ে আপনাদের গাঁ ছেড়ে চলে যাব।‘পুরখো কে জমিন জায়দাদ ওনেপৌনে ভাও মেঁ’ বেচে দেব। পূর্বপুরুষের জমিজমা ভিটে সব জলের দরে ছেড়ে দেব। আপনিই নিয়ে নিন। উঠে যাব অন্য কোথাও।কিন্তু নালিশ তুলে নিন। আমাদের মাফ করে দেন। আল্লাহ আপনাকে অনেক বরকত দেবে। রহম করুন, একটু দয়া করুন।

    একটা ঘোরের মধ্যে বাড়িতে ফিরে এলাম। কিন্তু আমাকে মূল বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হল না। গোয়ালঘরের পাশে একটা ঘরে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে দেয়া হল। কানে এল আমি নাকি অপবিত্র, আমি ম্লেচ্ছ ছোকরার ঝুঠন বা এঁটো। কিন্তু ওই ঘরে আলো নেই। মেজেতে গোবরের গন্ধ, মশা কামড়াচ্ছে। রাত্তিরে কেউ তালা খুলল। সামনে ভাতের থালা নিয়ে সুশীলা রওতাইন, পেছনে লন্ঠন হাতে মায়ের কঠিন মুখ, বয়েস বেড়ে গেছে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। মা লন্ঠনটা নামিয়ে চলে গেল। সুশীলা আমার কথার কোন উত্তর দিল না। খাওয়া হয়ে গেলে তালা লাগাতে লাগাতে বলল — জ্যায়সী করণী, ঐসী ভরণী। যেমন কম্ম তেমন ফল।

    এভাবে দু’দিন কেটে গেল। তিনদিনের মাথায় দুপুর বেলায় বাবা-মা এল। বলল, সেই গোটা পরিবারের নাক কাটিয়ে ছাড়লি? তোকে স্কুলে পাঠানোই ভুল হয়েছে। আগেই বিয়ে দেয়া উচিত ছিল।

    বিকেলে বাবা এল, সঙ্গে দেখি বাবার বন্ধু বিনোদ আংকল, সেই ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। আজকে উনি আমাকে দেখে হাসলেন না। ঘরের কোণায় একটা গরুবাঁধা দড়ি পড়েছিল। সেটা টেনে এনে ছাদের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে লাগলেন। যাকগে, আমি বাবার কথায় কান দিলাম। বাবার গলার স্বর আজকে অনেক নরম।

    - দেখ তো মুন্নি, কী কান্ড বাঁধিয়েছিস! যতই চাপাচাপি করি কথা ছড়িয়ে যায়, সার পচলে গন্ধ ছড়ায়। আমি সাত গাঁয়ের যে বড়সড় পঞ্চায়েত, তার সরপঞ্চ। পাঁচকোশের মধ্যে সবাই আমায় এক ডাকে চেনে। ন্যায়বিচার চাইতে আদালতের ঝামেলায় না জড়িয়ে আমার কাছে আসে। শেষে কিনা আমার ঘরেই এই কান্ড! সবাই বলছে জাতধর্ম বলে কিছু রইলনা। আমায় রাজধর্ম পালন করতে হবে। সেখানে বাকি সব তুচ্ছ।

    বাবা কী বলতে চাইছে? আমার কেমন ভয় ভয় করছে।

    একটা খট করে শব্দ।

    ভেজানো দরজা ঠেলে মা ঢুকেছে। ভেতর বাড়ি থেকে একটা কাঠের টুল তুলে এনেছে। ওটা নামিয়ে দরজায় শেকল তুলে দিল। মা তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। বাবা তাকাল বিনোদ আংকলের দিকে। আংকল দড়িটা দিয়ে একটা ফাঁস বানিয়ে টেনে দেখছে। বাবা মা’র দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল। মা আমার দিকে এগিয়ে এল। আমি কিছু বোঝার আগেই আমার মুখ চেপে ধরে ওড়নাটা মুখে ঠুসে বেঁধে ফেলল। আমি চেঁচাতে চাইলাম, হাত-পা ছুঁড়লাম, কোন লাভ হল না। আমাকে আংকল আর মা ঠেলে মিলে টেনে নিয়ে কড়িকাঠের নীচে দাঁড় করাল। আংকল লম্বা দড়ির আরেক মাথা ছুঁড়ে কড়িকাঠের বীমের উপর দিয়ে গলিয়ে এনেছে। তারপর গলায় ফাঁসটা পরিয়ে কষে টান। আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এবার বাবা-মা মিলে আমায় জোর করে টুলের উপর দাঁড় করিয়ে দিতেই আংকল দড়ির ওদিকের মাথাটা কামরার ভেতরের কাঠের থামের গায়ে শক্ত করে বেঁধে দিল। তারপর বাবা আমার টুলের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে কাঁদতে শুরু করল।

    আমায় মাপ করিস মুন্নি। কিন্তু আমাকে ন্যায় করতে হবে। রামজী সীতাজীকেও আগুনে ঝাঁপ দিতে বলেছিলেন। আমি অসহায়।

    একধাক্কায় টুল সরে গেল। আমি এখন শূন্যে, আমার গলা লম্বা হয়ে যাচ্ছে।

    সেই রাত্তিরেই আমাকে নদীর পাড়ে পঞ্চায়েতের শ্মশানে দাহ করা হল। আমার কোভিড হয়েছিল নাগপুরে বেড়াতে গিয়ে। জ্বর ও শ্বাসকষ্ট, তিনদিনের বেশি সময় দিল না ওই মহামারী। ডাক্তারের সার্টিফিকেট তৈরি ছিল।

    হাওয়ায় ভেসে ভেসে দেখছি আমার শ্রাদ্ধ হচ্ছে। কোভিডের রেশ মিলিয়ে যায়নি। তবু ভিনগাঁয়ের লোকজন খেতে এসেছে। বিনোদ আংকল খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছেন। পুরি ও পনীরের সবজি কয়েকবার করে নিলেন। শেষপাতে গাজর কা হালুয়া।

    কিন্তু নিয়মমত দাহ হলে আমি আজ হাওয়ায় ভেসে নিজের শ্রাদ্ধ দেখতে পেতাম কী করে? আসলে হাসপাতাল থেকে একটি বেওয়ারিশ লাশ এনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আমি চালান হয়ে যাই মর্গে।হিমঘরে তিনদিন। বেশ মজা, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি আমার বাবার জন্যে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। আমাকে কত ভালবাসত তা তো জানি।

    শ্রাদ্ধের পরের দিন আমি চালান হয়ে গেলাম আরেক শহরের হিমঘরে। সেখান থেকে জাহাজে চড়ে প্রায় পাঁচদিনের সফর। কাল মাঝ রাত্তিরে স্টিমার থেকে আমায় একটি দ্বীপে নামিয়ে আনা হয়েছে। শুনছি কাল অমাবস্যার রাতে এই নাম-না-জানা জায়গায় একটা বড়সড় যজ্ঞ হবে। আগুনের তাপে গলবে বরফ, পুড়ে যাবে যত পাপতাপ । ম্লেচ্ছের উচ্ছিষ্ট অপবাদ থেকে মুক্ত হব, পবিত্র হব। অপেক্ষায় আছি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | |
  • ধারাবাহিক | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৯৬১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন