দীর্ঘ পদযাত্রা বলতে আমার প্রথমেই মনে আসে গান্ধিজীর ডান্ডি অভিযান। ইংরেজের লবণ আইনের প্রতিবাদে ২৪ দিন ধরে পায়ে হেঁটে ৩৮৫ কিলোমিটার অতিক্রম করার গল্প। স্কুলের ইতিহাস বইয়ে পড়া লম্বা রাস্তা হেঁটে পেরোনর ঐ গল্পের পর আবার লকডাউনের সময় অভিবাসী শ্রমিকদের হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরার গল্প চমকে দিল মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত ভারতকে। ডান্ডি অভিযান আর লক ডাউনের মাঝেও রয়েছে অজস্র হাঁটার গল্প আমার আপনার চোখের আড়ালে। জলের জন্য হাঁটা, স্কুলে যাওয়ার জন্য হাঁটা। কাজ খোঁজার জন্য হাঁটা, কাজ হারিয়ে হাঁটা। কখনও ভালবাসার গল্প কখনও বা মৃত্যুর ঘ্রাণমাখা অন্তহীন হাঁটার গল্প মিশে রয়েছে এই দেশের এক বড় সংখ্যক মানুষের যাপনে।
বুন্দেলখন্ডের সাতনা জেলার রাজোলা গ্রামের মেয়েদের পড়াশোনা শেষ হয় ক্লাস ফাইভে উঠলেই। কারণ মনে করা হয় ঐ বয়সে মাথায় দুটো মাটির কলসি পরপর বসিয়ে হাঁটার ক্ষমতা হয়ে যায় মেয়ের। আর এই ক্ষমতার সদ্ব্যবহার ভিন গাঁ থেকে জল আনার কাজেই হওয়া উপযুক্ত বলে মনে করেন সেখানকার বাসিন্দারা। এই গ্রামের মেয়েদের বিয়েও হয় হাঁটতে পারা এবং জল আনতে পারার ক্ষমতার উপরে ভিত্তি করেই। মেয়েদের রূপ এখানে তেমন কোনও গুরুত্ব পায় না। উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের সীমান্ত অঞ্চল ঝাঁসি, চম্বল ইত্যাদি এলাকায় ১২ টা গ্রামে প্রচলিত নিয়ম হল যে সব গ্রামে জলের কোন উৎস আছে অর্থাৎ মেয়েদের অন্যত্র যেতে হয় না জল আনতে সেই গ্রামের প্রাপ্তব্য বরপণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।
‘গাঁও কানেকশান’ নামক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে ১৯টা রাজ্যের ৩৯ শতাংশ গ্রামীণ মহিলা প্রতিদিন গড়ে ৭ কিলোমিটার করে হাঁটেন জল আনার জন্য। ১৮ হাজার মানুষের মধ্যে সমীক্ষা করে দেখা গিয়েছে ৩ হাজার জন দিনে দুবার ৫ কিলোমিটার করে হাঁটেন জল বহনের জন্য। মোটামুটি দেখা গেছে ভারতের একজন গ্রামীণ মহিলা দিনে গড়ে ৫ থেকে ২০ কিলোমিটার হাঁটে শুধু জল আনার জন্য। ভূগর্ভস্থ জলতল ক্রমশ নেমে যাওয়ায় আরো বেশি করে মানুষ দূরবর্তী স্থান থেকে জলবহনে বাধ্য হচ্ছেন আর এঁরা বেশিরভাগই মহিলা। এ তো গেল শুধু জলের জন্য হাঁটা। এবার আমরা একটু পিছিয়ে যাই চলুন। ১৯৪৭ এর জুনে ভারত ভাগ হবে এবং পরে সীমান্ত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই সীমান্তের দুই পার জুড়ে শুরু হয় অভূতপূর্ব মাইগ্রেশান যার অনেকটাই হেঁটে হেঁটে।
১৯৪১ এ জাপান বোমা ফেলে বার্মায় আর সেখানে বসবাসকারী সাধারণ ভারতবাসী প্রথমে রেঙ্গুন থেকে জাহাজে করে ভারতে ফেরার চেষ্টা করে। মাস দুই পরে জাহাজঘাটা বন্ধ হয়ে গেলে বার্মায় আটকে পড়া ভারতবাসী হাঁটতে শুরু করে। তিনটি রুট ধরে হেঁটে ফেরে মানুষে, একটি আরাকান কয়ে চট্টগ্রাম আরেকটি চিন্দউইন উপত্যকা ধরে মণিপুর সীমান্ত আর তৃতীয় রুট লেদোপাস হয়ে অসম। তা সেই বোধহয় প্রথম রুজি-রুটির সন্ধানে বাইরে যাওয়া ভারতবাসী আচমকা বিপর্যয়ে একসাথে হেঁটে ১০০০ কিলোমিটারের মত রাস্তা পাড়ি দিয়ে স্বস্থানে ফেরার চেষ্টা করে। এবার এই যে রুজি-রুটির সন্ধানে বাইরে যাওয়া এর কারণ মূলত নিজ বাসস্থান বা আশেপাশে জীবিকার যোগাড় না হওয়া।
১৯৪৭-৪৮ এ দেশভাগ পরবর্তী মাইগ্রেশান ও অসংখ্য লোকের হাঁটার ছবির পরে ভারত আবার দেশবাসীকে হাজারে পনেরোশ মাইল হাঁটতে দেখল লক ডাউনের সময়। মাত্র তিন ঘণ্টার নোটিশে গোটা দেশ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষ পথে নেমে আসতে বাধ্য হন। তাঁদের কাজ এবং বাসস্থানও চলে যায়, অথচ যানবাহন সব বন্ধ,থাকার উপায় নেই ঘরে ফেরার উপায়ও নেই। প্রধানমন্ত্রী বা নীতি নির্ধারক মন্ত্রীরা কেউই এঁদের কথা ধর্তব্যের মধ্যে আনেন নি। ২০২০র ৮ইমে সারা ভারত আঁতকে উঠেছিল মহারাষ্ট্রে আওরঙ্গাবাদের কাছে রেললাইনে ছিটিয়ে থাকা রক্তমাখা আধপোড়া রুটি আর মানুষের দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গর ছবি দেখে। ৮৫০ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি পৌঁছোবার কথা ছিল মানুষগুলোর।
এই দলটির অধিকাংশ লোক ছিলেন গোন্দ সম্প্রদায়ের, আওরঙ্গাবাদ থেকে ছত্তিশগড়ে ফেরার ট্রেন চালু হতে পারে এই সম্ভাবনার কথা শুনে এঁরা লাইন ধরে হাঁটতে শুরু করেন। এঁরা জানতেন কোথাও কোন ট্রেন চলছে না, তাই ৩৬ কিলোমিটার অর্ধাহার, অনাহারে একটানা হেঁটে অবসন্ন হয়ে লাইনে ঘুমিয়ে পড়ার সময় এঁদের মনে রেললাইনে ঘুমানোয় কোনও বিপদাশঙ্কা কাজ করে নি। ছিন্নভিন্ন মৃতদেহের ছবি দেখে অবশ্য ভারতবাসীর একাংশ প্রশ্ন তুলেছে ‘রেললাইনটা কি ঘুমানোর জায়গা?’ সেই ভারতবাসী যারা প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ মেনে ব্যালকনিতে থালা বাটি পিটিয়ে, রাত ন’টায় বাড়ির সব আলো নিভিয়ে ব্যালকনিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে করোনার সাথে লড়েছে।
রেললাইনকে বালিশ আর কংক্রিটের স্লিপারকে বিছানা বানিয়ে যারা ঘুমিয়ে পড়েছিল তাদের কারো বাড়িতেই ‘ব্যালকনি’ নেই, ছিলও না কস্মিনকালে। বিদ্যুৎ সংযোগও কজনের বাড়িতে ছিল বা আদৌ একজনের বাড়িতেও ছিল কিনা সন্দেহ। একটা ব্যাপার এখানে খেয়াল করার মত সেটা হল যে কোনো রেল দুর্ঘটনায় আমরা দেখি রেলের তরফে এবং সরকারের তরফে হেল্পলাইন তৈরি হয়, আহত নিহত ব্যক্তিদের নাম আছড়ে পড়ে দূরদর্শনের পর্দায়, সংবাদপত্রের পাতায়। এই ঘটনার পরে আমরা কোনও মাধ্যমেই মৃতদের নাম ধাম তেমন দেখতে পাই নি। তবে জামলো মাকদম বা রণবীর সিঙের নাম আমরা অবশ্য জানতে পেরেছি। জামলো সেই ১২ বছরের মেয়েটি ১৫০ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে বাড়ির ৫০ কিলোমিটার আগে মরে যায়।
রণবীর সিং, দিল্লি থেকে হেঁটে মধ্যপ্রদেশ যেতে গিয়ে ২০০ কিলোমিটার চলার পরে পথে শুয়ে মরে যায়। ফোনে বাড়ির সাথে শেষবার কথা হবার সময় ফিসফিস করে বলেছিলেন সম্ভব হলে এসে আমাকে নিয়ে যাও। সরকারি নীতির প্রত্যক্ষ প্রভাবে মৃত এই শ্রমজীবীদের অন্তত দেহটুকুও কোনও সরকারই বাড়ি পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করে নি। আসুন এবার একটা অন্যরকম হাঁটার গল্পে চোখ রাখি। উত্তরাখণ্ডে এখনো পর্যন্ত ৭৩৪টি গ্রামকে বলা হয় ভুতিয়া গাঁও, মানে ভুতুড়ে গ্রাম। না না ভুতের ভয় টয় নয় জীবনধারণের প্রাথমিক জিনিষগুলো যথা খাদ্য,বস্ত্র, বাসস্থান,জল, বিদ্যুৎ, সড়ক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যকেন্দ্র না পেয়ে দলে দলে মানুষ গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে অন্য কোথাও। গ্রাম শূন্য হওয়া ঠ্যাকাতে সরকার একটি দপ্তর তৈরি করেছে ‘উত্তরাখণ্ড পলায়ন আয়োগ’।
উত্তরাখণ্ডের পাউড়ি গাড়োয়াল জেলায় এরকম অসংখ্য গ্রাম আছে যার লোকসংখ্যা মাত্র দুই কিংবা এক। থেকে যাওয়া শেষ বাসিন্দার মৃত্যু হলে গ্রামটি সম্পূর্ণ শূন্য হয়ে যাবে। এরকমই একটা গ্রাম সাইনা। একটামাত্র পরিবার অবশিষ্ট রয়েছে, দু'জন মানুষ, ভরত সিং ও তাঁর স্ত্রী সুশীলা। দুটো গরু আছে তাঁদের, সামনের জমিতে কুমড়ো, শশা আর কিছুটা বাজরা চাষ করেন। একদিকে মস্ত উঁচু পর্বতশ্রেণী আর একদিকে সরু ঝর্ণা থেকে তৈরি হওয়া নদীর মাঝে সাইনা। মাসে একবার গ্যাস সিলিন্ডার আসে, সেই ভ্যান ওঁদের বাড়ি পর্যন্ত আসতে পারে না। কারণ রাস্তা নেই। ভরত সিং পাহাড়ি চড়াই উৎরাই বেয়ে সিলিন্ডার ঘাড়ে পিঠে করে নিয়ে আসেন কয়েক কিলোমিটার। পথের মাঝামাঝি এক জায়গায় সুশীলা এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। বাকী পথটুকু দুজনে ধরাধরি করে নিয়ে আসেন সিলিন্ডার।
সারা ভারত জুড়ে বছরভর যে মাইলের পর মাইল পদযাত্রা চলে এগুলো তারই সামান্য কয়েকটা টুকরো দেখলাম আমরা। এরকম আরো অজস্র হেঁটে-চলার, হাঁটতে হাঁটতে বসে পড়ার, পড়ে মরে যাবার নির্মম কাহিনী রয়েছে সমৃদ্ধ দত্তর লেখা ‘হাঁটার গল্প’ বইয়ে। এই লকডাউনে যারা হেঁটে গেল দেশজুড়ে তারা কজন পৌঁছল গন্তব্যে? কেমন ছিল সেই পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরন্তর হাঁটার অপমানগুলোর কাহিনী? কত রকমের মাইগ্রেশান হয় দেশে? শিক্ষার নিরিখে একেবারে নীচের দিকে থাকা বিহার আর একদম উপরে থাকা কেরলে মাইগ্রেশানের হার এত বেশি কেন? কী সেই অন্তর্নিহিত সমীকরণ যার ফলে দলে দলে মানুষ বাইরে যায়? এইরকম নানা প্রশ্নের উত্তর এই বইতে খোঁজার চেষ্টা করেছেন লেখক।
ঝলমলে সোশ্যাল মিডিয়া আর স্মার্টসিটির বাইরে কবে থেকে যেন হেঁটেই চলেছে আরেকটা ভারত। এতদিনে তাদের অন্তত নামটুকু নথিবদ্ধ থাকার কথা ছিল সরকারের কাছে। কথা ছিল, কিন্তু নেই আসলে, আর সেজন্য আমরা ন্যুনতম লজ্জিতও নই, প্রশ্নও করি না কেন অভিবাসী শ্রমিকদের তালিকা নেই সরকারের কাছে? কেন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও গ্রামীণ মেয়েদের এত হাঁটতে হবে শুধুমাত্র জলের জন্য? বইটা আমাদের জ্বলন্ত এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় ‘সুনাগরিক’এর দায়িত্ব পালন করি নি আমরাও। অত্যন্ত জরুরী বইটায় সামান্য দু’একটা ত্রুটি যা নজরে এলো ‘জামলো মাকদম’এর নাম ‘জামালো’ লিখেছেন একাধিকবার। মৃত বালিকার নামটুকু অন্তত ঠিক করে বলা দরকার আমাদের সকলেরই। ১০৪ নম্বর পৃষ্ঠায় রাজেন্দ্রর বাবার মৃত্যু প্রথমে লেখা হয়েছে জমি বিক্রির শোকে হার্ট অ্যাটাক, কিছু পরে আবার করোনায় মৃত বলে লেখা। এই খুচরো ভুলগুলো আঁটসাঁট সম্পাদনায় এড়ানো সম্ভব ছিল।
বই – হাঁটার গল্প
লেখক – সমৃদ্ধ দত্ত
প্রকাশক – দে’জ পাবলিশিং
দাম – ৩০০/-