এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  প্রবন্ধ

  • কোলকাতার গাড়ি বারান্দা না থাকলে কি আমরা পঙ্কজ কুমার মল্লিককে পেতাম ! 

    Debasis Sarkar লেখকের গ্রাহক হোন
    প্রবন্ধ | ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ | ৩৬৮ বার পঠিত
  • প্রসঙ্গটি কৌতুহলোদ্দীপক করে তোলার তাগিদে আমরা শুরুতে ভারতবর্ষের প্রথম শ্রমিক ধর্মঘট নিয়ে আলোচনা শুরু করি। উঁহু ! বিরক্ত হবেন না। ধান ভানতে শিবের গীত নয়।

    ভারতবর্ষের প্রথম সফল শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয় ১৮২৭ সালে কোলকাতায়, সেটা ছিল পালকি বেহারাদের ধর্মঘট। এই ধর্মঘটে ইংরেজ প্রশাসন তথা সমাজের অভিজাত মানুষেরা বেশ বিপাকে পড়েন। সরকার তথা প্রশাসন খানিকটা নমনীয় হয় এবং পালকি বেহারাদের দাবি আংশিক মেনে নিতে বাধ্য হয়। তবে সেই ফাঁকে একটা ঘটনা ঘটে যায়। ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন হয়ে যায় ! হয়েছিল কি, তিন দিন অফিস যেতে না পেরে ব্রাউন পদবীর একজন সাহেবের ধৈর্যচ্যুতি হল। কি করি কি করি ভাবতে ভাবতে তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বাড়ির উঠোনে তো পালটি অকেজো হয়ে পড়েই ছিল, হঠাৎ সেই সাহেব করলেন কি, কাঠের মিস্ত্রি ডাকিয়ে পালকির হাতল দুটো খুলে ফেললেন এবং তলায় দুখানা চাকা লাগিয়ে দিলেন আর সামনে জুড়ে দিলেন ঘোড়া। কলকাতায় চালু হয়ে গেল ঘোড়ার গাড়ি। ওদিকে পালকি ধর্মঘট তো মিটে গেল তবে কলকাতার রাস্তা ছেয়ে গেল এই নতুন ঘোড়ার গাড়িতে ! এভাবেই যন্ত্রপ্রযুক্তির চাকা এড়িয়ে যায় আর শ্রমিকরা ছিটকে পড়েন রাস্তার দুপাশে ! যে কোনো উন্নয়ন আর সমৃদ্ধির রাস্তার দুপাশে পড়ে থাকে অসহায় এই সমস্ত শ্রমিককুল ! কলকাতা প্রবেশ করলো অশ্বযানের যুগে এবং কলকাতার গতি খানিক বেড়ে গেল।

    সাহেবদের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে অনুকরণপ্রিয় কলকাতা বাবুশ্রেণীর অনেকেই ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার করা শুরু করে দিলেন। একটা খুচরো সমস্যাও দেখা দিল। এতদিন তো পালকিতে চেপেই কলকাতার বাবুরা বাড়ির অন্দরমহল থেকে বাইরে বা বাইরে থেকে অন্দরমহলে এসে প্রবেশ করতেন। ঘোড়ার গাড়ি তো আর অন্দরমহলে ঢুকতে পারবে না ! ফলে বাবুদের বাইরে বেরিয়ে রাস্তার উপর আসতেই হবে ! বাবুর পক্ষে কি এসব শোভা পায় ! রাস্তার ধুলো মাড়িয়ে অন্দরমহলে ঢুকতে হচ্ছে ! মোসায়েবরা বলতে থাকলো, "বাবু এখন রাস্তার বাবু হয়ে গেছেন! গায়ে বর্ষার জল, গ্রীষ্মকালের কঠোর রোদ যারা গায়ে লাগায় তারা কি ঠিকঠাক বাবু!" তাই বাবুদের ইজ্জতের মাথা ঢাকতে ঘোড়ার গাড়ির মাথায় আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হল। বাড়ির বাইরে সদর দরজার সামনে মাথার ওপর ছাদসহ নতুন একটা বারান্দা করা হল, যেখানে বাবুর ঘোড়া গাড়ি এসে দাঁড়াবে, নাম দেওয়া হল, ' গাড়িবারান্দা '। কলকাতার রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা হু হু করে বাড়তে শুরু করল, পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো গাড়ি বারান্দার সংখ্যাও! এক একজন বাবু তো এক একটি গাড়িবারান্দা। এখন রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে মিউনিসিপ্যালিটি এই গাড়িবারান্দা গুলিকে নিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হল। উনিশ শতকের শেষের দিকে নতুন আইন পাস হলো যে আর গাড়ি বারান্দা তৈরি করা যাবে না। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কলকাতা তার বাবুযুগ হারিয়ে ফেলল এবং এর সঙ্গে গাড়ি বারান্দাগুলির অতীত গৌরবও বিলুপ্ত হল। পরবর্তীকালে এই গাড়ি বারান্দা গুলি হয়ে উঠল যতসব হকার এবং স্ট্রিটফুডের দোকান, দরিদ্র আর ভবঘুরেদের আস্তানা এবং বৃষ্টির হাত থেকে মাথা বাঁচানোর জন্য পথিকদের ক্ষণিকের আশ্রয়স্থল।

    ঠিক এর ১০০ বছর পরেই বৃষ্টি ভেজা এমনই এক বিকেলে এবং একটি গাড়ি বারান্দা থেকেই আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম বাঙালির আইকন, রবীন্দ্রসংগীত তথা বাংলা গানের জগতের অবিস্মরণীয় গায়ক, সুরকার পঙ্কজ কুমার মল্লিককে !

    পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সংগীত জীবনের শুরু হচ্ছে ১৯২৭ সালের ২৬ শে সেপ্টেম্বর গাড়িবারান্দা থেকেই! সেদিনও তুমূল বৃষ্টি। ক্যানিং স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ এর ফুটপাতে একটি গাড়ি বারান্দায় ছুটতে ছুটতে এসে মাথা গুঁজছেন একের পর এক মানুষ। এই গাড়িবারান্দাটির লাগোয়া একটি ডিসপেন্সারি। ডিসপেন্সারিটি এক দক্ষিণ ভারতীয় ডাক্তারের, ছোট্ট সাইনবোর্ডে লেখা আছে, নাম ডাক্তার রামস্বামী আয়েঙ্গার, তিনি ঘরের ভেতরে কি কাজ করছেন। খানিক পরে সেখানে ছুটতে ছুটতে এসে ডুকলেন সাদা ফুল শার্ট, সাদা ধুতি পরিহিত এক লম্বাটে যুবক। দু হাত দিয়ে ফুল শার্টটির গায়ে ও চুলে লেগে থাকা বৃষ্টির কণা ঝেড়ে ফেলে যুবকটি আর পাঁচজনের মতন সামনে রাস্তার ওপর বৃষ্টিপাত দেখতে থাকলেন। ঘরের ভেতরে সাহেবি পোশাক পরা ডাক্তার বাবুটি যে গানের ভক্ত তা তো এই আশ্রয়প্রার্থী নম্বাটে যুবকটির জানার কথা নয়, সে গুণগুণ করে একটি গান ধরল, "এমন দিনে তারে বলা যায় / এমনই ঘনঘোর বরষায়... "

    কখন যেন পেছন থেকে এসে ডাক্তার রামস্বামী গায়নরত যুবকটির পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন তা যুবকটির হুঁশ নেই। রামস্বামী যুবকটির পিঠে টোকা দিয়ে বললেন, "কাম ইন!" বিস্মিত যুবকটি রামস্বামীর পেছনে পেছনে এসে তার ডিসপেন্সারির ভেতর প্রবেশ করতে তাকে চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করে রামস্বামী বললেন, "গানটি আবার করো !" যুবকটি গাড়িতে ছোট করার পর দ্বিতীয় কলি থেকে রামস্বামী নিজেও তাঁর দক্ষিণ ভারতীয় বাংলা উচ্চারণে গলা মেলাতে শুরু করলেন! গান শেষ হলে উচ্ছ্বসিত হয়ে যুবকটিকে বললেন, "ডু ইউ ওয়ান্ট টু ব্রডকাস্ট? কলকাতায় যে রেডিও স্টেশন হয়েছে, সেখানে কয়জনের সঙ্গে আমার কিছু জানাশোনা আছে। তোমার নাম ঠিকানা দিয়ে যাও আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে নেব।" হপ্তা দুয়েক বাদে একখানা পালকি এসে যুবকটির সেই ঠিকানায় এসে থামতে নেমে এলেন রামস্বামী, তাকে ধরে নিয়ে এলেন সোজা টেম্পেল চেম্বার্স অফিসে। বললেন, "দ্যাখো! এই হলো রেডিও স্টেশন"। তার আলাপ করিয়ে দিলেন বাঙালি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর নৃপেন মজুমদারের সঙ্গে। যুবকটির গান শুনে উচ্ছসিত নৃপেন বাবু বললেন, "আজই আপনার গান ব্রডকাস্ট হবে!"। সেদিনই অর্থাৎ ২৬/০৯/১৯২৭ সরাসরি প্রচারিত হলো, "এমনই দিনে তারে বলা যায়" এবং "তুমি প্রিয় আমারই তরুমূলে" দুটি গান, যে দুটি আকাশবাণী থেকে প্রচারিত সর্বপ্রথম রবীন্দ্র সংগীত। বেতারজগতে সূর্যোদয় ঘটলো! অবশ্যই গান শুরু করার আগে গায়কের নাম ঘোষিত হলো, "পঙ্কজ কুমার মল্লিক"।

    গাড়িবারান্দা না থাকলে আয়েঙ্গার সাহেবের শ্রবণসীমার মধ্যে কি পঙ্কজ কুমার মল্লিক আসতেন !
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • প্রবন্ধ | ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ | ৩৬৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2601:84:4600:5410:3dc0:6a31:4c4b:***:*** | ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ ২৩:২১540817
  • বেশ 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন