বুরুডি ছাড়তে সন্ধ্যা ছ'টা বাজল। আবার আকাশে মেঘ ভেঙে পড়ার উপক্রম। বন্ধু আশিস মিশ্র বলেছিলেন, বুরুডির কোল বেয়ে পেছন দিকের একটা গ্রামে গিয়েছিলেন বন্ধুদের সাথে। পথটা আমার চেনা। ওই রাস্তায় সাত কিলোমিটার গেলেই ধারা জলপ্রপাত। অসাধারন সেই দৃশ্য, বিশেষ করে বর্ষাকালে। কিন্তু এই দুর্যোগ আর এই সময়ে সেই পথে যাওয়া চলেনা। অন্তত দু কিলোমিটার পথ ট্রেকিং করতে হবে কিন্তু বাকী পাঁচ কিলোমিটার পথও এই গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবেনা। এ যাত্রায় আমার আফসোস বর্ষায় ধারা প্রপাত দেখা হবেনা। রুষতি রিয়ানদের গুলি মুরগির ঝোল খাওয়া ছাড়াও অবশ্য আরও কিছু আফসোস যে থেকে যাচ্ছে তা বুঝতে পারলাম পরের দিন। তার অন্যতম হল পাথরের গহনা কেনা হলনা। ধারাগিরি জলপ্রপাত অধরা রেখেই আমরা হোটেলে ফিরছি, শুরুর দিনের যাত্রা শেষ করে এই প্রথম হোটেলে যাব আমরা। সেই পথেই বরং বলে নেওয়া যাক আমার কুড়ি বছর আগের ধারা জলপ্রপাত ও বুরুডি দর্শনের কাহিনী। যাঁরা বাংলা থেকে সরাসরি বুরুডি আসতে চান তাঁদের জন্য এই রুটটাও যথেষ্ট মনোরমের।
সে প্রায় দু'দশক আগের কথা! কাঁকড়াঝোরে গোপীনাথ মাহাতর বাড়ির উঠোনে দড়ির খাটিয়ায় বসে অক্টোবরের রোদ মাখছিলাম গায়ে। এখনকার সাবেক সরকারি বনবাংলোটির তলায় গোপীনাথ মাহাতোর দোতলা টালির চাল দেওয়া কোঠাবাড়ি। সরকারি বনবাংলো লাগোয়া ইএফআর বাহিনীর ছোট তাঁবু। নতুন একটা বিশাল সরকারি বনবাংলো তৈরি হচ্ছে। কাঁকড়াঝোর আসার সহজ রাস্তা দুটোর একটাও তখনও হয়নি। বেলপাহাড়ি থেকে ভুলাভেদা হয়ে প্রায় ১৬ কিলোমিটার রাস্তা। গাডরাসিনি পাহাড়কে বাঁদিকে রেখে দলদলির ওপর বরবার এই পথ। এই পথেই ফরেস্ট রেঞ্জারদের গাড়ি ছুটত হামেশাই, ফলে যাওয়ার সমস্যা ছিলনা। বাঁদিকে মস্ত খাদ আর ডান দিকে পাহাড়ের কোল সামলে চললেই হল। ২০০৪ সালে এই রাস্তার ওপরেই মাইন পেতে একটা গাড়ি সহ ৪ জন ইএফআর জওয়ান কে উড়িয়ে দেয় মাওবাদীরা। বাংলায় সেই প্রথম মাওাদীদের সফল বিস্ফোরন। সেই ভয়ংকর ঘটনা আমাকে কভার করতে যেতে হয়। এতদিনের চেনা একটি অপরূপ সৌন্দর্য্যময় রাস্তায়, পরিচিত মহুল গাছ গুলোর মাথায় কোনও এক জাওয়ানের ভারী বুট পরা ঝুলে থাকা একটা পা আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছিল বহুদিন। প্রায় ২৫ ফুট ওপরে ঝুলে থাকা পা থেকে তখনও রক্ত পড়ছিল চুঁইয়ে চুঁইয়ে। ২০০৪ সালেই মাওবাদীরা কাঁকড়াঝোরের দুটি বাংলোই মাইন বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তারপরই বিকল্প রাস্তার খোঁজ শুরু হয়। এখন কাঁকড়াঝোর যাওয়ার দুটো রাস্তা। বেলপাহাড়ি থেকে চিড়াকুঠি হয়ে বুড়িঝোর গ্রামের পাশ দিয়ে। অন্য রাস্তাটি বেলপাহাড়ি থেকে চাকাডোবা হয়ে।
গোপীনাথ মাহাতোর নিজের মত করে তৈরি করা হোম-স্টে 'মাহাত লজ' এর সামনে বসেছিলাম সেই ভয়াবহ ঘটনার দু'বছর আগে। গোপীনাথ মাহাতকে যারা চেনেননা তাঁদের জন্য বলা যে চারমূর্তি সিনেমায় টেনিদা রুপী চিন্ময় রায় গরুরগাড়ির যে গাড়োয়ানের পাকানো চেহারা আর ঝকঝকে দাঁতের হাসি দেখে ভুত ভেবে অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন গোপীনাথ সেই ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। দক্ষিণবঙ্গকে প্রথম হোম-স্টের রাস্তা দেখানো গোপীনাথ মাহাতো প্রয়াত হয়েছেন বেশ কযেকবছর আগে। তাঁর উঠোনে সেদিন খান দুয়েক মযুর চরে বেড়াচ্ছিল। অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এখানে প্রায় ঘরে ঘরে ময়ুর। বর্ষার পরে পাহাড়ের খাঁজ থেকে ময়ুরীর ডিম সংগ্রহ করে মুরগির তা দিয়ে ফোটায় এরা। সে ময়ুর চরে বেড়ায়, উঠোনে, রাস্তায়। পাহাড়ি চিতি, কালাচ গৃহস্থের উঠোনে ঢুকতে সাহস পায়না। গোপীনাথ আমাকে দুখানা ডিম দিতে চেয়েছিল কিন্তু লাভ নেই। ময়ুর বন্যপ্রাণী। পোষা নিষিদ্ধ। এঁদের অবশ্য কিছু বলেনা ফরেস্টের লোকজন। এরা ময়ুরের সংখ্যা বাড়ায়, ময়ুর শিকার বা খায়না।
সেই মযুর গুলোকে পাশ কাটিয়ে হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছিলেন আদিবাসী বেশ কয়েকজন তরুণ তরুণী। গ্রীবা উঁচু করে ময়ুর গুলো তাদের দিকে তাকায়। বেশ সাজগোজ তাঁদের। হলুদ চেক ধুতি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা তরুণদের কয়েকজনের হাতে বাঁশি, মেয়েদের কোমরে বেড়ে দেওয়া নতুন শাড়ির আঁচল, খোঁপায় গোঁজা ফুল। দুলতে দুলতে তারা উঠে যাচ্ছিল পাহাড়ের পথে। হাঁড়িয়া কিংবা মহুলের নেশা ধরেছে ওদের। তাকিয়ে ছিলাম একদৃষ্টিতে। তাই দেখে গোপীনাথ বলেছিলেন, ' উরা বিন্দা মেলায় যাচ্ছে। পাহাড়ের উপাশে, ঝাড়খন্ডের বুরুডিতে।' আমি আদিবাসীদের বড় মেলা কানাইসর দেখেছি কিন্তু বিন্দা মেলার নাম এই প্রথম শুনলাম। ইচ্ছাটা চাগাড় দিল বটে কিন্ত গোপীনাথ বললেন, ই পথে ভুটভুটি যেতে লারবেক।' ভুটভুটি মানে মোটর বাইক। ৫০ টাকায় বড় কাঁসার বাটি উপচে পড়া কুঁকড়া রং ঝোল আর লাল স্বর্ণ চালের ভাত খাইয়ে পথ বাতলে দিলেন গোপীনাথই। কাঁকড়াঝোর থেকে আমলাশোল, আমঝর্না হয়ে ময়ুরঝর্না পাহাড়কে পাশ কাটিয়ে ঝাঁটিঝর্না, ফুলঝোর কাশিডাঙা হয়ে লাখাইসিনি পাহাড়ের কোল বেয়ে নামার পথে চমকে গেলাম ঝরঝর গড়গড় শব্দে! লাখাইসিনির গা বেয়ে নামছে এক সুন্দরী ঝর্না, সেই প্রথম নাম শুনলাম, ধারাগিরি-র। মাথায় উঠল বিন্দা মেলা, ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম ঘন্টা খানেক। আনন্দে তিরতির করে কাঁপছিলাম আমি, বাংলার শহুরে মানুষের হয়ে এ পথ আমার প্রথম আবিষ্কার! কিন্তু আশ্চর্য যেন আরও অপেক্ষা করছিল। সে আশ্চর্যের নাম বুরুডি, সে আশ্চর্যের নাম বিন্দা মেলা। সেই বুরুডিও আমার কাছে প্রথম আর বিন্দা মেলাও।
শেষ হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে বু্রুডির ভেতর গড়ে যখন পৌঁছলাম তখন মেলা তুঙ্গে উঠেছে। ভীড় উপচে পড়ে গড়িয়ে পড়বে নীল হ্রদের ভেতরে। ঝুটা মতির গয়নার দোকান সার দিয়ে বসে। ওদিকেই ভীড়টা বেশী বটে কিন্তু পাথরের গয়না, ডোকরাও রয়েছে। সংখ্যায় কম হলেও মধুবনি আর ওড়লি ঘরানার ছাপা শাড়ি। এক সদ্য গোঁফ ওঠা তরুনের হাত ধরে বউ টানছে ওদিকে। বসেছে অসাধারণ বাঁশ আর বেতের ঝুড়ি, ঠাকা, কুলা, মান তো আছেই আর আছে পাথরের বাসন কোসন। কোনও এক পাশ থেকে সাঁওতালি যাত্রার ঘোষনা করা হচ্ছে। মেলা থেকে একটু দুরে হাঁড়িয়া বিক্রি করতে বসেছেন মধ্য বয়সী মহিলার দল। হাঁড়ির মুখে গামছা বেঁধে বাসি ভাত ঘষেই চলেছে তাঁরা। সন্ধ্যা গড়ালেই বাড়বে বিক্রি বাটা। জুয়ার চরকি ঘুরছে বনবন। হাব্বাডাব্বার কৌটায় নড়ছে ঝান্ডি, মুন্ডি, চিড়িয়া আর কাফান। সন্ধ্যা নামবে বলে কোনও কোনও দোকানদার হ্যাজাক আর ডে লাইট পরিষ্কার করে কেরোসিন তেল ভরছে, পাম্প দিচ্ছে। কথাটা মনে পড়তেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। রাতে থাকব কোথায়? যে পথে এসেছি সেই পথে ফেরার তো প্রশ্নই ওঠেনা আর রাতে রাস্তা চিনতেও পারবনা। তখনও আমার কাছে সেলফোন এসে পৌঁছায়নি। মেলাটা ঘুরে ঘুরে দেখছি বটে কিন্তু মনটা খচখচ করছে। একটা জিলিপি আর পাকুড়া ভাজার দোকানের পাশে বাইকটা গছিয়ে দিয়ে এসেছি। খড়গপুরের ছেলে হিসেবে হিন্দিটা মোটামুটি চলে। 'ডিবটি হ্যায়, বাইক এঁহি রহেগা।' বলে হ্যান্ডেল লক করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইতেই লোকটা 'জী সরকার' বলে সম্মতি দিল। খড়গপুরের বহু আরপিএফ কে আমি ডিউটির বদলে ডিবটি বলতে শুনেছি, ব এর উচ্চারন অর্ধেক হয়। বুলিটা চালিয়ে দিলাম, লোকটা নির্ঘাৎ আমাকে প্লেন ক্লথের পুলিশ ভেবে সরকার সম্বোধন করে বসল। সুতরাং বাইক নিয়ে চিন্তা নেই, চিন্তা রাতের আশ্রয় নিয়ে।
মেলার ঢালু ফাঁকা একটা অংশে গরুর গাড়ি আর মহিষের গাড়ি। মহিষের গাড়িতে বলদের বদলে জুতে দেওয়া হয় কাঁড়া বা খোজা করা পুরুষ মহিষ। সেই গাড়িতে করে ঘাটশিলা, মহুলিয়া, নরসিংহগড় প্রভৃতি জায়গা থেকে এসেছেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলারা। বয়স্কা বিধবা, যুবতী গৃহবধূ, ভীরু কিশোরী। ষন্ডাগন্ডা গাড়োয়ান ছাড়াও এঁদের সাথে দু'একজন করে পুরুষ আছেন। গাড়োয়ানরা গাড়িতে জুড়ছে বলদ, কাঁড়া। সঙ্গে থাকা পুরুষরা শেষ বেলায় মিলিয়ে নিচ্ছে খরিদ করা সমস্ত জিনিস ঠিকঠাক গাড়িতে উঠল কিনা। সন্ধ্যার মুখে বাড়ি ফেরার পালা। এরা সব ফিরে যাবে, থেকে যাবে শুধু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষরা। রাত ভর যাত্রা, মহুল-হাঁড়িয়া, মাদলের দ্রিম দ্রিম, আকুল বাঁশি মেলাময় খুঁজে বেড়াবে প্রিয় নারীটিকে। হাত ধরে জোড়ায় জোড়ায় নেমে যাবে বাহির গড়ের দিকে, হ্রদের ঢালু তে। দুজনের দুজন দুজনকে পছন্দ হয়ে ঘর বাঁধবে সারাজীবনের জন্য। না পোষালে যে যার ঘরে ফিরে যাবে, কেউ কাউকে ঠকাবেনা। বিন্দা মেলা এক সময় শুরু করেছিলেন ধলভূমগড়ের রাজারা। মুসাবনী, মৌভান্ডার, জাদুগাড়া, মহুলিয়া থেকে আজকের বাংলার জামবনী, গিধনী, চিল্কিগড় অবধি সে রাজ্যের বিস্তৃতি। ঘাটশিলা তার রাজ ধানী। এখন এই মেলা সাঁওতাল, খেড়িয়া, মুন্ডা ইত্যাদিদের। রাত যত বাড়ে মেলা জমে ওঠে, রাত ছাড়া সময় কোথায়? সূর্য উঠলেই কাজ আর কাজ। সম্ভ্রান্তের জমি জিরেতে, পাহাড়ে খনিতে, খাদানে খালে শুধু ওরাই। রাতটাই যে ওদের শুধু নিজস্ব।
গাড়ি গুলো যত ফাঁকা হচ্ছিল মনের মধ্যে উৎকন্ঠা বাড়ছিল ততই। কেমন একটা অসহায় মনে হচ্ছিল। এখানে কেউ আমার চেনা নয়, না আদিবাসী না অ-আদিবাসী। তবুও ওরা চলে যাচ্ছে দেখে এমনটা মনে হচ্ছে কেন? ততক্ষণে হ্যাজাক, ডে-লাইট, কেরোসিনের কূপী জ্বলে উঠেছে, আলো ঘিরে থাকা মেলাটা অনেকটা ছোট মনে হয়। ঝলমলে আলোয় আদিবাসী তরুণীদের গলায়, কানে, হাতে থাকা ঝুটামতির গয়না ঝলমলিয়ে উঠছে। তারা তরুণদের আরও ঘন, আরও সন্নিবিষ্ট। আমার অস্বস্তি হয়। আমি সরে যাই মেলার সেই অংশে যেদিকে পাথরের থালা বাটি বাসন কোসন বিক্রি হচ্ছে। ওদের দিকটা এখন হালকা, দোকানের ঝাঁপ অর্ধেক গুটিয়ে রাতের খাবার অথবা ঘুমিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি। দোকান খোলা থাকে সারারাতই তারই মধ্যে কেউ কেউ পালা করে ঘুমিয়ে নেওয়া। পাথরের থালা বাসন দেখে এগিয়ে যাই, মনের মধ্যে কোথাও একটু আশা জেগে ওঠে আর ঠিক কেউ যেন ডেকে ওঠে, 'হেই নরেশদা। ইদিকে যে বড়!' ঘুরে তাকিয়ে দেখি একটা দোকান থেকে উঁকি দিচ্ছে শিমুলপালের মদন মিস্ত্রি! হাতে চাঁদ পেয়ে যাই। মদন মিস্ত্রি কে যাঁরা চেনেননা তাঁদের জন্য বলি, বেলপাহাড়ির ঠাকুরান পাহাড়ের গায়ে শিমুলপাল গ্রামে বাড়ি মদনের। শিমুলপাল, বীরমাদল আর ঢাঙিকুসুম এই তিনটি গ্রামের কিছু বাসিন্দা পাথরের বাসন কোসন বানানোর কাজ করেন। বাঁকুড়ার ছাড়া এই কাজ আর কোথাও হয়না। সাংবাদিকতার সুবাদে এঁদের সাথে আলাপ। পরে সমাজকর্মী ঝরনা আচার্য্যর অনুরোধে এঁদের কিছু সরকারি সুযোগ সুবিধা, দাবি দাওয়া নিয়ে বিডিও, ডিএম প্রভৃতির সঙ্গে কথাবার্তা বলে কিছুটা সুরাহা করতে পেরেছিলাম। সেই থেকে মাথায় করে রাখেন এঁরা। মদনের সঙ্গে তার ভাই তারাপদও এসেছিল। তাঁদের দোকানেই থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। চপ, জিলিপি, পেঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কায় পেট ভরে ডিনার।
এবার ফেরার রাস্তা বাতলালো মদন। বুরুডি থেকে ঘাটশিলামুখী হয়ে সামান্য নামলেই ধনওয়ানি। সেখান থেকে বাঁদিক ধরে সোজা পূর্ব দক্ষিণে গ্রামের মেঠো পথ বেয়ে বাইক ছুটল ফুলপাল, দুধপুশি, মহিষাধারা, নুয়াগাঁও। এ অবধি রাস্তা মোটামুটি সমতল। এরপর পাকুড়িয়াশোল থেকে ফের ধীরে ধীরে উঁচুতে ওঠা। পাকুড়িয়াশোল ঝাড়খন্ডের শেষ গ্রাম। পশ্চিমবাংলা শুরু হচ্ছে জামাইমারি গ্রাম দিয়ে। বড় অদ্ভুত জায়গাটা। একই রাস্তার ওপাশের বাড়ি গুলি পাকুড়িয়াশোল, ঝাড়খন্ড আর ওপাশের বাড়ি গুলি জামাইমারি, পশ্চিম বাংলা। বাংলার গিন্নি বিকালে গা ধুয়ে ঝাড়খন্ডের গিন্নির সাথে গল্প করতে যায়। রাতে বাংলার দাওয়ায় বসে দুই রাজ্যের কর্তারা তাস পেটায়। অনেকেই আজকাল শখ করে ঘাটশিলা থেকে দুই রাজ্যের সীমান্ত হুলুং বেড়াতে আসেন। আমি বলব, বাংলার গ্রাম জামাইমারি অবধি উঠে আসুন। তারপর শাঁখাভাঙা, পাথরচাকড়ি, লাবনী হয়ে শিমুলপালে আসুন। দেখে যান কী অনুপম শিল্প নৈপুণ্য নিয়ে পাথরের থালা বাটি, চাকতি বেলনি, ধুনোদান ইত্যাদি বানায় এই পাহাড়ি গ্রাম। আপনি চাইলে পাথরচাকড়ি থেকে বাঁদিকে বেঁকে ধরতে পারেন বীরমাদল পাহাড়ের পথ। আপনাকে একটা ছোট ঝর্না ধারা পেরুতে হবে এবং তার অনায়াসে পেরুনো যাবে। আমি বাইক নিয়ে পেরিয়ে গেছি। এরনাম কেটকিঝর্না। আপনি আদর করে কেতকী ঝর্নাও বলতে পারেন।
বীরমাদলের পথে পাহাড়টার মাথায় মাথায় গাড়ী ছুটবে দিব্যি, রাস্তার ডানদিকে বাড়ি গুলি। যে পাহাড়ের ওপর দিয়ে যাওয়া তার নাম নাচনিডুংরি। বীরমাদল গ্রামে ঢোকার মুখে দাঁড়ান। গাড়ি থেকে নেমে ডানদিকে দেখুন। দেখবেন অপূর্বদৃশ্য! দেখবেন ঠাকুরান পাহাড়ের কোলে একটি গ্রাম, তার নামই শিমুলপাল। কিন্তু এখন আমরা শিমুলপালের পথ ছেড়ে বীরমাদল গ্রাম ছাড়িয়ে বাংলার অন্যতম সেরা একটি পাহাড়ে গ্রামে যাচ্ছি যার নাম ঢাঙিকুসুম! একটা কুসুম যেমন চারদিকে ডিমের খোলসের শক্ত আবরনে ঢাকা থাকে ঢাঙিকুসুম গ্রামটাও তেমন চারদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। ছবির মত একটা গ্রাম। বীরমাদলের কোল ছেড়ে ধীরে ধীরে নেমে যান সেই পাহাড় ঘেরা গ্রামে। না! হলফ নিয়ে বলতে পারি কলকাতার এত কাছে এই পাহাড় ঘেরা গ্রাম একটাও পাবেননা। কলকাতা থেকে মেরে কেটে আড়াইশো কিলোমিটার। ঝাড়গ্রাম থেকে বেলপাহাড়ি হয়ে চিড়াকুঠি থেকে বাঁয়ে নেমে পাহাড় টপকে টুক করে গ্রামে নেমে পড়ুন। আমরা অবশ্য নেমেছি বীরমাদলের কোল ঘেঁষে, অন্যপথে। তবে এখন শুনেছি চিড়াকুঠি থেকে যাওয়ার পথের পাহাড়টা কেটে সরকার একটা প্রশস্ত রাস্তা করে দিয়েছে। আমার মতে মারাত্মক গর্হিত একটা কাজ। আমি ২০ বছর আগে ওই পাহাড় টপকেছি সামান্য মারুতি ভ্যান নিয়ে, কোনও অসুবিধা হয়নি। মাঝখান থেকে গ্রামটার সৌন্দর্য্য হানি হল। এই গ্রামে এখন হোম-স্টে হয়েছে। চাইলে থাকতে পারেন অথবা ঝাড়গ্রামে রাত্রিবাস। পাথরের বাসন কোসন তৈরি করে এখানকার কিছু মানুষ। সেই সব মস্ত খাদান তো দেখতেই পারেন কিন্ত গ্রামের পশ্চিমের পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেলে আপনি পাবেন আরও সুন্দর একটা জিনিস। টুয়ারডুংরি ফলস্! কলকলিয়ে জল নামছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ওকে ডান দিকে এবার আপনাকে উঠতে হবে পাহাড়ের চূড়ায়। পশ্চিম পাটে সূর্য নেমে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে আপনার চোখ চলে যাবে সেই বুরুডির দিকেই। নিজের মনেই বলে উঠবেন, ‘আহা! কি দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না৷’ হ্যাঁ, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের নায়ক নবকুমার-এর সেই বিখ্যাত উক্তিটি।
আমি কিন্তু এই বেলা পাথরচাকড়ির পথ ছেড়ে বাঁয়ে মুড়িনি। বরং আমি লাবনী, শাঁখাভাঙা হয়ে শিমুলপালে নেমে গেছি। ফেরার পথে দেখে এসেছি নামের সঙ্গে কী অদ্ভুত মিল ওই শাঁখাভাঙা গ্রামের। পাহাড়ের মাথায় থাকা গ্রামটা যেন এয়োতির শাঁখার মতই গোল হয়ে একটা জায়গায় তোবড়ানো। শিমুলপাল ঢোকার মুখে জঙ্গলটার নাম চৌকিশাল। ২০০৮ সালের অক্টোবর মাসে আরও একবার যেতে হয়েছিল আমাকে। মাওবাদীরা আইইডি বিছিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল একটি অ্যাম্বুলেন্স! ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল ডাঃ ধানীরাম মান্ডি, নার্স ভারতী মাঝি আর চালক প্রনয় মিশিরের শরীর। ২২ বছরের ভারতী সেই মাত্র বিয়ের ছুটি কাটিয়ে জয়েন করেছিলেন। একটা লাইগেশন ক্যাম্পের প্রস্তুতি নিয়ে ফিরছিলেন তাঁরা। ওই পথে ওই নির্দিষ্ট দিনে এবং ওই নির্দিষ্ট টাটা সুমোতেই তাঁরা যাতায়ত করতেন। ঘটনাটি ঘটেছিল দিনের আলোতে। সুতরাং ইচ্ছা করেই এই নারকীয় ঘটনা ঘটিয়েছিল মাওবাদীরা। বাংলার সেই জঘন্য অধ্যায়ের সেই দিনটি ছিল সর্বাধিক কলঙ্কিত। রাজনৈতিক ঘৃণ্যতার নিকৃষ্টতম রূপ। যাইহোক ওই পর্ব শেষ। আপাতত: এই গোটা পথে নরাধমরা নেই।
সেবার খড়গপু্র ফিরেছিলাম শিমুলপাল, বালিচুয়া, বেলপাহাড়ি হয়ে। বালিচুয়া থেকে বেলপাহাড়ি পথটিও খুব সুন্দর! ডাঁয়ে বাঁয়ে ছোটবড় ডুংরি বা পাহাড়, টিলাগুলিকে রেখে মসৃণ পথ। টিলা গুলির নামও খুব সুন্দর। যেমন হাতির মত দেখতে বলে একটির নাম গজডুংরি। চাইলে এর মাথায় চড়তে পারেন। পরের পথ তো সবারই জানা, বেলপাহাড়ি থেকে ঝাড়গ্রাম হয়ে হাওড়া- মুম্বাই জাতীয় সড়ক।
ক্রমশ...