১
স্তরে স্তরে খুলে যাচ্ছে
খেলে যাচ্ছে ঝিলিমিলি আলো
ঝিরিঝিরি গোলাপি পরতের শরীরে
শেষে সব একদম ফাঁকা, শূন্য
কিচ্ছুটি নেই
জীবন,
এত কান্না পেল কেন?
২
- ছোটবউমা, তুই কি আমার জাত নষ্ট করলি?
নিষ্ঠাবতী বিধবার জাত নষ্ট করলি?
কেন আমায় খাওয়ালি ওসব?
- না, পিসিমা, ওই ভর্তা মাখায় বিশ্বাস করুন…
পেঁয়াজ ছিল না।
আদাকুচি, কাঁচালঙ্কা, ধনেপাতা আর একটু
আলুসেদ্ধ, তেঁতুলের আচার দিয়ে মেখে…
যদি অসুখের মুখে একটু ভালো লাগে…
- কী বলিস, ছিল না পেঁয়াজ?
- এক কুচিও নয়। আমি কি জানি না বলুন,
সে দিলে যে আমারও ভারি পাপ হবে।
- হ্যাঁ রে, ভর্তাহীন বিধবার ভর্তা খাওয়া কি উচিত?
বল না ছোটবউমা
বল… পেঁয়াজ দিসনি যদি,
সে ভর্তা খেয়ে এত কেন ভালো লাগল?
ভুলে যাওয়া ভাতারের চুমা যেন…
৩
ব্রেকফাস্ট টেবিলে স্যালাড কাটতে কাটতে
আমার রিনার কথা মনে পড়ল।
আমাদের বাচ্চারা একসঙ্গে
নার্সারি থেকে উচ্চমাধ্যমিক;
এখন বাচ্চারা বড় হয়ে যে যার মত
অনেক দূরে, আলাদা আলাদা শহরে।
রিনাও এখন অনেক দূরে। অন্য গ্যালাক্সিতে।
রিনা গার্জিয়ানদের ভিড় থেকে দূরে দাঁড়াত।
আমিও। রিনা একদিন বিড়বিড় করে বলল
‘উফফ, এই এক ঝামেলা।
রোজের রান্না আর টিফিন। কাজের লোক না এলে…
ঝোলের স্বাদ কী ভাবে বাড়ানো যায় বলো তো?
শুনেছি তুমি ভালো রাঁধো…
টিফিন দাও একেক দিন একেক রকম।’
- ‘একটু পেঁয়াজকুচি ভেজে দিও নাহয়—
চটজলদি স্বাদ ভালো হবে…’ বলেছিলাম আমি।
রিনার সঙ্গে অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না।
ফেসবুকে ছিল। কিন্তু সেভাবে একটিভ নয়।
আসলে ও বরাবর নিজের মত থাকত।
কী ভাবে জীবনের স্বাদ একটু বাড়িয়ে নিতে হবে,
এটা ভাবতে ভাবতে আমরা কেউই খেয়াল করিনি
জীবন হঠাৎ ফুরিয়ে যায়।
৪
অমৃত মিশে গিয়েছিল রক্তে
যদিও সে রক্ত অসুরের…
মোহিনীরূপী বিষ্ণু নামিয়ে রেখেছিলেন অমৃতের কুম্ভ
হাতে উঠে এসেছিল সুদর্শনচক্র
মুণ্ডচ্ছেদ হবার পরে
অমৃত মেশানো সে রক্ত
মাটিতে পড়ে সৃষ্টি হল পলাণ্ডু ও শুদ্ধিকন্দ।
হননেচ্ছার মধ্য দিয়ে তোমার জন্ম হল।
তাই অভিশাপ লেগে আছে;
অশ্রু ঢাকবে বলে রাহুগ্রস্ত মানুষ আজও
তোমারই শরীরে অস্ত্রাঘাত করে।
৫
মাটির নিচে,
অন্ধকার থেকেই আসে।
যেভাবে সীতা এসেছিলেন।
আবার পাতালে চলে গেলেন তিনি।
দেবী হতে হতেও দেবী হওয়া
সেভাবে হয়ে উঠল না তার…
তোমারও কি সেরকম অভিশাপ আছে কিছু?
৬
সংসারে মন নেই তোমার।
কী করে ভুলে গেলে
পেঁয়াজ ফুরিয়েছে আজ সকালেই।
পেঁয়াজ ছাড়া কী ভাবেই বা রাঁধবে?
ঢেকে দেবে তত ভালো রান্না
করতে না পারার অক্ষমতা।
৭
স্যালাডে পেঁয়াজ দিও
দরাজ হাতে হে সখি
আমাকেই দিও হে হৃদয়…
যদিও বেড়েছে দাম
ট্রাক ট্রাক পচে গেছে
এই দেশে কোথায় কী হয়।
নানা অবতারে আছো
ভোট কিম্বা বিরহ
ঝাঁঝেই ছিনিয়ে নাও জয়।
৮
একটা নধর আকারের গোটা পেঁয়াজ,
পান্তাভাতের থালার পাশে।
এই স্বপ্নটা বিলাস ক’দিন ধরেই দেখছে।
আসলে এখন গোটা একটা পেঁয়াজ
একবেলায় কে আর খেতে পাবে?
অর্ধেক বা সিকিভাগ বরাদ্দ,
যা দাম বাড়ল… কিছু করার নেই।
বাদ চলেও যেতে পারে একদম।
তখন শুধু লঙ্কার আচার দিয়েই…
বউ দু’আঙুল দিয়ে যেভাবে সিঁদুর পরত,
সেভাবে একটিপ লাল লঙ্কার আচার
কৌটো থেকে তুলে নেবে সে।
বউ অনেকদিন আগে
একটা পেঁয়াজরঙা বেনারসি চেয়েছিল।
এখন আর চায় না।
কারণ বউ দু’বছর আগেই
ভিখু ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে পালিয়ে গেছে।
বিলাসের মনে এখন ভাবনা ঢুকেছে
বউ কিসের স্বপ্ন দেখত,
পেঁয়াজের নাকি পেঁয়াজরঙা শাড়ির?
৯
সাদাগুলোই নিতে হবে। ওগুলো আপাতত সস্তা।
এখানে দেশের মত গোলাপি লালচে মিলবে না।
তবে স্পেন থেকে চালান হয় মাঝেমধ্যে।
সেরকম ঝাঁঝ হয় কি?
শ্যালট, শ্যালট সুখ মিষ্টত্ব চেয়েছিলে বুঝি
তুমি কি প্রবাসসুখ ফেলে ফিরে যাবে দেশে?
জুলিয়েন জুলিয়েন কাটবে,
তবে খোসা ছাড়ানোর আগে,
মাটি লেগে থাকা রুটস
গোল করে কেটে বাদ দিতে গিয়ে
সবসময় তোমার ‘শিকড়’ শব্দটা মনে পড়বে।
১০
আসমুদ্রহিমাচল অনেক মানুষ,
এবং পৃথিবী জুড়ে অনেকেই
আহা, পলাণ্ডু, তোমারই কথা ভাবছে
চেতনে, অবচেতনে।
পৃথিবী জুড়ে কত উপাসনালয়ের গম্বুজ
তোমারই আদলে গড়া।
পৃথিবীটা দেখতে কমলালেবুর মত হলেও
ওর রঙরূপেগুণে
তুমি আর ঈর্ষা কোর না।
তাহলে তোমার ঝাঁঝ আরও বেড়ে যাবে।
তখন বলো হে পলাণ্ডু,
আমি তোমায় কী ভাবে সইব?
১১
- সালফারের গন্ধ পাই রে, ছোটবউমা।
- সালফার কী ভাবে আসবে, পিসিমা?
- কিছুটা পেঁয়াজের মত… কেমিস্ট্রি পড়িয়েছি স্কুলে, ও গন্ধ আমি চিনি।
- কোথা থেকে পাচ্ছেন গন্ধটা?
- সব জায়গা থেকে আসছে। কেউ বশীকরণ করতে চায় আমায়।
- বশীকরণ?
- হ্যাঁ, সিঁড়িতে কে যেন রাখে সিঁদুরমাখা জবা…
- কিন্তু কী লাভ তার?
- এ বাড়ির দোতলার মালিকানা আমারই নামে। চলে গেলে…
- এ সব আপনার ভ্রান্তি পিসিমা।
- পেঁয়াজের গন্ধ, জবা… সব ভ্রান্তি?
- কিন্তু আমি যে গন্ধ পাচ্ছি না পিসিমা।
- তুই তো পাবি না। কেউ তোকে করবে না বশ।
আমারও যৌবন ছিল। কেউ পারেনি বশ করতে।
আজ বুঝি কাছে আসে যম। ঘিরে ধরে কালান্তক হাওয়া।
- ও কী কথা! সেরে উঠবেন শীগগির।
- না রে ছোটবউমা। আর সেরে উঠতে চাই না।
কারণ এই গন্ধটা আমার খারাপ লাগছে না।
১২
পেঁয়াজের প্রসঙ্গ উঠলেই আমার রিনার কথা মনে পড়ে।
একদিন মসুর ডালে পেঁয়াজের ফোড়নের গন্ধটা
আমার বেশ লাগছিল। সেদিন নেগেটিভ হলাম।
দুটো গোলাপি দাগের বদলে স্পষ্ট একটা দাগ।
অসুখ থেকে, অসুখের কাল থেকে
আমরা সবাই বেরিয়ে এলাম ধীরে ধীরে।
রিনা আসেনি। ও জানতেও পারল না
নেগেটিভ হলে পেঁয়াজের গন্ধটা অন্যরকম ভালো লাগে।
ভালো লাগলো। পেঁয়াজে যদি শান্তি মেলে
থাকুক পেয়াজ ভাতের থালে।