বেশিদিন নয়, মাত্র এক বছর আগে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের ঘটনা। অতিমারী শেষ ধরে নেওয়া হচ্ছে। নতুন বছর এসেছে সবে। কিন্তু ওদের মনে শান্তি নেই। বরফজমা শীতের রাতে জানুয়ারি মাসে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল যোশীমঠের বিরাট সংখ্যক মানুষকে। কারণ, ঘর আর থাকবার যোগ্য ছিল না। আগে থেকেই অবশ্য অনেক দরবার করেছিলেন ওরা সরকারের কাছে। তখন বলা হয়েছিল যে ওদের ভয়, আশঙ্কা সম্পূর্ণ অমূলক। অথচ দু’তারিখ থেকেই ঘরের দেওয়ালে, মেঝেতে থাকা ছোট ছোট ফাটলগুলো ক্রমে বেড়ে যাচ্ছিল দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে। প্রাণ বাঁচাতে বেরিয়ে এসেছিলেন ওরা। থাকবার বিকল্প ব্যবস্থা হয়েছিল, এটা ঠিক। কিন্তু ঘরছাড়া হবার যন্ত্রণা, উদ্বাস্তু হবার যন্ত্রণা অসহনীয়।
যোশীমঠে অনেক মন্দির। ঈশ্বরের আবাস। মন্দির ঘিরে ঘিরে গড়ে উঠেছে জনপদ। বিষ্ণু, শিব, বিষ্ণুর অবতার নৃসিংহদেবের মন্দির ছাড়াও আছেন কল্পবৃক্ষ। গাছ, একটি তুঁত গাছ এখানে ঈশ্বর। কল্পবৃক্ষের কাছে মানুষ কী প্রার্থনা করতে যায়? ধার্মিক মানুষের বিশ্বাস অমৃতমন্থনের সময় সমুদ্র থেকে উঠে এসেছিল এই কল্পবৃক্ষ। ফলে অমৃতের মতই নাকি এই কল্পবৃক্ষের মহিমা। এই ভাবনা থেকেই প্রশ্ন জাগে মনে… শুধু কি এই একটিমাত্র বৃক্ষকে ঈশ্বরজ্ঞানে পুজো করবে মানুষ? নাকি এই বৃক্ষপূজার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বৃক্ষরক্ষার বাণী ছড়িয়ে দেবার প্রয়াস ছিল ধর্মপ্রণেতাদের? আসলে গাছ একটা ভীষণ জরুরি বিষয় হিমালয়ের ভূপ্রকৃতিতে। গাছ পরিবেশ রক্ষা করে, একথা আমরা সবাই জানি। গাছের সালোকসংশ্লেষে উদ্ভূত অক্সিজেন পরিশুদ্ধ করে বাতাস। কিন্তু হিমালয়ের ক্ষেত্রে শুধু বাতাস নয়, গাছের প্রয়োজন মাটির জন্য। পাহাড়ের ঢালের মাটি স্থিতিশীল রাখতে, ধস প্রতিরোধ করতে গাছের জুড়ি নেই।
হিমালয়ের ভূত্বকের ক্ষেত্রে গাছের প্রয়োজন বুঝে নেবার আগে আমাদের একটু বুঝে নিতে হবে হিমালয়ের গড়ন এবং আকারের বিশেষত্ব। প্রায় ৫ কোটি বছর আগে শুরু হয়েছিল ভঙ্গিল পর্বত হিমালয় নির্মাণের প্রক্রিয়া। তারও অনেক আগে এখানে ছিল সমুদ্র। সামুদ্রিক প্রাণীর জীবাশ্ম থেকে শুরু করে আরও নানাবিধ ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে এখন যেখানে হিমালয়, একসময় সেখানে ছিল টেথিস সাগর। ছিল বটে, এখন আর নেই। এখন তো পাহাড়। হ্যাঁ, পাহাড় বটে, কিন্তু এই পাহাড় তৈরির প্রক্রিয়া জারি আছে এখনো। উত্তরে ইউরেশিয়ান প্লেটের উপরে দক্ষিণ দিক থেকে গিয়ে চেপে বসছে ইন্ডিয়ান প্লেট (চিত্র ১)। নিয়ত চলছে তাদের ধাক্কাধাক্কি। সেই কারণে হিমালয় পর্বতমালার পুরো অঞ্চলটিই প্রচণ্ড ভূমিকম্প প্রবণ। পৃথিবীর বয়সের তুলনায় হিমালয় শিশু। শিশুর চঞ্চলতা নিয়ে নির্মিত হয়ে চলেছে তার শরীর। পর্বতশৃঙ্গের হিমবাহগুলি থেকে যেসব নদী নেমে আসছে শিশুর উচ্ছলতা নিয়ে, তাদের চলার পথে বিশেষ কোনো বাধা থাকলে তারা অনায়াসে সরিয়ে পথ করে নিতে চায়। পাহাড় কেটে নামছে জলধারা প্রবল গতিবেগে, বর্ষার জল পেলে খুব স্বাভাবিক কারণেই তারা ফুলেফেঁপে ওঠে, ভেঙে আনে পাথর। পাহাড়ে নামে ধস। ভূমিকম্প এবং ধস এই দুটি বিপদ লুকিয়ে আছে হিমালয়ে সর্বদা। ধস নামার প্রবণতা বর্ষাকালে বেশি। সেই সময়ে পাহাড়ে ফুলেফেঁপে ওঠা নদীর শোভা দর্শনীয়। কিন্তু সেই নদীর প্রতি বাঁকে বিপদ। আর ভূমিকম্পও অনেকক্ষেত্রেই ধসের কারণ। সর্বদা যে বেশিমাত্রায় ভূমিকম্প পাহাড়ে ঘটে এমন নয়। মানুষে হয়তো বুঝতে পারেনা এমন ছোটখাটো কম্পন যা শুধুমাত্র যন্ত্রে ধরা পড়ে, সেরকম কম্পন পাহাড়ে লেগেই থাকে। কারণ ঐ দুই প্লেট একটা আরেকটার ঘাড়ে উঠতে চাইছে, ফলে ধাক্কাধাক্কি এবং কম্পন। অর্থাৎ হিমালয় পর্বতমালা একেবারেই স্থিতিশীল কোনো অঞ্চল নয়। এমনকি মানুষের পক্ষে যাওয়া দুষ্কর অনেক জায়গা, উচ্চতা এবং চরম শীতল আবহাওয়ার জন্য। পথ নেই অনেক জায়গায়, থাকলেও সে পথ দুর্গম। তবে মানুষ ভাবে যে হিমালয়ের অপরূপ দৈবী সৌন্দর্য বুঝি অধরা থাকবে এই জীবনের চর্মচক্ষুর জন্য। ঈশ্বরকে দেখতে পায়না মানুষ। তাই হিমালয়কে দেখতে চায়। সেই দর্শনের জন্যই সম্ভবত উদ্ভূত হয় উন্নততর পথ নির্মাণের ভাবনা।
এই যে মানুষের হিমালয়কে দেখবার এত ইচ্ছা, সে তো শুধুই তীর্থ দর্শনের পুণ্যার্জনের জন্য নয়। ট্রেকিং করতে যাওয়া ভ্রমণেচ্ছুক মানুষের সংখ্যা কম নয়। পর্বতারোহণ ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে স্পোর্টস হিসেবে। শুধুমাত্র ভারতবর্ষ নয়, সারা পৃথিবী থেকে আগত ট্যুরিস্ট, পর্বতারোহী এদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে দিন দিন। হিমালয়ে পদে পদে এত বিপদ, সে কথা কি মানুষ জানে না? হয়তো এই বিপদের জন্যই হিমালয়ের আকর্ষণ আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। যেদিন মানুষের ধরাছোঁয়ার মধ্যে চলে আসবে সমগ্র হিমালয়, সেদিন সে আকর্ষণ আর থাকবে না। হয়তো সে পথের দিকেই ক্রমাগত অগ্রসর হয়ে চলেছি আমরা।
ফিরে আসি কল্পবৃক্ষের কথায়। নিজের চাহিদা মেটানোর জন্য মানুষ প্রার্থনা করে কল্পবৃক্ষের কাছে। নতজানু হয় তার সামনে। কিন্তু গাছের প্রতি দেবত্ব আরোপ করেই কি থেমে যায় মানুষের কাজ? আসলে আমরা মিথকেও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি না। আবার বিজ্ঞানের কাছ থেকেও সেটুকুই আহরণ করি, যেটুকুতে আমাদের তাৎক্ষণিক কিছু জাগতিক লাভের আশা আছে। কল্পবৃক্ষের শাখা যেদিন হেলে পড়বে, সেদিনই নেমে আসবে যোশীমঠে এবং আশেপাশে বিপর্যয়, এমনিই ছিল মিথ। সে শাখা তো কবেই হেলে পড়েছিল। কেউ দেখেনি। কিম্বা গাছের ভাষা বিশ্বাস করেনি। তারপরও নির্বিচারে চলেছে চওড়া পথ তৈরির কাজ, সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ এবং অজস্র জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির কাজ। এসব নির্মাণকাজ করতে গিয়ে নির্বিচারে কাটা পড়েছে অজস্র গাছ। পর্বতের ঢাল আঁকড়ে মাটি শক্ত করে গাছের শিকড়, নিয়ত ছোটখাটো কম্পনের আঁচ আসতে দেয় না মাটির বুকে। মাটির নিচে অরণ্যের শিকড়ে শিকড়ে তৈরি হয় এক বন্ধুত্বের নেটওয়ার্ক, যা মাটির স্থিতিশীলতা ক্রমশ বাড়িয়ে তোলে। হিমালয়ের ভূপ্রকৃতির মাটি, বাতাস সবকিছুর জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় গাছ। অথচ সভ্যতার নির্মাণ যজ্ঞে কত গাছ বলি হয়ে যাচ্ছে, কেউ জানে না।
তবে যোশীমঠের ক্ষেত্রে ভুল একটা নয়। অজস্র ভুল একের পর এক হয়ে গিয়েছে। হিমালয় কোনো ভুল ক্ষমা করে না। হিমালয়ের প্রধান মিথ হল এই পর্বত দেবতাত্মা হিমালয়। দেবভূমি। দেবতাদের বাস, সন্ন্যাসী, সাধু সন্তদের বাস। গৃহী মানুষের উপস্থিত থাকা উচিত নয় এখানে। গৃহী, সংসারী মানুষ যেভাবে গুছিয়ে শিকড় গেড়ে বসবাস করে, তেমনটি এখানে না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এই মিথ তৈরি হবার পেছনে যৌক্তিকতা প্রমাণ করে দিয়েছে যোশীমঠ। কারণ এখানে পায়ের নিচের মাটি এখানে যে কোনো সময় বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। এখানকার ভূমিস্তরের কথাই যদি ধরা হয়, এখানে শহরটি নির্মিত হয়েছে নদীবাহিত, হিমবাহ দ্বারা বাহিত এবং ধসবাহিত মাটি-পাথরের দ্বারা যে ফ্যান অর্থাৎ পাখা আকৃতির ভূমিরূপ তৈরি হয়, সেরকম একটি ফ্যানের উপরে (চিত্র ২)। অর্থাৎ, একেই তো হিমালয় পর্বত নবীন, উপরন্তু যোশীমঠের ভূমি নবীনতর। হিমবাহ দ্বারা বাহিত পলির দানার সূক্ষ্মতা কম। পাথরের বড় বড় টুকরো মিশে আছে এই হিমবাহ দ্বারা বয়ে নিয়ে আসা কাদামাটির তালে। সাদা চোখে দেখে হয়তো বোঝা সম্ভব নয়, কিন্তু পরীক্ষা করে দেখলে পরিষ্কার হয়ে যায় যে এই পলির কঠিনায়ন হয়ে শক্ত মাটিতে পরিণত হতে এখনও কয়েক কোটি বছর বাকি। সুতরাং কোনো রকমের বড় নির্মাণ কাঠামোর ভার বহন করবার উপযুক্ত নয় যোশীমঠের মাটি। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াল? এই যোশীমঠ ঘিরে শহর গড়ে উঠবার পরিকল্পনাটাই ছিল সম্পূর্ণ ভুল এবং সেখানে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ছিল ভুলের উপর বৃহত্তর ভুল। যোশীমঠ ঘিরে বয়ে চলেছে অলকানন্দা। পার্বত্য নদী যে সাঙ্ঘাতিক গতিতে চারপাশের মাটি পাথর ভেঙে নিয়ে যায়, সেই ক্রিয়াও রয়েছে অব্যাহত। তাছাড়াও আছে চ্যুতিরেখার বিপদ, যা ভূমিকম্পের ফলে নড়েচড়ে সক্রিয় হয়ে ধস ত্বরান্বিত করে। অর্থাৎ যোশীমঠ তীর্থ হতে পারে, ঈশ্বরের আবাসস্থল হতে পারে, কিন্তু মানুষের বসবাসের যোগ্য, নগরায়নের যোগ্য ঠাঁই একেবারেই নয়।