(এক)
মাঝ রাতে নদীর পাড় ভাঙে কচ্ছপটি। গুটি গুটি নেমে আসে জঙ্গলের গহন পথে। এ সময় স্তব্ধ চরাচর। নিঝুম অন্ধকারে ঘুমায় জঙ্গল। ঘুমায় হাসদেও নদী। পায়ে আজকাল জোর মেলে না তেমন। ঘসা অভ্রের মতো চোখ। সে চোখে গ্রহণ লেগেছে বহুকাল। এতদিন বাঁচা ভালো নয়, তবু কেন বেঁচে আছে? এই ধ্বংসলীলা দেখতে হবে বলে? ওই যে দাগ দেওয়া হাজার হাজার গাছ, দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে। তাদের ঝপাঝপ মাটিতে পড়ে যাওয়া, আর পড়ে যাওয়ার আগে ঘরঘর মেশিন করাত, ফালাফালা করে দেওয়া বৃক্ষ শরীর। তাকে দেখতে হবে? এই বনানী, এই নদী তাকে কাচ্ছু বলেই চেনে।
কতকাল বেঁচে আছে সে? কাচ্ছু নিজেকেই প্রশ্ন করে।দেড়শ বছর নাকি তারও বেশি? ওই পাশে গা ঘেসাঘেসি করে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা শাল, সেগুন, হরিতকি, বহড়া। কাচ্ছু কী তাদের চেয়েও বড় নাকি তাদের সমবয়সী? আজকাল মনে পড়ে না অনেক কিছুই। সে তার মোটা আঁশওয়ালা ভারি খোল বয়ে বয়ে হাঁটে, খোলের গায়ে শ্যাওলা গন্ধ। বেশ কিছুদিন কিছুই খায়নি সে। খেতে ইচ্ছাও করে না খুব একটা। খাওয়া বলতে তো খুঁজে খুঁজে পাওয়া নরম তুলেতুলে খুকুণ্ডি। দু এক টুকরো, তাতেই চলে যায় পাঁচ সাত দিন। বয়স বাড়লে খিদেও মরে যায়, বিশেষ করে আমিষ তো রুচেই না আজকাল। অথচ এক সময় গিরগিট, ছিপকলি,চুহা, গিলহরি সাপটে দিত অবলীলায়। মেঢক কিংবা সাপের বাচ্চাও খেয়ে ফেলেছে কতবার। আর এখন শুধুই খুকুণ্ডি।
খুকুণ্ডি পাওয়া আজকাল বড় মুশকিল। জঙ্গলের গভীরে শাল গাছের গা জড়িয়ে ওঠা উইয়ের তোলা নরম মাটি কিংবা লাল গিলা মাটিতে সাদা কিংবা মেটে রঙের গোল গোল খুকুণ্ডি জন্মায়। সাপিনী কিংবা মাদি কাছুয়ার ডিমের মতো। গোন্দ,বাইগা মানুষের দল তার খবর রাখে আর রাখে সে। মানুষ দিনের বেলায় খুকুণ্ডি ঝুড়িতে ভরে রায়পুর, দুরগ্ আরও কোন কোন শহরে নিয়ে গিয়ে বেচে। শহরে তার নাম মাশরুম। তাকে বেরুতে হয় রাতের বেলায়, মানুষের চোখ এড়িয়ে। নাহলে মানুষগুলো হৈ হৈ করে উঠবে, কাছুয়া, কাছুয়া! ইতনা বড়া কাছুয়া! কেটে কুটে খেয়ে ফেলবে তাকে। হাসদেও আরন্দ অরণ্যের যুবতী মাদি কাছুয়া গুলোর গর্ভে কত হাজার হাজার ডিমের জন্ম দিয়েছিল সে! আজ কটা কাছুয়া বেঁচে আছে? বেশিরভাগই খেয়ে ফেলেছে মানুষ।
জঙ্গলের বুক চিরে টিরেন লাইন। কুচি পাথর ছড়ানো লাইনটা বুকে ভাঙে কাচ্ছু। এবড়ো খেবড়ো সেই পথ। আরও খানিকটা গেলে গভীর জঙ্গল। তার ভিতরে গেলে মিলবে খুকুণ্ডি। অবশ্য আর বেশি দিন মিলবে না। জঙ্গল কাটা শুরু হয়ে গেছে। ধিরে ধিরে পুরো জঙ্গল কোতল হয়ে যাবে। জঙ্গল না থাকলে খুকুণ্ডি থাকবে কী করে? লাইন পেরুতে পেরুতে ঘাড় ঘুরিয়ে আড় চোখে ইস্টিশনটাকে দেখে নেয় কাচ্ছু। শুয়ে আছে ইস্টিশনটা। না, শুয়ে নয় বরং বলা ভালো ঘুমিয়ে আছে। বাড়ি ফিরতে না পারা কুলি, কামিন, ঠিকা মজদুর কোলে কাঁখে ভরে পড়ে পড়ে টেনে ঘুম দিচ্ছে ইস্টিশন। কুয়াশায় আপাদ মস্তক ঢেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিব্যি ঘুমায় শাল সেগুন মহুল কিংবা বহড়া হরিতকির দল। হাঁড়িয়া অথবা রসির মাতন, সাঁতলানো বাখরে মাথা ঝিমঝিম। কাচ্ছু জঙ্গলে ঢুকে যায়।
বড় গহীন জঙ্গল। বুড্ঢা কাচ্ছু জানে দুনিয়া জুড়ে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির তত্ত্ব এই জঙ্গলে থমকে আছে। কোটি কোটি বছর আগের গণ্ডোয়ানার হিস্যা এই জায়গা। ভদ্দরলোক মানুষরা নিজেরা এগিয়েছে কিন্তু গোন্দ, বাইগা, ওঁরাওদের এগুতে দেয়নি। আজও কুড়িতেই বুড়ি অথবা বুড়ো হতে শুরু করে রুখু আর লাল মাটি, জঙ্গল জীবন। শুধু বড় বড় গাছগুলো দীর্ঘ আয়ু নিয়ে বাঁচতে পারে। পারে মাটির গহন ও গভীরতর অংশে শেকড় চালান করার ক্ষমতায়। মানুষের শেকড় নেই, আছে কেবল গাঁইতি আর শাবলের কঠিন, কঠোরতর উচ্ছ্বাস। সে উচ্ছাস মাটির গভীরতা ছুঁতে পারে না। তাই জঙ্গল মানুষের আয়ু বাড়ে না খুব একটা, চল্লিশেই খয়াটে জীবন। তাই যতদিন বাঁচা ততদিন আহ্লাদ যাপন।
কাচ্ছু সেই বুড়ি মানুষীটিকে জানে, যে কাচিয়ে রাখা ভাত মাটির হাঁড়িতে ভিজিয়ে রাখে। আদি ও অনন্তকালের প্রাচীনতম ফার্মেন্টেশন সূত্র, গেঁজিয়ে ওঠার রসায়ন! বুড়ির ঘোরা ফেরা বনানীর গর্ভগৃহে। সে জোগাড় করে সমরকানি, আনকান্ডাই ,চাউলিয়া, কাংগা-আলু, পাতাল-গরুড়া, হাবিনের ঝাড়। বাঁশের চাঁচর দিয়ে শালবিশাল, কুলুচি গাছের বাকল তোলে। ঝোরের পানি দিয়ে চাটানে বাটন বাটে, রোদ খাইয়ে বড়ি বনায়, জবরদস্ত বাখর অনুপান! তারপর দেড় দিনের দিন গেঁজানো ভাতে পরিমাণ মত বড়ি মিশিয় আরও দেড় দিন রাখা। তিন রাত পুহালে আঁচল দিয়ে ছেঁকে দুধ সাদা জল সংগ্রহ। অবশিষ্ট কাথ টুকু ছড়িয়ে দেয় সদ্য গজিয়ে ওঠা শাল সেগুনের কচি চারাগুলোর গোড়ায়। তক্কে তক্কে থাকে বন টিয়া, পাহাড়ি ময়না কিংবা ধনেশের ছানাপোনা রা। গাছেদের সাথে পরমাহ্লাদে অমৃত ভাগ করে খায়। সেই বাখর মেশানো কাথ চেটে পুটে পুরো তিন রাত ঘুমিয়েছিল কাচ্ছু।
কাচ্ছু গন্ধ পায়। সাদা ভাতের জল আর কালো দলা পাকানো বাখর মিশে টকচা গন্ধে ম ম করে জঙ্গলের বাতাস। সে ভাবে, আজ সন্ধ্যায় জরুর আগুন জ্বলেছিল। সেই আগুনে ধামসা আর মাদল সেঁকেছিল পুরুষের দল। কুড়চি ফুলে খোঁপা সাজিয়েছিল কালো ডাগর মেয়েরা। দ্রিম দ্রিদ্রিম, দ্রিম দ্রিদ্রিম আওয়াজ উঠেছিল । আম যুবতীদের ক্ষীণ কটি দুলে উঠেছিল বহুৎ খুব। আড় বাঁশের বাঁশরি পাহাড়ে গিয়ে প্রতিধ্বনি তুলেছিল, কেঁদরা আর ভুয়াং কঁকিয়ে কেঁদে উঠেছিল বিলম্বিত লয়ে। কাচ্ছুর বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। একসময় তারও দিন ছিল। কাছুয়ানিকে নিয়ে সে ঘুরে ঘুরে দেখত, মহুল আর হাঁড়িয়ায় ঢুলু ঢুলু মদিরা চোখ। জাতে মাতাল, তালে ঠিক। ঠিকঠাক আত্মজন খুঁজে নেয়। জীবন বড় ছোট, এই বেলা ডুংরির গড়ানটায় চলনা কেন্ ? জোড়ায় জোড়ায় তারুণ্য নেমে আসে ডুংরির ঢালে, মুড়হল অথবা বুঢ়া বুঢ়িরা আড় চোখে দেখে। তাদের নেশা চোখে অবাধ প্রশ্রয়। প্রণয় কাতর অবাধ্য যৌবন। অবিভ্রমের তালে বেজে ওঠে ধামসা, মাদল। দ্রিম দ্রিদ্রিম, দ্রিম দ্রিদ্রিম, দ্রিম দ্রিদ্রিম….
কাচ্ছু জানে বুড়ো শাল, বৃদ্ধ সেগুন, অতি বৃদ্ধ মহুল, বহড়া, হরিতকিরা এ মাতনে মাতে না। তারই মতো লাশ হতে হতে ভাগ্যক্রমে টিকে গিয়েছে ওরাও। তখন ফি বছর বৃক্ষ নিধনোৎসবে সময় এই বড় গাছগুলোর ছায়ায় বিলিতি কায়দায় পীরিত করত বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে কোম্পানির ইংরেজ সাহেব মেমের দল। এই উষর, বন্ধুর, লাল মরুর দেশে গা পুড়ানো রোদের তেজ থেকে ধবল লালচে সাহেব বিবিদের ছায়া জুগিয়েছিল কয়েকটা ছায়া তরুর দল। সেই কটা গাছ না থাকলে চলে না, তাই টিকে যাওয়া এদের। সেদিন থেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিরন্তর মৃত্যু গোনে তারা। কাচ্ছু জানে তার চেয়েও এই গাছেদের দুঃখ বেশি।
এই মহাবৃক্ষের দল স্বজাতির শেষ লাশ দেখেছিল একশ তিরিশ কিংবা চল্লিশ বছর আগে। হাত করাতে শত শত মজুর ফালা ফালা করেছিল তাদের। ধুমসা ধুমসা পাটা বনাই তার উপর দিয়ে চলেছিল রেলের লাইন। তারপর সে সব উপড়ায় এখন কংক্রিট স্লিপার। এখন আবার পালা আসছে লাশ বনার। তাই মাতনে মাতার উপায় কী? একশ চল্লিশ বছর ধরে ধুঁকে ধাঁকে ছেনাপোনা বাড়িয়েছে তারা। তাতেই জঙ্গল গভীর হয়েছিল খুব। এখন আবার, এই সময় সরগুজা, সহলি, ঘাটবড়া, ফতেপুরে ঘর ছাড়ার ধুম। কোলে কাঁখে ছেনাপুনা লিয়ে, মাথায় কাঁধে হাঁড়ি কুড়ি লিয়ে, কাঁধে কুঁদে বাঁক ঝুলিয়ে দড়ি, ঝুড়ি, ঝাঁটা, চাটাই লিয়ে ঘর ছাড়ছে কালা কুলা মানুষের দল। মিশিনে খবর মিলেছে তাদের ঘরের কাঁদলে, ভিতরে, উঠানে আর গাছের শিকড় গহনে নাকি কালো সোনা! খুলা খাদানে কাঁচা কয়লা মিলবে ঢের। ঘাস,পাতা,লতা, কন্দ, খুকুণ্ডি কারুরই টিকার উপায় লাই। এখন আর বিলিতি সাহেব মেম নেই কিন্তু দিশি সাহেবরা আছে। তারাই কিনেছে পুরা জঙ্গল।
(দুই)
কাচ্ছু মনে মনে হাসে আর ভাবে, সে সরকার বিলাতি ছিল, এ সরকার দেশি। এই কিছুদিন আগে সত্তর পাঁচের বাজনা বাজিয়েছে সরকার কিন্তু বেচে দিয়েছে বন আর পাহাড়। এখন মিশিন করাত ফিতা মেপে মেপে ফরসা করছে জঙ্গল। শুরুতে লড়াই হয়েছিল খুব কিন্তু শেষমেশ আদালতও সই দিয়েছে মৃত্যুদণ্ডে। আর বাঁচার উপায় নাই। শিকড় খেয়ে খুবলে, উপড়ে উগলে, গহন গভীর থেকে কালা সোনা তুলে আনবে গুজরাটি কুম্পানি। গুমগাম পাহাড় ফাটায় বার করবে কাঁচা কয়লা। সেই কাঁচা সোনা পুড়হাঁয় বয়লারে জল ফুটবে টগবগ করে, তেজি সাদা গরম হাওয়ায় মিশিন ঘুরবে পাগলপনা। বিজলির আলোয় ঝকমক করবে মরু প্রদেশ। শহরের আলোর জন্য জঙ্গলকে বলি দিতে হবে নাই! খুব একটা লইতন কথা কি? কাতারে কাতারে জঙ্গল ছাড়ছে গোন্দ ,বইগা, ওঁরাও, লোহার। মানুষ ঘর ছাড়া হলে গাছ কী নিজেকে ধরে রাখতে পারে? কাটা পড়তেই হবে। হয়ত ওরা শেষবারের মত মজা করে নিচ্ছে পাহাড়ের ঢালে। শাল সেগুন বহড়া হরিতকি মজা করতে পারে না, নিষ্পলক, নিদ্রাহীন সারারাত। আর মজা করতে পারে না কাচ্ছু । জঙ্গলের সাথে খুব দোস্তি যে তার।
কখনও কখনও মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে কাচ্ছু শুনতে পায়, পাহাড়ের ওপাশে ভারি বুটের ঝুপঝাপ। মাঝ রাতে ইস্টিশনে টিরেন উগরে দেয় জলপাই পোশাক। সে পোশাকে চকর বকর ছাপ। হাতে এলএমজি, একে ফিফটি সিক্স, হাজার ফুটোয়ালা মিশ কালো কারবাইন। বেনিয়ার লুটের পাহারাদার রাষ্ট্রের পুলিশ আর আধা সেনা, জো হুকুম চারপাশ। বাধা আসলে বারুদ গন্ধে সম্মোহিত হবে জঙ্গল। জঙ্গলের মাথায় তখন ভীষণ হুটোপুটি। ডানা ঝাপটে আকাশ থেকে খসে পড়ে পাহাড়ি ময়না, ডোরা কাটা পেঁচা, লাল জংলি মোরগ, লম্বা লেজওয়ালা দ্রাংগো, ময়ূর, তোতা, স্টেপ ঈগল, লাল পেঁচা, ফাকতা, ভুরা টিটার, হেরনের দল। গাছের বাকলে চেপ্টে মরে থাকে রঙ-বেরঙের প্রজাপতি, ফড়িং, পতঙ্গ, ব্যাঙ। পাহাড়ি ফাটল, মোরামের গর্ত, গাছের কোটর থেকে ছটপট করতে করতে বেরিয়ে আসে সাপ, গোসাপ, গেকো, টিকটিকি, গিরগিটি, খঞ্জনি, ক্যামেলিয়ান, কুমীর, ঘড়িয়াল, কচ্ছপ, কাছিমের দল। কর্পোরেট ফাঁদ এড়াতে এ জঙ্গল থেকে ও জঙ্গলে ছুটে বেড়ায় হাতি, লেপার্ড, শ্লথ ভালুক, হায়না, ধূসর রঙা নেকড়ে, বন্য বিড়াল, উড়ন্ত কাঠবিড়ালি, বানরেরা। ভোরের হকার মাঝে মধ্যে দূর দূর গ্রামের খবর বিলি করে, এনকাউন্টারে খতম হীরা, কাশডুবা, আহিরার জঙ্গিরা।
কাচ্ছু ঘুমোয় না, ঝিমোয়। ভোরের আলো মেখে পাখপাখালির নিশ্চুপ নীরতায়। বহু দূর থেকে টিরেনের হুইসেল শুনতে পায় বুঢ়া ফাগু মুণ্ডা। কাচ্ছুর মতই বুঢ়া ফাগুর ঘুম বড় কম। তার গতর পড়েছে , কুম্পানি তাকে জুতে দিয়েছে কুলি কামিনদের জল জোগানোর কাজে। ফাগুর চোখ মিটমিট করে, দু'হাতে চোখ কচলিয়ে দেখতে পায় সিগন্যালে হারা আলো। টিরেন আসছে, টিরেন আসছে, চেঁচিয়ে টিসন মাত করে ফাগু। ধড়ফড়িয়ে জেগে ওঠে জাড় মেখে ঘুমিয়ে থাকা স্টেশন। ফাগুর চেয়েও বুড়ো গাছগুলোর পাতা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়ে। আগের স্টেশন ছেড়ে আসছে ট্রেনটা।
খুকুণ্ডি খেয়ে ফেরার পথে কাচ্ছু দেখতে পায় ডিসট্যান্স সিগন্যালের হলুদ আলো কুয়াশায় নাচছে। সে শুনতে পায় টিরেনের মোটা কর্কশ অথচ তীক্ষ্ণ বাঁশি। চারপাশের জনপদকে জাগিয়ে আসছে একটা টিরেন। আসছে আরও মিশিন, আরও কুলি, কামিনের দল। কাচ্ছু বুড়ো শাল, সেগুন, হরিতকি, বহড়ার ছানাপোনা, নাতি নাতিনের দিকে তাকায়। সে ফিরতি পথের লাইন পেরুতে ভুলে যায়। কচি কচি শাল পিয়াশালের চারাগুলোকে বলে, আহা! ঘুমিয়ে নাও বাছারা আমার। আর একটু ঘুমিয়ে নাও। আরও কিছুক্ষণ ঘুমাও। ভালো করে জিরিয়ে ওঠো। দম নাও, নিজেকে আরো বড় করে তোল, এই আমার মত! এই পাহাড়, এই জঙ্গল, এই নদী, এই দুনিয়া আমাদের। ফির আমরা এর দখল লিবই। কী যেন তোলপাড় হতে থাকে কাচ্ছুর মধ্যে। কী এক শক্তি ভর করে তাকে। নিজেকে ফোলাতে থাকে সে। ফুলতে ফুলতে সে যেন একটা টিলায় পরিণত হয়ে যায়।
ট্রেনটা জোরে আসছিল। মারাত্মক গতিতে। কিন্তু কুয়াশা কাটার হলদেটে আলোয় চালক দেখল, ছোটখাটো পাহাড়ের মত কিছু একটা যেন হঠাৎ গজিয়ে উঠেছে লাইনের ওপর। ঝিমুনি কেটে গেল চালকের। ইমার্জেন্সি ব্রেক কষল সে। বিরাট ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল ট্রেনটা। ভোরের যাত্রীদের খোয়ারি ভাঙিয়ে চা বিক্রি করছিল একটা চাওয়ালা। কামরায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল হেঁড়ে গলায়, চায়ে গ্রাম্, চায়ে গ্রাম্ বুলি। সেও বুলিও থেমে গেল। আধ খোলা দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে চাওয়ালা দেখল, লাইনের ওপর টিলার মত দাঁড়িয়ে থাকা বস্তুটার দুটো চোখ আঁচের আগুনের মত জ্বলছে! খোলার ভেতর থেকে গলা বের করেছে কাচ্ছু। চালকের চোখে চোখ রেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাসদেওর প্রাচীনতম সরীসৃপ।