এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • লিটিং লিং - ১

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১১৪৫ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)

  • কচি ছেলেকে কোলে নিয়ে বউমাঠাকরেন আর ছোড়দিমণি উঠে পড়লেন গাড়ির ছইয়ের ভিতর। ছইয়ের ভিতর খড় বিছিয়ে নরম গদি, তার ওপরে পরিষ্কার বিছানার চাদর। তার ওপরে গুছিয়ে বসলেন বউমা ঠাকরুন, কোলে একবছরের ছেলেকে নিয়ে, আর ছোটদিমণি বসলেন তাঁর গা ঘেঁষে। গোলাপের ছবি ছাপা লোহার ট্রাংক, তার সঙ্গে অনেকগুলি পুঁটলি। সেই সব পুঁটলিতে আছে - কচি ছেলে বার বার হিসি করে ফেলবে, হাগুও  করে ফেলতে পারে, তাই কাচা কাপড়ের টুকরো - পুরোন ধুতি, শাড়ি ছিঁড়ে তৈরি করা। অন্য এক পুঁটলিতে আছে, শুকনো চিঁড়ে, গুড়ের পাটালি, বাতাসা, নারকেলের নাড়ু। আরেকটা বড়ো পুঁটুলিতে এত্তো মুড়ি, পথে খিদে পেলে সবার খাওয়া চলবে। মাটির কলসিতে আছে খাবার জল। পথ তো নেহাত কম নয়। বড়দাঠাকুর বলছেন পনের-বিশ ক্রোশ, আর গাড়ির গাড়োয়ান ভরতকা বলল, “লা গো বড়দাঠাকুর, লা - লয় লয় করে তিরিশ, পঁইতিরিশ কোশ তো হবেই! এই তো সেদিনকারে তোমার বে দে আনলোম ওই গাঁ থেকে, আমি জানবো নে”?
    যুবতী বউ আর তরুণী শালীর কাছে বেইজ্জত হবার ভয়ে, বড়দাঠাকুর খুব তাচ্ছিল্য করে জবাব দিলেন, “যাও, যাও, তুমি একেবারে সরকারি আমিন হয়ে উঠেছ, ভরতকা। মনে হচ্ছে, চেন ফেলে জরিপ করে দেখে এসেছ কতটা দূর?”
    ভরতকাকার প্রাণখোলা হাসিতে, পাশে বসে থাকা সাদা বলদদুটোও একটু যেন চমকে গেল, হাসি থামিয়ে ভরতকা বলল, “তা যা বলেচো, বড়দাঠাকুর, তবে হ্যাঁ, দু এক কোশ কমবেশি হতে পারে, তার বেশি লয়”। ভরতকা কথাও বলে, কাজও করে। বউমাঠাকরুনরা গাড়ির ভেতরে বসে গেছেন, সে দেখেছে। তাই চটপট হাতে, ছইয়ের পিছনে তুলে দিতে লাগল, শ্বশুরবাড়ি থেকে বউমার বাপের বাড়ির জন্য পাঠানো নানান শুভেচ্ছা তত্ত্ব। তার মধ্যে আছে একটা বড়োসড়ো কুমড়ো, দশ বারোটা নারকেল, বেয়াইমশাই লাউ খেতে খুব ভালোবাসেন, চাল থেকে সবে পেড়ে আনা দুটো নধর লাউ। বেতের ধামায় সের পাঁচেক গোবিন্দভোগ চাল, ছেলেপুলেরা পায়েস খাবে। নলেন গুড়ের নাগরি চারটে, এবারে খেজুর গাছের জিরেনে খুব রস এসেছিল, তাই একটু কড়া পাকে জ্বাল দেওয়া চারটে খেজুরগুড়ের পাটালি। রাজস্থানী কড়ির বড়ো বয়ামে গব্য ঘি।

    সব জিনিষপত্র একে একে গুছিয়ে তুলে দেওয়ার পর, ভরতকা বড়দাঠাকুরকে বলল, “থালে রওনা হওয়া যাক, বড়দাঠাকুর। বেলা বাড়িয়ে আর লাভ কী? অনেকটা পথ, এখনই রওনা হলে, তাও বেলাবেলি পৌঁচে যাওয়া যাবে”। বড়দাঠাকুরের অনুমতির অপেক্ষা না করে ভরতকা মুখে আওয়াজ তুলল, “হুরররর, হ্যা দ্দ্যাক, বসে আছে দুটো য্যান নবাব পুত্তুর, ওঠ ওঠ, হুরররর হ্যাট হ্যাট”।
    অলস বসে বসে জাবর কাটতে থাকা বলদ দুটো উঠে দাঁড়াল ভরতকার ভাষায়। ভোর ভোর ডাবায় ভরা সরষের ঝাঁজালো খোল মেশানো জল-বিচালি তারা ভরপেট খেয়ে নিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ আর খাবার চিন্তা নেই। ভরতকা তাদের পাছায় চাপড় দিতে দিতে ডেকে আনল গাড়ির সামনে, তারপর নিজের শরীরের ভারে নামিয়ে নিল গাড়ির সামনের দিক। মুখে “হা, হা, হা হা, অ্যাদ্দ্যাক অ্যাদ্দাক, আব্বর নাকি রে”? বলতে বলতে প্রথম বলদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিল জোয়াল, এবার দ্বিতীয়টাকেও ঠিক জায়গায় এনে, বাঁশের গোঁজ দিয়ে, জোয়ালের সঙ্গে বেঁধে ফেলল বলদ দুটোকে। এবার দুই বলদের কাঁধে সমান ভাবে চাপ দিয়ে, তুড়ুক লাফ মেরে উঠে বসল, গাড়ির একদম সামনে, দুই বলদের মাঝখানে ফালি জায়গাতে। সেখানেও চারটি খড় বিছিয়ে বসার জায়গা করা আছে, আর সেই আসনের তলাতেই গোঁজা আছে পাঁচন গাছটা। ভরতকা গাড়িতে চেপে বসাতে, গাড়ি এবার জমির সঙ্গে সমান্তরাল হয়ে গেল; ভরতকার ভারে, জোয়াল চেপে বসল দুই বলদের কাঁধে। গাড়ির সমস্ত ভার সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ল দুই চাকা ও দুই বলদের কাঁধে। বলদেরা নড়াচড়া করে, নিজেদের চার পায়ের ওপর সামলে নিল সেই ভার। বলদের পক্ষে এখন আর কোন মতেই এই ভার ছাড়িয়ে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
    ভরতকা পাঁচন গাছটা হাতে নিয়ে দুই হাত জড়ো করে, পুবের সূর্যের দিকে তাকিয়ে নমস্কার করল, তারপর বড়দাঠাকুরের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “কি ভাবচো, বল দিকি, ভাবতে ভাবতে বেলা কাবার করে দেবে নাকি? উটে পড়ো, উটে পড়ো, দুগ্‌গা দুগ্‌গা বলে”।
    বড়দাঠাকুর বাড়ির দরজার ফ্রেমে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “চললাম, মা, সাবধানে থেকো।  আমাদের জন্য চিন্তা করো না”।  
    মা বললেন, “আয় বাবা, আয়। বৌমাকে বলিস পৌঁছসংবাদ দিয়ে একটা পোস্টকার্ড লিখতে, কচি ছেলেকে নিয়ে এতটা পথ...দুগ্‌গা দুগ্‌গা। মা, মাগো, মা বিপত্তারিণী, সব দিক দেখো মা”। মা যখন জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার করছেন ইষ্টদেবতাকে, বড়দাঠাকুর লাফিয়ে উঠে বসলেন, ভরতকার পিছনে, ঠিক যেখানটায় ছই শেষ হয়েছে, সেই চওড়া জায়গাটায়। নিজে গুছিয়ে বসার পর, কোলে তুলে নিলেন বছর ছয়েকের ছেলেকে, তারপর পাশে আরাম করে বসিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে কাছে টেনে নিলেন - আদরও হল, আবার নিরাপত্তাও হল। তারপর বললেন, “ভরতকা, চালাও দেখি তোমার রথ”।
    ভরতকা হাসল, কথার উত্তর না দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “চ না, র‍্যা! দাঁড়োয়ে দাঁড়োয়ে কতা শুনতেচে দ্যাখো, যেন কত বুঝদেরে হয়েচে, হুরররর, হ্যাট”।
    অচল অবস্থা থেকে গাড়িকে চালু করতে একটু বেশি শক্তি লাগে, চাকা একবার গড়াতে শুরু করলে, অনেক সহজ হয়ে যায় চলতে থাকা। বলদদুটোর লেজে হালকা মোচড় দিয়ে ভরতকা আবার বেজে উঠল, “টান, টান, হুরররর, হ্যাট, মুখ নেড়ে ভোর ভোর এক নাদা খোল বিচুলিতো পেটে পুরলি, বাপ আমার, এবার গতরটাকে একটু নাড়া, হুরররর”।
    লেজের ব্যাথায় আর ভরতকার কথায়, বলদদুটো বেশ জোরের সঙ্গে টানতে লাগল জোয়ালটা, আর তারপরই গাড়িটা গড়াতে শুরু করল। লেজের থেকে হাত সরিয়ে ভরতকা, দুই বলদের পিঠে হালকা চাপড় দিল, যেন বলতে চাইল, ‘ব্যথা একটু দিয়েছি, বাপ, ওটা মনে রাখিস না’। হাতের ভাষা বুঝে বলদদুটো স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে লাগল।  তাদের স্বাভাবিক চলার ছন্দে, তাদের গলায় বাঁধা ঘন্টির ধ্বনিও ছন্দোময় হয়ে উঠল, লিটিং লিং লিটিং লিং টিংলি টিং।



    গাড়ি চলছে। ছইয়ের সামনে পর্দা ফেলা, ছইয়ের পিছনেও পর্দা ফেলা। এই গাঁয়ের বউ বাপের বাড়ি যাচ্ছে, তাই বলে উটকো লোক বউয়ের মুখ দেখবে নাকি? এমন অসৈরণ হতে আছে? তাছাড়াও বলদের ক্ষুরের আঘাতে, গাড়ির চাকার নিকে, মেটে রাস্তায় ধুলো ওড়ে বিস্তর। রাঢ় বাংলার মাটির রঙ গিরি, সে মাটির ধুলো চুলের কালো বর্ণকে ধূসর লালচে করে দেয়, আর সেই ধুলোয় কিচকিচ করে চোখের কোল, ঠোঁটের কষ আর দাঁত। পর্দা থাকলে, সেটা অনেকটাই রক্ষে হয়, তবু ফাঁক ফোকর তো আর বন্ধ করা যায় না।
    আব্রু আর নিয়মকানুনের মজাই হল, তাকে ভেঙে ফেলার মধ্যে। চেরা বাঁশের কাঠামোর ওপর চাপানো, বেতের বোনা ছইয়ের ভেতরের দিকে কাপড়ের পাড় দিয়ে যতই নকশা করা থাক না কেন, কতক্ষণ আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা সম্ভব সেই একঘেয়ে শিল্পকর্ম? আর সঙ্গে যদি থাকে শৈশবের সঙ্গী সেই ছোট্ট বোনটি, যে এখন জীবনের ধর্মে মোটেই আর ছোট্ট নেই এবং হয়তো দু এক বছরের মধ্যে সেও চলে যাবে অজানা এক শ্বশুরবাড়িতে, তাহলে? তার সঙ্গে এই নির্জন ছইয়ের মধ্যে কিছুটা চপল হওয়াই যায়, কিছুটা খুনসুটি করাই যায়। কোলে দুধের শিশু ঘুমিয়ে রয়েছে বলেই, বউমাঠাকরুণ যে তিনকেলে বুড়ি হয়ে গিয়েছে এমন তো আর নয়!
    “ওই, ওই যে দেখতে পাচ্ছিস, মণি? ওই যে রে জোড়া নারকেল গাছের ওপাশে পুকুরটা - দেখতে পাচ্ছিস না? ওই পুকুরেই আমরা রোজ যাই স্নান করতে”। পর্দার একটুখানি ফাঁক করে বৌমাঠাকরুন তার বোনকে শ্বশুরবাড়ির গ্রাম চেনাতে লাগলেন।
    “বাবা, বেশ দূর তো, রে দিদি, তোদের বাড়ি থেকে”। মণি উত্তর দিল।
    “ধুর তেমন কিছু না, আমরা কি আর এই বড়ো রাস্তা ধরে আসি নাকি? আমরা তো যাই পাছ দুয়োর দিয়ে বেরিয়ে, মাঠের আল পথ দিয়ে। এই পুকুরে নাইতে খুব মজা, জানিস মণি, গরমের দিনেও জলের ভেতরটা এমন ঠাণ্ডা থাকে, ডুব দিলেই, আঃ কি শান্তি। গরম কালের বিকেলে আমরা গা ধুতে আসি রোজ”। মণি চোখ বড়ো বড়ো করে জিগ্যেস করল,
    “একা, একা”?
    “পাগল, হয়েছিস? তাই কেউ ছাড়ে? ঘরের বউ একা ঘর থেকে বেরোলেই রাইকিশোরী হয়ে যায়, তা জানিস”? মুখ টিপে হেসে বউঠাকরুন আবার বললেন, “সেজ থাকে, ও বাড়ির ননদরা থাকে, জায়েরা থাকে, পাড়া প্রতিবেশীদের বউ-ঝিরাও থাকে, সবাই মিলে যাই”।
    “ও বাড়ি, মানে”।
    “ওরা আমাদের জ্ঞাতি। তোর জামাইবাবুর ছোট কাকার ঘর। আর যায় সামন্তবাড়ির বউ-ঝিরা, আমাদের বাড়ির ডানদিকেই ওদের বাড়ি, একই পাঁচিলের এপার আর ওপার”।
    খুব গম্ভীর মুখ করে মণি বলল, “দিদি, আমার জামাইবাবু, তোর কে হয় রে”?
    খুব রাগ রাগ ভাব আনতে গিয়েও পারলেন না বৌমাঠাকরুণ, ফিক করে হেসে ফেলে, মণির চুলের লম্বা বেণী ধরে টানলেন, বললেন, “খুব ফাজিল আর ডেঁপো হয়েছিস তো? পাঁচ বছরের বড় দিদিকে আর দিদি বলে মান্যিই করছিস না! দাঁড়া, মাকে বলে, এই বোশেখেই তোর গলাতেও বিয়ের মালা পড়াচ্ছি, তখন হাড়ে হাড়ে টেরটি পাবি, তোর জামাইবাবু আমার কে হয়!”
    মণির গালে হাল্কা লজ্জার রঙ লাগল, তবুও খুব তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, “আহা, আমি তাই বললাম বুঝি? বিয়ে করতে আমার বয়েই গেছে, এখন আমি বিয়ে করবই না”।
    “আচ্ছা? তা কখন করা হবে শুনি? বাবাকে বলে, তাহলে তো স্বয়ম্বরের ব্যবস্থা দেখতে হয়”।
    “আঃ, দিদি, ভাল হবে না বলে দিচ্ছি”। ঠোঁট ফুলিয়ে রাগ দেখাল মণি। বউমাঠাকরুণ হেসে ফেলল বোনের এই সংকোচ ও লজ্জা দেখে। বুঝতেও পারল, তার বোনটি আর ছোট্টটি নেই, তার মনের মধ্যে এখন বাসা বাঁধছে নিজের বাসা, নিজের সংসারের স্বপ্ন। মেয়েরা ঠিক বোঝে, এই বিষয়ে আর কোন ঠাট্টার মধ্যে গেল না বউমাঠাকরুণ, তবে মনে মনে ঠিক করে নিল, বাড়ি গিয়ে মাকে বলতে হবে। অন্য প্রসঙ্গ এনে বললেন, “আমার এক ননদ আছে, তার এই মাঘে বিয়ে, আমি চলে আসছি শুনে, তার সে কি কান্না জানিস তো”?
    অবাক হয়ে মণি জিগ্যেস করল, “কেন”?
    হাসতে হাসতে বৌমাঠাকরুন বললেন, “‘ও বৌদি গো, তুমি ওই সময় না থাকলে, আমি কোজ্জাবো গো? আমার যে খুব ভয় করবে গো’। আমার তো সেই শুনে এত হাসি পাচ্ছে, এদিকে হাসতেও পারছি না। অনেক কষ্টে হাসি চেপে খুব গম্ভীর হয়ে বললাম, বিয়ের দিনে ভয় পায় না, এমন ডাকাবুকো মেয়ে আমি দেখিনি, ঠাকুজ্জি। ও কিছু না, দেখ সব ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া আমি না থাকলেই বা, তোমার আরো বৌদিরা, দিদিরা রয়েছে। বন্ধুরা রয়েছে। ভয় কি? তখন কি বলল জানিস? বলল, ‘ও বৌদি গো, তোমাকে আমি কি নজরে দেখি তুমি জানোনা গো। আর জন্মে তুমি নিশ্চই আমার মায়ের পেটের দিদি ছিলে গো’”।
    “যাঃ, তুই হাসছিস? বেচারি তোকে কত ভালোবাসে দেখ”।    
    “ভালোবাসে না, ছাই। আদিখ্যেতা। অমন কুচুটে মেয়ে আর দুটো দেখিনি। কেউ ওকে দেখতে পারে না। এর কথা তাকে, তার কথা ওকে, এই করে যাচ্ছে, সারাটা দিন। এ বাড়িতে এসে প্রথম প্রথম বুঝতে পারিনি, বিশ্বাস করে অনেক কথা বলে ফেলতাম। ওমা, সব এসে তোর জামাইবাবুর মায়ের কাছে লাগাত, আর কান ভাঙানি দিত। এখন আমিও ওই, ওপর ওপর চলি”।      
    এতক্ষণ মায়ের কোলে একইভাবে অসাড়ে ঘুমোচ্ছিল, এখন ছেলেটা একটু নড়ে উঠল। বৌমাঠাকরুণ মূহুর্তের মধ্যেই দিদি থেকে মা হয়ে উঠলেন। এতক্ষণ যে চপলা দিদিটি বোনের সঙ্গে সখীর মতো গপ্পো করছিলেন, তার মুখের দিকে তাকিয়ে মণি এখন অবাক হয়ে গেল। তার মুখে আর এতটুকুও চপলতা নেই, মুখময় মাতৃত্বের মমতা, দু চোখে অদ্ভূত মায়া।  
    বছর সাতেক আগে এই দিদির যখন বিয়ে হল, দিদির বয়েস তখন সতের। আটবোন আর দুই ভাইয়ের মধ্যে এই দিদি – নদিদি; নদিদির পরে ফুলদিদি, তারপর সে। বিয়ের আগে এই নদিদির খুব ন্যাওটা ছিল তারা, সারাদিন তার পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াত। সমস্ত দিনের মধ্যে তাদের কতবার যে ঝগড়া হত, আবার ভাব হত, তার আর হিসেব নেই। বিয়ের পরদিন দিদি যখন শ্বশুরবাড়ি আসার জন্য রওনা হয়েছিল, মণিকে বুকে নিয়ে সে কি কান্না! মণির কেন যেন মনে হয়েছিল, দিদি তাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না, কয়েকদিন বাদেই আবার ফিরে আসবে ঠিক। সেই দিদি, এখন নরম নরম দুই হাতে ছেলের কাঁধে আর পাছায় চাপড় দিচ্ছে। মুখে গুনগুন আওয়াজে ঘুম পাড়ানি সুর তুলছে। এখন তার দুই হাতের শাঁখা, পলা, নোয়া আর সোনার চুরিতে সুর উঠতে লাগল ঠিন ঠিনিক ঠিন। মণি খুব মন দিয়ে দিদিকে যখন দেখছিল, বাইরে তখন বলদদুটো একই তালে গাড়িটা টেনে নিয়ে চলেছে, লিটিং লিং লিটিং লিং টিংলি টিং।



    “সকাল সকাল কোথায় যাওয়া হচ্ছে গো, ভাইপো? তাও আবার গাড়ি হাঁকিয়ে”? সুদেবকাকা গরুর গাড়ি আসতে দেখে মাঝপথ ছেড়ে ধারের দিকে দাঁড়িয়েছিলেন।
    বড়দাঠাকুর হাত জোড় করে নমস্কার করে বললেন, “প্রণাম গো কাকা, এই যাচ্ছি, একটু শ্বশুরঘর”। সুদেবকাকা একগাল হাসলেন, তাঁর গালে এবং চোখের কোলে অভিজ্ঞতার ভাঁজ। হাতের পাঁচন নিয়েই ভরতকাও জোড়হাতে প্রণাম করল, মাথা নিচু করে।
    সুদেবকাকা হাসতে হাসতে বললেন, “তা বেশ, বেশ। ভালো থাকো বাবা, খুব ভালো থাকো। তা একটু কেন গো, যাচ্ছো যখন পুরোটাই যাও না। হা হা হা হা। বৌমা, খোকা সবাই ভাল আছে তো, বাবা? ভরত তোমরাও সব ভাল আছ তো, ভাই? তা হীরকবাবু, এবার যে পাঠশাল যাবার সময় হয়ে আসছে, দাদুভাই। আর তো স্বস্তি থাকবে না, বাপু?” বলে চোখ কুঁচকে একটু হাসলেন।
    পুরুষের পক্ষে শ্বশুরবাড়ি যাওয়াটা তেমন সম্মানের ব্যাপার নয় যেন, তাই বড়দাঠাকুর লজ্জা লজ্জা মুখে হাসলেন, ঘাড় নেড়ে সবাই ভাল আছে সায় দিয়ে ছেলেকে বললেন, “হীরু, দাদুকে নমো করো”। তারপর সুদেবকাকাকে বললেন, “কাকিমা, ভাই বোনেরা সকলে ভালো আছেন তো কাকা? কাকিমাকে আমার প্রণাম দেবেন। কাকিমাকে বলবেন, ফিরে এসে একদিন আপনাদের ওখানে আসব”।
    কথা বলতে বলতে গাড়ি পার হয়ে গেল, সুদেবকাকা পথের ওপর নেমে এসে হাত তুলে আশীর্বাদের ভঙ্গি করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলেন, তিনি জানেন খোকাকে কোলে নিয়ে বউমা পর্দার আড়ালে তাঁর দিকেই দেখছেন। বউমার ডাগর দুই মায়াময় চোখের দৃষ্টিতে তিনি নিজের কন্যার অনুভব পান। তাঁর পরনে হাঁটু অব্দি খাটো ধুতি, গায়ে বুকখোলা ফতুয়ার ভেতর সাদা পৈতে দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর তিনি পিছু ফিরে হাঁটতে শুরু করলেন। বড়দাঠাকুর তাঁর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “সুদেবকা মানুষটা বড়ো ভালো, জানো ভরতকা। খুব প্রাণখোলা, সবার খোঁজখবর রাখে।”
    কথা বলার ফাঁকে বলদদুটো একটু ঢিলে হয়ে গিয়েছিল, ভরতকা তার শক্ত হাতের আঙুলে বলদের পিঠে খোঁচা দিয়ে বলল, “তোরা দুটোতে খুব স্যায়না হয়েচু, ন্যা? কতা বলচি দেকেই অমনি গতর ছেড়ে দিলি? যা বলেচ বড়দাঠাকুর, অমন সজ্জন দেকা যায় না। সব্বোদা হাসিমুক আর সব্বার সঙ্গে হাসিমুকে কতা বলেন। দেবদ্বিজেও যেমন ভক্তি, তেমনে ছোটবড়ো সকলেরেই ভালোবাসেন। এমন মানুষ আজকাল আর দেকা যায় কই? অথচ ভগমানের কি বিধেন বলো দেকি, এমন লোকেরাই কিনা পাঁজর ভাঙা দুক্কো বয়ে বেড়াচ্ছে!”

    পর্দার আড়াল দিয়ে দেখা আটকানো যায়, কথা তো আর আটকানো যায় না। বৌমাঠাকরুণ চুপটি করে শুনছিলেন সব। এখন পিছনের পর্দা অল্প ফাঁক করে জোড় হাতে প্রণাম করলেন, সুদেবকাকার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে মণিকে বললেন, “এই মানুষটা বড়ো দুঃখী মানুষ জানিস? আমাদের বাড়ি মাঝে মাঝেই আসেন। আমার হাতের চা খাবেন বলে, আর আমাকে দেখতে পাবেন বলে”।
    মণি কিছুটা অবাক হল, বলল, “যতই হোক বাইরের লোক, তোকে দেখতে আসেন মানে?”
    “হ্যাঁরে, মাঝে মাঝেই আমাকে দেখতে আসেন। সুদেবকাকার বড়ো মেয়ের বিয়ে হয়েছিল, আমার এ বাড়িতে আসার মাস ছয়েক আগে। ওঁনার চার ছেলে, দুই মেয়ে। ওই মেয়েই ছিল সবার বড়ো। প্রায় আমারই বয়সী”।
    “ছিল বলছিস কেন?”
    “বছর ছয়েক আগে মারা গেছে, শুনেছি চার মাসের পোয়াতি ছিল”।
    “তাই? এ মা, মারা গেল কি করে?”
    “জানি না, শ্বশুরবাড়ি থেকে বলে, পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটে পা পিছলে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছিল। তাতেই নাকি মারা গেছে। আর লোকে বলে, শ্বাশুড়ির কথায়, ওর স্বামী নাকি নোড়া ছুঁড়ে মেরেছিল কপালে। সেই চোটে উঠোনেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল, আর ওঠেনি। কেউ তুলেও দেখেনি; অনেকক্ষণ নড়াচড়া করছে না দেখে, কাছে গিয়ে দেখে পোড়াকপালি মরে গেছে”।
    “ইস, কি বলছিস, দিদি?” আতঙ্কে মণি দিদির হাতটা চেপে ধরল।
    “হ্যাঁ রে, সুদেবকাকাকে জিগ্যেস করলে কিছুই বলেন না, শুধু কাঁদেন। আর বলেন, তোকে মা অবিকল আমার সেই মরে যাওয়া মেয়ের মতো দেখতে। তাই তোকে বারবার দেখতে আসি। সাবধানে থাকিস, মা। যে যাই বলুক, খুব ঠাণ্ডা থাকবি মা, খুব ঠাণ্ডা থাকবি। মেয়েদের জ্বালা, বড়ো জ্বালা, মা। আর একটা কথা সর্বদা মনে রাখিস মা, ভেজা খড়ে আগুন দিলে ধোঁয়া ওঠে ঠিকই, কিন্তু শুকনো খড়ের মতো জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায় না। মেয়েরা মা বসুন্ধরা, সর্বংসহা – তাদের সব সইতে হয়”। বৌমাঠাকরুণ পর্দার ফাঁক দিয়ে সুদেবকাকার পিছন ফিরে পথচলা দেখতে দেখতে বললেন, “মানুষটা মনে মনে সর্বদা কাঁদছেন, কিন্তু বাইরে হাসি দিয়ে সেটা ঢেকে রেখেছেন”।
    বউমাঠাকরুণের দুচোখের কোলে জল টলটল করে উঠল। ঘোমটার কাপড় একটু টেনে মুখটা আড়াল করে, কান্নার আবেগ সামলালেন, তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কোলের ছেলের দিকে তাকিয়ে হাল্কা হাল্কা পা নাচিয়ে ছেলেকে আদর করতে লাগলেন। মণির মুখেও এখন কোন কথা নেই, সে ভাবছে, মানুষ এমন নৃশংসও হতে পারে! এতদিন একসঙ্গে ঘর করার পর, যে পত্নীর গর্ভে নিজের সন্তান – সেই পত্নীকেও এভাবে হত্যা করা যায়? এমন হত্যা করে, দোষীরা পারও পেয়ে যায়? থানা-পুলিশ, সরকার–আইন, পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক তাহলে কাদের জন্যে? অসহায় ওই বৃদ্ধ পিতা, মৃতা কন্যার স্মৃতি মনে নিয়ে পুড়ে চলেছেন দিবারাত্র, ভেজা খড়ের মতো...ধোঁয়া হচ্ছেন, কিন্তু জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছেন না!
    সকলেই যে যার নিজের মতো ভাবনায় মগ্ন, সকলেই চুপ, শুধু গাড়ীর একঘেয়ে গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘণ্টা বেজে চলেছে, লিটিং লিং লিটিং লিং টিংলি টিং।



    হঠাৎ ঘচাং করে গাড়ির চাকা লাফিয়ে উঠল গর্তে, সকলেই টাল খেল। বড়দাঠাকুর ছেলেকে চেপে ধরলেন বুকের কাছে। বউমাঠাকরুণ ও মণিদিদিমণির মাথা ঠকাস করে গাড়ির ছইয়ে ঠুকে গেল। দুজনেই নিজেদের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে, চোখাচোখি করে হাসতে লাগল। বড়দাঠাকুর পর্দা সরিয়ে ছইয়ের মধ্যে মুখ বাড়িয়ে উদ্বেগের স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,
    “পান্না ঠিক আছে তো? মণি, তোমাদের লাগে-টাগেনি তো?” বড়দাঠাকুরের পিছনে শালী, সামনে বসে আছে ভরতকা, পত্নীকে সরাসরি জিগ্যেস করাটা তাই সমীচিন নয়। ওই সামান্য সময়েই বৌমাঠাকরুণের ঘোমটার ভেতর থেকে বড়দাঠাকুরের চোখাচোখি হল, সে চোখের ভাষা পড়েও নিল দুজনে। মণি লক্ষ্য করল, সেই চাহনির ইঙ্গিত; কিছুই না দেখার মতো মুখ ঘুরিয়ে ঠোঁট টিপে হাসতেই লাগল। ভরতকার একটু বুঝি ঝিমুনি এসে গেছিল, গাড়ির এই আচমকা ঝাঁকুনিতে তার ঝিমুনি ছুটে গেল, একটু লজ্জাও পেল নিজের গাফিলতিতে।
    সে তীব্র স্বরে ঝেঁকে উঠল, “শালোরা, চোকের মাতা খেয়েচু না কির‍্যা? খানাখন্দ চোকে পড়ে না? মাঠাকরেন, ঠিক আছেন তো? খোকাঠাউর ঠিক আছে তো? শালোরা চলছে যেন বুড়ো কানা গাধা, খানা খন্দ কিচুই চোখে পড়তেচে না”।
    বউমাঠাকরুন মুচকি হেসে বললেন, “ভরতকা, এমন চললে আমাদের মাথায় অনেক আলু গজিয়ে উঠবে, তখন আর তোমাকে রোদে জলে আলু চাষ করতে হবে না”।
    এই কথায় একটু অপ্রতিভ হয়েও ভরতকা হাসল হো হো করে, তার পর বলল, “আর হবে না, মাঠাকরেন, বলদদুটোকে কেমন চানকে নিয়ে যাই এবার, দেখই না”।

    আচমকা গাড়ির ঝাঁকুনিতে চমকে উঠেছে কোলের ছেলেটাও। নিশ্চিন্ত আরামে মায়ের কোলের ওমে ঘুমোচ্ছিল বেচারা, এখন ছোট্ট দুই হাতের মুঠি আর দুই পা ছুঁড়ে মাকে ব্যস্ত করে তুলল। ছেলের মুখের দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে বউমাঠাকরুণ বলতে লাগলেন, “কু হয়েচে বাবা? ভোয় পেয়েচো, ভোয়? কিচ্চু হয়নি, বাবা, মায়ের কোলেই তো রয়েচ, সোনা, কোন ভোয় নেই, ঘুমু করো”।
    নীলাভ সাদার মধ্যে গভীর কালো চোখের তারায় যে ভয় ফুটে উঠেছিল শিশুর, মায়ের চেনা মুখের দিকে তাকিয়ে, আর মায়ের কথার আওয়াজে সে ভয় কেটে গেল। ফোকলা মুখে হেসে ফেলল একগাল, তারপর মুঠি খুলে হাত বাড়িয়ে দিল মায়ের মুখের দিকে; নিচু হয়ে থাকা মায়ের নাক আর গাল খাবলাতে লাগল। মোচার কলির মতো ছোট্ট ছোট্ট আঙুলের পাতলা নখের খোঁচায়, গালে নাকে ব্যথা লাগে। এই কষ্টটুকুতেও মার আনন্দ, বরং খুব ব্যথা লাগার ভান করে আস্তে চেঁচিয়ে উঠলেন “আউ”। তাতে ছেলে আরো আমোদ পেয়ে খল খল করে হাসতে লাগল, কথা বলার চেষ্টায় নানান আওয়াজ করে উঠল।
    “তবে রে, দুষ্টু ছেলে, মায়ের মুখে খিমচি দিয়ে খিলখিলিয়ে হাসি? দাঁড়াতো, দাঁড়াতো, আঙুলগুলো কামড়ে দিই”। ছেলের আঙুলের কয়েকটা, মা মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে দুই ঠোঁটে হাল্কা চেপে ধরলেন। ছেলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মায়ের চোখের দিকে; মায়ের কণ্ঠস্বর, মায়ের ঠোঁটে ধরা পড়া তার আঙুলের ডগায় অদ্ভূত অনুভব। মা কী রেগে গেলেন? মাকি সত্যিই তাকে শাস্তি দিতে পারেন? ছেলের দুই চোখে সংশয়, অজানা আশংকা আর অভিমানে তার পাতলা দুই ঠোঁট ফুলে উঠল। তাই দেখে কোন মা পারেন রাগ করে থাকতে?
    বউমাঠাকরুন ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে বলতে লাগলেন, “উ বাবা, তোমাকে কে বকেছে বাবু? তোমার মা তোমাকে বকেছে? তোমার মা খুব দুট্টু আর বম্মাস, তাই না বাবু”?  মায়ের কথার ভঙ্গিতে আর ঘাড় নাড়ায় শিশু নিঃসংশয় হল, তার মুখে একটু একটু হাসি ফুটে, আবার খলখল করে বেজে উঠল আনন্দে আর সেই সঙ্গে ভিজিয়ে দিল মায়ের কোল।
    বউমাঠাকরুণ একইভাবে ছেলেকে আদর করতে করতে বললেন, “ওই যাঃ, তুমি হাসতে হাসতে হুসু করে ফেললে? অ্যাঁ, এত্ত দুত্তু হয়েছো আর বলতে পারো না, মা, মা, হুসু কব্বো? মণি, ওই পুঁটলিটা খুলে একটা ন্যাকড়া দে না, রে”? শেষের কথাটা বোনকে বলতে বলতে তিনি ছেলের ভেজা প্যাণ্টটা খুলে দিলেন, ন্যাংটাপুটো ছেলে ঘাড় ঘুরিয়ে আর চোখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগল, মায়ের মুখ, মায়ের মাথার পিছনে চালচিত্রের মতো গাড়ির ছইয়ের নকশা। দুলছে, সবকিছুই দুলছে, গাড়ির চলার গতিতে দুলেই চলেছে। শিশু পাদুটো ভাঁজ করে, পায়ের বুড়ো আঙুলটা নিজের মুখে পুরে চুষতে লাগল।
    মণি সেই দৃশ্য দেখে মজা পেল খুব, বলল, “তোর ছেলের কাণ্ড দ্যাখ, দিদি, আর কিছু না পেয়ে নিজের পায়ের বুড়ো আঙুল চুষছে”!
    মণির হাত থেকে কাপড়ের টুকরোটা নিয়ে ছেলেকে পরাতে পরাতে বউমাঠাকরুণ বললেন, “তুই দ্যাখ। আমি ওই দেখছি সারাদিন, ওর কিত্তিকলাপ দেখি আর খুব হাসি পায় মাঝে মাঝে। তবে একটা কী বল তো? ভুটকু আর যাই করুক, কান্নাকাটি খুব কম। এক একটা ছেলে থাকে না, এপাশ ফিরতে ভ্যাঁ, ওপাশ ফিরতে ভ্যাঁ।  ভুটকু আমার তেমন নয়, ফোকলা মুখে সর্বদাই হাসি, কেবল খুব খিদে-টিদে পেলে একটু খুঁৎখুঁৎ করে, এই যা”।
    খিদের কথায় বউমাঠাকরুণ নিজের দুইস্তনে ভার অনুভব করলেন, ছেলেটা অনেকক্ষণ খায়নি, তাঁর দুই স্তনে জমে উঠেছে শিশুর জীবনসুধা। শুকনো কাপড় পরে শিশু এখন অনেকটাই স্বস্তি পেল এবং খিদেও অনুভব করতে লাগল। সে মুখে আওয়াজ করে হাত বাড়িয়ে দিল, মায়ের বুকে। বউমাঠাকরুণ ছেলেকে শাড়ির আঁচলের মধ্যে নিয়ে, নিজের স্তনভার হাল্কা করতে সন্তানের অধরে তুলে দিলেন বৃন্ত। শিশু দুইহাতে স্তন ধরে, পরম তৃপ্তিতে শুষতে লাগল মাতৃসুধা। মণি কোন কথা বলছিল না, সে শুধু দেখছিল তার দিদির এই পূর্ণতা। তার মধ্যেও কোথাও জন্ম নিচ্ছিল এই পূর্ণতা লাভের স্বপ্ন, তার মনের মধ্যেও যেন ঘন্টা বাজতে লাগল, লিটিং লিং লিটিং লিং টিংলি টিং।
     
    (চলবে)
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১১৪৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • হীরেন সিংহরায় | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০১:২২516824
  • আহা সেই খড়ের ওপর কম্বল বিছানো ঘেরা গাড়ি ! কত দিনের কত স্মৃতি 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন