এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • সংসার সুখের হয়...

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ২৮ মার্চ ২০২৩ | ১০৮৯ বার পঠিত | রেটিং ৩ (১ জন)


  • সন্ধে হবো হবো সময়ে দাদার সঙ্গে গ্রামে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন অচ্যুত। শিবতলার মন্দিরে প্রণাম সেরে, গিয়েছিলেন হাজরাচৌধুরিদের বাড়ি। হাজরাচৌধুরি মশাইয়ের বৈঠকখানায় সন্ধের পর জমাটি মজলিশ বসে। প্রতিবেশীদের নানান কথা প্রসঙ্গে উঠে আসে চাষবাস, গরুবাছুর, গ্রাম, হাট, সাতগেছে, মেমারি, বর্ধমান, কলকাতা মায় সুদূর দিল্লিও। সদা হাস্যমুখ হাজরাচৌধুরি মশাই প্রবীণ মানুষ। তিনি নিজে কথা বলেন কম, শোনেন বেশি। কারো সঙ্গে তর্ক করেন না। ফলতঃ সজ্জন ও সদালাপী হিসেবে তিনি এপাড়ায় জনপ্রিয়। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ বসলেন দাদা ও অচ্যুত। সকলের সঙ্গে আলাপের পর, সকলের কথাবার্তা কিছুক্ষণ শুনে অচ্যুতকে নিয়ে দাদা বাড়ি ফিরলেন।
    বাড়ি ঢোকার মুখে দাদা বললেন, “আমায় এখন কিছু খাতা দেখার কাজ সারতেই হবে, ভায়া। এই ফাঁকে তুমি বরং সোনার কাছে তোমাদের কলকাতা যাবার প্রস্তাবটা বলে ফেলো। দেরি করো না”।
    অচ্যুত হাসলেন, বললেন, “আচ্ছা দেখছি”।    
    নতুন ঘরের উঁচু দাওয়ায় উঠতে উঠতে, ঘরের ভেতর থেকে নিজের স্ত্রী, বড়ো পুত্র হীরু আর দুই শ্যালিকা সুভা আর কলুর গলার আওয়াজ পাচ্ছিলেন অচ্যুত। ও বাড়িতে সবাই নিশ্চয়ই রাতের রান্নার কাজে ব্যস্ত। দরজার পাশে চটি খুলতে খুলতে তিনি গলা ঝেড়ে শব্দ করলেন।
    ঘরের ভেতর থেকে সুভা বেরিয়ে এল, “ওই তো জাঁইবাবু এসে পড়েছেন। জাঁইবাবু মুড়ি খাবেন? আমতেল মেখে দি? মাকে বলি কটা বেগনি ভাজতে?”
    প্রসন্ন হেসে অচ্যুত বললেন, “আনতে পারো, তবে মুড়ি খুব সামান্য, অবেলায় খেয়ে তেমন খিদে হয়নি”। সুভা আর কলু দৌড়ে চলে গেল ওদিকের মহলে, ঘরে এখন শুধু সোনা, হীরু আর সোনার কোলে শুয়ে খেলতে থাকা পান্না। পান্না ছোট্ট ছোট্ট হাত বাড়িয়ে দাদার মুখে, নাকে, চোখে থাবা মারছিল। ভাইয়ের হাতের স্পর্শে হীরু মাঝে মাঝে ব্যথা পাওয়ার মতো ‘আউ’ আওয়াজ করলেই, পান্না হেসে উঠছে খলখল করে।
    আর তখনই হীরু ঘাড়মুখ নেড়ে খুব অঙ্গভঙ্গি করে বলছে, “তবে রে? তবে রে? আমার নাক খিমচে দিচ্ছিস? দাঁড়া তো, দাঁড়া তো, দেখাচ্ছি তোর মজা”। পান্না ভয় তো পেলই না, উলটে খলখল হেসে, আনন্দে পা ছুঁড়ল, তার মায়ের বুকে লাগল শিশুর লাথি। ।
    “তোদের দুটোর এই দৌরাত্ম্যি আর ভালো লাগে না, বাপু, কবে যে তোরা বড় হবি, তাই ভাবি”। সোনা বললেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর স্বরে এতটুকু বিরক্তি ফুটল না বরং ঝরে পড়ল স্নেহের প্রশ্রয় কারণ সমস্ত মাতৃত্ব নিয়ে তিনি উপভোগ করছিলেন, তাঁকে ঘিরে দুই ভাইয়ের এই ক্রীড়া। অচ্যুত কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তাঁর ছোট্ট সুন্দর এই পরিবারের দিকে। তারপর সোনার সামনে বসতে বসতে বললেন, “ভাবছি, এখান থেকে তোমাদের নিয়ে আর দুউরি না গিয়ে, কলকাতায় যাবো”। হীরু লাফিয়ে মায়ের পাশ থেকে দৌড়ে এল বাবার পাশে। বলল, “হ্যাঁ? আমরা ট্রেনে চড়ে যাব, বাবা?”
    “হুঁ। ট্রেনে চড়েই তো যাব। মেমারি থেকে ট্রেন ধরে কলকাতা...”।
    “ট্রেন বুঝি পালিয়ে যায়, তাকে ধরতে হয় কেন?”
    “ধুর বোকা, পালাবে কেন? ট্রেন তার নিজের সময় মতো চলে কিনা। ঠিক সময়ে পৌঁছে ট্রেন ধরতে না পারলে, হুস করে চলে যায়। কারও জন্যে সে বসে থাকে না”।
    “মেমারি এখান থেকে কতদূর বাবা, গরুর গাড়িতে যেতে হবে?”
    “না রে, এখান থেকে গরুর গাড়িতে মাঝের গাঁ যাব, সেখান থেকে বাসে মেমারি - অনেকটাই দূর। তারপর ট্রেনে চেপে হাওড়া। জানিস তো, কলকাতায় গঙ্গা আছে। গঙ্গা পার হওয়ার বিশাল হাওড়ার ব্রিজ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। জাদুঘর। বটানিক গার্ডেন। কত চওড়া চওড়া বাঁধানো রাস্তা সব। সকাল থেকে রাত অব্দি লোকজনের ব্যস্ততা আর ছুটোছুটি। কত বাস, ট্রাম, মোটর গাড়ি। দেখলে অবাক হয়ে যাবি!”
     হীরুর দুচোখে স্বপ্ন। বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, “পান্না যাবে, আমাদের সঙ্গে?”
    “যাবে বৈকি”!
    “মাও যাবে তো”?
    “বা রে, মা না গেলে তোরা থাকবি কী করে?”
    “ও বাবা, আমাদের সঙ্গে ঠাকুমা যাবে না?”
    কলকাতা যাওয়ার জন্যে উদ্গ্রীব হীরুর এই কথার উত্তর দেওয়ার আগেই সোনা জিজ্ঞাসা করলেন, “হঠাৎ আমাদের নিয়ে তোমার এমন বেড়ানোর শখ হল যে?”
    “বেড়ানোর শখ নয়। বাসা নিয়ে কলকাতাতেই থাকবো। হীরুকে লেখাপড়া করতে হবে না? ওখানে স্কুলে ভর্তি করে দেবো”। পুত্রকে হাতের বেড়ে খুব কাছে টেনে এনে অচ্যুত বললেন, “এ ছেলেকে ডাক্তার করতে হবে, সে কী দুউরির স্কুলে লেখাপড়া শিখলে হবে ভাবছো?”
    সোনা বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন স্বামীর দিকে, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “মাকে বলেছো”?
    “মাকে...মানে, আমার মাকে? না, না। মাকে এখন বললে কুরুক্ষেত্র বাধাবেন। কাউকেই বলিনি। খাওয়াদাওয়ার পর আজ বিকেলে তোমার দাদাকে বললাম, আর বলেছি কলকাতার দু একজন বন্ধুকে। এ কথা চাউর হয়ে গেলে, আর যাওয়াই হবে না”।
    হীরু জিজ্ঞাসা করল, “ও বাবা, চাউর মানে কী?”
    সোনা চোখ বড়ো বড়ো করে হীরুকে বললেন, “বড়দের কথায় ছোটদের কথা বলতে নেই, বলিনি হীরু? কিন্তু মা কী ভাববেন? তুমি তো আবার মা অন্ত প্রাণ। মার অনুমতি ছাড়া একদমই চলো না”। শেষের কথাগুলো তিনি স্বামীকে বললেন।
    “আঃ, এখন আবার ওসব কথা পাড়ছো কেন?”
    সোনা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, বললেন “পাড়বো না? কোন আমোদ নেই, আহ্লাদ নেই। বিয়ের পর থেকে সেই যে তোমাদের ঘরে পা দিয়েছি, কবার বাপের বাড়ি আসতে দিয়েছে, তোমার মা? তোমার ছোটবোন বছরে তিনবার করে এসে, পনেরদিন করে থেকে যেতে পারে। আর আমি বাপের বাড়ি আসার কথা বললেই, তোমার মায়ের অম্বুবাচী, মলমাস, অশ্লেষা, গাজন, বিপত্তারিণী, মনসাপুজোর ফিরিস্তি মনে পড়ে যায়। গাঁয়ের বৌ-মেয়েদের সঙ্গে দুটো কথাও বলা যাবে না। সর্বদা শুধু কাজ আর কাজ। এই যে আমার দু’দুটো ছেলে হল, কোন ডাক্তার নেই, বদ্যি নেই। গাঁয়ের সেই বুড়ি ধাই ভরসা। ওষুধ বলতে ডেটল আর তুলো। ওসব কথা পাড়বো না মানে?”
    ছোট্ট কলু মুড়ি-বেগুনি নিয়ে এসে, নদিদির উত্তেজিত কথায় ভয় পেয়ে, দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইল। সুভা ঘরের মধ্যে ঢুকে জামাইবাবুর হাতে মুড়ির বাটি দিতে দিতে বলল, “জাঁইবাবু, আপনার মুড়ি। অ্যাই নদি, চুপ কর, বাবা ওপরের ঘরে শুয়ে আছেন, শুনতে পেলে রাগ করবেন”। সুভার কথায় সোনা চুপ করলেন। কিন্তু তাঁর মুখে ক্ষোভ আর রাগের রেশ। অচ্যুত মাথা নিচু করে বাটি থেকে মুড়ি নিয়ে মুখে তুললেন। কলুমাসী হীরুর হাতে ছোট্ট বাটিতে মুড়ি দিতে, সেও বাবার দেখাদেখি মুড়ি খেতে শুরু করল, কিন্তু ভয়ে ভয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকাতে লাগল বারবার। পান্না এতক্ষণ খেলছিল মায়ের কোলে, এখন সে শান্ত, অবাক চোখে তাকিয়ে রইল মায়ের মুখের দিকে।
    সোনার পাশে এসে বসল সুভা, বলল, “দিদি, মুড়ি নে। আমাদের একটাই বাটি”।
    “তুই খা। আমি খাবো না”।
    “নে না দিদি, তোর নাম করে আনলাম। দুমুঠো খা। কলু, মা আরো বেগনি ভাজছে, আরেকটা প্লেট নিয়ে এসে বস না, ভাই”। কলু ছোট্ট পায়ে দৌড়ে গেল, ও বাড়ির দিকে।
    অচ্যুত বেগুনিতে কামড় দিয়ে বললেন, “মুড়িটা বেশ মাখা হয়েছে, একটু খেয়ে দেখো না। আর বলছিলাম কী, এই সব কারণের জন্যেই তো কলকাতায় গিয়ে থাকতে চাইছি। মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবে দেখো, আর পুরোনো কথা ভুলে গিয়ে ছেলে দুটোর কথাও ভাবো”।
    “কলকাতায় আমি যাবো না। আমি জানি, কলকাতায় গিয়ে আমরা থাকতে শুরু করলেই, তোমার মা, সেখানে গিয়ে ঠিক নাকে কান্না শুরু করবে। তুমি বাড়ির বড়বৌ, সংসারের লক্ষ্মী, তোমাকে ছাড়া চলবে কী করে, মা? আর তুমিও তখন গলে গিয়ে বলবে, তাহলে ফিরেই চলো, মা যখন এমন করে বলছেন। এসব ধ্যাষ্টামোর মধ্যে আমি নেই। যেতে হয় তুমি তোমার ছেলেদের নিয়ে, কলকাতায় যাও, আমি থাকবো আমার কপাল নিয়ে আর শাশুড়ির সেবা নিয়ে”।
    হীরুর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, ধ্যাষ্টামোর মানে কী জানার, কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে চুপ করেই রইল।
    অচ্যুত বললেন, “কী যে বলো তার ঠিকানা নেই, আমি থাকবো ছেলেদের নিয়ে কলকাতায়, আর তুমি থাকবে গাঁয়ে? এ কখনো হয় নাকি? পরশুদিন আমি কলকাতায় ফিরে বাসা ঠিক করে ফেলবো কদিনের মধ্যেই। তারপর গোছগাছ করে, তোমাদের নিয়ে যাবো মাসখানেকের মধ্যে। জানুয়ারির মধ্যে সব স্কুলে ভর্তি শুরু হয়ে যায়। এ বছরে ভর্তি না করতে পারলে এক বছর বসে থাকতে হবে। হীরুর অকারণ একটা বছর নষ্ট হবে। হাতে এখনো মাস দুয়েক সময় আছে ঠিকই, কিন্তু যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে”।
    সোনা স্বামীর চোখে চোখ রেখে একমুঠি মুড়ি মুখে তুললেন। হীরু মায়ের মুড়ি নেওয়া দেখে, এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত হল, সে একটুও দেরি না করে বলল, “ও মা, চলো না গো, কলকাতা চলো না”।
    হীরুর দিকে তাকিয়ে সোনা বললেন, “কলকাতায় গিয়ে স্কুলে পড়বি”?
    মস্ত ঘাড় নেড়ে হীরু বলল, “হ্যাঁ”।
    সোনা পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, “সেখানে কিন্তু তেঁতুলতলা নেই, দে’দের পুকুর নেই, সামন্তদের ছেলেদের সঙ্গে ছাগল চড়ানো নেই...”।
    হীরু মায়ের কথায় একটু দ্বিধায় পড়ল, কলকাতা জায়গাটা তবে কেমন? সেখানে কী স্কুল ছাড়া আর কিছুই নেই? সোনা ছেলের পিঠে হাত রেখে বললেন, “তা নাই বা থাকল, সেখানে কালীঘাট আছে, জাদুঘর আছে”।
    অচ্যুত বললেন, “গড়ের মাঠ আছে, শিবপুর বোটানিক গার্ডেন আছে, যত গাছ চাইবি, সব আছে”।
    “সেখানে তেঁতুল গাছ আছে?” হীরু নিশ্চিত হবার জন্যে বাবাকে জিজ্ঞাসা করল।
    অচ্যুত বললেন, “আছে বৈকি। তেঁতুল গাছ ছাড়া আবার বাগান হয় নাকি”? হীরুর পিঠের ওপর অচ্যুতও হাত রাখলেন, তাঁর হাতের স্পর্শ লাগল সোনার হাতে। সোনা চোখ তুলে, লাজুক দৃষ্টিতে তাকালেন স্বামীর দিকে। অচ্যুত সোনার উষ্ণ হাতে হাল্কা চাপ দিতে, সোনার অধরে ফুটে উঠল হাল্কা হাসি, তিনি বললেন, “দুউরিতে আমার অনেক জিনিষ রয়ে গেল যে, সেগুলোর কী হবে”?
    “কোথায় আছে? তোমার ট্রাঙ্কে তো? সে আমি পরে কোন সময় গিয়ে নিয়ে আসবো, ভেবো না। আগে তো কলকাতার বাসায় গিয়ে থিতু হই”।
    হীরু এখন নিশ্চিন্ত, কারণ মা আর রেগে নেই, মা এখন প্রসন্ন। মুড়ি খেতে খেতে সে জিজ্ঞাসা করল, “ও মা, ধ্যাষ্টামো কী?” হীরুর এই কথায় সোনা ছাড়া সবাই হেসে উঠল, অচ্যুত এমন কি সুভা, কলুও!
    সোনা অপ্রস্তত হয়ে বললেন, “চুকঃ, পাকা ছেলে। বলেছি না, বড়দের সব কথায় থাকতে নেই? শুনছো, বাসা যে নেবে বলছো, একটা ঠাকুরঘর যেন থাকে। আর ছোট একটা বারান্দা বা উঠোন, সেখানে আমি তুলসী নয়নতারা, সন্ধ্যামণি, বেলিফুলের গাছ লাগাবো”।
    স্ত্রীর এই কথায় অচ্যুত একটু হাসলেন, কিছুটা মলিন আর করুণ হাসি, বললেন, “দেখি কী হয়। বড়ো বাসার বেশি ভাড়া সে তো বুঝতেই পারছো। আমি ভেবেছিলাম, একটা বসার ঘর, একটা শোবার ঘর, রান্নাঘর, কলপাইখানা, চানের ঘর। এরই ভাড়া হবে মাসে আশি-একশ টাকা। আর তুমি যেমন বলছো, তেমন হলে দেড়–দুশোর কমে হবে না”।
    “আচ্ছা, আচ্ছা সে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, যেমন আমাদের সাধ্যে কুলোয় তেমনই নাও, আমি কিন্তু নিজের মতো করে সাজিয়ে নেবো”।
    অচ্যুত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, “নিও। তার আগে সংসারের জিনিষপত্র তোমার কী কী লাগবে, আমায় ফর্দ করে দিও। বাসা ঠিক হয়ে গেলে, আমি কিনেটিনে, গোছগাছ করে সব রেখে আসবো, তোমাদের নিয়ে যাবার আগেই”।
    “ফর্দ করার কী আছে? আর অত কেনাকাটা করারই বা...”
    বলতে বলতে সোনা থমকে গেলেন। এতক্ষণে তাঁর মনে হল, তাঁকে নতুন করে সংসার পাততে হবে, শুরু করতে হবে শূণ্য থেকে। বিয়ের আগে এ বাড়িতে বাবা-মায়ের সংসারে তাঁকে কোনদিন এসব নিয়ে ভাবতে হয়নি। বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়ি গিয়েও শাশুড়ির সাজানো একটা সংসারই পেয়েছিলেন, সে সংসার তাঁর বাপের বাড়ির থেকে হয়তো একটু আলাদা। কিন্তু এখন তাঁকে নিজের হাতেই সব গড়ে নিতে হবে। তাঁর মাথার ওপরে স্নেহময়ী মা কিংবা অভিজ্ঞা শাশুড়ি মায়ের কোন হাত থাকবে না, সে শাশুড়ি মা যতই কটকটি হোন না কেন! তিনি এবার কল্পনা করতে পারলেন। চোখের সামনে যেন স্পষ্ট দেখতে পেলেন, কলকাতার রিক্ত বাসায় তিনি একলা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর একহাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে আছে হীরু, আর তাঁর কোলে পান্না। স্বামী বেরিয়ে গেছেন আপিসে, সন্ধেয় তিনি ফিরে আসবেন ক্লান্ত হয়ে, যেভাবে পাখিরা বাসায় ফেরে নিশ্চিন্ত কুলায়।
    কলকাতায় বাসা নিয়ে থাকা, সংসার সামলানো, জ্বরজারি, বিপদআপদ, বড়ো হতে থাকা ছেলেদের বেড়ে ওঠা দৌরাত্ম্য, তাদের লেখাপড়া, ভালো-মন্দ, সব কিছু এখন থেকে তাঁকেই সামলাতে হবে। ওই বাসায় তাঁর পাশে স্বামী ছাড়া থাকবে না আর কেউ। দুই সন্তানের জননী এই যুবতী, পরিপূর্ণ ‘গিন্নিবান্নি’ হয়ে উঠেছেন ভেবে, নিজের মনে এতদিন বেশ তৃপ্তি পেতেন। আজ এই প্রথম তিনি অনুভব করলেন পরিপূর্ণ গৃহিণীর দায়িত্ব তিনি কোনদিন জানতেই পারেননি। সে দায়িত্ব প্রথম আজ উপলব্ধি করলেন। এই দায়িত্বর কথা ভেবে তিনি ভয় পেলেন না, বরং উদ্গ্রীব হয়ে উঠলেন কলকাতার বাসায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে।
    সোনা ছোট বোন কলুকে বললেন, “অ্যাই কলু, যা তো দাদার থেকে একটা কাগজ আর কলম নিয়ে আয়। তোর জাঁইবাবুকে একটা ফর্দ বানিয়ে দি”।

    দিদির আদেশে কলু আবার ছুটল বড়দার ঘরে। বড়দা লন্ঠন জ্বেলে তখন খাতা দেখছিলেন। ছাই ফেলার বাটিতে জমে উঠেছে অনেক পোড়া সিগারেট। ছোট্ট বোনকে আদর করে তিনি বলেন, কলু, পেঁয়াজ কলি। তাকে দৌড়ে আসতে দেখে হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি হয়েছে রে, পেঁয়াজ কলি?”
    খুব গম্ভীর মুখ করে কলু বলল, “নদিদি একটা কলম আর কাগজ চাইল”।
    টেবিলের ড্রয়ার থেকে কলম বের করতে করতে তিনি বললেন, “কেন রে? তোর ন’দিদি কাগজ-কলম নিয়ে কী করবে?”
    “বা রে। কলকাতার বাসার জন্যে ফর্দ লিখবে না?” দিস্তা কাগজ থেকে একটা রুলটানা কাগজ আর কলমটা কলুর হাতে দিয়ে দাদা হাসলেন, কলুর নাকটা হালকা টিপে দিয়ে বললেন, “তাই? তুই সব বুঝে গেছিস? পাকা বুড়ি?” কলু আগের মতোই দৌড়ে চলে যেতে তিনি স্বস্তির শ্বাস ফেললেন, মুখে তাঁর মৃদু হাসি।

    ..০০..
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৮ মার্চ ২০২৩ | ১০৮৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ২৮ মার্চ ২০২৩ ২০:৪৬517970
  • কেন যেন বুকটা মুচড়ে উঠল।
    মনে পড়ল কোলকাতার ভাড়াবাড়িতে বাইশজনের হেঁসেল ঠেলা মাকে।  আর তারপর বোকারো পাওয়ার হাউসের ছোট্ট লেবার কোয়ার্টারে এবং পাঁচবছর পরে ভিলাইয়ের অফিসার্স কোয়ার্টারে মায়ের স্বতন্ত্র সংসার, মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। 
  • Kishore Ghosal | ২৮ মার্চ ২০২৩ ২১:৫৫517975
  • রঞ্জনদা, 
    "ভিলাইয়ের অফিসার্স কোয়ার্টারে মায়ের স্বতন্ত্র সংসার, মুখে পরিতৃপ্তির হাসি"। একদম মনের কথাটি বলেছেন। 
     
    অমিতাভবাবু, 
    অচেনা নয় - কিন্তু আজ চারপাশে তাকালে  শুধু অচেনাই নয়, অবান্তর বলেও মনে হয়...অনেক ধন্যবাদ পড়ে মন্তব্য করার জন্যে।  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন