১
‘স্স্স্স্শিল কুট্ঔ’
স-এ তীক্ষ্ণ সিটি দিয়ে শুরু করে, কণ্ঠের অদ্ভূত ইয়ডলিংয়ে ‘ঔ’ হেঁকে সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় বিহারি শিল কুটোনোওয়ালা। তার ডাক শুনে দৌড়ে বারান্দায় গেল পান্না।
ওই লোকটি তার চেনা, কয়েকদিন আগেই মা ওর থেকে শিল নোড়া কুটিয়েছিল। শিলকুটোনোর সময় পান্না বসেছিল তার সামনে। ছোট্ট ছেনিতে হাতুড়ির ঠুকঠুক ঘায়ে সে খড়খড়ে করে তুলেছিল শিল আর নোড়ার মসৃণ হয়ে যাওয়া গা। হাতুড়ির আঘাতে ছেনির আগায় মাঝে মাঝেই ছিটকে উঠছিল ছোট্ট ছোট্ট ফুলকি আর পাথরের মিহিন কুচি। বিহারী শিলকুট্নেওয়ালা তাকে সতর্ক করেছিল, “হঠ যাও খোখাবাবু, আঁখমে পাত্থর গিরবা করেগা, তো বহোত দরদ হোবে”।
মাও ঘরের ভেতর থেকে বলেছিলেন, “ওখান থেকে সরে আয় ভুট্কু, চোখে লাগবে”। পান্না তার ডাকনাম হলেও, সোনা ছোটপুত্রকে আদর করে ডাকেন ভুট্কু। পান্না একটু সরে এসে উঠে দাঁড়িয়েছিল, আর অবাক হয়ে দেখেছিল ছেনির ঘায়ে ছোট্ট ছোট্ট গর্তে বুনে ওঠা মাছের নকশা, আর তার পাশে যেন অজস্র বৃষ্টির ধারা। শিল কুটোনো হয়ে গেলে বিহারী ডাক দিয়েছিল, “লিয়ে যান, মাজী, হোইয়ে গেলো”।
মায়ের সাহায্য হবে ভেবে, পান্না শিল তুলে ঘরের ভেতরে আনতে গিয়েছিল, শিলকুটোনোওয়ালা বলেছিল, “বহোৎ ভারি, তুমি শকবে না, খোখাবাবু, ছোড় দো, মাজি লিয়ে যাবে”। এবং পিছন থেকে মা হাঁ হাঁ করে উঠেছিলেন, “তুই কখনো শিল তুলতে পারিস ভুট্কু? পায়ে পড়লে আঙুল থেঁতলে যাবে, সর সর, আমি দেখছি”।
তুলে নেওয়ার আগে শিল আর নোড়ার গায়ে হাত বুলিয়ে দেখে নিচ্ছিলেন মা, ঠিকঠাক খসখসে হল কি না, বিহারী কুটনোওয়ালা বলল, “দিখা লাগবে না, মাজি, ছোমাস কুছু করতে হোবে না, দেখে লিবেন”।
“ছমাস যাবে, না ছাই যাবে, একমাসেই পাথরের গা তেলা হয়ে যায়”। সোনার কথায় টেনে টেনে হেসেছিল বিহারী কুটনেওয়ালা, “ওইসান না হলে, হামাদের ভি চলবে কী করে, মাজি?”
সোনা আর কথা বাড়াননি, শিল-নোড়া তুলে ঘরে এনে, পান্নার হাতে দশপয়সা দিয়ে বলেছিলেন, “যা তো গিয়ে দিয়ে আয়”। একটা দায়িত্ব পেয়ে উত্তেজিত পান্না দৌড়ে গিয়ে পয়সাটা তুলে দিল কুটনোওয়ালার হাতে। উপার্জিত অর্থ পেয়ে খুশী কুটনোওয়ালা পান্নার দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর কোমরে বাঁধা ময়লা বটুয়া বের করে, তার মধ্যে রাখল পয়সাটা। তারপর বেরিয়ে গেল ছেনি-হাতুড়িওয়ালা ছোট্ট চটের ব্যাগ নিয়ে। রাস্তায় নেমে, হাঁক দিল, “স্স্স্স্শিল কুটঔ”।
ঘরে এসে শিশু পান্না জিজ্ঞাসা করেছিল, “শিল কোটালে কেন গো, মা?”
“শিল-নোড়ার গা তেলতেলে মসৃণ হয়ে গেলে, মশলা বাঁটতে অসুবিধে হয় যে! আদা, পেঁয়াজ তাও বাঁটা যায়, কিন্তু শিল-নোড়া খসখসে না হলে পোস্ত, সরষে, ধনে, জিরে বাঁটাই যায় না!”
আজ পান্নাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, সেই কুটনোওয়ালা জিজ্ঞাসা করল, “মাজিকো বোলো, শিল কুটতে হোবে?” তার কথায় পান্না ঘরে ঢুকে মাকে জিজ্ঞাসা করল, “মা, মা, সেই শিলকুটোনোওয়ালা আজ আবার এসেছে, আজও শিল কোটাবে?”
সোনা বালতিতে বাসি জামাকাপড় ভেজাচ্ছিলেন, ভুরু কুঁচকে তাকিয়েও হেসে ফেললেন, বললেন, “বলেছিল ছমাস যাবে, সাতদিন না হতেই আজ আবার এসেছে? বলে দাও, দরকার হলে, তুমিই ওকে ডাকবে”। এরকম একটা দায়িত্ব পেয়ে পান্না অভিভূত হয়ে গেল, অবাক আনন্দে বলল, “আমি ডাকবো, মা?”
সোনা স্মিতমুখে বললেন, “হুঁ, তুমিই তো ডাকবে...কত্তো বড়ো হয়ে গেছো তুমি, আমার আর চিন্তা কী? এখন থেকে তুমিই তো ডাকবে!” পান্না আবার দৌড়ে গেল বারান্দায়, অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা শিলকুটোনোওয়ালাকে, ঘাড় নাড়িয়ে বলল, “আজ নয়, দরকার হলে, আমিই তোমায় ডাকবো, কেমন?”
২
এ সময় এজমালির বাথরুমটাও খালি থাকে। দোতলার ভাড়াটেরা স্বামী স্ত্রী দুজনেই অফিসে বেরিয়ে যায়। বাথরুমে ঢুকে, একরাশ ভেজানো জামাকাপড় মেঝেয় ফেলে, তাতে বার সাবান ঘষতে বসলেন সোনা। বাইরে দাঁড়িয়ে পান্না ব্যস্ত মায়ের দিকে চুপ করে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। ঘাড়ের কাছে এলিয়ে পড়েছে আলগাবাঁধা খোঁপা। কপালের ওপর দু একটা আলগা চুলের গুছি। কপালে, নাকের ডগায়, চিবুকে জমে উঠেছে, বিন্দুবিন্দু ঘাম। সাবান ঘষা, থুবি দিয়ে কাচার সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠছে মায়ের হাতের শাঁখা, নোয়া, পলা আর সোনার চুরি।
পান্না ঘুম থেকে ওঠার আগে থেকে সোনার কাজ শুরু হয়ে যায়। উনুন ধরানো, ঘর ঝাঁট দেওয়া, কুটনোকোটা, বাঁটনা বাঁটা, রান্না-বান্না, এঁটো থালাবাসন ধোয়ার পর, এই জামাকাপড় কাচতে বসা...মায়ের কাজের যেন অন্ত নেই! বাবা অফিসে, দাদা স্কুলে। এখন কে হবে তার সঙ্গী? কিছুক্ষণ মায়ের কাজ দেখে, সে আবার চুপচাপ বারান্দায় গেল। এই সময় মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করলে, বকুনি জুটবে, হয়তো পিঠে দু একটা চড়-চাপড়ও।
প্রাক দ্বিপ্রহরে সামনের রাস্তাটাও একটু ফাঁকা, পথচারীর সংখ্যা কম। পাড়ার বড়োরা সবাই অফিসে, ছোটরা, যারা তার মতো ছোটও নয়, তারাও সবাই স্কুলে। বিহারি টানা-রিকশাওয়ালারা সকাল থেকে বেরিয়েছিল, এখন এক এক করে ফিরছে। রিকশাগুলো রাস্তার ধারে, পান্নাদের বারান্দা ঘেষে দাঁড় করিয়ে, এখন একটু বিশ্রাম নেবে। উল্টোদিকের টিউবওয়েল থেকে জল ভরে আনবে ঘটিতে। তারপর কাগজের ঠোঙা থেকে কিনে আনা ছাতু ঢালবে কানা উঁচু কাঁসার থালায়। সেই ঠোঙাতেই থাকে দুটুকরো পেঁয়াজ, দুটো কাঁচা লংকা, একটু তেঁতুলের আচার। থালার ওপর চূড়ো করা ছাতুর কোল ভেঙে থালাতেই একটু জল নিয়ে ছাতু ভিজিয়ে গোল্লা পাকিয়ে মুখে তুলবে। কখনো পেঁয়াজ, কখনো লংকায় কামড় দেবে, কখনো জিভের ডগায় ঠেকাবে তেঁতুলের আচার। খাওয়া সেরে তারা টিউবওয়েলে গিয়ে থালা এবং ঘটি সুন্দর করে মেজে নেবে। রাস্তার বাঁদিকে বিশাল পুরোনো বাড়িটার একতলায়, ওদের একটা ঘর ভাড়া নেওয়া আছে। সেই ঘরে থাকে না কেউ। সেই ঘরে থাকে ওদের ওই থালা-বাটি-ঘটি। এক আধটা ধুতি। চটের বস্তায় জড়ানো ওদের বিছানা। একপাশে থাকে কয়লা, ঘুঁটে, কেরাসিন তেলের শিশি, তোলা উনুন। ওদের ওই ঘরের সামনের বারান্দাতে, রাত্রে ওরা রুটি আর সবজি বানিয়ে খায়। তারপর গরমের সময়, অনেক রাত অব্দি নিজেদের মধ্যে গল্প করে, তাদের গ্রামের খেতি-জমিন, গায়-ভ্যাঁয়েস, গেঁহু, চানা...। তারপর অনেক রাতে ওই বাড়ির রোয়াকে বিছানা বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। মতিহারি, ছাপরা থেকে আসা বিশ-পঁচিশ জন দেহাতি মানুষের বৈচিত্র্যহীন দিনযাপনের এই চিত্রগুলি মুখস্থ হয়ে গেছে পান্নার।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে রিকশাওয়ালাদের ফিরে আসা দেখতে দেখতে, পান্নার মনে পড়ল, কিছুদিন আগেই রথের মেলা থেকে সে একটা বাঁশি কিনে এনেছিল। মেলায় দেখা সেই বাঁশিওয়ালার ঝুড়িতে ছিল একগাদা বাঁশি, আর একটা বাঁশি হাতে নিয়ে সে খুব সুন্দর সুর তুলছিল বাঁশিতে। সেই সুরে মুগ্ধ পান্না বাঁশি কেনার জন্য বায়না ধরল। অবশেষে বাবার একটা হাত ধরে ঝুলে পড়ে, দুপয়সা দিয়ে একটা বাঁশি কিনতে বাধ্য করিয়েছিল বাবাকে । বাড়িতে এনে সে বাঁশিটা বাজাতে চেষ্টা করেছে অনেক। কিন্তু যতবার ফুঁ দিয়েছে কিছুতেই সুর বেরোয় নি। বরং বিদঘুটে ভাঙাগলা এক আওয়াজ বেরোচ্ছিল।
সেই বাঁশিটা নিয়েই এখন সে ক্যাঁ ক্যাঁ বাজাতে লাগল। সোনা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন ছেলেকে। বাঁশির বিচ্ছিরি আওয়াজটা তাঁর কানে লাগছিল, বিরক্তির সৃষ্টি করছিল। কিন্তু তাও কিছু বললেন না, ছেলেটাই বা করে কী? এই বয়সের বালক চঞ্চল ও অস্থির তো হবেই, গ্রামের বাড়িতে থাকলে, সমবয়সী পড়শী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হুটোপুটি, দৌড়োদৌড়ি করলে, একটু আনন্দ পেত, মজা পেত। কিন্তু কলকাতার এই একখানা ঘরের বাসায় সেই উপায় কই? তাছাড়া, তিনি নিজেও চান না, এই পাড়ার ছেলেপিলেদের সঙ্গে ছাড়তে। কলকাতার লোকজন সম্বন্ধে তাঁর একটা ভীতি মনের মধ্যে কাজ করে। এখানে ছেলে-ধরা কিংবা ছেলেকে বখাটে বানিয়ে তোলার হরেক আয়োজন এবং কে জানে তাঁর ছেলের জন্যেই ওই সব লোকেরা উদ্গ্রীব হয়ে আছে হয়তো বা!
চলবে...
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।