বাংলায় বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল। সিপিএম ও কংগ্রেস তত্ত্বগত ভাবে বিজেপি বিরোধী হলেও, বাস্তবে তারা অনেক বেশি মমতা বিরোধী। ফলে তাদের সমস্ত আক্রমণই মমতা কেন্দ্রিক। কিন্তু এদের হতাশার মূল কারণ, ভোট রাজনীতিতে মমতার সঙ্গে কোনমতেই পেরে না ওঠা। ২০২১এর ভোটে সিপিএম - কংগ্রেস হাত মেলালো, সঙ্গে নিল চরম মৌলবাদী ইসলামী দল আই এস এফ কে। তবুও সিপিএম - কংগ্রেসের ঝুলি শূন্যই রয়ে গেল, কোনক্রমে ভাঙরের আসনটি পেল আই এস এফ। বিজেপির ফলও হলো খুবই হতাশাজনক। ২০০ আসন প্রাপ্তির দাবিদারকে দেখা গেল ১০০ও নয়, তারও অনেক নিচেই আটকে গেল।
বর্তমানে মমতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো অভিযোগ হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণেই সিপিএম নাকি মমতার সঙ্গে জোট করা তো দূর, তাঁর ছায়াও মাড়াতে চায়না। ২০২৪ এর নির্বাচনে মোদী শাসনের ভয়ংকর বিপদের সামনে দাড়িয়ে বিজেপি বিরোধী সব দল যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভোটে লড়ার কথা বলছে, জোট ইন্ডিয়া গঠন করেছে তখন বেসুরো গাইছে সিপিএম।
সিপিএম সম্পাদক ইয়েচুরি সাহেব জোটের পক্ষে সদর্থক কথাই বলছেন, প্রকাশ কারাত কেরলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মুখোমুখি লড়াইয়ের কথা বলছেন, আবার মোঃ সেলিম বলছেন - এরাজ্যে ইন্ডিয়া জোট কার্যকরী নয় আর ইন্ডিয়া কোন নির্বাচনী জোটই নয় শুধু একটি বিজেপি বিরোধী ব্লক মাত্র। এমন সব আজগুবি কথা কিভাবে দলের এক রাজ্য সম্পাদক বলতে পরে, তার উত্তর সম্ভবত ইয়েচুরি সাহেবেরও জানা নেই। দলটা যে এখনও অটুট আছে, তার কারণ সম্ভবত দলের বিশাল পরিমাণ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি, যা ম্যাজিক অ্যাডেসিভের কাজ করছে।
মোঃ সেলিম ঐ বয়ানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আরও বলেছেন, কোন দল যখন দুর্নীতির পাঁকে পুরো ডুবে যায় তখন সেই দলের সঙ্গ এড়িয়ে চলতে হয়। যুক্তি হিসেবে বিষয়টি সঠিক হলেও তথ্য হিসেবে তা সম্পূর্ন সঠিক কিনা, সে সন্দেহ অনিবার্য রূপেই আসবে। কারণ, সেলিম যা ভাবেন, তেমনটি হয়তো ভাবেন রাজ্যের মাত্র ৫% এরও কম মানুষ। অপর দিকে রাজ্যের বিপুল সংখ্যক মানুষতো এরকম ভাবেন না, নইলে পঞ্চায়েত ছেড়ে দিলাম, ধুপগুড়ির ভোটে এমন চমকপ্রদ ফলাফল এরাজ্যে তৃণমূলের পক্ষে দেখা যেত কি? এক্ষেত্রে অবশ্য ভোট কারচুপির কোন অভিযোগ শোনা যায়নি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, রাজ্যের সব মানুষ না জানলেও রাজনীতি সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন, গণতন্ত্রে শাসন ক্ষমতার সঙ্গে দুর্নীতি অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত এবং তার প্রকাশ ঘটে পণ্ডিত নেহেরুর মতো একজন বিশ্ববরেণ্য সফল রাষ্ট্রনেতার আমলেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুর্নীতিকে সম্পূর্ন নির্মূল করা সম্ভব নয়। কঠোরভাবে তা বন্ধ করতে গেলে গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ব্যাহত বা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তবে হ্যাঁ, নিয়ন্ত্রণ করা অবশ্যই সম্ভব লোকপাল বা লোকায়ুক্ত কমিশনের সক্রিয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। কিন্তু প্রায় কোথাও এগুলোর কোন কার্যকারিতাই নেই। ফলে দুর্নীতির দাপট কমবেশি সর্বত্র।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে কেন্দ্রীয় শাসকদলের রাজনৈতিক স্বার্থে ও দুষ্প্রভাবে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এজেন্সি, বড় সব মিডিয়া ও বিচারালয়ের একটা অংশ সম্মিলিত ভাবে জনমানসে এমন একটি ধারণা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে যে গোটা দেশে আর কোথাও কোন দুর্নীতি নেই, একমাত্র এরাজ্যেই দুর্নীতির চাষ হচ্ছে বাম্পার। ২০১৬র নির্বাচনের আগেও সারদা, নারদা ইত্যাদি নিয়ে অনেক হৈ চৈ হয়েছিল, কিছু মানুষ জেল খাটছে বা বহুদিন খেটে জামিন পেয়েছে। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়া আর এগোয়নি বা সম্পন্ন হয়নি এবং কবে হবে, সেটাও কেউ নিশ্চিত জানেনা। এরপর ২০১৯র ভোটে বিজেপি অনেকগুলো আসন পেল, তখন আর কোন দুর্নীতি নিয়ে তদন্তের প্রয়োজন পড়েনি। ২০২১এর ভোট হোল, জিতবে বলে কতই না বাগাড়ম্বর শোনা গেল, কিন্তু নিদারুণ হার হোল ভোটে। এরপরেই শুরু হয়ে গেল নানাবিধ দুর্নীতি নিয়ে প্রভূত শোরগোল। আলোচ্য সব দুর্নীতি নিয়ে কোন তদন্তই হোত না, যদি বিজেপি সেই ভোটে জিততে পারতো। বালি তোলা, কয়লা পাচার, গরু পাচার ইত্যাদি সবই চলছে যুগ যুগ ধরে। সেগুলি তখন দুর্নীতি ছিল না? ২০১১র আগে সেসব অর্থ কে পেত, কোথায় যেত, কোন তহবিলে? সবাই সব জানে, কিন্তু তখন এসব দুর্নীতি নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতো না। কারণ, সিপিএম জমানায় ছিল খুন, জখম, রক্তপাত ইত্যাদি অর্থাৎ এক হিংসাত্মক পরিস্থিতির ভয়াল পরিবেশ। কিন্তু এখন ঘামাতে হচ্ছে স্রেফ রাজনৈতিক কৌশলের কারণে, ঘায়েল করার মতো আর কোন হাতিয়ার না থাকার কারণে। আর মউকা বুঝে সেলিম, সুজন, অধীররাও দুর্নীতি নিয়ে কোরাস গাইছে। এমনকি সেলিমরা নাম না করে অভিষেক কে অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবিতে ইডি দফতরে গিয়ে বিক্ষোভ পর্যন্ত দেখিয়ে এসেছে। কিন্তু মোদী-শাহ তাদের নিজস্ব হিসাব অনুযায়ীই চলবেন এবং সঠিক সময়ে মোক্ষম নির্দেশ দেবেন।
ইডি, সিবিআই যতই দুর্নীতি তদন্তের নামে হেনস্থা করুক বা জেলে পুরুক প্রকৃত তথ্য কিন্তু সম্পূর্ন ভিন্ন ছবি দেখাচ্ছে। কর্ণাটকের ভোটে আমরা জেনেছি যে ওখানে সরকারী কাজ পেতে গেলে ৪০% কাটমানি দিতে হয়, শোনা গেছে কোথাও কোথাও নাকি ৫০% পর্যন্ত দিতে হয়। এমনকি চাপের মুখে আর্থিক ভরাডুবির কারণে বহু ব্যবসায়ীকে নাকি আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নিতে হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রের বিরোধিতা না করলে কোন দুর্নীতির তদন্তের প্রয়োজন হয়না। তাই আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হই যে, উড়িষ্যা বা অন্ধ্রে কোন দুর্নীতি নেই। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ও বঙ্গের বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারীর মতো নেতারা হাজার অভিযোগ সত্বেও সৎ নেতা রূপে মানতে সবাই বাধ্য। প্রধান মন্ত্রীর চোখে ৭০,০০০ হাজার কোটির ঘোটালার নায়ক অজিত পাওয়ারও রাতারাতি বিজেপিতে ঢুকে অর্থমন্ত্রী বনে গেলেন কোন অসুবিধে ছাড়াই।
সুতরাং, একথা এখন পরিষ্কার যে, কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি ও তার সঙ্গী সিপিএম তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থে এরাজ্যের দুর্নীতিকে হাতিয়ার করেই যে যার মতো মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাজনৈতিক ফয়দা তুলতে চাইছে। কিন্তু তথ্য বলছে - বিশ্বের সম্ভবত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এর সর্বশেষ সার্ভে, ২০১৯র রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের বড় ও মাঝারি মিলিয়ে ২০টি রাজ্যের মধ্যে প.বঙ্গের স্থান ১৭তম। অর্থাৎ যথেষ্ট নিচের দিকে। এর মানে এটা নয় যে, এখানে দুর্নীতি নেই। অবশ্যই আছে, বিশেষত বিভিন্ন নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই দুর্নীতির সত্যতা আছে এবং তার দ্রুত তদন্ত শেষ করে বিচারের রায় বের হোক, দোষীরা শাস্তি পাক। কিন্তু যদি বিষয়টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় তাহলে মূল লক্ষ্য থেকেই আমরা বিচ্যুত হবো। কারণ, একথা মনে করার যথেষ্ট সঙ্গত যুক্তি আছে যে, বিজেপি ও সিপিএম দুর্নীতির অবসান নয়, চায় শুধুমাত্র তৃণমূল দলকে কলঙ্কিত করে রাজনৈতিক ফয়দা তুলতে। আর এ কারনেই বিষয়টি ঘেঁটে যাবার সম্ভাবনা প্রবল।
২০২৪এর লড়াই যে মোদীর জেতা হারার প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত মমতার নয়, সেসব জেনে বুঝেও সিপিএম দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো আচরণ করে মোদী ও মমতাকে একই বন্ধনীতে রেখে মোদী বিরোধী লড়াইকে বিপথগামী করতে মরীয়া হয়ে উঠেছে। বিজেপি বিরোধী সমস্ত দল যখন মোদীকে হারাতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে তখন সিপিএম মমতার দুর্নীতি ভিন্ন আর কিছুই দেখতে পারছে না এবং ক্ষমতায় কুলোলে মোদীকে এরাজ্য থেকে ৪২টি আসনই উপহার দিয়ে দেয়। ফলস্বরূপ সিপিএম ক্রমশ জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদেরকে সম্পূর্নরূপে এক অন্তর্ঘাতমূলক শক্তিতে পরিণত করে ফেলছে।
শুধুমাত্র ক্যাডার নির্ভর জনসমর্থনহীন সিপিএম নেতৃত্ব মমতার প্রতি এতখানিই অন্ধ বিদ্বেষে নিমজ্জিত যে কোন সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি তাদের নেই। শুধুই বর্তমান ও তাৎক্ষণিক কৌশলেই তাদের আগ্রহ, যেনতেন প্রকারে মমতাকে বেকায়দায় ফেলা, ক্ষতি করা বা নিদেনপক্ষে বেইজ্জত করা। কিন্তু সিপিএমের নিজের ক্ষমতায় তার কিছুই করা সম্ভব নয়। জাতীয় পরিসরে বা জোট ইন্ডিয়াতে মমতার গুরুত্ব সিপিএমের চেয়ে বহু বহু গুণ বেশি। আর সেটা এমনি এমনি হয়না, হয় রাজনৈতিক ওজনের কারণে। দেশব্যাপী বিজেপি বিরোধী জনমানসে রাহুল, সোনিয়ার পরেই মমতা সর্বাধিক জনপ্রিয় নেত্রী। ২০২১এ প্রবল জনসমর্থনের অধিকারী মোদীকে প্রায় একক প্রচেষ্টায় পর্যুদস্ত করা কি অতুলনীয় কৃতিত্বের নয়? তুলনায় বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে সিপিএমের ভূমিকা স্রেফ কংগ্রেসের অনুসরণকারী ছাড়া আর বেশি কিছু কি? ত্রিপুরায় তো দেখা গেল, সম্পূর্ন আত্মসমর্পণ করে রাজ্যটিকে তুলে দেওয়া হোল বিজেপির হতে। এছাড়াও বঙ্গ রাজনীতিতে সিপিএমের ভূমিকা অনেকটাই বিজেপি নির্ভর। যথা, অভিষেক সহ তৃণমূলের মন্ত্রী সান্ত্রীরা গ্রেফতার হলেই সিপিএম সাফল্যের মুখ দেখবে, এমনটাই তারা ভাবে।
সিপিএম নেতৃত্ব এটুকু ভাবার ক্ষমতাও হারিয়েছে যে, ২০২৪এ মোদী ভোটে হেরে কেন্দ্রের ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলে এরাজ্যেও বিজেপির প্রভাব তলানিতে এসে ঠেকবে এবং সাংগঠনিকভাবে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হবে। তখন এরাজ্যে মূল বিরোধী শক্তি হবার জায়গায় সিপিএমের সামনে আর কোন বাঁধা থাকবে কি? কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ৩৪বছর একটানা ক্ষমতায় থেকে এমন এক রাজকীয় মানসিকতায় আটকে পড়েছে যে বিরোধীপক্ষের দায়িত্ব পালন করে ধীরে ধীরে একসময় সাফল্যের মুখ দেখবে, সে ভরসাও সম্ভবত আর নেই। ফলে শর্টকাট কৌশলই শ্রেয়, অর্থাৎ ২০২৪এ মোদীকে জিতিয়ে ২০২৬এ মোদীর হাতে মমতা নিধন হলেই সেলিম, সুজনদের চূড়ান্ত লক্ষ্য পূরণ হয় এবং নতুন প্রজন্মের হাতে নেতৃত্বের দায়ভার তুলে দিয়ে বিমানবসু সুলভ দায়হীন গার্জেনগিরি করেই কালাতিপাত করবেন অথবা নিশ্চিন্ত শীতঘুমে চলে যাবেন। এসবের জন্য যদি মোদী শাসনে দেশ যদি চূড়ান্ত সর্বনাশের পথেও যায়, যাবে। অত ভাবতে গেলে কি আর মমতাকে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে? যাবেনা। সুতরাং, মমতাকে সরানোর লক্ষ্যে স্থির থেকে ২০২৪এর ভোটে মনে হচ্ছে, মোদীকে জেতানোই আশু কৌশল রাজ্য সিপিএম নেতৃত্বের।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।