কলকাতার সবার একজন নিজস্ব ফুচকাওলা থাকে।
কলকাতার বাঙালি পাকা ও সবজান্তা। চাট্টি বই পড়ে, ছটি ছবি দেখে, আট্টি গান শুনে সত্যজিতকে মানিকদা, সিনেমাকে পারাদিসো ও জনগণকে লেসার মর্টাল বলে ডেকে থাকি। এবং ওয়ান-আপম্যানশিপের চূড়ান্ত। কেউ যদি বলল, "ওহ, যা ফুচকা খেলাম না!" অমনি বাঙালি বলবে, "ফুচকা খেয়েছিলাম বটে - ওই ডোভার লেন আর গড়িয়াহাট রোডের মোড় থেকে দুশ গজ ঢুকে একটা ফুচকাওলা বসত। কী তার সাইজ আর কী তার স্বাদ।" অপিচ, কলকাতার সবার একজন নিজস্ব ফুচকাওলা থাকে।
এবং থাকে নিজস্ব রোলওলা। রোলের ঠেলা বছর চল্লিশ আগে কলকাতায় আবির্ভূত হয়েছে। সে অবশ্য নামেই ঠেলা। আদতে অজর-অমর, নট-নড়নচড়ন-নট-কিচ্ছু স্থায়ী দোকান। আমি আজ অব্দি কোন রোলের দোকান স্থানচ্যুত হতে দেখিনি। রোলের নড়বড়ে গাড়ি দেখেছি কাঁচ দেওয়া, চকচকে শকটে উত্তীর্ণ হয়েছে। এমনকি সেখান থেকে ফুটপাতে ইঁটের গাঁথনি পড়ে স্থায়ী দোকানও - কিন্তু যে জায়গায় একবার রোলের ঠেলা বসেছে, প্রলয় আসা অব্দি সে স্থানে রোল বিক্রয় চলিবেই। এটি নিউটনের চতুর্থ স্থিতিসূত্র।
শুধু রোলের রকমফেরেই সারা কলকাতার ভিন্নরুচির লোককে তোয়াজ করা সম্ভব। আলু-টিক্কি রোল দিয়ে কলকাতার ডেমোগ্রাফির পঞ্চাশ শতাংশ মানুষকে তাদের নিরামিষ ভাবাবেগে আঘাত না দিয়ে সন্তুষ্ট করে ফেলা যায়। তাছাড়াও আছে পনির রোল। তাও কাউকে ভেগান বলে সন্দেহ করে থাকলে, এসব ছেড়ে ভেজিটেবিল রোল - যার পুরে শুধু শশা, পেঁয়াজ, বিট (যা আদতে নাকি রং করা লালমোহন আলু), গাজর - চালিয়ে দিন। ধর্ম, স্বাস্থ্য, এথিক্স সব কভার করে যাবে।
এগ রোল নিঃসন্দেহে রোল সাম্রাজ্যের চেতন ভগত। সারল্যের ধোঁকা দিয়ে জনপ্রিয়তার চূড়ান্তে। মাটন বা চিকেনের উৎস নিয়ে লোকের খুঁতখঁতানি চিরকালই ছিল। তাই এগ রোলের এত বিক্কিরি। আর ভাগাড় কাণ্ডের পর তো এগ রোলই অমিতাভ বচ্চন। এগের তারতম্য না থাকলেও এগ রোলের তারতম্য আছে।
রোল নিয়ে অনেক কাহন হয়েছে। আজ হাল্কা করে ফুচকাবন্দনা করি। ফুচকা শুনে হতচ্ছেদ্দা করবেন না। ফুচকার ইতিহাস রোলের ইতিহাসের থেকে আরও দীর্ঘ তো বটেই, তাৎপর্যপূর্ণ ও রহস্যময়ও বটে। রহস্য নিয়েই আগে বলি - ফুচকার জন্মরহস্য কেউ জানে না। এমনকি তা জানতে কারুর সেরকম আগ্রহও দেখিনা। সাবেকি ফুচকার তিনটি বাসস্থান। বম্বে, থুড়ি মুম্বাইতে তার নাম পানিপুরি, দিল্লিতে গোলগাপ্পা আর কলকাতায় ফুচকা। পানিপুরি নামটি সমগ্রতই ব্যাকরণসম্মত। যে পুরির ভেতর পানি থাকে - এরকম ব্যাসবাক্য করলে স্বয়ং পাণিনিও বোধহয় রুষ্ট হতেন না। গোলগাপ্পা অন্ততঃ আধা ব্যাকরণসম্মত। আকারে এটি গোলই বটে। গাপ্পার ব্যাকরণগত ব্যুৎপত্তির হদিশ আমার কাছে নেই। কিন্তু ফুচকা? কোন মানেই হয়না। ব্যাকরণ পরীক্ষায় ফুচকা ডাহা ফেল। এমনকি মার্কেটিঙেও। গুগুল বাজার গরম করার আগে জ্ঞানসমুদ্রে যার কদর ছিল রাশভারি জ্যাঠামশাইয়ে, সেই এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার অনলাইনে চাটের এন্ট্রিতে গোলগাপ্পা ও পানিপুরির উল্লখ থাকলেও ফুচকার নেই। এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে মমতা ব্যানার্জি থেকে আমরা বাঙালি - সবাইকার যে গর্জে ওঠা উচিত, সে ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করি।
ব্যকরণে ও মার্কেটিঙে ফুচকাবাবু ফেল্টু হলেও স্বাদের দিক দিয়ে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট। বাঙালি বলে আমার মুখের কথায় প্রত্যয় হচ্ছে না তো? ওই ভীর সিংভি মশাইকে জিগেস করুন। উনি ভি, বম্বেতে বড় হয়ে পানিপুরির প্রতি নস্ট্যালজিক আসক্তি দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত ফুচকাকে জিতিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। দিল্লির গোলগাপ্পা যাকে বলে ডিস্ট্যান্ট থার্ড।
ফুচকা একটি পরিপূর্ণ সৃষ্টি, যদিও ফুচকার বাড়ির তেমন বাহার নেই। যেখানেই যান সেই ছোট পুরি, মানে আটার লুচি। মাইক্রো সাইজ। ফুচকার সব কারসাজি ঘর সাজানোয়। বাড়ির ভেতরে কী পড়ছে। সাবেক বাঙালি ফুচকায় আলুসেদ্ধ, অল্প ছোলাসেদ্ধ, ধনেপাতা, বিটনুন আর সিক্রেট মশলা। অল্প লেবুর রস পড়তে দেখেছি। কাঁচালংকা কুচো, অবস্থাভেদে কাঁচালংকা-বাটাও সব ফুচকাওলাই তূণে গোপন রাখে। সবাই বলে এই মশলাতেই ফুচকাওলার হাতযশ। আমি বলি আরেকটু খেয়াল করে দেখুন। মশলার কেরদানি যদি সাতান্ন হয় তো বাকি তিন-চল্লিশ কেরদানি তেঁতুল জলে। যত ডাকসাইটে ফুচকাওলা দেখবেন, তাদের তেঁতুলজল শুধু তেঁতুলজল নয়। সে যে মিশ্রণ - তার কাছে ব্লু লেবেল ব্লেন্ডেড হুইসকি থেকে ফাসক্লাস সরবত-এ-আজম - সব শালা হারে। আলুর পুরে যে মশলা পড়ে সে তো পড়েই তেঁতুলজলে, সেই সঙ্গে নুন আর ঝালের কন্ট্রোলেও তেঁতুল জলের ভূমিকা ম্যাচ-রেফারি-সদৃশ। আলুর পুর আর তেঁতুলজলের স্বাদের ব্যালেন্সের ওপর নির্ভর করে ফুচকার ফাইনাল কোয়ালিটি। শুধু অফেন্স দিয়ে যেমন ডিফেন্সের দোষ ঢাকা যায়না, তেমনি নিরেস ও বোদা পুরে চড়া তেঁতুলজল দিয়ে ফুচকাকে জাতে তোলা যায়না। একইরকমভাবে ট্যালট্যালে টোকো তেঁতুলজল দিয়ে চড়া স্বাদের পুরওলা ফুচকাকে ফার্স্ট ডিভিশনে তোলা মুশকিল।
এর পরে পানিপুরি আর গোলগাপ্পার কীই বা বর্ণনা দেব। চন্ডীপাঠের পরে কি ওলাইচন্ডির গুণকীর্তন কেউ শোনে? তবে, একটি কথাই বলি। ব্রুহত বেঙ্গালুরু মহানিগম পালিকায় একদা ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুগনির পুর দেওয়া ফুচকা খাবার দুর্ভাগ্য হয়েছিল। এ কথা শোনার পরে আশা করি কেউই আমার ফুচকা নিয়ে প্রবন্ধ লেখার পেডিগ্রিকে সন্দেহ করবেন না।
"অমর প্রেম" দেখেছেন? সেখানে ওমপ্রকাশের চরিত্রটি, যতদূর স্মরণে পড়ে কেননা বায়াস্কোপটি দেখার পরে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর ঘুরে গেছে, ফুচকা খাওয়ার নতুন কায়দা শিখিয়েছিলেন তাবত মাতালকুলকে। সেই কায়দা হল ফুচকায় তেঁতুলজলের পরিবর্তে মদ ঢেলে খাওয়া। শুনতে পাই কোন অকুতোভয় ভারতীয় শেফ কোন হাইএন্ড রেস্তোরাঁয় ফুচকা-উইথ-ভোদকা চালু করেছিলেন। কেমন চলেছিল সে খবর আমার কাছে আসেনি। তবে মার্কিনমুলুকের নব্বই শতাংশ ভারতীয় রেস্তোরাঁ যে দুপুরবেলার বাফে চালায়, তার বহুতেই, বিশেষতঃ একটু উঁচুমানের যারা, তারা তাদের অডর্ভে ফুচকা-সদৃশ পানিপুরির বন্দোবস্ত রাখে। সেই জিনিসের কাটতি খুব।
ফুচকার কথা বলে চুরমুরের কথা না বললে আলোচনা শেষ হয়না। চুরমুরকে বলা যেতে পারে যে সম্পূর্ণ ফুচকা হয়ে উঠতে পারেনি। যদি মনে হয় রবিঠাকুরের একটি যথার্থ কোটেশন ছাড়া (একটি অযথার্থ কোটেশন কিন্তু আগে দিয়েছি ধর্মাবতার) প্রবন্ধ অসম্পূর্ণ, তাহলে চুরমুরকে "যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে" বলা যায়। আলুর পুরে ফুচকার খোলা ভেঙে তার সঙ্গে অল্প তেঁতুলজল দিয়ে ভেজা ভেজা যে বস্তুটি পরিবেশিত হয় তাহাকে চুরমুর বলে। একই র' মেটিরিয়াল পরিমাণ আর আকারের তারতম্যে ফুচকা আর চুরমুরের সৃষ্টি করে। যথা হীরে ও গ্র্যাফাইট। এখানে নাদানদের উদ্দেশে একটি বিধিসম্মত সতর্কবার্তা দেওয়া বাঞ্ছনীয় - দেখ বাছাসকল, অধিকাংশ ফুচকাওলাই ফুচকার সঙ্গে আলুকাবলি এবং চুরমুর বেচে। অনুপানের দিক থেকে আলুকাবলির সঙ্গে চুরমুরের যথেষ্ট মিল থাকলেও উহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব।
এখানে আর একটা খাবারের উল্লেখ করে ফুচকা প্রসঙ্গে ইতি টানব। একটা খাবার ঠিক নয়, এক টাইপের খাবার।
আচ্ছা, কখনও ভেবে দেখেছেন যে যে ফুচকার খোল ভাজার সময়ে একেবারেই ফোলে না, সেগুলোর কী গতি হয়? এরকম তো কখনই হতে পারে না সব ফুচকার ব্যাচই ফোলার ব্যাপারে একশোয় একশো। কিছু জনতা নিশ্চয়ই ফেলও করে। সেই ফেল্টু ফুচকার খোলেরা কোথায় যায়? তারা যায় বিভিন্ন রকমের চাট হতে। দহি-চাট থেকে পাপড়ি-চাট। চাট সাম্রাজ্যে দই ও তেঁতুলের চাটনি যদি সম্রাট ও সাম্রাজ্ঞী হয়, চ্যাপ্টা ফুচকার খোল অন্তত প্রধান মহামাত্যর গুরুত্ব পেতে পারে।
ফুচকা সন্দর্ভ একটি ব্যক্তিগত আখ্যান দিয়ে শেষ করি। আমি সল্ট লেকের বিডি স্কুলে ৮১ সালে ভর্তি হয়ে দেখেছি কালো, সুঠাম চেহারার মিলনদা স্কুলের বাঁধা ফুচকাওলা। আজ সাঁইতিরিশ বছর পরে মিলনদা এখনও প্রতিদিন সিএ মার্কেটে বসে। মে মাসে গিয়ে বন্ধুর প্ররোচনায় ফুচকা খেতে গিয়ে দেখলাম, পঁচিশ বছরের প্রবাস জীবনে হাইজিন-সংক্রান্ত খুঁতখুঁতুনি এতটাই বেড়েছে যে দিনের আলোয় আলু চটকানো দেখে আর খেতে পারলাম না। স্থির করেছি পরেরবার গিয়ে সন্ধ্যের আঁধারের সুযোগ নিয়ে হাইজিন গুলি মেরে মিলনদাকে প্যাট্রনাইজ করে আসব।
ও হ্যাঁ, আমার ইশকুলের বান্ধবীদের নিজস্ব ফুচকাওলা এখনও মিলনদা।
ওমা! মূল উপাদানটার কথাই কেউ লেখেনি! ড্রেনের জল! নইলে ঐ চমৎকার স্বাদ হতেই পারে না।তাছাড়া ঐ পাত্রের জলে শৌচকর্ম, ধৌতকর্ম সবই হয়...
মফস্বলি-বৃত্তান্ত
"কিন্তু ফুচকা? কোন মানেই হয়না। ব্যাকরণ পরীক্ষায় ফুচকা ডাহা ফেল।"
আমার মাথায় পুলক ঘোষাল বর্ণিত হাই-ভোল্টেজ স্পার্ক হয়েছে। ফুচকা শব্দটা এসেছে ফোস্কা থেকে। ফোস্কা > ফোসকা > ফোচকা > ফুচকা।