এটা জানা কথা যে, একজন বক্তার কণ্ঠনিঃসৃত ভাষা বিধিগতভাবেই তার মনোভাবের প্রকাশক। এই প্রকাশ একটি উচ্চারণগত চর্চা যা প্রয়োজনের তাগিদেই জিহবা নামক আমাদের সক্রিয় অঙ্গটিকে আশ্রয় করে অভ্যেসের রূপ নেয়। প্রতিটি সম্প্রদায়ের মধ্যে এই অভ্যেস তাদের আচারেরই প্রতিনিধিত্ব করে। আরবের বেদুইনদের মাঝেও এই অভ্যেসটি বর্তমান ছিল, আর তা ছিল সব থেকে সুন্দর অভ্যেস যা কিনা তাদের মনোভাবকে সব থেকে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে পারত। তারা একে ব্যবহার করত কোন প্রকার তাত্ত্বিক জ্ঞানের শরণাপন্ন না হয়েই। শুধুমাত্র জিহবার আশ্রয়ে গড়ে উঠা বেদুইনদের এই অভ্যেস একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে প্রবাহিত হত, ঠিক যেভাবে বর্তমানকালে শিশুরা আমাদের ভাষাকে আত্তীকরণ করে থাকে নিজেদের মধ্যে।
কিন্তু যখন ইসলাম আবির্ভূত হল, আর বেদুইনরা হিজা’জকে পরিত্যাগ করল বিভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্রের হাতে থাকা সাম্রাজ্যগুলো জয় করার অভিপ্রায়ে, তখন তাদের মিশ্রণ ঘটলো বিভিন্ন আরব-বহির্ভূত জাতির সাথে। এই সময়েই তাদের উপরে বর্ণিত অভ্যেসটি বদলাতে শুরু করল ভিন্ন এক কথ্যভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যা আরবী ভাষা শিখতে চাওয়া আরব-বহির্ভূত মানুষগুলোর মধ্যে থেকে জন্ম লাভ করেছিল। বলতে কি, শ্রবণ প্রক্রিয়া সব সময়ই ভাষাগত অভ্যেস ও চর্চার একটি নিয়ামক ও উৎস। আরবী ভাষা এভাবে এক সময় বিকৃত হতে শুরু করল তার আদি রূপ থেকে বিচ্যূত হওয়ার কারণে। এই সময়টায় আরবরা তাদের সংস্পর্শে আসা মানুষদের মুখ থেকে যা শুনছিল, তাতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল। এহেন পরিস্থিতিতে আরব পন্ডিতস্মন্যরা প্রমাদ গুনতে শুরু করলেন, তাদের ভয় হল যে ভাষাটা পুরো বিকৃত হয়ে পড়বে, এবং মানুষ তাতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়বে যে কোরান ও অন্যান্য আচারিক উপাদানগুলো দুর্বোধ্য আকার ধারণ করবে। ফলে তারা নিয়ম-কানুন প্রণয়ন করল তাদের বেদুইন জাতির সর্বজনস্বীকৃত ও বৈধ বাকভঙ্গি থেকে সূত্র খুঁজে নিয়ে। তারা এই নিয়মগুলো অনুশাসনের মত করে ব্যবহার করল তাদের পরবর্তী কালের মুখের ভাষা প্রয়োগে, সদৃশ বস্তুর সাথে সাদৃশ্য খুঁজে নিয়ে নিয়ে। উদাহরণস্বরূপ, তারা দেখতে পেলেন যে, কোন বাক্যের মূল প্রতিনিধি বা ক্রিয়া সম্পাদনকারী কর্তৃকারকে অবস্থান করে, অন্যদিকে যাকে আশ্রয় করে প্রতিনিধি তার কাজ সম্পন্ন করে তা অবস্থান করে কর্মকারকে। এছাড়া বাক্যের বিষয়বস্তুটিও অবস্থান করে কর্তৃকারকে। শব্দস্থিত স্বরবর্ণের পরিবর্তন হলে শব্দের অর্থও যে বদলে যায়, তারা এ বিশয়েও সচেতন হলেন। এই প্রক্রিয়াটির বিধিগত নামকরণ করা হল ‘আই রব’ বা ‘অবনমন’। আর যে উপাদানটির জন্য এই পরিবর্তন সঙ্ঘটিত হয়, তার নামকরণ করা হল ‘আমিল’ বা ‘প্রশাসক’ । এরকম করে আরো সব শব্দের জন্ম হল যা তাদের কাছে বিধিগত পরিভাষায় পরিণত হল। তারা মৌখিক এ শব্দগুলোকে লিখিত রূপ প্রদান করলেন, আর পরবর্তীতে বিশেষ শৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ করলেন, যাকে তারা নামকরণ করলেন ‘ইলম আন নাহঅ’ বা ‘ব্যাকরণের বিজ্ঞান।‘
(ইবনে খালদুন, মুকাদ্দিমা, সংখ্যা/এডিশান, বৈরুত, ১৯৬৭, পৃষ্ঠাঃ ৫৪৬)
মহান ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন (মৃত্যু: ১৩৫৬) তার বিশ্ব ইতিহাস বিষয়ক রচনা (মুকাদ্দিমা) প্রবর্তনের জন্যই প্রধানত পরিচিত। এই মুকাদ্দিমা মূলত সামাজিক ইতিহাস-আশ্রয়ী একটি বিশাল প্রবন্ধ যা কিনা ৬০০ পাতার একটি মুদ্রিত সংস্করণে লিপিবদ্ধ রয়েছে। প্রবন্ধটিতে ইবনে খালদুন আলোচনা করেছেন সভ্যতার উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে, আর সেই ধারাবাহিকতায় বেদুইন ও সাংসারিক জীবনের বৈপরীত্যের উপর আলো ফেলে প্রবন্ধটি শেষ হয়েছে। ইতিহাসে এই বৈপিরিত্যের উপর একটি মতবাদ রয়েছে, আর তা হল - সভ্যতা বিকাশ লাভ করে একটি যাযাবর জীবনপদ্ধতি থেকে গৃহী জীবনপথে অসগ্রর হওয়ার মাধ্যেম। দু’টি জীবনধারার মধ্যকার পার্থক্যগুলোর অন্যতম হল সাংসারিক জাতিগুলোর নাগরিকদের হাতে থাকা অফুরন্ত অলস সময়। যেহেতু যাযাবর জাতির লোকেদের মত তাদের পুরো সময় ব্যয় করতে হয় না খাদ্য ও আশ্রয়ের সন্ধানে, তারা চিত্তবিনোদনের নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়, যার মধ্যে কারুশিল্প ও বিজ্ঞানও অন্তর্ভূক্ত। ইবনে খালদুন এই তারতম্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই তার অঙ্কিত সভ্যতার উন্নয়ন সারণীতে ভাষা-শৃঙ্খলার গোড়াপত্তনকেও অন্তর্ভূক্ত করেন। তিনি আমাদের দেখান যে, বেদুইনরা আরবী ভাষা বলে এক প্রাকৃতিক প্রবণতা থেকে যা তাদের প্রাত্যহিক জীবনসংগ্রাম দ্বারা অনুপ্রাণিত, আর সে কারণেই তাদের কোন ব্যাকরণবিদের প্রয়োজন হয়নি সঠিক আরবী বলা শিখিয়ে দিতে। কিন্তু সাংসারিক সভ্যতায় পারিপার্শ্বিকতার পরিবর্তন অবক্ষয়কে উস্কে দিল এবং ভাষা বিকৃতকরণের হুমকির মুখে পড়ে গেল। ইবনে খালদুনের বর্ণনায়, এই বিকৃতকরণের পদ্ধতিটি ব্যাকরণের উদ্ভবের সাথে সংযুক্ত।
আরবী ভাষার ঐতিহাসিক বিকাশের উপর ইবনে খালদুনের দৃষ্টিভঙ্গি আরব জাতি নিজেদের ভাষার ইতিহাসকে যে দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত তারই স্বাক্ষর বহন করে। আরব বিশ্বে ভাষা সম্পর্কিত মনোভাবের পরিবর্তন ও বিকাশকে বুঝতে আমাদের একটু দৃষ্টি দেয়া দরকার আরবদের এ সংক্রান্ত নিজেদের ধারণার দিকে। তাদের ভাষার ইতিহাস শুরু হয় ইসলাম আবির্ভূত হওয়ার পূর্বেই। ‘জাহিলিয়া’ বা ‘অজ্ঞতার কাল’ বলে পরিচিত এই যুগে - যখন বেদুইনরা ইসলামের বার্তা লাভ করেনি, সকল গোষ্ঠি বা সম্প্রদায় একটাই ভাষাতেই কথা বলত যার নাম ‘আল আরাবিয়া’। ব্যাকরণবিদদের লেখায় আমরা সম্প্রদায়গুলোর ভাষাতাত্ত্বিক ভিন্নতা বা তথাকথিত ‘লুঘট’ -এর বহু উল্লেখ দেখতে পাই; কিন্তু এই ভিন্নতাগুলো আরবী ভাষার অপরিহার্য ঐক্যকে ধ্বংস করতে পারেনি।
বহুল কথিত সম্প্রদায়গত ভিন্নতার একটি উদাহরণ হিসেবে আমরা উল্লেখ করতে পারি শ্বাসরন্ধ্র বন্ধের মাধ্যমে উৎপন্ন ধ্বনি ‘হামযা’র উচ্চারণের কথা। আরব ব্যাকরণবিদগণের মত অনুযায়ী, আরব উপদ্বীপের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সম্প্রদায়গুলো এই ধ্বনিটি উচ্চারণ করলেও পশ্চিমাঞ্চলীয় সম্প্রদায়গুলো, যাদের মধ্যে আছে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর নিজস্ব গোত্র কুরাইশ, একে বর্জন করতো বা এড়িয়ে যেত। সেজন্যই পূর্বাঞ্চলের বেদুইনরা যখন উচ্চারণ করত ‘কাইম’ বা ‘দাঁড়াও’, পশ্চিমী বেদুইনদের মুখে তা বদলে যেত ‘কাইয়েম’ এ। একইরূপ পার্থক্যের কথা বর্ণিত আছে অন্যান্য ধ্বনি ও আভিধানিক বিষয়সমূহকে নিয়ে; অথচ ব্যাকরণবিদরা স্পষ্টভাবেই বলে গেছেন যে, যা কিছু প্রকৃত আরবদের মুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছে, তা-ই হচ্ছে বিশুদ্ধ আরবী ভাষা।
আর এই দৃষ্টিকোন থেকেই সম্ভবত ইসলাম-পূর্ববর্তী আরব উপদ্বীপের ভাষাগত পরিস্থিতির উপর পশ্চিমা আরব-তাত্ত্বিকদের মতামতে বড় ধরণের গরমিল দেখা যায়। অধিকাংশ পশ্চিমা আরব-তাত্ত্বিকদের মতে, জাহিলিয়ার অন্ধকার যুগে গোত্রগুলোর দৈনন্দিন কথ্যভাষার সাথে কোরান ও কাব্যসাহিত্যের ভাষার একটি প্রণিধানযোগ্য পার্থক্য ছিল। পরবর্তী ধরণটিকে সাধারণত আখ্যায়িত করা হত ইসলাম-পরবর্তী উপভাষা বা ‘পোয়েটিকো-কোরানিক কোইন’ হিসেবে। আর আরব সম্প্রদায়গুলোর মুখের কথ্যভাষাকে ফেলা হত ‘ইসলাম পূর্ববর্তী’ উপভাষার শ্রেণীতে। আর উপরোক্ত তাত্ত্বিকদের ভাষ্য অনুসারে, এই কণ্ঠ নিঃসৃত উপভাষাগুলো ইতিমধ্যেই হারাতে শুরু করেছিল ধ্রুপদী আরবীর অল্পস্বল্প বৈশিষ্ট্য, বিশেষ করে, কারক সমাপ্তির মত বিষয়গুলোতে।
ইবনে খালদুনের বর্ণনামতে, বেদুইনদের বিশুদ্ধ ভাষা অস্পৃশ্য বা অকলঙ্কিত থেকেছিল বিজয়ের যুগে আরবদের অন্য জাতির সংস্পর্শে আসার আগ পর্যন্ত। বলা বাহুল্য, একটা সময় বাসযোগ্য পৃথিবীর একটি বড় অংশ আরবদের অধিকৃত ছিল, যা বাহু বিস্তার করেছিল মধ্য এশিয়া থেকে শুরু করে ইসলামের পতাকার নীচে থাকা স্পেন পর্যন্ত। সে সময় আরব ও অধিকৃত অঞ্চলের জনতার মধ্যকার মিথস্ক্রিয়ায় আরবী ভাষা ব্যবহৃত হত। কিন্তু যেহেতু অধিকৃত মানুষগুলোর অনেক সমস্য হত আরবী ভাষার জটিল গঠনকে শিখে নিতে, তাদের প্রায়শই ভুল হত, আর এভাবে ভাষাটিতে বিকৃতি ঢুকে পড়ত। ইবনে খালদুনের গবেষণার মূল বিষয়ই ছিল ভাষার এভাবে ঘটে চলা বিকৃতি। তার ভাষ্যকে আধুনিক ভাষায় এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে, ভাষার বিকৃতি তখনই ঘটে যখন একটি দ্বিতীয় ভাষাকে ভুলভালভাবে শেখার ঘটনা ঘটতে থাকে। আরবিভাষী বিশ্বের প্রেক্ষাপটে এর মানে হল, ভাষার কথ্যরুপ যার জন্ম হয়েছিল বিজয় অভিযানের যুগে, তা আসলে আরবী ভাষার বিকৃত সংস্করণ। যেহেতু ব্যাকরণবিদদের মূল লক্ষ ছিল ‘আরাবিয়া’র উপর, তারা তাদের ভাষার এই বিকৃত সংস্করণে কোন আগ্রহ-উদ্দীপক কিছু খুঁজে পাননি। ব্যাকরণনির্ভর ধ্রুপদী ভাষা আর ব্যাকরণবিহীন কথ্য ভাষার মধ্যকার এই বিরোধ আরব বিশ্বে আজ অবধি বজায় আছে।
আরবী ভাষার ইতিহাস সম্পর্কিত পশ্চিমা বিবরণগুলো মাঝে মাঝে বিজয়ী আরব ও বিজিত জনগনের মিথস্ক্রিয়ায় জন্ম নেয়া ত্রুটিপূর্ণ ধরণগুলির অস্তিত্ব স্বীকার করে; কিন্তু তারা একই সঙ্গে অভিমত প্রকাশ করে যে, এই গলদপূর্ণ উপভাষাগুলোভাষার আরবীকরণের সাথে সাথে বিলীন হয়ে গিয়েছিল, এবং সাম্রাজ্যের সকল অধিবাসী ভাষার আদিম সংস্করণকে বরণ করে নিয়েছিল। এই পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ইসলাম পূর্ববর্তী কথ্যভাষা থেকে আধুনিক উপভাষায় প্রবাহিত হওয়ার পথে কোন বিরতি ছিল না, এবং যদি কোন বিকাশ হয়েও থাকে, তা ছিল একটি ক্রমশ ও ধীর প্রক্রিয়া। এ মতানুযায়ী আরবী উপভাষাকে দেখা হয় বিজেতাদের ভাষা হিসেবে, আর বিজিত অঞ্চলগুলোর অধিবাসীদের চিন্তা করা হয় তাদের নতুন প্রভুদের ভাষার নীরব ও নিষ্ক্রিয় গ্রাহক হিসেবে। কিছু প্রচেষ্টা অবশ্য হয়েছে উপভাষাগুলোর আঞ্চলিক ভিন্নতাকে বিজিত রাজ্যগুলোর (অর্থাৎ, কপটিক, সিরিয়াক, বার্বার, পার্সিয়ান, সাউথ আরাবিয়ান) ভাষার প্রভাবে ফসল হিসেবে দেখাতে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এক্ষেত্রে বড়সড় কোন প্রভাবের চিহ্ন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা সত্যি কঠিন।
এটা অনুধাবন করা গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাকরণবিদরা ভাষাটির বর্ণনায় ভাষাতাত্ত্বিক বাস্তবতার একটি বড় অংশকে এড়িয়ে গেছেন। প্রকৃত কথ্যভাষা ব্যাকরণ বিদ্যার আদর্শিক গঠন থেকে অনেকটাই ভিন্ন ছিল। ইসলামের চতুর্থ শতাব্দীতে (সাধারণ বা প্রচলিত বর্ষপঞ্জির হিসেবে দশম শতাব্দী), কেউই আর ধ্রুপদী ভাষায় কথা বলত না। সে সময় থেকেই প্রতি বক্তার মাতৃভাষা হয়ে উঠেছিল একটি বৈচিত্রপূর্ণ কথ্যভাষা, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছিল আধুনিক আঞ্চলিক ভাষাগুলোরই ছায়া। আরবের কথ্যভাষী সম্প্রদায়কে সেই দ্বৈতভাষীদের (ডিগলসিক) দলে ফেলা যায় যারা আসলে একই সাথে ভাষার একাধিক রূপ ব্যবহার করে থাকে তাদের দৈনন্দিন কথাবার্তায়। ভাষার ব্যাপারে আরবদের মনোভাব বুঝতে হলে আমাদের দ্বৈতভাষা প্রয়োগের প্রকৃতিটি একটুখানি বিশদে বুঝে নেয়া প্রয়োজন। একটি দ্বৈতভাষী সমাজে ভাষার দুটি রূপের সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়। ফার্গুসনের (১৯৫৯) এ সংক্রান্ত একটি স্মরণীয় প্রবন্ধ রয়েছে যেখানে উত্তম ও হীণ শ্রেণীর ভাষার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়, যাদের রয়েছে নিজ নিজ কার্যক্ষেত্র। উত্তম শ্রেণীটি ব্যবহৃত হয় প্রধানত লেখ্য এবং আনুষ্ঠানিক কথোপকথনের ক্ষেত্রে, যেমন, ভাষণ বা জনসভার বক্তৃতা-বিবৃতিতে। অন্যদিকে, হীণ সংস্করণটি ব্যবহৃত হয় অনানুষ্ঠানিক পরিস্থিতিগুলোতে; যেমন, বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনের মধ্যকার সংলাপে। এছাড়া দ্বিতীয় একটি পার্থক্য হল, উচ্চ সংস্করণটি বিদ্যালয়গুলিতে শেখানো হয় একটি কৃত্রিম-আদর্শিক প্রথা হিসেবে, আর হীন সংস্করণটি ব্যবহৃত হয় সর্বসাধারণের মাতৃভাষা হিসেবে।
এমন একটা পরিস্থিতিতে একটি সম্প্রদায়ের সদস্যদের জন্য এমনটা বিশ্বাস করা অস্বাভাবিক নয় যে, উচ্চ সংস্করণটিই তাদের সকলের মাতৃভাষা, এবং যদিও কেউই তাদের সাধারণ দৈনন্দিন কথাবার্তায় উচ্চশ্রেণীটি ব্যবহার করে না, তারা অনুভব করে যে, তারা এই উচ্চসংস্করণটিরই দেশজ উত্তরাধিকার। অথচ বাস্তবতা হল, এই শ্রেণীটি শুধু স্কুলেই শেখানো হয়, এবং সে কারণেই সম্প্রদায়ের সবার জন্য উপযোগী নয়। কিছু মানুষ তো এমনকি তাদের বিশ্বাসকে মর্যাদা দিয়ে হীন শ্রেণীর ভাষাটির অস্বিত্বকেই অস্বীকার করতে শুরু করে। আর এরই ফলশ্রুতিতে, ভাষার এই বিশেষ আঞ্চলিক রূপটিকে ভাষাবিদ্যাগত ত্রুটির থেকে বেশী মর্যাদা দান না করার একটা সাধারণ প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। আবার বিকল্প একটি ধারণাও অনেকের মধযে জন্মলাভ করে যে, এই আঞ্চলিক রূপটি বোধহয় নারী-শিশু-অশিক্ষিত তথা গন্ডমুর্খদেরই ভাষা!
এই পরিস্থিতিটা হেলেনিস্টিক গ্রীস ও মধ্যযুগের রোমান রাজ্যগুলিতে দেখতে পাওয়া পরিস্থিতি থেকে খুব একটা ভিন্ন নয়। উভয় ক্ষেত্রেই ধ্রুপদি ভাষা, মানে, গ্রীক ও ল্যাটিন বিবেচিত হয়েছিল সত্যিকারের ভাষা হিসেবে। অন্যদিকে, ভাষার জনপ্রিয় ও মেঠো রূপটি, যেমন, গ্রিসে আধুনিক গ্রিক ভাষার পূর্ববর্তী ভাষা, আর রোমান সাম্রাজ্যে রোমান উপভাষা, সভ্য ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভে ব্যর্থ হয়েছিল। এবং একই কারণে এগুলোকে অপ্রাসঙ্গিকও করে রাখা হয়েছিল ভাষাগত কর্মকান্ডে। যখন ল্যাটিন ব্যাকরণবিদরা বাচনপ্রক্রিয়ায় ত্রুটি বিচ্যুতির কথা আলোচনা করত, তারা প্রকৃত রোমান উপভাষার কথা আলোচনাতেই আনত না; বরং শিক্ষার অভাবজনিত কারণে ধ্রুপদি ভাষা ব্যবহারে অদক্ষতা ও ত্রুটির কথাই প্রাধান্য পেত তাদের আলোচনায়। ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ববিদেরা মাঝেমধ্যে অবশ্য এই ত্রুটিপূর্ণ ল্যাটিনকে ‘ভালগার’ বা অশ্লীল ল্যাটিন হিসেবে অভিহিত করত। তবে এরূপ নামকরণ সত্বেও এই অশুদ্ধ ধ্রুপদি ল্যাটিন কিন্তু প্রকৃত কথ্যভাষার অনুরূপ ছিল না।
একইভাবে আরব বিশ্বে অনেক ব্যাকরণবিদ ছিলেন যারা অনেক সন্দর্ভ রচনা করেছেন কণ্ঠভাষার ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে (তথাকথিত ‘লাহন আল-আম্মা’ বা ‘সাধারণ মানুষের ত্রুটি’র কথা স্মরণযোগ্য)। অথচ তাদের কোনই মাথাব্যথা ছিল না অভিজাত ও হীন শ্রেণীর ভাষার তুলনামূলক বিশ্লেষণে, কথ্যভাষার একটি সর্বাত্বক বিশ্লেষণ তো আরো পরের কথা। এই সন্দর্ভগুলি লেখা হয়েছে সেই ভাষাগত ভুলগুলোকে তুলে ধরতে যা কিনা অর্ধশিক্ষিত আরবেরা ধ্রুপদি আরবী ভাষা প্রয়োগ করতে গিয়ে প্রায়শই করে থাকে। অবশ্য ‘ত্রুটিযুক্ত আরবী ভাষা’কে জানতে এই সন্দর্ভগুলিই আমাদের একমাত্র উৎস নয়, কারণ আমরা জানি যে, অনেক অশিক্ষিত লোকও বিপুল পরিমাণ তথ্যকে নথিভূক্ত করেছেন, যার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত নলখাগড়ার কাগজে সন্নিবেশিত লেখা থেকে শুরু করে পশুচিকিৎসা সংক্রান্ত টেকনিকাল অভিসন্দর্ভ। এই ধরণের লেখাগুলোকে ‘মধ্যযুগীয় আরবী’ নামে অভিহিত করা হয় সেই দৃষ্টিকোন থেকে যে দৃষ্টিকোনে ত্রুটিপূর্ণ ধ্রুপদি ল্যাটিন ভাষায় রচিত নথিগুলোকে অভিহিত করা হয় ‘অশ্লীল ল্যাটিন’ হিসেবে। এই লেখাগুলোর প্রয়োগরীতিতে ধ্রুপদি ভাষার সাথে আঞ্চলিক উপাদান এবং লোক দেখানো অতিবিশুদ্ধবাদিতার ছাপ চোখে পড়ে। এটা কোনভাবেই নিজস্ব নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত কোন ভাষা নয়, আর একে কোনভাবেই আদি ও অকৃত্রিম আরবীর সাথে এক করে দেখার সুযোগ নেই।
কোন বিশদ বিবরণ বা প্রামান্য ব্যাখ্যা ছাড়াই আরব ব্যাকরণবিদরা আরবী ভাষায় উপরেল্লিখিত ত্রুটির উদ্ভব প্রক্রিয়াকে ‘ভাষার বিকৃতি’ আখ্যা দিয়েছেন। এই ব্যাকরণবিদরা অবশ্য ভাষার উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অনন্য কোন ধারণার প্রবর্তন করেননি। প্রকৃতপক্ষে, যখন একটি প্রামাণ্য ভাষা ও তা থেকে সৃষ্ট কিছু প্রাদেশিক ভাষা পাশাপাশি বিরাজমান থাকে, তখন এই ধারণাগুলি স্বাভাবিক কারণেই জন্মলাভ করে। ষষ্ঠ ও সপ্তদশ শতাব্দি তথা মধ্যযুগের পশ্চিমা ব্যাকরণবিদদের কাছে সেজন্যই হয়ত রোমান কথ্যভাষাগুলি ল্যাটিনের একটি বিকৃত রূপ ছাড়া কিছুই নয়। সাধারণত ব্যাকরণবিদরা এইসব ক্ষেত্রে ভাষার অভিজাত সংস্করণের বিভিন্ন সনাক্তরণ বৈশিষ্ট্য আবিষ্কারে মনোনিবেশ করেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর উদাহরণ হতে পারে বাক্যের অর্থভেদে শব্দশেষে বিভক্তির প্রয়োগ। যদি কেউ এই বিভক্তিগুলো ব্যাকরণবিদদের বেঁধে দেয়া নিয়মে শব্দ বা ধাতুর অন্তে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাকে নিশ্চিতরূপেই অশিক্ষিত অভিধায় অভিহিত হতে হয়। এই দৃষ্টিকোন দিয়ে বিচার করলে, ভাষার কথ্যরীতিতে একটি ব্যাকরণীয় কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে যাওয়া সুস্পষ্টরূপেই একটি তামাশার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আর এ জায়গাতে এসেই আরব ও রোমান ব্যাকরণবিদদের সাদৃশ্য টুটে যায়। সত্যি বলতে, রোমানভাষী অঞ্চলের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ অনেকটাই ভিন্ন ছিল আরববিশ্বের থেকে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর রোমান উপভাষা ব্যবহারকারী অনেকগুলো রাজ্য স্বাধীন হয়ে যায়, আর সেই নতুন সৃষ্ট জাতিগুলোর জন্য ভাষার কথ্যরূপ পুরো জাতিকে এক সুতোয় বাঁধার জন্য জন্য একটি বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। এই বিষয়টিই ফরাসি ও ইটালিয়নের মত কথ্যভাষাগুলোকে আলাদা ও পূর্ণাংগ পৃথক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সুযোগ করে দেয়। ল্যাটিন ভাষা অবশ্য তারপরো একটা দীর্ঘ সময় ধরে বৃত্তি ও ধর্মপরিচালনার ভাষা হিসেবে তার অবস্থানে অটুট থাকে।
আরবিভাষী বিশ্বে এরকম কোন ঘটনার নজির নেই। যদিও আরবের অনেক এলাকা আরো আগেই স্বাধীনতা লাভ করেছে (উদাহরণ হিসেবে কর্ডোভার খেলাফত, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার কতিপয় ক্ষুদে রাজ্যের কথা বলা যেতে পারে), আরব-ইসলামিক বিশ্বের মূল জায়গাগুলোর সাথে ঐ দেশগুলির সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক মিত্রতা, বিশেষ করে ধর্মীয় ঐক্য রীতিমত অক্ষুণ্ণ ছিল। ভিন্ন ভিন্ন ইসলামিক সাম্রাজ্যের অধিবাসী হলেও তারা নিজেদের একই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত বলে বিবেচনা করত, যারা ইসলাম ও আরবি ভাষার অধীন। কোরানের ধ্রুপদী আরবী ভাষা ছিল এই ঐক্যবোধের সব থেকে শক্তিশালী প্রতীক। এই ঘটনাটাই ব্যাখ্যা করে কেন আরবি কথ্য ভাষাকে ধ্রুপদী আরবির একটি হীনতর রূপ হিসেবে গণ্য করার কাজটি চলমান থাকে আরববিশ্বের ভূরাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটে যাওয়ার পরেও, এবং এখনো অবধি কেন এই মতবাদটি টিকে আছে শক্তিশালী ভাবে। আরব চিন্তাবিদদের প্রায়ই জোর দিতে শোনা যায় যে,আরবী কথ্যভাষার আসলে বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই। আর এ কারণেই ধ্রুপদী আরবী ভাষা ও প্রচলিত কথ্যরূপের মধ্যে পরিলক্ষিত পার্থক্যগুলোকে তারা অবশযবর্জনীয় ত্রুটি বলে চালিয়ে দিতে চান। ঐতিহ্যবাহী ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরবী উপভাষার অধ্যায়নকে সাধারণত এড়িয়ে চলতে দেখা যায়, যেহেতু এই উপভাষাগুলোর চর্চাকে আরবীয় ঐক্যের পথে ক্ষতিকারক হিসেবে চিন্তা করা হয়। এই উপভাষাগুলি এমনকি মাঝে মাঝে উপনিবেশবাদী শক্তিগুলোর দ্বারা আরব ঐক্যে ফাটল ধরানো ও আরব দেশগুলিকে একে অন্যের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা হিসেবেও বিবেচিত হয়।
আঞ্চলিক ভাষার প্রতি এই অবহেলার জন্য আরবীর ভাষাগত ঐতিহ্যে ভাষার বিবর্তন সম্পর্কিত ধারণার অভাবকে দায়ী করা যেতে পারে। আমরা উপরে (অধ্যায় আট) দেখেছি যে, আরবী ভাষাতত্ত্বে ভাষার ক্রমবিকাশের বিষয়টি অনেকাংশেই অনুপস্থিত। আরবী ব্যাকরণের উন্মেষকালে, ব্যাকরণবিদেরা, যাদের অনেকেই ছিলেন আরব বহির্ভূত, বেদুইন তথ্যদাতাদের উপরই নির্ভর করতেন ধ্রুপদি ও বিশুদ্ধ আরবী তথা কোরান ও কাব্যসাহিত্যের ভাষার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহে। অবশ্য খুব শীঘ্রই আর ইসলামিক যুগের প্রাথমিক শতাব্দীকালের মধ্যেই, তারা বাধ্য হলেন স্বীকার করতে যে অধিকাংশ বেদুইন গোত্র প্রভাবিত হয়েছেন তাদের সাংসারিক ও গ্রহী জীবনের দৈনন্দিন ভাষা দিয়ে, যার সাথে যাযাবর জীবনের কথ্যভাষার মিল নেই। আর এরপর থেকেই বেদুইনদের ভাষা আল-আরব পরিণতি পায় একটি আদর্শিক কাঠামোয়। ব্যাকরণবিদগণের ভাষার বিশ্লেষণ তাই অপরিহার্যভাবে সাংসারিক জীবনে আবদ্ধ বেদুইনদের সেই তথ্য-উৎসগুলোর উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যাদের একবার নির্বাচন করা হলে তারা অনন্তকালের জন্য নির্ধারিত হয়ে যেত উপরে বর্ণিত আদর্শিক কাঠামোকে অনুসরণ করে; ভাষার সেই নিয়মে কখনো আর কোন ব্যত্যয় ঘটত না। উদাহরণস্বরূপ, ইসলাম-পূর্ববর্তী কবিতা, ও ইসলাম পরবর্তী কোরানের ভাষ্যের কথা বলা যেতে পারে। এই উৎসগুলো গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যেতে লাগল বেদুইনদের কথিত কণ্ঠভাষার সূত্র ধরে, এমনকি তখনো যখন কোন বিশুদ্ধ আরবীভাষী যাযাবর বেদুইনের আর অস্তিত্ব ছিল না কোথাও। ব্যাকরণবিদদের ক্ষেত্রে অবশ্য তাদের ব্যাকরণীয় নীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে উৎসগুলি ব্যবহার করতে হয়েছিল, তার সত্যসত্য যাচাইয়ের কোন দায় ছিল না। কারণ স্থানীয় আরবীভাষীরা তাদের ভাষা সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা পেয়ে গিয়েছিল, আর ভাষার উপরেল্লিখিত বেদুইন, অর্থাৎ, আদর্শিক কথকদের উল্লেখ ব্যাকরণ প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্টই ছিল। একই সময়ে, তথ্য-উৎসের অপরিবর্তনীয় রুপ ও পর্যবেক্ষণমূলক নিয়ন্ত্রণের অভাব ভাষায় কোনরূপ বিকাশ বা উন্নয়ন প্রায় অসম্ভব করে তুলল।
ইবনে খালদুনের আলোচনার দ্বিতীয় প্রণিধানযোগ্য উপাদান হল, ভাষার বিকৃতি ও ভাষাবিদ্যার অন্তর্নিহিত শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠার মধ্যকার যোগসূত্র। প্রথম অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে, ব্যাখ্যাদানকারী মন্তব্য ও টিকা-টিপ্পনিসমূহ আরব বিশ্বে ভাষা শিক্ষার সর্বপ্রথম নজির সৃষ্টি করে। পন্ডিতেরা পবিত্র গ্রন্থের আয়াতসমূহ ও এর কোন কোন জায়গার অপ্রচলিত শব্দসমূহকে তরজমা করতে শুরু করে দেন। অন্যদিকে, যেরকম আমরা দেখেছি ভূমিকায়, ব্যাকরণগত ঐতিহ্যের আদি ও অকৃত্রিম বর্ণনাগুলো পূর্ণ থাকে ইসলামের প্রথম যুগে আরব-বহির্ভূত ধর্মান্তরিতদের মৌখিক ভাষায় বিদ্যমান ভুলের পৌনঃপুনিকতা দিয়ে। এর মধ্যে সব থেকে জনপ্রিয় বর্ণনা আমরা পাই ‘আবু ওয়ান-আসওয়াদ আড-ডুয়ালি’র (মৃত্যু ৬৮৮) থেকে, যাকে আমরা উপরে উদ্ধৃত করেছি। যদি আমরা ইবনে খালদুনে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের সাথে এবং ইসলামের প্রথম শতাব্দিতে সদ্য ধর্মান্তরিতদের মুখে মুখে জন্ম নেয়া ব্যাকরণগত ত্রুটি সম্পর্কিত উপাখ্যানগুলির সাথে আবু ওয়ান আসওয়াদ সম্পর্কিত গল্পকে যুক্ত করি, এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, প্রথম দিককার ইসলামী সমাজে কিছু মানুষ মৌখিক ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে তীব্রভাবে সচেতন ছিল এবং এর ফলশ্রুতিতে, বিকৃতির বিরুদ্ধে ভাষার প্রতিরক্ষা ছিল একটি সাঙ্ঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুদ্ধিজীবিদের আলোচনায়। কিন্তু খুব শীঘ্রই ভাষাগত-বিদ্যার কেন্দ্রবিন্দুটি ‘নিরক্ষরতা তথা বিকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম’ থেকে স্থানান্তরিত হল ‘আরবী ভাষার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো প্রণয়ন সংক্রান্ত আগ্রহে’র দিকে যেখানে ভাষার বিচ্যুতিকে নিয়ে আর ভাবা হচ্ছিল না। আর সেজন্যই ব্যাকরণবিদদের ব্যাখ্যামূলক অভিসন্দর্ভগুলোতে ভাষার বিচ্যুতি বা গলদের অনুপস্থিতি আমাদের বিষ্ময় জাগায় না। যেহেতু টিকাদানকারী ও ভাষ্যকারেরা পবিত্র গ্রন্থের কালামগুলির ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন নিজেদের শ্রম ও সময়, ভাষার গঠনকাঠামো নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি তাদের। যখন প্রথম ব্যাকরণগত অভিসন্দর্ভটি রচিত হয়েছিল, দ্বৈতভাষার পরিস্থিতিটা আরবের বাচিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ততদিনে দানা বেঁধে গিয়েছিল, এবং প্রচলিত কথ্যরূপটি আর প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হচ্ছিল না। সে সময়ই প্রথম আবু আসওয়াদের মত মানুষের প্রচেষ্টার কারণে (যদিও তার একক উদ্যোগেই সবটা হয়েছে এমনটা নয়) একটি স্কুল প্রথার উদ্ভব ঘটে, যেখানে অভিজাত সম্প্রদায়ের সন্তানেরা পড়াশুনোর সুযোগ লাভ করে। সাধারণ মুসলিমরা এর আগে কোরানের কালামসমূহের তেলোয়াত শুনতে পেত বটে, কিন্তু ধ্রুপদি ভাষায় কথা কথা বলার নিয়ম বা অধিকার ছিল না। বিদ্যালয় প্রথার উদ্ভব হতেই, এটা আরবী ভাষার প্রতি হুমকিস্বরূপ যে বিপদগুলোর জন্ম হয়েছিল, সেগুলোকে নিয়ে কাজ করতে শুরু করল। ‘বিশুদ্ধ/সঠিক ভাষা’(আল-লুঘা আল-ফু হা) হিসেবে পরিচিত ভাষার উত্তম সংস্করণে সমাজের অভিজাত ও গুরুত্বপূর্ণ লোকেরা যেন প্রশিক্ষন লাভ করতে পারে, স্কুলগুলো অচিরেই তা নিশ্চিত করল।
যখন ধ্রুপদি ভাষার বিঘ্নহীন প্রবাহ নিশিচত করা হল, ভাষায় পরিবর্তনের উল্লেখ অতীব দুর্লভ হয়ে পড়ল। ব্যাকরণবিদগণেরা শুধুমাত্র যে তাড়াহুড়ো করেছিলেন তাদের পাঠকদের সতর্ক করতে ভাষার স্থায়ী ধরণে কোনপ্রকার পরিবর্তন না করার ব্যাপারে, তা নয়; তারা এমনকি মৌখিক ভাষার বিদ্যমান স্তরগুলিতে বিবর্তনজনিত ব্যাখ্যাকে সুস্পষ্টভাবে বাতিল করে দিয়েছিলেন। ভাষাবিদ্যাগত যুক্তি উপস্থাপনের সময় ভাষার এই ক্রমবিকাশের ধারণাটা, উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ধ্বনিগত চক্রের কথা, তাদের দ্বারা এক প্রকার অপহৃতই হয়েছিল। অথচ আমরা উপরে দেখেছি (অধ্যায় পাঁচ) যে, বিভিন্ন স্তরে ভাষাগত ব্যাখ্যা প্রদান করা যেতে পারে। যেমন, আয-যাযাযি সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যাখ্যা হিসেবে তাকেই দেখছেন, যেখানে বাহ্যিক কারণগুলো নিয়ে আসা হয় ব্যাকরনীয় যুক্তিসমহূকে বৈধতা দিতে। কাওয়ামা শব্দটির ক্ষেত্রে আইনটি প্রয়োগ করা হয় বাহ্যিক একটি নীতির উপর ভর করে। ব্যাকরণবিদদের দ্বারা এই নীতিটি প্রণীত হয় ভারী সব ধ্বনির সংযুক্তিকে এড়িয়ে চলা সংক্রান্ত বক্তার একটি প্রবণতার সাপেক্ষে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে গ্লাইড ডব্লু বর্ণটির কথা। এর সাথে দুটি ভাওয়েল বা স্বরবর্ণের সংযুক্তি বক্তার জন্য খুব বেশি ভারী, সেজন্য ব্যাকরণবিদেরা এই যুক্ত অক্ষরকে পরিবর্তন করেছেন এ’’তে। এমন একটি কাজকে অবশ্য খুব সহজেই বিশ্লেষণ করা যেতে পারে ভাষার ক্রমবিকাশ বা বিবর্তনের ধারায়ঃ সময়ের বিবর্তনে বক্তারা কিছু শ্রুতিমধুর নীতির প্রয়োগ করেছেন এবং এভাবে একে ধীরে ধীরে পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু ইবনে জিন্নির (মৃত্য ১০০২) অভিমত আবার অন্যরকম। তিনি মনে করেন, ব্যাকরণবিদরা যখন বলেন যে, ক্রিয়ারূপ কা’মা এসেছে কাওয়ামা হতে, তখন এটা নির্দেশ করে না যে, মানুষ কখনো না কখনো কাওয়ামা শব্দটা ব্যবহার করেছে। ব্যাকরণবিদরা বস্তুত কোন ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া বর্ণনা করেন না; বরং, তারা একটি সুবিন্যস্ত নিয়ম বর্ননা করেন যার মাধ্যমে ধ্বনির বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামোটি কার্যকর হয় নিজস্বর অবস্থানগত বাস্তবতার মধ্য দিয়ে।
কা’মা‘ বা ‘উঠে দাঁড়াও’ এর বিদ্যমান রূপ হল ‘কাওয়ামা’। ইহা কিছু মানুষকে এই ধরণের রূপগুলির প্রতি বিশ্বাসের দিকে চালিত করেছে, যেখানে অন্তর্নিহিত অর্থগুলো বাহ্যিক বা উপরিকাঠামোর অর্থগুলোর সমানুরূপ নয়। তবে কোন এক সময়ে এরকম ছিল হয়ত, কারণ মানুষ কখনো কখনো কামা জায়েদুন এর পরিবর্তে কাওয়ামা জেদুন বলত। পক্ষান্তরে ঘটনাটা হয়ত এরূপ এরকমক নয়। বস্তুত এই শব্দগুলোর সর্বদাই একটি রূপ ছিল যা তুমি এখন দেখতে ও শুনতে পাও।
(ইবনে জিন্নি, খা এ আই, এডিশান, মুহাম্মদ আলী আন-নাজ্জার, ৩য় ভ্লিউম, কায়রো-১৯৫২-৬, আই, পৃষ্ঠা ২৫৭)
অন্যান্য ব্যাকরণবিদেরাও সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করেন যে ভাষার উপাদানগুলোর মধ্যকার আনুক্রমিক সম্পর্কের যে বিবরণ তারা দিয়ে থাকেন তা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে বিবর্তনের ধারায়। আয যাযযাযি, উদাহরণস্বরূপ, ব্যাখ্যা করেন যে, বিশেষ্যগুলো ক্রিয়াপদের পূর্বে বসে। কিন্তু তিনি যোগ করেন,
"এর সাথে তাল মিলিয়ে, আমরা আরো বলতে পারি যে, বিশেষ্য ক্রিয়াপদের পূর্বে বসে, কারণ ক্রিয়াপদ বিশেষ্যের কারনিক ঘটনা। কিন্তু ইহা কখনই সত্য হয়নি যে, কোন সময়ের জন্য বিশেষ্য দিয়ে শুধুমাত্র একটি ভাষা প্রচলিত ছিল, এবং এরপর জনগন ক্রিয়াপদও ব্যবহার করতে শুরু করেছিল তাদের কথোপকথনে। পক্ষান্তরে, মানুষ সর্বদাই ব্যবহার করত তাদের দুইটা রূপকে একত্রে, এবং এদের প্রত্যেকের আছে নিজস্ব অধিকার ও অবস্থান।" (আজ-জাজ্জাজি, আই, আহ, এডিশান, মাজিন আল-মুবারক, কায়রো, ১৯৫৯, পৃ ৬৮)
ধ্বনিগত নিয়মের এই ঐতিহাসিক/এহিস্টরিকাল চরিত্র ও ভাষার রূপগুলোর মধ্যকার সম্পর্কের উপর এই জোরদান আসলে আরবী ভাষার স্থায়িত্ব ও বহমানতাকে নির্দেশ করতে বড় ভূমিকা পালন করে। পশ্চিমা ভাষাবিদ্যায় উনবিংশ শতাব্দি থেকেই একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সর্বদা বিদ্যমান যেখানে ভাষাবিদ্যাগুলোর ইতিহাস-আশ্রয়ী তুলনার উপর জোর দেয়া হয়। কিন্তু এমনকি এর বহু পূর্বেই, ল্যাটিন ও আঞ্চলিক ভাষার সম্পর্ক বিষয়ক সচেতনতা খুব স্বাভাবিকভাবেই ভাষার প্রবৃদ্ধি ও বিকাশের একটি দর্শনের দিকে আমাদের চালিত করেছে যেখানে ভাষার পরিবর্তন একটি প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
এরই পথ ধরে একটা সময়, আরবীভাষী সম্প্রদায়ের মধ্যে কারো পক্ষে প্রকৃত বাকপ্রণালীর সাথে কোরানের ভাষা বা বেদুইনদের অনুমিত ভাষার প্রমিত পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন না হয়ে আর উপায় থাকল না। তবে এই ঘটনাটা তারপরেও কিন্তু উভয় ভাষার সম্পর্ককে একটি উন্নয়নমূলক দিগদর্শনের দিকে চালিত করল না। ভাষা, যেমনটা ইবনে খালদুন বলেছেন, হল একটি অভ্যেস যা সঞ্চারিত হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কোন পরিবর্তন ছাড়াই। যেহেতু সঞ্চরণ প্রক্রিয়াটি নির্বিঘ্নে চলতে পেরেছে জাহিলিয়ার সময় থেকে খালদুনের সময় পর্যন্ত, এবং যেহেতু স্থানীয় কথকেরা কখনোই ভুল করতে পারত না এই দর্শন অনুযায়ী, ভাষার সঠিকতা একদম নিশ্চিত ধরা হয়েছিল এবং পরিবর্তনের জন্য কোন জায়গাই আর অবশিষ্ট ছিল না। ব্যাকরণবিদদের ব্যাপারে বলা যেতে পারে যে, ব্যাকরণীয় আইনকানুন আরোপ করার পরিবর্তে তাদের করনীয় নির্ধারিত হয়েছিল এই অপরিবর্তনশীল ভাষার নিয়মগুলোকে ব্যাখ্যা করা। সর্বোপরি, তারা পরিচালিত হত এই ধারণার উপর ভিত্তি করে যে, স্থানীয় ভাষাভাষীরা নিখুঁত আরবী বলতে পারে, এবং তাদের কোন বৈয়াকরণ প্রয়োজন নেই ভাষাবিদ্যাগত শুদ্ধ-অসুদ্ধ দেখিয়ে দিতে।
ব্যাকরণের উন্নয়নে ইবনে খালদুনের বিবরণ কেন্দ্রীভূত থাকে ভাষাবিদ্যগত নিয়ম ও মানদ্বন্ড প্রতিষ্ঠায় ব্যাকরণের ব্যবহারকে নিয়ে। এবং এই এহেন বিবরণকে সাংঘর্ষিক মনে হতে পারে উপরে উল্লিখিত ব্যাকরণের মান-নিরেপেক্ষ চরিত্র সম্পর্কিত খালদুনেরই আরেকটি অভিমতের সাথে। এই ভাষ্য অনুযায়ী, ব্যাকরণ আবিষ্কৃত হয়েছিল এক ঝাঁক নতুন নিয়মকানুন হিসেবে, যাদের কাজ ছিল শুধুমাত্র অশুদ্ধ ভাষার সাথে লড়াই করা। আমাদের অবশ্য মনে রাখা প্রয়োজন যে, ইবনে খালদুন কোন ব্যাকরণবিদ ছিলেন না, বরং তিনি, ভাষাবিদ্যার পদ্ধতিগত অনুমানের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী ছিলেন সংস্কৃতির সাধারণ বিকাশে। তার অবশ্যই সুস্পষ্ট ধারণা থাকার কথা যে, ব্যাকরণবিদদের মাননিরেপেক্ষ নীরবতা পুরো সমাজের জন্য প্রযোজ্য নয়, স্থানীয় কথকের আদর্শিক গঠনকাঠামোয় শুধু তা প্রাসঙ্গিক। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সংস্কৃতির সব স্তরেই এক প্রকার সাধারণ অবনমন ঘটছিল এবং ভাষার ব্যাপারটা কোন ব্যতিক্রম ছিল না। খালদুনের বিশ্বাস ছিল, স্থানীয় কথকদের ব্যাক্তি পর্যায়ে বিশ্বাস করা চলে না। আর তাই কালামের লিখিত রূপের স্বাক্ষ্যকে চুড়ান্ত নির্দেশক হিসেবে ব্যবহার করা অধিকতর নিরাপদ মনে হল তার। পাশাপাশি তার যুগে, এবং বিশেষ করে তার বিশ্বে যে স্থানটিতে তিনি বিচরন করেছেন, অর্থাৎ, উত্তর আফ্রিকায় খুব কম বেদুইন উপজাতি পাওয়া যেত, যাদেরকে কোন না কোন মানদ্বন্ডে ধ্রপদি ভাষার স্থানীয় বক্তা হিসেবে বিবেচনা করা যেত। এই কারণে ব্যাকরণের একটি মান-সক্রিয় ধারা অবশ্যই অস্তিত্বশীল ছিল যা অত্র এলাকাটিতে ব্যবহৃত হত। কেউ কেউ তো এমনো জল্পনা করেছিল যে, প্রমিত ভাষার সাথে কথ্যভাষার অসঙ্গতি এমনকি অধিক তীব্র ছিল আরবভাষী বিশ্বের মাঘরেবাইন অঞ্চলের অতিশয় খেয়ালী উপভাষার কারণে।
ভাষার বিকাশে ইবনে খালদুনের বৈচিত্র্য সম্পর্কিত চিন্তা তার লেখা থেকেও টের পাওয়া যায়। মুকাদ্দিমায় তিনি মত প্রকাশ করেছেন যে, শব্দভান্ডারে সর্বদাই আঞ্চলিক ভিন্নতা বিরাজ করে। দৈনন্দিন জীবনে এমনকি খুব চেনা পরিচিত বস্তু, উধাহরণস্বরূপ, রুটি, রান্নাঘরের পাত্র ইত্যাদি নির্দেশ করতে ভিন্ন ভিন্ন এলাকার মানুষ ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করে। এটা অভিমত একান্তই একজন ভাষাবিদ্যার সাথে সংশ্লিষ্টতাহীন ব্যাক্তির যে কিনা সাধারণত আগ্রহী মানব সংস্কৃতির বৈচিত্র্য নিয়ে। একইরূপ অভিমত প্রকাশ করেছে আরব ভৌগোলিকগণেরাও, যারা তাদের ভ্রমণ থেকে তুলে এনেছেন ইসলামিক সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা মানুষের বিভিন্ন চলমান প্রথার বিবরণ যার মধ্যে ভাষাবিদ্যার কথাও ছিল। ব্যাকরণবিদেরা কিন্তু এই ঘটনাটার কোন ব্যাখ্যা প্রদান করে না। এমনকি আরো আশ্চর্যের হল, তাদের অধিকাংশই ঘটনাটার উল্লেখ পর্যন্ত করে না। কেউ হয়ত আশা করবে যে, অন্ততপক্ষে অভিধানপ্রনেতারা আঞ্চলিক বৈচিত্র্য ও প্রকারভেদের উপর কিছুটা মনোযোগ দেবেন। কিন্তু তারাও আঁকড়ে রইলেন স্বীকৃতি পাওয়া শব্দভান্ডারকে নিয়েই, যা তাদের উৎসগুলিতে মিলে যেত। এটা সত্য যে, ইসলাম পূর্ববর্তী যুগে ভাষার রূপবৈচিত্র্যের সন্ধান মিলত বেদুইন উপজাতিগুলো থেকে। কিন্তু এই রূপগুলো স্বীকৃত হয়েছে স্বতন্ত্র সংস্করণ হিসেবে এবং বলতে কী, সরকারীভাবে নথিভূক্ত করা হয়েছে ভাষার নিবিড় দেহের অংশবিশেষ হিসেবে। ব্যাকরণবিদেরা কেবলমাত্র এটুকু উল্লেখ করেছিল যে, আরব উপজাতিগুলো আরব উপদ্বীপের মরুভূমিতে ঘুরে বেরিয়েছে, আর এ কারণেই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন রূপ ব্যবহার করতে শিখেছে। যেহেতু সকল বেদুইন বিবেচিত হত স্থানীয় কথক হিসেবে, সেহেতু সব ক’টি সংস্করণই ছিল নীতিগতভাবে গ্রহণযোগ্য, যদিও বেদুইনরা আর উৎপাদনশীল ছিল না। এর মানে হল, তাদের কথাবার্তায় ভাষাগত প্রত্যাশার উপর নির্ভর করার অনুমতি ছিল না । অন্য ভাষায়, বৈচিত্র্য বা রকমভেদ সেখানে অস্তিত্বশীল ছিল প্রথম থেকেই এবং যেহেতু এই ভাষাটির মধ্যে বিপুল পরিমাণ সমার্থ ও ভিন্নার্থকবোধক শব্দের উপস্থিতি ছিল, একে আরবী ভাষার গুনাবলির একটা অংশ হিসেবে গ্রহণ করা দরকার ছিল। অন্যদিকে, অভিধানে থাকা সমসাময়িক আঞ্চলিক ভ্যারিয়েন্ট এমন কোন প্রাসঙ্গিক সমস্য হিসেবে বিবেচিত হয়নি, ব্যাকরণবিদদের যার ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন পড়ত।
কিছু ক্ষেত্রে স্বীকৃত প্রমিত ভাষাটি ইসলাম পূর্ববর্তী বিভিন্ন উপভাষা থেকে নিয়ে একটি মিশ্র সংস্করণ নিজের ভেতর ধারণ করত। এই প্রক্রিয়াটিকে ব্যাকরণবিদরা নাম দিয়েছিলেন ‘তাদাখুল আল-লুঘাত’ বা, ‘উপভাষাগত রূপের আন্তঃঅনুপ্রবেশ’। একটি উদাহরণ হিসেবে ক্রিয়াপদ হাসিবাকে উদ্ধৃত করতে পারি যার ত্রুটি বলতে বোঝাত অনিয়মিত প্রায়োগিকতাঃ যেমন, এ-আই-এ ধরণের স্বরবর্ণে গঠিত ক্রিয়াপদের জন্য প্রত্যাশা অনুযায়ী ইয়াহসাবু হওয়ার কথা, কিন্তু তার পরিবর্তে প্রয়োগ হতে লাগল ইয়াহসিবু। এই ধরণের ঘটনাকে কেউ কেউ হয়ত ভাষার বিবর্তন সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যাকে উস্কে দেয়া হিসেবে দেখবেঃ যেমন, একটি উপজাতি বা গোত্র ব্যবহার করছে ক্রিয়াপদ হাসিবা/ইয়াহসাবু, অন্য একটি গোত্রে তা হয়ে যাচ্ছে হাসাবা/ইয়াহসিবু, এবং পরবর্তীতে মানুষ ব্যবহার করতে শুরু করে একটি গোত্রের নিখুত রূপ, ও অন্য একটি গোত্রের ত্রুটিপূর্ণ রূপ। তথাপি এই রকমের বিশ্লেষণ , যাকে আমরা হয়ত ভাষার বিবর্তন বলার লোভ সামলাতে নাও পারি, তা-ই ব্যাকরণবিদদের জন্য ছিল একটি সুসংগত বা সিনক্রোনিক ব্যাপার। ভাষার সবগুলি রূপ আরাবীয়ার সাধারণ শব্দভান্ডারের সাথে যুক্ত ছিল বলে বক্তা পুরো স্বাধীন ছিল ভাষার ইচ্ছামাফিক রূপ বেছে নিতে। এখানে যে ঘটনাটি উদ্ধৃত হয়েছে, সে ধরণের ক্ষেত্রে কথকেরা প্রথাগতভাবে পছন্দ করত অসংগত বা হীন রূপটিই।
ভাষার অন্য একটি আপাত প্রতীয়মান বিবর্তনীয় রূপ শব্দভান্ডারের পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রভাবের সাথে সংযুক্ত। সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ এই ক্ষেত্রে অবশ্য ইসলামের আবির্ভাব। নতুন ধর্মের বার্তার সাথে সাথে ইসলাম-পূর্ববর্তী সমাজে এক ঝাঁক নতুন জাতি প্রবেশ করে। বেদুইনরা প্রচলিত শব্দগুলোকে একটি নতুন ও ধর্মীয় ধ্যান-ধারণায় উচ্চারণ করতে শুরু করে । একটি উদাহরণ হিসেবে আমরা উদ্ধৃত করতে পারি খোদ ‘ইসলাম’ শব্দটিকেই, যার অর্থ ‘সারেন্ডার’ বা,’আত্মসমর্পণ’, কিন্তু নতুন প্রেক্ষাপটে এই শব্দটি বোঝাতে লাগল স্রষ্টার নিকট আত্মসমর্পনকে, এবং আর এভাবে নতুন ধর্মটিকেই নির্দেশ করল অর্থটা। এক অর্থে, নতুন ধরণটি ইতিমধ্যেই গুপ্ত ছিল লুকিয়ে শব্দটার মধ্যে; কেউ বলতেই পারত যে কোন সত্যিকারের পরিবর্তন ছিল না এমনকি এক্ষেত্রে। সর্বোপরি, সৃষ্টিশীলতা সব সময়ই একটি বৈশিষ্ট্য ছিল সত্যিকারের বাকপটু আরবভাষীদের, মানে, বেদুইনদের। আল ফারাবির (অধ্যায় ৬ দ্রষ্টব্য) মত থেকে সরে গিয়ে ইবনে খালদুন ধর্মীয় শব্দভান্ডারের নতুন অর্থবোধকে আরবী ভাষার অন্তর্নিহিত উন্নয়ন হিসেবে দেখেছেন ও মর্যাদা দিয়েছেন।
এই অধ্যায়ে একটি শেষ কথা অবশ্যই বলা দরকার। কথাটা উঠে আরব ব্যাকরণবিদদের বিবর্তনশূন্য পরিকাঠামোয় আরবী ও অন্যান্য ভাষার সম্পর্ক নিয়ে। অধ্যায় আটে আমরা দেখেছি যে ইসলামিক সমাজ পূর্নাংগ ভাষাকে বিবেচনা করেছে এমন কিছু হিসেবে যা প্রদত্ত হয়েছে বা নিদেনপক্ষে অনুপ্রাণিত হয়েছে ঈশ্বরকে দ্বারা, যে কিনা পছন্দ করেছেন আরবী ভাষাকে তার প্রত্যাদেশের জন্য এবং এর মাধ্যমে পরিষ্কার করেছেন যে আরবী ভাষা অন্য সকল ভাষা থেকে শ্রেষ্ঠত্বর, শ্রেয়তর। আরব ব্যাকরণবিদেরা জানত অবশ্যই যে, কিছু ভাষা একে অন্যের প্রতিধ্বনি করে অন্য আরো কিছু ভাষার চেয়ে; কিন্তু যেহেতু তারা আগ্রহী ছিলেন না কোন উন্নয়ন ব্যাখ্যায়, ভাষাগুলোর মধ্যকার সম্পর্ককে দেখা হয়েছে ধ্রুবক বা কিছুটা স্থিতিশীল হিসেবে। হিব্রু ব্যাকরণবিদদের থেকে ভিন্ন পথে (দ্রষ্টব্য অধ্যায় ১৩) যাওয়ার কারণে, তারা আগ্রহী ছিলেন এই সম্পর্কের কারণ খোঁজায়। পৃথিবীতে মানবজাতির বন্টনের প্রমিত ধারণা অনুযায়ী, মানুষ মহাপ্লাবনের পর বিভক্ত হয়ে পড়েছিল বিভিন্ন দলে, এবং এর প্রত্যেকটি দল আয়ত্ত করেছিল নিজস্ব ভাষা, যাকে ইবনে খালদুন নিজস্ব অভ্যেস বলে অভিহিত করেন। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক কারণেই, যত বেশী সরাসরি সম্পর্কিত ছিল এই দলগুলো, তাদের ভাষা তত বেশি সম্পর্কযুক্ত ও কাছাকাছি ছিল। বিশ্বজনীন একটি কাঠামোর বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ভাষাকে, বিশেষতঃ গ্রীক ও সিরিয়াক, অধ্যায়নের জন্য যুক্তিবিদদের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবেসিত হয়েছিল (উপরে অধ্যায় চার দ্রষ্টব্য)। ফলশ্রুতিতে, আমরা ব্যাকরণবিদদের অভিসন্দর্ভে কদাচিত অন্যান্য ভাষার উল্লেখ দেখতে পাই। একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম অবশ্য রয়েছে, যা আবু হায়ান (মৃত্যু ১৩৪৪) কর্তৃক সামনে এসেছে। যেমন আমরা দেখতে পাব ত্রয়োদশ অধ্যায়ে, হায়ান তার প্রথা ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন, আর অন্য ভাষাগুলোর অধ্যায়ন শুরু করেছিলেন, যেমনঃ তার্কিক, বারবার, ইথিওপিয়ান, এবং মঙ্গোলিয়ান। হায়ানের এই অধ্যায়ন সঙ্ঘটিত হয়েছিল আরবী ব্যাকরণের মডেল অনুসরণ করে বা সাহায্য নিয়ে। কিন্তু তিনি ছিলেন একটি ব্যতিক্রম। অধিকাংশ ব্যাকরণবিদদের কাছে, অন্য কোন ভাষার যেন কোন অস্তিত্বই ছিল ছিল না!
ইবনে খালদুন কোন ব্যাকরণবিদ ছিলেন না। সত্য হল, মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে তার আগ্রহের কারণে, তিনি একটি মুক্ত মত গ্রহণ করতে পেরেছিলেন ভাষার ঘটনাপ্রবাহের উপর এবং অনুসন্ধান করতে পেরেছিলেন সমাজে এর ভূমিকা নিয়ে। পেশাদার ব্যাকরণবিদদের থেকে ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করে, তিনি বিবেচনায় নিয়েছিলেন প্রকৃত ভাষাগত পরিস্থিতি। যদিও তিনি পুরোপুরি বেরিয়ে আসেননি একটি মাত্র আদর্শিক ভাষার অস্তিত্বের রূপকথা থেকে, তার লেখা প্রমাণ করে যে, তিনি খুব ভাল করেই সচেতন ছিলেন ভাষার দুইটি রূপ, অর্থাৎ, ধ্রুপদি ও কথ্য - তাদের মধ্যে বিরাজমান অস্থিরতার বিষয়ে ।
লেখক পরিচিতিঃ
‘’আরবী ভাষার ইতিহাসে ইবনে খালদুনের ভূমিকা’’ প্রবন্ধটি ‘হিস্টরি অফ লিংগুয়িস্টিক থট’ সিরিজের ‘ল্যান্ডমার্কস ইন লিঙ্গুস্টিক থট – থ্রিঃ দ্য এরাবিক লিংগুয়িস্টিক ট্র্যাডিশান’ শীর্ষক বইয়ের দ্বাদশ অধ্যায় থেকে অনুদিত হয়েছে। বইটির প্রকাশকালে এর লেখক কিস ভার্সটিগ নেদারল্যান্ডের ‘নিজমেগেন’ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউটে ‘আরব জাতি ও ইসলাম’ – এই বিষয়ের উপর অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন। এই ডাচ ভাষাতত্ত্ববিদের জন্ম ১৯৪৭ সনে। নিজমেগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ভার্সটিগ ১৯৭৭ সালে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন আরবী ভাষার উপর গ্রীক প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে। পরবর্তীতে তিনি মিশরের কায়রোতে অবস্থিত নেদারল্যান্ড ইন্সটিউটে ‘মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজ’ বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর নিজ বিশ্ববিদ্যালয় নিজমেগেনে ২০১১ সাল পর্যন্ত কর্মরত থেকে প্রফেসর ইমেরিটাস হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।