সত্যজিৎ রায় প্রথম সঙ্গীত পরিচালনার ভার নিজের হাতে নিয়েছিলেন ১৯৬১ সালে, 'তিনকন্যা' ছবির সময়ে। 'গুপি গাইন বাঘা বাইন' বেরোল ১৯৬৮ সালে। সত্যজিৎ ততদিনে সঙ্গীত তৈরির ব্যাপারে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস পেয়ে গেছেন, পরিণত হয়েছেন। যদিও ছবির প্রয়োজনে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তৈরি করা এক জিনিষ, বা তৈরি-গান অ্যারেঞ্জ করে ও যন্ত্রানুষঙ্গে বেঁধে প্রয়োগ করা এক জিনিষ আর স্রেফ গানের জন্যে গান তৈরি আরেক ব্যাপার। গুপি গাইনের আগে সত্যজিতের আস্ত গান রচনার অভিজ্ঞতা দুটো। প্রথম, 'তিনকন্যা'রও আগে 'দেবী' ছবিতে। আর অন্যটা গুপি-গাইনের ঠিক আগের ছবি 'চিড়িয়াখানা'র জন্যে। দেবীর ছবিতে কথা ও যন্ত্রানুষঙ্গ সত্যজিতের হলেও সুর ছিল প্রচলিত রামপ্রসাদী। চিড়িয়াখানার গান অবশ্য পুরোটাই নিজের, যদিও সিচুয়েশন-নির্ভর, কাজেই কিছু বাঁধাবাঁধি ছিল। গুপি-বাঘার ক্ষেত্রে সিচুয়েশনের চাহিদা থাকলেও, সত্যজিৎ জানিয়েছেন যে তার গান রচনাটা কতটা উৎরোবে সেই বিষয়ে সন্দেহ থাকার কারণে তিনি চিত্রনাট্য তৈরির আগেই গোটাকয়েক গান তৈরি করে ফেলেছিলেন। যখন দেখা গেল যে গানগুলো ভালই উৎরেছে, তখন তিনি চিত্রনাট্য রচনায় হাত দেন এবং তৈরি গানগুলো ব্যবহারের সিচুয়েশন সৃষ্টি করেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে "ছবির প্রয়োজনে গান" - এই নীতির বদলে "গানের জন্যে ছবি" এমন কাজ সত্যজিৎ করলেন। ব্যাপারটা হয়তো এমন বিচ্ছিন্ন ছিলনা। স্রষ্টা যখন একজনই তখন ঠিক কোথায় গানের কাজ শেষ হয়ে চিত্রনাট্যের কাজ শুরু হয়েছে তা বলা শক্ত। হয়তো গান তৈরির সময়েই তাঁর মোটামুটি ধারণা ছিল যে কী ধরণের পরিস্থিতিতে গানটা লাগান হবে। (সত্যজিৎ এও জানিয়েছেন যে, এর বিপ্রতীপে, অন্য ছবির সঙ্গীতের কাজ শুরু হয় অন্যান্য কাজ - বিশেষতঃ সম্পাদনা - শেষ হয়ে যাবার পরে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও চিত্রনাট্য লেখার সময়েই অনেক সময়ে কোন বিশেষ সিচুয়েশনের জন্যে কিছু সঙ্গীতচিন্তা তাঁর মাথায় এলে, তিনি তা লিখে রাখতেন। পরে সঙ্গীতের কাজ করার সময়ে সেই প্রাথমিক ভাবনাকে হয়ে-ওঠা-ছবির পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করে গ্রহণ বা বর্জন করা হত।)
গুগাবাবা ছবির টাইটেল মিউজিককে ছবিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন গানের সুরের একটা কোলাজ বা মিউজিকাল মন্তাজ বলা যেতে পারে। সাঙ্গীতিক ছবি, যাকে হলিউডি ভাষায় মিউজিকালস বলে, তার ক্ষেত্রে এরকম টাইটেল মিজিকের ব্যবহার প্রচলিত একটি রীতি, বিশেষতঃ পাশ্চাত্য ছবির ক্ষেত্রে। হিন্দুস্থানী ধ্রুপদী সঙ্গীতে "রাগমালা" ধরণের গায়নের প্রচলন থাকলেও, বিভিন্ন তাল-লয়-সুর সমন্বিত একাধিক মিউজিকাল প্যাসেজকে এক নিরবচ্ছিন্ন ও সম্পূর্ণ মিউজিকাল কম্পোজিশনে পরিণত করা মূলতঃ পাশ্চাত্য সঙ্গীতের রীতি। সত্যজিৎ নিজে পাশ্চত্য অপেরার রসগ্রাহী ছিলেন বলে অনুমান করা যেতে পারে অপেরার ওভারচার থেকেও অনুপ্রাণিত হয়ে গুগাবাবার নাম-সঙ্গীতকে একটি পত্রপুষ্পপ্ললবিত মিউজিকাল কম্পোজিশন হিসেবে ভাবতে চেয়েছিলেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রে সত্যজিতের আগে কেউ, বিশেষ করে হিন্দি ছবিতে, এই ডিভাইস ব্যবহার করেন নি একথা হলফ করে বলা যায় না। তা হলেও এই কাজ সত্যজিতের সৃষ্টির নিরিখেও ব্যতিক্রমী। এ বলার আর একটা কারণ হল, সত্যজিতের অন্যান্য ছবির টাইটেল মিউজিক সুগঠিত ও সুপ্রযুক্ত হলেও খাঁটি সঙ্গীত হিসেবে সেগুলোর আবেদন সীমিত। গুগাবাবা ছাড়া আর একটি ব্যতিক্রম হবে খুব সম্ভবত চারুলতার টাইটেল মিউজিক। গুগাবাবার ক্ষেত্রে এই কাজে মুন্সিয়ানার পরিচয় যে আরও গভীর তা অনুধাবন করা যায় গুগাবাবার বিভিন্ন গানের ধরণ বিশ্লেষণ করলে। রাগপ্রধানের আদলে, বাংলা লোকসঙ্গীতের আদলে, বিলিতি মার্চিং গানের আদলে তৈরি গান তিনি গুগাবাবায় ব্যবহার করেছেন, আর সেই সব সুরকে যন্ত্রে বিন্যস্ত করে একটি সাঙ্গীতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ মিউজিক বানানো সহজ কাজ নয়। আড়াই মিনিটের কিছু বেশি সময়ের এই মিউজিকাল পিসটি ভারতীয় ছবির টাইটেল মিউজিক হিসেবে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হওয়া উচিত।
এরপরে আসে ভূতের নাচের সঙ্গে শুধু চারধরণের তালবাদ্য দিয়ে বানানো সঙ্গীত। সময়ের হিসেবে পূর্ণমাপের এই গানে মৃদঙ্গম, ঘটম, মুরসিং ও খঞ্জিরা ব্যবহার করা হয়েছে। লক্ষ্যণীয় যে, এই তালবাদ্যের একটিও হিন্দুস্থানী রাগসঙ্গীত বা উত্তর-পূর্ব-পশ্চিম ভারতের কোনো তালবাদ্য নয়। এর প্রেক্ষিত সত্যজিতের একটা সাক্ষাৎকার থেকে তুলে দিচ্ছি - "...যখন দিল্লিতে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হয়, তখন ডেলিগেটদের জন্য একটা পারফর্ম্যান্স দিয়েছিল - কর্ণাটিক, সাউথ ইন্ডিয়ান পারকাশান ইনস্ট্রুমেন্ট 'তালবাদ্যাকাচেরি' বলে একে - চার রকম পারকাশান - মৃদঙ্গ, ঘট্টম মানে হাঁড়ি, খঞ্জিরা আর মুড়শৃং, মানে একটা ছোট যন্ত্র মেঁয়াও-মেঁয়াও ক'রে বাজে। এই চারটে নিয়ে অসাধারণ একটা জিনিশ ওরা করে, যেটা পৃথিবীর কোনো মিউজিকে আছে ব'লে আমার মনে হয় না - একেবারে ইউনিক। শুধু পারকাশান নিয়ে গান ছাড়া এ-রকম কোয়ার্টেট আর নেই। তখন আমি ভাবলাম, এই চারটে শ্রেণীর ভূতকে এই চারটে যন্ত্রের সঙ্গে যদি আইডেন্টিফাই করা যায়। মৃদঙ্গ হল রাজার, যেহেতু মৃদঙ্গটা রীয়্যালি ক্লাসিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট। তাই নাচের ফর্মটা একেবারে ক্ল্যাসিক্যাল রাখা হ'লো। খঞ্জিরা হল চাষাভুষোর - একেবারে চাষাভুষো এবং তাদের একটু সেমি-ফোক ধরণের করা হ'লো। সাহেবদের জন্য ঘট্টম রাখা হ'লো, একটু কটকটে আওয়াজ - একটু রিজিড আওয়াজ। ... আর মোটাদের জন্য ঐ মুড়শৃং রাখা হ'লো যেটা একটা ফোক ইনস্ট্রুমেন্ট একেবারে। সে অদ্ভুত - লাস্ট যেটা মোটাদের ভূত - টোয়াং টোয়াং - এ-রকম ধরনের জিনিশ - পারকাশন যন্ত্র - দাঁতে চিপে বাজায়।" সুরবর্জিত এই গানও একটি অসাধারণ সাঙ্গীতিক প্রয়োগ। বিশেষ করে ভূতের নাচের পরিকল্পনা, তার ব্যবহার, প্রয়োগ আর সবার ওপরে তার নতুনত্ব - এর সঙ্গে এই অনন্য সাঙ্গীতিক প্রয়োগ ছাড়া অন্য কিছুর কথা ভাবা শক্ত।
আর একটা গানে দক্ষিণী সঙ্গীতের প্রভাব পাচ্ছি - "ওরে বাঘা রে, ওরে গুপি রে" গানে। সেখানে গানের সুরে দক্ষিণী আন্দোলনের সঙ্গে দক্ষিণী তারবাদ্য বেজেছে বাংলা ঢোলের পাশে। এই গানের শেষে গুপি-বাঘা ভারতনট্টমের নেক মুভমেন্ট করতে করতে পালায়। এই পুরো ব্যাপারটাকেই সত্যজিৎ 'প্যারোডিস্টিক' করতে চেয়েছেন।
গুগাবাবাতে একটি বাঁশির composition আছে যা ব্যক্তিগতভাবে ছবিতে আমার সবচেয়ে প্রিয়। এটি রেকর্ডে শুন্ডি থিম বলে লেখা আছে। লৌকিক রাজস্থান থেকে সংগৃহীত এই গান সত্যজিতের নিজের রচনা নয়। একজন একই সঙ্গে দুটো বাঁশি বাজিয়ে এই সুর তোলে। একটি বাঁশিতে মূল সুরটি ওঠে। অন্য বাঁশিতে একটিমাত্র ফুটো বাদ দিয়ে বাকিসব মোম দিয়ে বন্ধ। ফলে এই দ্বিতীয় বাঁশিতে একটিই মাত্র সুর বের হয়। অনেকটা যেন সানাইয়ের পোঁ বা drone-এর কাজ করে। একক বাদনে এই যন্ত্র বহুস্বরের (polyphony) আভাস দিতে পারে।
এই মিউজিক পাওয়া নিয়ে সত্যজিৎ লিখেছেন, "... এমন সময়ে কোত্থেকে জানি ভেসে এল এক আশ্চর্য সুন্দর বাঁশির সুর। ... লোকটিকে খুঁজে বার করে হল। মাথায় পাগড়ি, গায়ে সাদা সার্টের উপর কালো ওয়েস্ট কোট, চোখে অমায়িক, উদাস দৃষ্টি। বয়স মনে হল চল্লিশের কাছাকাছি। ওয়েস্ট কোটের পকেট থেকে উঁকি দিচ্ছে বাঁশি - তবে একটা নয় দুটো। ... আমরা বংশীবাদককে বললাম, তাঁর বাজনা আমাদের দূর থেকে শুনে খুব ভাল লেগেছে - তিনি কি সন্ধেবেলা আমাদের ডেরায় এসে একটু বাজনা শুনিয়ে যাবেন? ইচ্ছে ছিল সম্ভব হলে এই বাঁশির রেকর্ড করে আমাদের ছবিতে ব্যবহার করব। বাঁশিওয়ালা এক কথাতেই রাজি হয়ে গেল।"
সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ জওহরনিবাসে এসে হাজির হল বাঁশিওয়ালা আর তার বন্ধু। আমার ঘরে মাটিতে কার্পেটের উপর বসে প্রায় এক ঘন্টা ধরে বাঁশি শোনা ও রেকর্ড করা হল। শুরুতেই অবাক হলাম দেখে যে পকেট থেকে দুটো বাঁশি বার করে দুটোই এক সঙ্গে মুখে পুরলেন শওকত আলি (নামটা আগেই জেনে নিয়েছিলাম)। ফুঁ দেবার পরে বুঝলাম কী আশ্চর্য ব্যাপার ঘটতে চলেছে। একটা বাঁশিতে কেবল একটা ফুটো ছাড়া অন্যগুলো সব মোম দিয়ে বন্ধ করে ফেলা হয়েছে। এই বাঁশি কাজ করবে সানাই-এর পোঁ-এর মতো। আর অন্য বাঁশির সব ফুটোই খোলা; এতে বাজবে সুর। পরে জিগ্যেস করে জানলাম, এই বাঁশির নাম হল সাতারা। এর উৎপত্তি হয়েছে জয়সলমিরের পঁচিশ মাইল পশ্চিমে পাকিস্তান সীমানা থেকে মাত্র কুড়ি মাইল দূরে খুড়ি নামে একটি গ্রামে। ছোট্ট গরিব গ্রাম - কিন্তু সে গ্রামের প্রত্যেকটি লোক নাকি গান বাজনায় ওস্তাদ। এই গ্রামেই নাকি উদ্ভব হয়েছিল সাপুড়ের বাঁশির - যাকে রাজস্থানে বিন বলে - যা আজকাল ভারতবর্ষের সব শহরে শুনতে পাওয়া যায়।"
সত্যজিৎ যেটা লেখেননি সেটা হল এই যে এই বাঁশির আর একটা নাম আলগোজা।
সত্যজিতের পশ্চিমি সঙ্গীতে রুচি ও আগ্রহ নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। আমার ধারণা ভারতীয়, বিশেষতঃ বাংলাদেশের, লোকসঙ্গীত ও লোকবাদ্যেও সত্যজিতের বিশেষ আগ্রহ ছিল। একটি লেখায় সত্যজিৎ পুববাংলার ছড়টানা তারের যন্ত্র সারিন্দায় polyphony'র আভাসের কথা লিখেছেন। সেই লেখাতেই লোকগানের সঙ্গে দোতারার সঙ্গতেও chordal pattern-এর আদিরূপ খুঁজে পেয়েছেন। ঠিক সেইরকম জায়গা থেকে শুধু polyphonic sound production-এর পরিপ্রেক্ষিতে রাজস্থানী বাঁশির ব্যবহার বেশ অর্থবহ লাগে।
শুধু গুপি গাইনেই নয়, 'তিনকন্যা'র সমাপ্তি ও পোস্টমাস্টারে - পটভূমির কারণেই সম্ভবত - দেখি মূলত বাংলার লোকবাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার, বিশেষতঃ সারিন্দা আর দোতারা ব্যবহার খুবই উল্লেখযোগ্য লাগে।
সত্যজিৎ সঙ্গীত নিয়ে এদিক-ওদিক যা লিখেছেন বা আলোচনা করেছেন তার মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে একটা লেখা বাদ দিলে বাংলা বা ভারতের লোকসঙ্গীত নিয়ে বিশেষ কিছু বলেছেন বলে মনে পড়ছে না। অবশ্য এমন নয় যে, আমি সব আলোচনাই পড়ে ফেলেছি। কাজেই আমার গোচরের বাইরে লোকসঙ্গীত নিয়ে আলোচনা থাকতেই পারে। সত্যজিতের বেড়ে ওঠা যদি দেখি - খুবই অল্পবয়সে গড়পারে পিতৃপরিবারের বাইরে এসে মামার বাড়িতে মানুষ হওয়া - যে মামারা কাকাদের তুলনায় হয়ত বেশি সাহেবী - কারণ সত্যজিৎ ছেলেবেলা থেকে রেকর্ডে বিলিতি গান শোনার অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ, কিন্তু অন্য গান শোনার অভিজ্ঞতা নয়, সেক্ষেত্রে এই অনুমান হয়ত বেঠিক হবে না যে বাংলা সাহিত্যের মতন বাংলা লোকসঙ্গীতে সত্যজিতের সিরিয়াস এক্সপোজার ডি কে গুপ্ত ও কমলকুমার-প্রমুখদের সান্নিধ্যে আসার আগে হয়নি। এই অনুমানের ভিত্তিতে যখন গুপি গাইনের লোকসঙ্গীত আদলের গান শুনি ("মহারাজা, তোমারে সেলাম" আর "এক যে ছিল রাজা") তখন আশ্চর্য হতে হয় থেকে বাংলা লোকসঙ্গীতের স্ট্রাকচারের মধ্যে থেকে কী অসম্ভব টাটকা আর অভূতপূর্ব সুরের প্রয়োগ করা যায়। বিশেষতঃ "এক যে ছিল রাজা" গানটি শুনলে এক লহমায় বাংলা লোকগান হিসেবে একে চিহ্নিত করা যায়, অথচ বাংলা লোকগানের প্রচলিত সুরের কোন ফ্রেজ এতে ব্যবহার করা হয়নি।
আরেক উল্লেখযোগ্য গান "হাল্লা চলেছে যুদ্ধে"। যুদ্ধসঙ্গীত তাই মার্চিং ব্যান্ডের কেটল ড্রামের পটভূমিকায় স্ট্যাকেটোতে বাঁধা গানটা পশ্চিমী স্ট্রাকচারে লীড-কোরাস-লীড-কোরাস এই রীতিতে চলে। মার্চিং সং তো স্ট্যাকেটোতে চলবেই। কিন্তু স্ট্যাকেটোর খাড়া নোট লাগানোর সুবিধে নিয়ে দুজন অনিয়মিত গায়ক জহর রায় আর কামু মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গান গাওয়ানোও সোজা হয়ে গেছিল নিশ্চয়ই। গান শুরু হচ্ছে যদিও গিটারের আরপেজিওতে। এখানেও ভোকাল হারমনির চমৎকার প্রয়োগ আছে, যেখানে কামু আর জহর গাইছেন "শুন্ডিরে দেব পিন্ডি চটকে / শুন্ডিরে দিও পিন্ডি চটকে" ইত্যাদি পেছনে কোরাস হারমনিক স্কেলে "হাল্লা, হাল্লা" চালিয়ে যাচ্ছে। এই ধরণের ভোকাল হারমনির প্রয়োগ হয়ত আজকাল জলভাত হয়ে গেছে, কিন্তু ছয়ের দশকে বাংলা ছবির গানে এই প্রয়োগ নতুনই লাগে। বাংলায় ভোকাল হারমনির প্রথম উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ বলে যে গান ধরা হয়, সলিল চৌধুরীর সুরে "সুরের ঝর ঝর ঝর্ণা", সেটি প্রকাশিত হয় এর বছর দশেক আগে।
পশ্চিমি কম্পোজিশনে একটা ডিভাইস বিভিন্ন রূপ ধরে আসে - সেটাকে সাঙ্গীতিক কথোপথন বলা যেতে পারে। সিম্ফনিতে অনেক সময় দুটো থিমের চলন তার রকমফের ধরা যেতে পারে। অনেকসময় দুটো যন্ত্রের কথোপকথন চলে। ভারতীয়ে সঙ্গীতে যন্ত্রসঙ্গীতের শেষে তবলার সঙ্গে সওয়াল-জবাবে হয়ত খানিকটা তার আভাস পাওয়া যাবে। সত্যজিৎ তার সঙ্গীতে অনেক জায়গায় এই ডিভাইসের ব্যবহার করেছেন। গানে গায়কের সঙ্গে যন্ত্রানুষঙ্গের কথোপকথন চলছে যেন। কোথাও অনুষঙ্গে গায়কের সুরই বলছে, কোথাও গায়কের সুরের প্রতিস্পর্ধী সুর বলছে। যেমন 'ও মন্ত্রীমশাই' গানে -
সুবিদিত হলেও, সত্যজিতের পশ্চিমি ধ্রুপদী সঙ্গীতের দখলের কথা যত বলা হয় তত বলা হয়না ওনার হিন্দুস্তানী সঙ্গীতের দখল সম্বন্ধে। পশ্চিমি ধ্রুপদী সঙ্গীতে ওনার দখল ও উৎসাহ তখনকার গড়পড়তা সঙ্গীতবোদ্ধাদের তুলনায় অনেক বেশি ছিল সে কথা বহু-আলোচিত। আমি এমনও শুনেছি বন্ধুমহলে ওনাদের একটা খেলাই ছিল একটি কম্পোজিশনের পিস শুনে চিনতে হবে - কম্পোজার চেনা তো তুশ্চু - কন্ডাকটরকে! কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ধারণা হিন্দুস্তানী সঙ্গীতে সত্যজিতের দখল ছিল পশ্চিমি সঙ্গীতের থেকে হয়ত বেশিই। গুগাবার গানের বাজির দৃশ্যটি তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ছবির দিক দিয়ে দেখতে গেলে গানের বাজির শুরুয়াৎ কিন্তু হাল্লার রাজসভারও আগে, যখন গুপি-বাঘা ভূতের দেওয়া খাবার খেয়ে হাত-মুখ ধুতে ধুতে ও সঙ্গে রাজকন্যার চিন্তা করার সময়ে দোলায় চড়ে টোড়ি গাইতে গাইতে যাওয়া ওস্তাদের সাক্ষাৎ পায়। সেই দৃশ্য শেষ হয় লয় বাড়িয়ে দ্রুতে খেয়াল গাইতে গাইতে যখন "বাপ রে বাপ, কী দাপট"-এর সঙ্গে ওস্তাদজী হাল্লার রাজসভার দিগন্তে মিলিয়ে যান। এও দেখার বিষয় যে গানের বাজিতে একটি কীর্তন আর একটি ঠুংরি ভিন্ন আর সবই যাকে বলে পাকা গানা। ধ্রুপদ ও খেয়াল। মানে পাকা আর আধা-ধ্রুপদীর বাইরে কোন গান নেই। নো লোকগান। নেই যন্ত্রসঙ্গীতও। এটাও স্রেফ একটা অবজার্ভেশান। কোন বিশেষ কারণ নির্দেশ করার চেষ্টা করছি না।
সত্যজিতের হিন্দুস্তানী গানের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে আমি বলতে পারি যে গুপি ভূতের বরে সাঙ্গীতিক প্রতিভা পাওয়ার পরে যে গানটি করে সেটি "ভৈরবী রাগিনী"-আশ্রিত "দেখ রে নয়ন মেলে"। কাহিনীগত দিক থেকে সেটা হবারই ছিল। কারণ গানটি খুব সম্ভবতঃ পাঁচপুকুরের বড় ওস্তাদ বল্লভ গোঁসাইয়ের থেকে প্রাপ্ত। উটের কুচকাওয়াজের জন্যে পেন্টাটোনিক স্কেলে একটা মার্চিং মিউজিক তৈরি করেছিলেন যার পর্দাগুলো আমাদের মালকোষের পর্দার সঙ্গে মিলে যায়।
গুগাবাবার সাউন্ড ট্র্যাকের মজা হল গানগুলোর বাইরের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকেও নতুন চিন্তা আর প্রয়োগের ছাপ পাওয়া যায় - যা পরের ছবির ক্ষেত্রে কিছুটা একঘেঁয়ে হয়ে গেছিল। তবে প্রথম থেকে সত্যজিতের সুর থেকে শুরু করে যন্ত্রের ব্যবহার এমন এক স্বকীয়তা তৈরি করেছিল যে শুনলেই বোঝা যায় এ সত্যজিতের সৃষ্টি। খুব সম্ভবতঃ বনরাজ ভাটিয়া বলেছিলেন যে অদীক্ষিত (মানে প্রথাগত তালিম না-পাওয়া) কম্পজার হিসেবে যতদূর যাওয়া সম্ভব, সত্যজিৎ ততটাই গেছেন।
তবে যে গানটার জন্যে আমি কম্পোজার সত্যজিৎকে আভূমি কুর্নিশ করি, সেটি ছবির শেষে গান "ওরে বাবা দেখ চেয়ে"। এই গানের কম্পোজিশন সম্বন্ধে সত্যজিৎ বলছেন, "... প্রথম দিকটা ভূপালী, পিওর ক্ল্যাসিক্যাল রাগের ওপর বেস করা। সেকেন্ড পোরশনে গানটা [ যখন ] মডিউলেট করছে সেখানে মেজাজটা আবার ফোক-এর দিকে চ'লে যায়।" এর সঙ্গে পশ্চিমি অ্যারেঞ্জমেন্ট মিলে গানটাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে যে শুনলে রাগ-রাগিনী, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য এসব ছেড়ে স্রেফ গান হিসেবেই সৃষ্টিটি জেগে থাকে। গানের প্রথম অংশে বিলিতি ছড়টানা তারের যন্ত্র - বেহালা আর চেলোর সঙ্গে সঙ্গত করছে বাংলা ঢোল। এখানে বিশেষ করে লক্ষ্য করতে বলি বেহালার বোইং টেকনিক। টানা সুরের লিগ্যাটো নয়, যুদ্ধক্ষেত্রের গান বলে (যুদ্ধ থামাবার হলেও) স্ট্যাকাটো বোইং। সেই সঙ্গে কথায় ছোট ছোট শব্দে কাটা কাটা স্ক্যানিং। যুদ্ধের মিছিলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বোইং চলে। গানের পরের অংশে ("ওরে হাল্লা রাজার সেনা, তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল"), যেখানে সুরে দিশি লোকগানের আমেজ আসছে সেখানে দিশি যন্ত্রের প্রবেশ - দোতারা, সরোদ, বাঁশি ইত্যাদি।
সত্যজিতের সংলাপ লেখার হাতের কথাও সুবিদিত। সেই সঙ্গে কথা নিয়ে খেলা। গুপি-গাইন-বাঘ-বাইনে সত্যজিৎ সেই জমি চষে নিলেন নিজের মতন করে। "তৃতীয় সুর, ষষ্ঠ সুর" থেকে শুরু করে হল্লা-রাজার সেনা পরিদর্শন করে উষ্মাপ্রকাশ, "না হচ্ছে কুচ না হচ্ছে কাওয়াজ" গানে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে ইডিওমেটিক বাংলায়। আমার ধারণা, এই গানের ভাষা আর মেজাজের প্রস্তুতি হয়েছিল সন্দেশের জন্যে লিয়র এবং ক্যারলের ছড়ার অনুবাদের মধ্যে দিয়ে। কথ্য বাংলাকে গানের কথায় সহজ করে তুলে আনায় যা আলোচনা হয়েছে, সত্যজিৎ আশ্চর্যরকমভাবে সেখানে অনুপস্থিত। অথচ, এমনভাবে মুখের কথাকে গানে তুলে আনা, এবং মিউজিকালি তুলে আনা, আর কটা গানে হয়েছে সে অনেক ভেবে বলতে হয় -
রাজা করেন তম্বি-তম্বা
মন্ত্রী মশাই কিসে কম বা!
এর আগে "মন্ত্রীমশাই, থেমে থাক" গানে বাংলা ইডিয়মকে গানের কথায় চালাচ্ছেন -
শুধু দেখেছ ঘুঘুটি তাই এত ভুরুকুটি
পড়লে ফাঁদেতে চুপসিয়ে যাবে যাক।
আবার সেই গানে চলতি কথা -
যত চালাকি তোমার জানতে নাইকো বাকি আর
যত ক্যার্দানি-শয়তানি সবই ফাঁক।
সব দিক থেকে দেখলে, আজও গুপি-গাইনের গান এক আশ্চর্য সৃষ্টি, যেমন টাটকা তেমনি নজিরবিহীন।
তথ্য, উপস্থাপনায় অনবদ্য।
খুব ভালো লাগল।
আমাদের চেনা ন্যাড়া স্যার। মুগ্ধ।
দারুণ।
অপূর্ব উপস্থাপনা! ভেতরে আলোড়ন জাগালো।
ভালো লাগল কিন্তু ন্যাড়াদার অন্য লেখাগুলোর মতন ততটা নয়
এইটা ভাল হয়েছে। কিন্তু কামু ও জহর কেন, সন্তোষ দত্ত ও জহর তো !
খুবই ভাল লাগল। ঐ ভুতের গল্পগুলো কমিয়ে এরকম লেখা আরো বেশী বেশী করে লিখলে পারেন তো।
না না ভূতের গল্পও চাই। ভূতের গানের সাথে।
লেখকের কাছে একটা প্রশ্নঃ
গুগাবাবা সংগীত প্রতিযোগিতায় "বর্ষণ লাগি বদরিয়া" গানটা (কাজরী??) কার গলায় গাওয়া জানা আছে?
[এইখানে পোস্টেড "GuGaBaBa Music Competition" ইউটিউবের ভিডিওতে ২ঃ১৬ মিনিটে আছে।]
উটের (camel march)-এর ভিডিওটা ইউটিউব প্রিমিয়াম মেম্বার না হলে দেখা যাবে না বলছে
লেখকের কাছে একটা প্রশ্নঃ
গুগাবাবা সংগীত প্রতিযোগিতায় "বর্ষণ লাগি বদরিয়া" গানটা (কাজরী??) কার গলায় গাওয়া জানা আছে?
[এইখানে পোস্টেড "GuGaBaBa Music Competition" ইউটিউবের ভিডিওতে ২ঃ১৬ মিনিটে আছে।]
অনুমতি না নিয়ে গিরজা দেবীর রেকর্ডের গান। পরে এয়ারপোর্টে দেখা হতে গিরজা দেবী অভিযোগ করায় রায়মশাই অম্লানবদনে বলেছিলেন, "চাইলে তো অনুমতি দিতেন না।"
ক্যামেল মার্চের আর ভিডিও পাচ্ছি না। আমাকেই একটা বানাতে হবে মনে হচ্ছে।
লসাগু, ভূতের নাচের লিংটাও ভাঙা। এইটা লাগিয়ে দেখবে?
নাহ, এটাও এমবেড করা যাচ্ছে না।
মার্চের গানটা ৩৬' থেকে শুরু হচ্ছে:
শুধু গুপী গাইন বাঘা বাইন নিয়ে একটা গোটা টই হয়ে যায় | কত কিছু যে লেখার আছে!
1:42' থেকে যেটা শুরু হচ্ছে সেটা ক্যামেল মার্চ মিউজিক। ধন্যবাদ অরিন।
:-), ও আচ্ছা, এইটা |
গিরিজা দেবী আর রবি কিচলু'র যুগলবন্দী:
এই টইটা খুব ভালো হয়েছে। টুক টুক করে ক্লিকিয়ে গান নাচ দেখে নেওয়া যাচ্ছে। ঃ-)
"বরসন লাগি" এইটা বেজেছে।
বইকতের একটা প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়নি, "হাল্লা চলেছে যুদ্ধে" গানে সন্তোষ দত্তর প্লেব্যাক করেছিলেন কামু মুখুজ্জে।
ক্যামেল মার্চ মিউজিক নিয়ে আরো দু-একটা জিনিস থাক:
(একেই বলে শুটিং থেকে নেওয়া ) |
শওকত আলির সঙ্গের ভদ্রলোকটি একসময়ের রাজস্থানের ডাকাত কর্ণ ভিল। ইনিও পরে সোনার কেল্লার শুটিং এর সময় বাঁশী বাজিয়েছিলেন। শওকত আলি ততদিনে পাকিস্তানে চলে গেছেন।
চমৎকার লেখা ! ভাবনাচিন্তার সঙ্গে বেশকিছু মিল পেয়ে গেলাম। আরো লিখুন। সমৃদ্ধ হই ।
অসাধারণ লেখা। বহুদিন পর এই রকম একটি লেখা পড়ে সমৃদ্ধ হলাম।
@সম্বিৎ,
অনেক ধন্যবাদ। ঐ কলিটার মাঝখানে গায়িকার একটা বিশেষ কাজ (বা মোচড়) আছে, যা অন্যদের গলায় পাইনি। মনে হয় বেনারসী ঘরানা special।
লেখায়, ভিডিওতে, মন্তব্যে ন্যাড়াবাউর বৈঠকখানা জমজমাট। খুব উপভোগ্য পোস্ট।
খুব ভালো লেখা। তথ্যের চেয়েও বেশি স্পর্শ করলো তুখোড় রসবোধ। মেজাজী গদ্য।