এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  টুকরো খাবার

  • ব্যক্তিগত রোলকাতা

    সম্বিৎ বসু লেখকের গ্রাহক হোন
    টুকরো খাবার | ০৬ আগস্ট ২০১০ | ২১৯৭ বার পঠিত
  • জুলাই ১৮-র হিন্দুস্তান টাইমসের Brunch পত্রিকায় ভির সাংভি কাঠি রোল সম্বন্ধে কটা কলাম লিখেছেন। যার নাম চালভাজা, তার নামই মুড়ি। আমরা কলকাতার লোকেরা যাকে রোল নামে জানি, বৃহত্তর ভারত জানে 'কাঠি রোল' বলে। সাংভিবাবুর মতে কাঠি রোল আসল ভারতীয় স্যান্ডউইচ। স্যান্ডউইচ কি না-স্যান্ডউইচ এই ব্যাপারে আমার বিশেষ কোন বক্তব্য নেই। সাংভি যে 'খ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর' স্টাইলে কাঠি রোলের উৎস-সন্ধান করে মরেছেন, সে ব্যাপারের আমার দু পয়সা দেবার আছে।
    চট করে ভির সাংভির মোটিভটা বলে দিই। সাংভি খুব সৎভাবে স্বীকার করেছেন যে খ্যাপা পরশপাথর শেষ অব্দি খুঁজে পায়নি। তবে মোটামুটি কলকাতার নিজাম অথবা দিল্লির মোতি মহল কী খান চাচা - এদের মধ্যে একজন কাঠি রোলের জনক। এরকমও হতে পারে যে হয়তো যে এই দুই জায়গাতেই কাঠি রোল আলাদা আলাদাভাবে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছে। খুবই সম্ভব। কারণ বর্ণনা শুনে যা মনে হল (দিল্লি যাইনি, তাই দিল্লির রোল খাইনি) দেখতে এবং খেতে এ দু'জায়গার রোলই একই ধরণের হলেও, আসলে মাল আলাদা। প্রথমতঃ কলকাতার রোল পরোটা দিয়ে তৈরী, দিল্লিতে বানায় রুমালী রুটি মুড়ে। কলকাতার রোলের ভেতরের মাংস কাঠি কাবাব, ঝলসানো (গ্রিল করা) মাংসর টুকরো, রোলে ঢোকাবার আগে তাওয়ায় তেলে ভাজা হয়। সেখানে দিল্লির রোলের ভেতরে তন্দুরি মাংস পোরা হয়।
    দিল্লির রোলের ভেতরে মাংসর সঙ্গে গারনিশিং হিসেবে কী দেয় জানিনা। কলকাতায় পড়ে পেঁয়াজ কুচো, শশা-বীট-গাজর কুচোনো, কাঁচালংকা, টম্যাটো সস, চিলি সস। সসের আমদানী বছর পঁচিশেক আগে। তার আগে সসের বদলে পড়ত লেবুর রস। নিজামে বোধহয় ভিনিগার দিত। বীট-গাজরও তুলনামূলকভাবে হালের আমদানী। সসের সঙ্গেই, কী আরও পরে। বাল্যকালের নিজামের আমার যা স্মৃতি তাতে বসে-খেলে খাওয়া হত আন্ডা পরোটা আর কাবাব। কাবাব অবশ্যই গরুর মাংসর। সঙ্গে স্যালাড বলে যা আসত তা হল এক প্লেট কুচোনো পেঁয়াজ। টেবিলে প্লাস্টিকের বাটিতে নুনের পাশে থাকত ভিনিগারের বোতল। স্যালাডে ভিনিগার ঢেলে মুখরোচক করে নেওয়া হত। আন্ডা পরোটার বদলে প্লেন পরোটাও থাকত সময়ে সময়ে। এখন ভেবে দেখলে, নিজামের রোল কিন্তু একদম এই জিনিস দিয়ে তৈরী। আলাদা আলাদা আসার বদলে এক মোড়কে এলেই হয়ে গেল নিজামের রোল। কাজেই কলকাতায় রোলের সৃষ্টিতে নিজামের ক্লেম বেশ স্ট্রং।

    এই প্রসঙ্গে অন্য এক স্মৃতিচারণ খুব বেমক্কার হবে না। নিজামের ঠিক পাশে আরও দুটি কাবাব-পরোটার দোকান ছিল। নাম ছিল বিহার আর ইউপি। মাক্কালী। কলকাতার পুরোনো কোন খাদ্যরসিক থাকলে জিগেস করে নেবেন। খাদ্যরসিক যাঁরা অলিগলি সুলুকসন্ধান রাখতেন। নিউ মার্কেট ভেতরে নাহুম-টাহুম পেরিয়ে, সেমুইয়ের স্টলের গা ঘেঁষে যদি মিনার্ভা, মানে এখনকার চ্যাপলিন, সিনেমার দিক দিয়ে বেরোতেন তাহলে ঐ নিউ মার্কেটের গেট আর নিজামের মাঝে ছিল বিহার আর ইউপি। তো আমার প্রথম রোল খাওয়ার স্মৃতি বিহার-ইউপি। পুজোর বাজার-টাজার করার মতন কোন সপরিবার উপলক্ষ্যে। যদ্দূর মনে পড়ে সেও নিজামের মতনই। সে দোকান এখন আছে কিনা জানিনা। থাকলেও যে আর সে রবরবা নেই, তা তো বোঝাই যাচ্ছে।
    আসলে তখন কলকাতা শহরে রোলের দোকান বলতে সবেধন ঐ দু-তিনটিই। বিশেষ বিখ্যাত। পরবর্তীকালের স্টলওয়ার্টরা - যেমন লিন্ডসে স্ট্রিটের বাদশা কি গড়েহাটার বেদুইন - তখনও মাতৃগর্ভে। রোলের দোকান ছড়াতে শুরু করল সত্তরের মাঝ-শেষ থেকে। আমরা তখন কলকাতার প্রান্তবাসী। থাকি লেক টাউনে। প্রথম রোলের দোকান হল অন্নপূর্ণা-নিউ অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভান্ডারের লাইনে, হাঁড়ি কলসীর দোকানে একটু আগে। সে বোধহয় ৭৭-৭৮ সাল। ঠেলা নয়। একদম ফুল-ফ্লেজেড মাথায় ছাতওলা দোকান। ধবধপে সাদা ময়দার লেচি লাল শালুতে চাপা দেওয়া থাকত সানমাইকার কাউন্টার-টপে। দেখলেই মন আনচান করে উঠত। রোল বানাতে সময়ও লাগত তখন। এখনকার মতন দড় হয়ে ওঠেনি রোল-বানিয়েরা। আর কদিন পরেই লেক টাউনের দ্বিতীয় দোকান খুলল। জয়া সিনেমা থেকে একটু এগিয়ে ট্যাংকের গোল চক্করে সাঁই ব্রাদার্সের পাশে। বোঝা গেল বাংলায় রোল যুগ এসে পড়েছে।
    তারপর তো রোল শুধু রোল। ঠেলাগাড়িতে পাড়ার মোড়ে মোড়ে। বেকার স্বল্পশিক্ষিত যুবকদের লেজিটিমেট ও চালু বিজিনেস মডেল। (মহিলা রোল-বানিয়ে দেখিনি কিন্তু কভু।) শুধু রোল চলল ক' বছর। তারপর ডাইভার্সিফিকেশনের বাজারে রোলের সঙ্গে এল নানান ধরণের চপ, আলু টিকিয়া এবং সব শেষে বাঙালীর কালজয়ী অবদান, 'চাইনিজ ফুড'।
    যাদবপুরের এইট-বি বাসস্ট্যান্ডের সামনে সার দিয়ে যে চার কী পাঁচজন রোলওলা বসতেন, তারা যাদবপুরের ছাত্রদের দৈনান্তিক সর্বগ্রাসী খাই-খাইয়ের টোটকা হিসেবে আলু রোলের উদভাবন করেছিলেন। সেদ্ধ, চটকানো আলু গোল করে টিকিয়ার মতন করা থাকত। মাংসর বদলে রোলের পুর হিসেবে সেই চালনো হত। সস্তা এবং পেট-ভরানো। পপুলার ছিল এগ-পোটাটো। তাছাড়া আলু বিশেষ চলেছিল বলে মনে হয় না। পরে অন্য কোথাও দেখিনিও।
    রোল, মানে রুটির মধ্যে মাংসর পুর - এই কনসেপ্টের একটা সর্বজনীনতা আছে সেটা খেয়াল করেছেন? ধরুন টেংরি-মেংরি; (টেংরি সের মেংরি কান, খাঁটি মেংরি কোর মেংরি কান খাবার নয়) 'বারিটো' বা 'বুরিতো' - যা অ্যামেরিকায় বিশেষতঃ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের রাজ্যগুলোয় গোগ্রাসিতমা&#১৫৬;¡য় জনপ্রিয় - সেও তো আদতে রুটির মধ্যে মাংসর পুর। রুটিটা মেংরি;কান টোর্টিয়া, ময়দার। পুরে মাংসর সঙ্গে রয়েছে ভাত ও সব্জি, বিশেষতঃ অ্যাভেকাডো দিয়ে তৈরি য়াকামোলি। মাংস কিমাও হতে পারে, চাকলিও হতে পারে। খোবা, কলকাতার রোল-মাফিক, মাংসর টুকরো চোখে পড়েনি।
    অ্যামেরিকা মহাদেশ থেকে প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি, বেদের প্রতিস্পর্ধী অবেদার জন্মভূমি ইরান মানে পারস্য ইয়ানি কি ইস্পাহান দেশে আসুন। খান কুবিদে। মশলার গরগরে ভাব নেই। স্রেফ পেঁয়াজ-বাটা আর নুন দিয়ে মাখা মাংসর কাবাব যে অমন স্বাদ বের করতে পারে, তা মাইরি না চাখলে বিশ্বাস হবে না। সেই কুবিদেই 'স্যান্দউইচ' বানিয়ে দিতে বলুন। শুকনো ও ঠাণ্ডা রুটির মধ্যে কুবিদে, কুচোনো পেঁয়াজ আর টোমেটোর ওপর শুমাক ছড়িয়ে সঙ্গে তুলসীপাতা-টাতা মুড়ে যে জিনিস দেবে সেও তো রোলই। বেজাতি বলে কি স্বজাত নয়? অবশ্য এই কুবিদে স্যান্ডউইচ একটি বিশেষ দোকানের সৃষ্টি না ইরানে বহুল-প্রচলিত, সে খবর নেওয়া হয়নি। মার্কিনি র‌্যাপেরও তো এই রোল বংশেই জন্ম।
    বনেদি বংশ। প্রাচীনতায় কৌলীন্য না থাক, জনপ্রিয়তায় অনেক শালাকেই হারায়। ব্যাঙ্গালোরে তো 'কাঠি জোন' বলে একটি কর্পোরেট চেনই রমরমিয়ে চলছে। কলকাতা স্টাইল। লোকমুখে খবর পাই উইপ্রোর কিছু লোকের তৈরী চেন। খেয়ে দেখেছি, মন্দ নয়। তবে রান্না মাংস মাইক্রোওয়েভে গরম করে বানানো রোলের বদলে আমি যে কোনদিন তাওয়ায় এপাশ-ওপাশ করা মাংসর রোল বিনাবাক্যব্যয়ে ইস্তেমাল করব। আরও একটা ব্যাপার। 'কাঠি জোন' নাম যদিও কাঠি রোল থেকে এসেছে, কিন্তু নামে 'রোল' শব্দ না রাখার প্রতিবাদে আমি নেহাত ঠেকায় না পড়লে 'কাঠি জোন'-এ যাব না স্থির করেছি। প্রমিস।
    পুনশ্চঃ এই মাত্র খবর পাওয়া গেল মুম্বাইতে 'হ্যাংলা' নামক একটি চেনের উৎপত্তি হয়েছে। ২৫ শে জুলাইয়ের নিউ ইয়র্ক টাইমসের ট্র্যাভেল সেকশনের গ্লোবস্পটার পশ্য। দেখার ব্যাপার এই যে সেখানে কিন্তু ঐসব সস-টসের আড়ম্বর ছেড়ে শুধু লেবুর রস, পেঁয়াজ কুচো, কাঁচালংকা আর নুন দেওয়া হচ্ছে মাংসর সঙ্গে। পুরানো সেই দিনের কথা ...

    অলঙ্করণ সায়ন কর ভৌমিক
    ৯ আগস্ট, ২০১০


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • টুকরো খাবার | ০৬ আগস্ট ২০১০ | ২১৯৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Abhyu | ***:*** | ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:৩৩89241
  • হুতোর ছবি, পোষ্কার চেনা যায়। আর লেখাটা এককের মত হয়েছে - মানে বোঝে কার সাধ্যি
  • aka | ***:*** | ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:৩৮89242
  • এককও এমন লিখতে পারলে ধন্য হত।
  • | ***:*** | ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:৫৪89243
  • কিন্তু 'রোলকাতা' কেসটা কী? রোলকলের খাতা?

    আর এইটা মোনয় বাংলাপ্লেন জাতীয় কোনও নন-ইউনিকোড ফন্টে লেখা, ফলে এমন হায়েরোগ্লিফিক্সের মতম দেখতে হয়েছে।
  • এগ্রোলের কলকাতা | ***:*** | ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ০৪:০০89244
  • এগ্রোলের কলকাতা মনে হচ্ছে।
  • ন্যাড়া | ***:*** | ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ০৪:৩০89245
  • আরে এটা তো আমার বছর তিন-চার আগে লেখা আর একটি যুগান্তকারী প্রবন্ধ! সেটা এরকম এককিফায়েড হয়ে গেল কেং কয়ে?
  • byaang | ***:*** | ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ০৪:৪২89246
  • এটাতেই কি সেই আলুর্রোল নামের বস্তুটির উল্লেখ আছে?
  • ন্যাড়া | ***:*** | ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ০৪:৪৬89247
  • ইয়েস। যে কারণে এই প্রবন্ধটি দুর্গেশনন্দিনী, নিধুর টপ্পা ও চর্যাপদের সঙ্গে একাসনে বসার দাবীদার।
  • Tim | ***:*** | ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ০৫:৫৩89248
  • পরিষ্কার পড়া যাচ্ছে, তবে বোঝা যাচ্ছেনা কি বক্তব্য। সে পাঠকের ভাষাজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। হ্যাঁ ছবিটা হুতোদার, চিনেছি।
  • sinfaut | ***:*** | ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ০৮:৫৭89249
  • আমি শুধুই সাংকেতিক কিছু চিহ্ন দেখছি, সে কি শুধুই আমি?

    আর লেখাটা বা লেখকের নাম font face ?
  • satyajit | ***:*** | ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ০৯:১৭89236
  • সবারে বাসরে ভালো নইরে মনের কালো মুছবে নারে
  • এইটা পড়া যাচ্ছে? | ***:*** | ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ০৯:১৮89237
  • এইটা পড়া যাচ্ছে?
  • একক | ***:*** | ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ০৯:৩৬89238
  • পরিস্কার#পড়া#যাচ্ছে
    #তবে#হাইলি#ডিকনসট্রাকটেবল#:/
  • এইটা পড়া যাচ্ছে? | ***:*** | ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ০৯:৪২89239
  • আমার মেশিন থেকে পড়া যাচ্ছে না।
  • তাপস | ***:*** | ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ০৯:৪৬89240
  • পড়া যাচ্ছে না l
  • Ishan | ***:*** | ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ১০:২১89250
  • এটা মনে হচ্ছে বাংলাপ্লেন থেকে ইউনিকোডে মাইগ্রেশনের সময় ঘেঁটে গেছে। এরকম কি আরও আছে নাকি?
  • Abhyu | ***:*** | ২৫ অক্টোবর ২০১৪ ১২:২২89251
  • সেটা তো আপনারই জানার কথা মশাই। আমাদের তো কাজ খালি খিল্লি করা :)

    সিরিয়াসলি, আর তো কিছু চোখে পড়ে নি, পড়লই জানাবো।
  • সিকি | ***:*** | ২৬ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:২৫89252
  • টেকলিকালি জানা সম্ভব নয়। এত বেশি সংখ্যক লেখা হয়ে আছে, আলাদ আলাদা করে ধরে কেউ চেক না করলে জানা সম্ভব নয়।

    যাক, এটা মোটামুটি পাঠযোগ্য করে দিলাম। কিছু জায়গা বুঝতে পারি নি - সেটা ন্যাড়াদা কারেক্ট করে দিলে ভালো হয়।

    ব্যক্তিগত রোলকাতা
    সম্বিৎ বসু

    জুলাই ১৮-র হিন্দুস্তান টাইমসের Brunch পত্রিকায় ভির সাংভি কাঠি রোল সম্বন্ধে কটা কলাম লিখেছেন। যার নাম চালভাজা, তার নামই মুড়ি। আমরা কলকাতার লোকেরা যাকে রোল নামে জানি, বৃহত্তর ভারত জানে 'কাঠি রোল' বলে। সাংভিবাবুর মতে কাঠি রোল আসল ভারতীয় স্যান্ডউইচ। স্যান্ডউইচ কি না-স্যান্ডউইচ এই ব্যাপারে আমার বিশেষ কোন বক্তব্য নেই। সাংভি যে 'খ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর' স্টাইলে কাঠি রোলের উৎস-সন্ধান করে মরেছেন, সে ব্যাপারের আমার দু পয়সা দেবার আছে।

    চট করে ভির সাংভির মোটিভটা বলে দিই। সাংভি খুব সৎভাবে স্বীকার করেছেন যে খ্যাপা পরশপাথর শেষ অব্দি খুঁজে পায়নি। তবে মোটামুটি কলকাতার নিজাম অথবা দিল্লির মোতি মহল কী খান চাচা - এদের মধ্যে একজন কাঠি রোলের জনক। এরকমও হতে পারে যে হয়তো যে এই দুই জায়গাতেই কাঠি রোল আলাদা আলাদাভাবে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছে। খুবই সম্ভব। কারণ বর্ণনা শুনে যা মনে হল (দিল্লি যাইনি, তাই দিল্লির রোল খাইনি) দেখতে এবং খেতে এ দু'জায়গার রোলই একই ধরণের হলেও, আসলে মাল আলাদা। প্রথমতঃ কলকাতার রোল পরোটা দিয়ে তৈরী, দিল্লিতে বানায় রুমালী রুটি মুড়ে। কলকাতার রোলের ভেতরের মাংস কাঠি কাবাব, ঝলসানো (গ্রিল করা) মাংসর টুকরো, রোলে ঢোকাবার আগে তাওয়ায় তেলে ভাজা হয়। সেখানে দিল্লির রোলের ভেতরে তন্দুরি মাংস পোরা হয়।

    দিল্লির রোলের ভেতরে মাংসর সঙ্গে গারনিশিং হিসেবে কী দেয় জানিনা। কলকাতায় পড়ে পেঁয়াজ কুচো, শশা-বীট-গাজর কুচোনো, কাঁচালংকা, টম্যাটো সস, চিলি সস। সসের আমদানী বছর পঁচিশেক আগে। তার আগে সসের বদলে পড়ত লেবুর রস। নিজামে বোধহয় ভিনিগার দিত। বীট-গাজরও তুলনামূলকভাবে হালের আমদানী। সসের সঙ্গেই, কী আরও পরে। বাল্যকালের নিজামের আমার যা ØÈ«তি তাতে বসে-খেলে খাওয়া হত আন্ডা পরোটা আর কাবাব। কাবাব অবশ্যই গরুর মাংসর। সঙ্গে স্যালাড বলে যা আসত তা হল এক প্লেট কুচোনো পেঁয়াজ। টেবিলে প্লাস্টিকের বাটিতে নুনের পাশে থাকত ভিনিগারের বোতল। স্যালাডে ভিনিগার ঢেলে মুখরোচক করে নেওয়া হত। আন্ডা পরোটার বদলে প্লেন পরোটাও থাকত সময়ে সময়ে। এখন ভেবে দেখলে, নিজামের রোল কিন্তু একদম এই জিনিস দিয়ে তৈরী। আলাদা আলাদা আসার বদলে এক মোড়কে এলেই হয়ে গেল নিজামের রোল। কাজেই কলকাতায় রোলের সৃষ্টিতে নিজামের ক্লেম বেশ স্ট্রং।

    এই প্রসঙ্গে অন্য এক স্মৃতিচারণ খুব বেম&#১৩০;¡র হবে না। নিজামের ঠিক পাশে আরও দুটি কাবাব-পরোটার দোকান ছিল। নাম ছিল বিহার আর ইউপি। মাক্কালী। কলকাতার পুরোনো কোন খাদ্যরসিক থাকলে জিগেস করে নেবেন। খাদ্যরসিক যাঁরা অলিগলি সুলুকসন্ধান রাখতেন। নিউ মার্কেট ভেতরে নাহুম-টাহুম পেরিয়ে, সেমুইয়ের স্টলের গা ঘেঁষে যদি মিনার্ভা, মানে এখনকার চ্যাপলিন, সিনেমার দিক দিয়ে বেরোতেন তাহলে ঐ নিউ মার্কেটের গেট আর নিজামের মাঝে ছিল বিহার আর ইউপি। তো আমার প্রথম রোল খাওয়ার স্মৃতি বিহার-ইউপি। পুজোর বাজার-টাজার করার মতন কোন সপরিবার উপলক্ষ্যে। যদ্দূর মনে পড়ে সেও নিজামের মতনই। সে দোকান এখন আছে কিনা জানিনা। থাকলেও যে আর সে রবরবা নেই, তা তো বোঝাই যাচ্ছে।

    আসলে তখন কলকাতা শহরে রোলের দোকান বলতে সবেধন ঐ দু-তিনটিই। বিশেষ বিখ্যাত। পরবর্তীকালের স্টলওয়ার্টরা - যেমন লিন্ডসে স্ট্রিটের বাদশা কি গড়েহাটার বেদুইন - তখনও মাতৃগর্ভে। রোলের দোকান ছড়াতে শুরু করল সত্তরের মাঝ-শেষ থেকে। আমরা তখন কলকাতার প্রান্তবাসী। থাকি লেক টাউনে। প্রথম রোলের দোকান হল অন্নপূর্ণা-নিউ অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভান্ডারের লাইনে, হাঁড়ি কলসীর দোকানে একটু আগে। সে বোধহয় ৭৭-৭৮ সাল। ঠেলা নয়। একদম ফুল-ফ্লেজেড মাথায় ছাতওলা দোকান। ধবধপে সাদা ময়দার লেচি লাল শালুতে চাপা দেওয়া থাকত সানমাইকার কাউন্টার-টপে। দেখলেই মন আনচান করে উঠত। রোল বানাতে সময়ও লাগত তখন। এখনকার মতন দড় হয়ে ওঠেনি রোল-বানিয়েরা। আর কদিন পরেই লেক টাউনের দ্বিতীয় দোকান খুলল। জয়া সিনেমা থেকে একটু এগিয়ে ট্যাংকের গোল চক্করে সাঁই ব্রাদার্সের পাশে। বোঝা গেল বাংলায় রোল যুগ এসে পড়েছে।

    তারপর তো রোল শুধু রোল। ঠেলাগাড়িতে পাড়ার মোড়ে মোড়ে। বেকার স্বল্পশিক্ষিত যুবকদের লেজিটিমেট ও চালু বিজিনেস মডেল। (মহিলা রোল-বানিয়ে দেখিনি কিন্তু কভু।) শুধু রোল চলল ক' বছর। তারপর ডাইভার্সিফিকেশনের বাজারে রোলের সঙ্গে এল নানান ধরণের চপ, আলু টিকিয়া এবং সব শেষে বাঙালীর কালজয়ী অবদান, 'চাইনিজ ফুড'।

    যাদবপুরের এইট-বি বাসস্ট্যান্ডের সামনে সার দিয়ে যে চার কী পাঁচজন রোলওলা বসতেন, তারা যাদবপুরের ছাত্রদের দৈনান্তিক সর্বগ্রাসী খাই-খাইয়ের টোটকা হিসেবে আলু রোলের উদভাবন করেছিলেন। সেদ্ধ, চটকানো আলু গোল করে টিকিয়ার মতন করা থাকত। মাংসর বদলে রোলের পুর হিসেবে সেই চালনো হত। সস্তা এবং পেট-ভরানো। পপুলার ছিল এগ-পোটাটো। তাছাড়া আলু বিশেষ চলেছিল বলে মনে হয় না। পরে অন্য কোথাও দেখিনিও।

    রোল, মানে রুটির মধ্যে মাংসর পুর - এই কনসেপ্টের একটা সর্বজনীনতা আছে সেটা খেয়াল করেছেন? ধরুন টে&#১৩২;-মে&#১৩২; (টে&#১৩২;¡সের মেÏ&#১৩২;কান, খাঁটি মেÏ&#১৩২;কোর মেÏ&#১৩২;কান খাবার নয়) 'বারিটো' বা 'বুরিতো' - যা অ্যামেরিকায় বিশেষতঃ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের রাজ্যলোয় গোগ্রাসিতমা&#১৫৬;¡য় জনপ্রিয় - সেও তো আদতে রুটির মধ্যে মাংসর পুর। রুটিটা মেÏ&#১৩২;কান টোর্টিয়া, ময়দার। পুরে মাংসর সঙ্গে রয়েছে ভাত ও সব্জি, বিশেষতঃ অ্যাভেকাডো দিয়ে তৈরি য়াকামোলি। মাংস কিমাও হতে পারে, চাকলিও হতে পারে। খোবা, কলকাতার রোল-মাফিক, মাংসর টুকরো চোখে পড়েনি।

    অ্যামেরিকা মহাদেশ থেকে প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি, বেদের প্রতিস্পর্ধী অবেع¡র জন্মভূমি ইরান মানে পারস্য ইয়ানি কি ইস্পাহান দেশে আসুন। খান কুবিদে। মশলার গরগরে ভাব নেই। সেÐফ পেঁয়াজ-বাটা আর নুন দিয়ে মাখা মাংসর কাবাব যে অমন স্বাদ বের করতে পারে, তা মাইরি না চাখলে বিশ্বাস হবে না। সেই কুবিদেই 'স্যান্দউইচ' বানিয়ে দিতে বলুন। শুকনো ও ঠা¾ডা রুটির মধ্যে কুবিদে, কুচোনো পেঁয়াজ আর টোমেটোর ওপর শুমাক ছড়িয়ে সঙ্গে তুলসীপাতা-টাতা মুড়ে যে জিনিস দেবে সেও তো রোলই। &#১৪৫;¡তি বলে কি স্বজাত নয়? অবশ্য এই কুবিদে স্যা¾ডউইচ একটি বিশেষ দোকানের স«ষ্টি না ইরানে বহুল-প্রচলিত, সে খবর নেওয়া হয়নি। মার্কিনি র‌্যাপেরও তো এই রোল বংশেই জন্ম।

    বনেদি বংশ। প্রাচীনতায় কৌলীন্য না থাক, জনপ্রিয়তায় অনেক শালাকেই হারায়। ব্যাঙ্গালোরে তো 'কাঠি জোন' বলে একটি কর্পোরেট চেনই রমরমিয়ে চলছে। কলকাতা স্টাইল। লোকমুখে খবর পাই উইপ্রোর কিছু লোকের তৈরী চেন। খেয়ে দেখেছি, মন্দ নয়। তবে রান্না মাংস মাইক্রোওয়েভে গরম করে বানানো রোলের বদলে আমি যে কোনদিন তাওয়ায় এপাশ-ওপাশ করা মাংসর রোল বিনাবাক্যব্যয়ে ই®Ø¹মাল করব। আরও একটা ব্যাপার। 'কাঠি জোন' নাম যদিও কাঠি রোল থেকে এসেছে, কিন্তু নামে 'রোল' শব্দ না রাখার প্রতিবাদে আমি নেহাত ঠেকায় না পড়লে 'কাঠি জোন'-এ যাব না স্থির করেছি। প্রমিস।

    পুনশ্চঃ এই মাত্র খবর পাওয়া গেল মুম্বাইতে 'হ্যাংলা' নামক একটি চেনের উৎপত্তি হয়েছে। ২৫ শে জুলাইয়ের নিউ ইয়র্ক টাইমসের টÐÉ¡ভেল সেকশনের গ্লোবস্পটার পশ্য। দেখার ব্যাপার এই যে সেখানে কিন্তু ঐসব সস-টসের আড়ম্বর ছেড়ে শুধু লেবুর রস, পেঁয়াজ কুচো, কাঁচালংকা আর নুন দেওয়া হচ্ছে মাংসর সঙ্গে। পুরানো সেই দিনের কথা ।।।

    অলঙ্করণঃ সায়ন কর ভৌমিক

    ৯ আগস্ট, ২০১০
  • π | ***:*** | ২৬ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:৩৫89253
  • সিকি, মূল লেখাটা পাঠালাম। দেখে নিও।
  • b | 162.158.***.*** | ২৬ মার্চ ২০২০ ১৩:১৮91775
  • তুললাম।
  • ন্যাড়া | ২৭ মার্চ ২০২০ ০৮:২৭91806
  • এইটা কেন উঠল, কে জানে। কিন্তু এইটা পড়ে প্রবল হেসেছি - "ধরুন টেংরি-মেংরি;"। টেক্স-মেক্স (টেক্সাসের মেক্সিকান খাবার) যে কী বর্ণবিপর্যয়ে টেংরি-মেংরি হয়ে যায় জানিনা।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন