জুলাই ১৮-র হিন্দুস্তান টাইমসের Brunch পত্রিকায় ভির সাংভি কাঠি রোল সম্বন্ধে কটা কলাম লিখেছেন। যার নাম চালভাজা, তার নামই মুড়ি। আমরা কলকাতার লোকেরা যাকে রোল নামে জানি, বৃহত্তর ভারত জানে 'কাঠি রোল' বলে। সাংভিবাবুর মতে কাঠি রোল আসল ভারতীয় স্যান্ডউইচ। স্যান্ডউইচ কি না-স্যান্ডউইচ এই ব্যাপারে আমার বিশেষ কোন বক্তব্য নেই। সাংভি যে 'খ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর' স্টাইলে কাঠি রোলের উৎস-সন্ধান করে মরেছেন, সে ব্যাপারের আমার দু পয়সা দেবার আছে।
চট করে ভির সাংভির মোটিভটা বলে দিই। সাংভি খুব সৎভাবে স্বীকার করেছেন যে খ্যাপা পরশপাথর শেষ অব্দি খুঁজে পায়নি। তবে মোটামুটি কলকাতার নিজাম অথবা দিল্লির মোতি মহল কী খান চাচা - এদের মধ্যে একজন কাঠি রোলের জনক। এরকমও হতে পারে যে হয়তো যে এই দুই জায়গাতেই কাঠি রোল আলাদা আলাদাভাবে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছে। খুবই সম্ভব। কারণ বর্ণনা শুনে যা মনে হল (দিল্লি যাইনি, তাই দিল্লির রোল খাইনি) দেখতে এবং খেতে এ দু'জায়গার রোলই একই ধরণের হলেও, আসলে মাল আলাদা। প্রথমতঃ কলকাতার রোল পরোটা দিয়ে তৈরী, দিল্লিতে বানায় রুমালী রুটি মুড়ে। কলকাতার রোলের ভেতরের মাংস কাঠি কাবাব, ঝলসানো (গ্রিল করা) মাংসর টুকরো, রোলে ঢোকাবার আগে তাওয়ায় তেলে ভাজা হয়। সেখানে দিল্লির রোলের ভেতরে তন্দুরি মাংস পোরা হয়।
দিল্লির রোলের ভেতরে মাংসর সঙ্গে গারনিশিং হিসেবে কী দেয় জানিনা। কলকাতায় পড়ে পেঁয়াজ কুচো, শশা-বীট-গাজর কুচোনো, কাঁচালংকা, টম্যাটো সস, চিলি সস। সসের আমদানী বছর পঁচিশেক আগে। তার আগে সসের বদলে পড়ত লেবুর রস। নিজামে বোধহয় ভিনিগার দিত। বীট-গাজরও তুলনামূলকভাবে হালের আমদানী। সসের সঙ্গেই, কী আরও পরে। বাল্যকালের নিজামের আমার যা স্মৃতি তাতে বসে-খেলে খাওয়া হত আন্ডা পরোটা আর কাবাব। কাবাব অবশ্যই গরুর মাংসর। সঙ্গে স্যালাড বলে যা আসত তা হল এক প্লেট কুচোনো পেঁয়াজ। টেবিলে প্লাস্টিকের বাটিতে নুনের পাশে থাকত ভিনিগারের বোতল। স্যালাডে ভিনিগার ঢেলে মুখরোচক করে নেওয়া হত। আন্ডা পরোটার বদলে প্লেন পরোটাও থাকত সময়ে সময়ে। এখন ভেবে দেখলে, নিজামের রোল কিন্তু একদম এই জিনিস দিয়ে তৈরী। আলাদা আলাদা আসার বদলে এক মোড়কে এলেই হয়ে গেল নিজামের রোল। কাজেই কলকাতায় রোলের সৃষ্টিতে নিজামের ক্লেম বেশ স্ট্রং।
এই প্রসঙ্গে অন্য এক স্মৃতিচারণ খুব বেমক্কার হবে না। নিজামের ঠিক পাশে আরও দুটি কাবাব-পরোটার দোকান ছিল। নাম ছিল বিহার আর ইউপি। মাক্কালী। কলকাতার পুরোনো কোন খাদ্যরসিক থাকলে জিগেস করে নেবেন। খাদ্যরসিক যাঁরা অলিগলি সুলুকসন্ধান রাখতেন। নিউ মার্কেট ভেতরে নাহুম-টাহুম পেরিয়ে, সেমুইয়ের স্টলের গা ঘেঁষে যদি মিনার্ভা, মানে এখনকার চ্যাপলিন, সিনেমার দিক দিয়ে বেরোতেন তাহলে ঐ নিউ মার্কেটের গেট আর নিজামের মাঝে ছিল বিহার আর ইউপি। তো আমার প্রথম রোল খাওয়ার স্মৃতি বিহার-ইউপি। পুজোর বাজার-টাজার করার মতন কোন সপরিবার উপলক্ষ্যে। যদ্দূর মনে পড়ে সেও নিজামের মতনই। সে দোকান এখন আছে কিনা জানিনা। থাকলেও যে আর সে রবরবা নেই, তা তো বোঝাই যাচ্ছে।
আসলে তখন কলকাতা শহরে রোলের দোকান বলতে সবেধন ঐ দু-তিনটিই। বিশেষ বিখ্যাত। পরবর্তীকালের স্টলওয়ার্টরা - যেমন লিন্ডসে স্ট্রিটের বাদশা কি গড়েহাটার বেদুইন - তখনও মাতৃগর্ভে। রোলের দোকান ছড়াতে শুরু করল সত্তরের মাঝ-শেষ থেকে। আমরা তখন কলকাতার প্রান্তবাসী। থাকি লেক টাউনে। প্রথম রোলের দোকান হল অন্নপূর্ণা-নিউ অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভান্ডারের লাইনে, হাঁড়ি কলসীর দোকানে একটু আগে। সে বোধহয় ৭৭-৭৮ সাল। ঠেলা নয়। একদম ফুল-ফ্লেজেড মাথায় ছাতওলা দোকান। ধবধপে সাদা ময়দার লেচি লাল শালুতে চাপা দেওয়া থাকত সানমাইকার কাউন্টার-টপে। দেখলেই মন আনচান করে উঠত। রোল বানাতে সময়ও লাগত তখন। এখনকার মতন দড় হয়ে ওঠেনি রোল-বানিয়েরা। আর কদিন পরেই লেক টাউনের দ্বিতীয় দোকান খুলল। জয়া সিনেমা থেকে একটু এগিয়ে ট্যাংকের গোল চক্করে সাঁই ব্রাদার্সের পাশে। বোঝা গেল বাংলায় রোল যুগ এসে পড়েছে।
তারপর তো রোল শুধু রোল। ঠেলাগাড়িতে পাড়ার মোড়ে মোড়ে। বেকার স্বল্পশিক্ষিত যুবকদের লেজিটিমেট ও চালু বিজিনেস মডেল। (মহিলা রোল-বানিয়ে দেখিনি কিন্তু কভু।) শুধু রোল চলল ক' বছর। তারপর ডাইভার্সিফিকেশনের বাজারে রোলের সঙ্গে এল নানান ধরণের চপ, আলু টিকিয়া এবং সব শেষে বাঙালীর কালজয়ী অবদান, 'চাইনিজ ফুড'।
যাদবপুরের এইট-বি বাসস্ট্যান্ডের সামনে সার দিয়ে যে চার কী পাঁচজন রোলওলা বসতেন, তারা যাদবপুরের ছাত্রদের দৈনান্তিক সর্বগ্রাসী খাই-খাইয়ের টোটকা হিসেবে আলু রোলের উদভাবন করেছিলেন। সেদ্ধ, চটকানো আলু গোল করে টিকিয়ার মতন করা থাকত। মাংসর বদলে রোলের পুর হিসেবে সেই চালনো হত। সস্তা এবং পেট-ভরানো। পপুলার ছিল এগ-পোটাটো। তাছাড়া আলু বিশেষ চলেছিল বলে মনে হয় না। পরে অন্য কোথাও দেখিনিও।
রোল, মানে রুটির মধ্যে মাংসর পুর - এই কনসেপ্টের একটা সর্বজনীনতা আছে সেটা খেয়াল করেছেন? ধরুন টেংরি-মেংরি; (টেংরি সের মেংরি কান, খাঁটি মেংরি কোর মেংরি কান খাবার নয়) 'বারিটো' বা 'বুরিতো' - যা অ্যামেরিকায় বিশেষতঃ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের রাজ্যগুলোয় গোগ্রাসিতমা১৫৬;¡য় জনপ্রিয় - সেও তো আদতে রুটির মধ্যে মাংসর পুর। রুটিটা মেংরি;কান টোর্টিয়া, ময়দার। পুরে মাংসর সঙ্গে রয়েছে ভাত ও সব্জি, বিশেষতঃ অ্যাভেকাডো দিয়ে তৈরি য়াকামোলি। মাংস কিমাও হতে পারে, চাকলিও হতে পারে। খোবা, কলকাতার রোল-মাফিক, মাংসর টুকরো চোখে পড়েনি।
অ্যামেরিকা মহাদেশ থেকে প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি, বেদের প্রতিস্পর্ধী অবেদার জন্মভূমি ইরান মানে পারস্য ইয়ানি কি ইস্পাহান দেশে আসুন। খান কুবিদে। মশলার গরগরে ভাব নেই। স্রেফ পেঁয়াজ-বাটা আর নুন দিয়ে মাখা মাংসর কাবাব যে অমন স্বাদ বের করতে পারে, তা মাইরি না চাখলে বিশ্বাস হবে না। সেই কুবিদেই 'স্যান্দউইচ' বানিয়ে দিতে বলুন। শুকনো ও ঠাণ্ডা রুটির মধ্যে কুবিদে, কুচোনো পেঁয়াজ আর টোমেটোর ওপর শুমাক ছড়িয়ে সঙ্গে তুলসীপাতা-টাতা মুড়ে যে জিনিস দেবে সেও তো রোলই। বেজাতি বলে কি স্বজাত নয়? অবশ্য এই কুবিদে স্যান্ডউইচ একটি বিশেষ দোকানের সৃষ্টি না ইরানে বহুল-প্রচলিত, সে খবর নেওয়া হয়নি। মার্কিনি র্যাপেরও তো এই রোল বংশেই জন্ম।
বনেদি বংশ। প্রাচীনতায় কৌলীন্য না থাক, জনপ্রিয়তায় অনেক শালাকেই হারায়। ব্যাঙ্গালোরে তো 'কাঠি জোন' বলে একটি কর্পোরেট চেনই রমরমিয়ে চলছে। কলকাতা স্টাইল। লোকমুখে খবর পাই উইপ্রোর কিছু লোকের তৈরী চেন। খেয়ে দেখেছি, মন্দ নয়। তবে রান্না মাংস মাইক্রোওয়েভে গরম করে বানানো রোলের বদলে আমি যে কোনদিন তাওয়ায় এপাশ-ওপাশ করা মাংসর রোল বিনাবাক্যব্যয়ে ইস্তেমাল করব। আরও একটা ব্যাপার। 'কাঠি জোন' নাম যদিও কাঠি রোল থেকে এসেছে, কিন্তু নামে 'রোল' শব্দ না রাখার প্রতিবাদে আমি নেহাত ঠেকায় না পড়লে 'কাঠি জোন'-এ যাব না স্থির করেছি। প্রমিস।
পুনশ্চঃ এই মাত্র খবর পাওয়া গেল মুম্বাইতে 'হ্যাংলা' নামক একটি চেনের উৎপত্তি হয়েছে। ২৫ শে জুলাইয়ের নিউ ইয়র্ক টাইমসের ট্র্যাভেল সেকশনের গ্লোবস্পটার পশ্য। দেখার ব্যাপার এই যে সেখানে কিন্তু ঐসব সস-টসের আড়ম্বর ছেড়ে শুধু লেবুর রস, পেঁয়াজ কুচো, কাঁচালংকা আর নুন দেওয়া হচ্ছে মাংসর সঙ্গে। পুরানো সেই দিনের কথা ...
অলঙ্করণ সায়ন কর ভৌমিক
৯ আগস্ট, ২০১০