ফ্রান্স দেশটা চারদিক থেকে অনেক গুলো দেশ দিয়ে ঘেরা -- বেলজিয়াম, জার্মানী,সুইজারল্যান্ড, ইতালি,স্পেন। ইতিহাসের অনেক গুলো পাতা উল্টে গেলে দেখবেন এই সব দেশ থেকেই কখনো না কখনো মানুষের পা এসে পড়েছে ফরাসী দেশের ধুলোয়। কাজেই তাদের সাথে তাদের খাবারের স্বাদও যে আসবে তা তো জানাই কথা। যীশুর জন্মের ১৫০০ থেকে ৫০০ বছর আগে বারে বারে এসেছে সেল্টিক গল জাতি। ওদের চাষবাসের ধারা বুনে দিয়ে গেছে এখানে। তারপরে ধরুন ৫৬ খৃষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ এলো রোমানরা। তাদের সঙ্গে এলো মাংস ঝলসানোর রেওয়াজ, চীজ তৈরীর কায়দা কানুন। ৭১৮ সালে স্পেনীয় অভিযাত্রীদের সঙ্গে এলো সেখানকার স্বাদ আর রান্নার ধরণ ধারণ,আর মধ্যযুগে যখন মশলা বণিকরা দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াতো তখন তাদের ঝুলি থেকে এদেশের বাজারে এসে নামলো জিরে, শাজিরে,গোলমরিচ, অ্যানিস,দারচিনি, আদা, গালাংগাল। জার্মানী থেকে যারা এসেছিলো তারা সঙ্গে করে আলু, সসেজ,বীট খাবার অভ্যেসটি আনতে ভোলেনি, আবার ফ্রেঞ্চ নাইটরাই আরব দেশ থেকে নিয়ে এসেছিলো বাদামবাটা আর চাল দিয়ে ঝোল ঘন করার কায়দা।
আজকে সারা দুনিয়ায় যা ফ্রান্সের 'গ্রাঁ কুইজিন' ব'লে বিখ্যাত সেই রাজকীয় ঘরানার রান্নার সূত্রপাত হয়েছিলো ইতালির ফ্লোরেন্সের রাজকুমারী ক্যাথরিন দ্য মেদিচি যখন 'দ্বিতীয় অঁরি'কে বিয়ে করে ফ্রান্সে এলেন। সেটা ১৫৫৩ সালের কথা। নতুন বৌ সঙ্গে করে এক দল ইতালিয়ান শেফ নিয়ে এসেছিলেন। ওঁদের হাত ধরে এসেছিলো নানান রান্না, রান্নার নানান তরিকা,আর খাবার নানা রকম কায়দা।
রান্নার ধরণ-ধারণের দিক দিয়ে যদি দেখেন তো মোটামুটি চার ভাগে ফরাসী কুইজিনকে ভাগ করা যায়। এক হলো 'কুইজিন বুর্জোয়া'। নাম শুনে ঘাবড়ে যাবেননা ভাই, এ হলো আসলে যাকে বলে 'ক্লাসিক ফ্রেঞ্চ' রান্না। এই ঘরানার খাবারদাবার বেশির ভাগই ক্রীম দেওয়া স্যসের রকমফের। এই বুর্জোয়া রান্না যখন রাজকীয়তা আর আভিজাত্যের চরমে ওঠে তখন তার নাম হয়ে যায় 'অত্ কুইজিন'। সে রান্নার মত 'রিচ' কম জিনিষই আছে। আর এই ঘরনায় শুধু রাঁধলেই হলোনা, খাবার কেমন ভাবে সাজানো হচ্ছে তার গুরুত্বও কম নয়। তবে ফরাসীরা শুধু ভারী আর ক্রীমী খাবারদাবার খান ভাবলে কিন্তু আপনি ভুল করছেন। সহজিয়া হাল্কা খাবারের স্টাইল নিয়ে দিব্যি হাজির আছে 'কুইজিন নুভেল' বা নতুন ধারার রান্না। আধুনিক ফরাসী রন্ধনশিল্পের অনেকখানি জুড়ে এর অবস্থান। আর আছে 'কুইজিন দু তেরওয়ার'। এতে তাজা লোকাল সব্জি দিয়ে কিছুটা 'রাস্টিক' স্টাইলে রান্না করা হয়।
লম্বা লাঠির মত বেগ্যেত রুটি, মাখনে ম্ম্ম্ ক্রোয়াসঁ পেস্ট্রি,ওয়াইনে জরানো এসকার্গো শামুক, মুর্গি আর লালমদের স্ট্যু 'কক ও ভ্যাঁ',মেঘের মত হাল্কা মিষ্টি ম্যুস, মখমলি ক্রীম ব্রুলে .... ফরাসী খাবারের গপ্পো নিয়ে একখানা আস্ত 'বৃহৎ গল্পকথা' লিখে ফেলা যায়। অতখানি পাতা নষ্ট করা আজ আর সম্ভব হচ্ছেনা ভাইজান, বরং সে অন্য কোনদিন হবে। আজ শুধু সেই দুই জিনিষের কথা ছুঁয়ে যাই যাদের ছাড়া ফ্রেঞ্চ কুইজিনের কথা ভাবাই যায়না। তার একটি হলো চীজ। চীজ এদেশে শুধু রান্নাতেই দেওয়া হয় তা নয়। চীজের কৌলীন্য এখানে একটা আলাদা কোর্সের জায়গা করে নিয়েছে। মূল খাবারের পরে মিষ্টি দেবার আগে পরিবেশন করা হয় এই চীজ কোর্স। রকফোর্ট, ব্রী,মর্বিয়েয়র,শেভার্স আরো কত রকম যে তাদের নাম, কত রকম যে স্বাদ, গন্ধ আর টেক্সচার তা বলে শেষ করা যাবেনা। তারপরে সেই নীলচে শিরার মত ছাতাধরা ব্লু চীজ, মাশরুমের মত উমামী স্বাদের নরম ক্যামেম্বেয়র চীজ, ফল আর বাদাম মেলানো স্বাদের শক্তপানা গ্রুয়ের চীজ.... উ: নিজেকে ইঁদুরের মত লাগে আমার।
আর আর এইবার... সেই দ্বিতীয় জিনিষটি হলো .... যা বলেছেন, ফরাসী ওয়াইন। এদেশে সব চাষের মধ্যে আঙুরের চাষ হলো প্রধান। কাজেই দ্রাক্ষাসবের রমরমা হবে না তো কি? ওয়াইন এখানে খাবারের মূল সঙ্গত হিসেবে ধরা হয়। ঠিক মত ওয়াইন না হলে খাবারের পুরো স্বাদ পাওয়া যায় বলে এঁরা মানতে চান না। রোজকার খাবারের সাথে হয়তো একটাই ওয়াইন দেওয়া হয়, লাল বা সাদা, কিম্বা রোজে। তবে তেমন তেমন ভোজে প্রত্যেকটি পদের সাথে আলাদা ওয়াইন পরিবেশন হয়। শ্যাম্পেন, মার্লো, স'ভিনিয়ঁ ব্লঁ,দমপিরিনিয়ঁ এমন কটা নাম তো সবাইই শুনেছেন,কিন্তু সত্যি কথা জানেন কি ভাই? ফরাসী ওয়াইন সুন্দরীদের রূপবর্ণনা করা.... বাপ রে, তার স্পর্ধা এই নাচীজের নেই। স্বয়ং সাহিত্য সম্রাট 'আয়েষার' রূপ বর্ণনা করিতে পারেননি। ফরাসী ওয়াইনও রন্ধনসাহিত্যে 'আয়েষা'ই।
বেশ, ফ্রেঞ্চ খাবারের রাহান সাহান, হাল হকিকৎ এর খবরাখবর তো সব জানা হলো। এবার একটু তুলি কলম হাতে ধরা যাক চলুন। আজকে আমরা বানাবো ক্রেপ সুজেৎ। ডেজার্ট। এর জন্যে আপনার প্রথমেই লাগবে এক কাপ ময়দা। এর মধ্যে এক চিমটি নুন মিশিয়ে একটু চেলে নিন। এবারে মধ্যিখানে একটা গর্ত করে তার মধ্যে ভেঙে দিন দুটো ফেটানো ডিম। এবারে দুধ লাগবে এক কাপ পুরো ভর্তি আর আরো ১/৪ কাপ। ময়দা-ডিমের মধ্যে এবারে অল্প অল্প করে দুধটা মেশান। সমানে নাড়তে থাকবেন যাতে দলা না পাকায়। এবারে দুই বড় চামচ গলানো মাখনও দিন এতে। ভালোভাবে মিশে গেছে তো? এবারে এক চা চামচ ভ্যানিলা দিয়ে দিন দেখি।
একটা ফ্রাইপ্যান বসান মাঝারী আঁচে। এক টুকরো পরিষ্কার কাপড় সামান্য সাদা তেল এ ডুবিয়ে নিন। এবার ঐ কাপড় দিয়ে মুছে নিন প্যানটা। মানে জাস্ট তেল বোলানো হলো আর কি। এবার ৩ বড় চামচ গোলা ঢালুন। ঢেলেই চট করে প্যানটা কাৎ করে ঘুরিয়ে নিন, যাতে পুরোটা জুড়ে গোলাটা বেশ পাতলা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এক মিনিট পরে চ্যাপ্টা খুন্তি দিয়ে সাবধানে উল্টে দিন। এই পিঠটা ভাজা হবে তিরিশ সেকেন্ড মত। এবার তুলে অন্য প্লেটে রাখুন। এই মাপে সাত আটটা হবে। প্রথম ক্রেপটা অনেক সময় ভেঙে যায়, তাতে ভয় পাবেননা। কচুগাছ কাটতে কাটতেই তো লোকে ডাকাত হয়।
ভাবছেন তো ডেজার্ট অথচ চিনির নামগন্ধ নেই কেন? আসছে আসছে। ক্রেপ তো ভাজা হলো। এবার এর সুজেৎ অংশ করতে হবে। সেইটিই মিষ্টি এবং ফরাসীমাত্রায় রিচ। তার জন্যে আপনার লাগছে ৩/৪ কাপ চিনি আর এক কাপ মাখন। মাখনটা গলিয়ে নিন। অথেন্টিক ক্রেপ সুজেতে গ্রামনিয়েঁ আর কনিয়াক এইসব দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা আগেই বলেছি ওসব খটোমটো দুÖপ্রাপ্য জিনিষের সাথে আমাদের কারবার নেই। অতএব আপনি তার বদলে নিন একটা গোটা কমলালেবুর খোসা কোরানো। সাবধান, কোরানোর সময় কিন্তু শুধু কমলা অংশটাই নেবেন,খোসার ভেতরদিকের সাদা অংশ নিলে কিন্তু তেতো হয়ে যাবে। এইবার এই খোসা কোরানোর সাথে গলানো মাখনটা মিশিয়ে নিন ভালো করে। এবার এক একটা ক্রেপের দুপিঠে বেশ ভালো করে এটা মাখান। তারপরে একটা প্লেটে রেখে ওর ওপরে ছড়িয়ে দিন চিনি। এবারে ভাঁজ করে নিন চারপাট করে। আর যদি ভাবেন যে অত মাখন খাবোনা, ফ্যাট হবে, কোলেস্টেরল বেড়ে যাবে ইত্যাদি ...... তাইলে স্রেফ জ্যাম বা জেলির পুর দিয়ে পাটিসাপ্টার মত রোল করে নিতে পারেন। বা জ্যাম-জেলিটা ক্রেপের আধখানায় রেখে আধ খানা চাঁদের মত ভাঁজ করতে পারেন। তবে তখন তাকে আর ক্রেপ সুজেৎ বলা চলবেনা। জ্যামের পুর দেওয়া ক্রেপ বলেই ডাকতে হবে। তা হোক, তাতে কি?
** শেষবেলায় একটি কথা ব'লে যাই। আমি ফরাসী ভাষা ততটাই জানি যতটা জক পাপ্যাঁ বাংলা জানেন, কাজেই বাংলা হরফে উচ্চারণ লিখতে গিয়ে নিঘ্ঘাত হাজার গন্ডা ভুল করে বসে আছি। নিয়ামতের আর্জি রইলো -- পাঠকভাই, নিজগুণে একটুকু ক্ষমাঘেন্না করে দিন।