মধ্য-এশিয়ার ভবঘুরে দলের সাথে যা এসেছিলো তা হলো গরু, ভেড়া, ছাগলের মাংস খাবার চল। মাটি খুঁড়ে গর্ত বানিয়ে তাইতে আগুন করে আবার চাপা দিয়ে ওরা বানাতো 'তন্দির'। তাতেই রান্না হতো। আবার খোলা উনুনে কাঠকয়লার আগুনে মাংস ঝলসানোরও রেওয়াজ ছিলো। সেই খাবারের নাম হলো 'কেবাব'। আজ্ঞে হ্যাঁ, তন্দুর আর কাবাব বৈ কি? আবার মাংস ছোট টুকরো করে, তার নিজের চর্বিতেই রেঁধে নুন দিয়ে জারিয়ে মাটির পাত্রে রেখে দেওয়া হত শীতের দিনের জন্য। তার নাম 'কাভুরমা'। ভারী জনপ্রিয়তা তার। আর ছিলো নুন-মশলা দিয়ে রোদে শুকিয়ে রাখা 'শুঁটকী মাংস' বা 'পাস্তিরমা'। ছিলো বলছি কেন, এখনও সেসব খাবার আছে,দিব্যি আছে। ঐ ভাবেই রান্না হয়,অমনিই সুস্বাদু। দুধ,সর, দই এসব খাবারের চলও সেই মধ্য-এশিয়ার যাযাবরদের সাথেই এসেছে। গরু নয়, ঘোড়ার দুধের অভ্যেস ওদের। তা মন্দ কিছু নয়, কারণ এতে ভিটামিন সি আছে গরুর দুধের চারগুণ বেশি। ঘোড়ার দুধের সর, আগুনে ফুটিয়ে রোদ্দুরে শুকিয়ে বানানো দুধের গুঁড়ো, দুধ গেঁজিয়ে বানানো 'কিমিজ' মদ তুর্কি কুইজিনে রমরমিয়ে ছেয়ে আছে।
মধ্যপ্রাচ্যের স্বাদের কথাও বলছিলাম না? আরব, ইরান, পারস্যের প্রভাব দেখবেন দক্ষিণ আর দক্ষিণ-পুর্ব আনাতোলিয়ায়। মশালাপাতি, লঙ্কা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, পার্সলে পাতা এইসব এসেছিলো পার্সী,হিতাইত, আর বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের থেকে। সব্জি-মাংস দিয়ে ঝোল বা 'ইয়াখনি',কেবাব,পিলাভ (ইরানে বলে পুলাও) এ'সবই তো ইরানী খাবারের বংশোদ্ভুত।
দূর প্রাচ্যেরও কিছু কিছু প্রভাব দেখবেন তুর্কির খানায়। চীন আর মঙ্গোলিয়া থেকে এসেছে বাড়িতে বানানো নুড্ল ধরণের খাবার। দুনিয়া জুড়ে টার্কিশ রেস্তোরাঁয় শুনতে পাবেন 'মান্তি' ব'লে এই রকমই এক নুড্ল জাতীয় খাবারের নামডাক। এর বানান মান্তি হলেও উচ্চারণে কেউ ডাকে 'মান্তাহ্', কেউ বলে 'মান্তু', ঠিক যেন বাড়ির আদরের মেয়েটি, না?
তবে তুর্কিদেশে রান্নাশিল্পের সবচাইতে বেশি রমরমা হয়েছিলো অটোমান সাম্রাজ্যের আমলে, সপ্তদশ শতাব্দীতে। এই বংশের সুলতানরা ছিলেন সত্যিকার স্বাদের সমঝদার,রান্নাঘরকে সভাঘরের থেকে ওঁরা কিছু কম গুরুত্ব দেন নি। প্রায় তেরোশো জন রান্নাবিশারদ কাজ করতেন সুলতানী পাকশালায়। সুলতানরা এমন অনেক মশলা,সব্জি, সুগন্ধী গাছগাছড়া, মাছ-কাঁকড়া, ফলমূল আমদানি করতেন যা আগে কোনদিন তুর্কিস্তানের মুখ দেখেনি। অলিভতেল, জিরে, ধনে, পুদিনাপাতা,সর্ষে, জাফরান, গোলমরিচ যেমন স্বাদের আসরে জাঁকিয়ে বসেছিলো, তেমনি মিষ্টির ফরাশে দিব্যি জায়গা করে নিয়েছিলো আঙুর থেকে তৈরী গুড় আর মিষ্টি সিরাপ,মেওয়া আর বাদাম।
এদেশের খাবারদাবার নিয়ে বলতে বসলে আমার কলমে কালি, খাতায় কাগজ, কম্পিউটারের বাইট স-ব কম পড়বে তবু গল্প আর ফুরোবে না। এই দেখুন, এত কিছু বলার পরেও এই যে তুর্কিদেশের নরম ফুলোফুলো 'ইয়ুফকা একমেক' রুটির কথা বলতে বাকি রয়ে গেলো। আবার রুটির কথায় এসে এও বলা হলো না যে শুধু গ্রীক গোল-রুটিই নয় আরো কত গ্রীক স্বাদের প্রভাব আছে তুর্কির কুইজিনে। তাছাড়া বকবক শুনতে শুনতে কি আপনারও পেটে এতক্ষণে ছুঁচোরা হাডুডু খেলা শুরু করে দেয়নি? আচ্ছা, তাহলে বেশি কথা থাক, আসুন বরং দেখি আজ কী বানানো যায়। হুম্, হুম্..... হ্যাঁ হয়েছে। আসুন আজ বানানো যাক কোফ্তে। নাম শুনে ঠিকই চিনেছেন ভাইজান। এ হলো আমরা যাকে কোপ্তা বা কোফ্তা বলে জানি। মাংসের বড়া। তবে কোফ্তের রকমফেরও কম নয় তুর্কিমুলুকে। এই তো দেখুন না ডুবো তেলে ভাজা 'কুরু কোফ্তে',কাঁচা মাংসের বড়া 'সিগ কোফ্তে',স্যসের মধ্যে রান্না করা 'ইজমির কোফ্তে',মাংসের সাথে চীজ দিয়ে গড়া 'কাসারলি কোফ্তে'। কিন্তু সবার চাইতে বেশি আমার পছন্দ হলো 'কাদিনবুদু কোফ্তে'। টার্কিশ খাবারের মধ্যে এই কাদিনবুদু কোফ্তের কদর বেশ। মানে যাকে বলে গিয়ে পালে পার্বনে খাবার মত। আর তাছাড়া এর মানেটিও ভারী রোম্যান্টিক। কাদিনবুদু কোফ্তের বাংলা করলে হয় 'রমণী-উরু কোফ্তা'। কেন অমন নাম তা আর আমাকে জিজ্ঞেস নাই বা করলেন! বরং চলুন এবার হাতেকলমে করে দেখা যাক কেমন হয় আমাদের টার্কিশ টিউসডে'র প্রজেক্ট।
তা এই সেন্সুয়াল কোফ্তা তৈরী হয় গরুর মাংসের কিমা দিয়ে। আটপৌরে বাড়িতে আমরা চিকেনের কিমা দিয়েই করব। বা আপনার ইচ্ছে হলে মাট্ন্ কিমাও নিতে পারেন। এই ধরুন সাড়ে চারশো থেকে পাঁচশো গ্রাম। আর লাগবে আধ কাপ চাল, একটা বড় পেয়াঁজ, আর .... আচ্ছা, বরং ধাপে ধাপেই এগোই।
জলে একটু নুন দিয়ে চাল সেদ্ধ করে ভাত বানিয়ে রাখুন। একটা কড়াইয়ে কিমার তিনভাগের দু'ভাগ দিয়ে মাঝারী আঁচে উনুনে বসান। আরে না, তেল টেল দিতে হবেনা। এমনিই বসান। ওর মধ্যে মিশিয়ে দিন বেশ খানিকটা গোলমরিচ আর খানিক রসুনবাটা। নাড়তে থাকুন। কিমা থেকে জল বেরিয়ে আবার তা শুকিয়ে কিছুটা বাদামী রং ধরবে। এই বারে পেয়াঁজটা বেশ মিহি করে কুচিয়ে ওতে দিয়ে দিন। আঁচ আরো কমিয়ে রাখুন। যখন দেখবেন পেঁয়াজ একেবারে নরম হয়ে গেছে তখন নুন,আর এক চামচ জিরে গুঁড়ো মিশিয়ে উনুন থেকে কড়াই নামিয়ে নিন। এর মধ্যে বাকি কাঁচা কিমা আর ভাতটা মেশান। এক বড় চামচ মত পুদিনা পাতার কুচি মেশান। এবারে বেশ চটকে মেখে নিন। এইবারে এর থেকে একটু লম্বাটে চ্যাপ্টা, অনেকটা বেগুনীর আকারে কোফ্তা গড়ে নিন। এই মাপে গোটা দশেক হবে।
এইবারে দুটো ডিম ফেটিয়ে একটা বাটিতে রাখুন। আর একটা থালায় নিন কিছুটা ময়দা। চ্যাপ্টা প্যান বা তাওয়া বসান আগুনে। একটা করে কোফ্তা নিয়ে প্রথমে ময়দার ওপরে গড়িয়ে নিন যাতে সারা গায়ে বেশ ময়দা মেখে যায়। এবার ওকে ডিমের গোলায় ডুবিয়ে নিয়ে তাওয়ায় অল্প তেল ছড়িয়ে তার মধ্যে বসিয়ে দিন। একেক বারে চার পাঁচটা করে কোফ্তা দু পিঠ বেশ সোনালী-বাদামী হওয়া অব্দি ভেজে তুলুন। সঙ্গে খাবার জন্য কেটে নিন পেঁয়াজ-টমেটো-লেটুশের স্যালাড।
বা: এই তো। এবার এই রমণীয় কোফ্তার থালা সামনে রেখে একটু চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো। ঐ তো বসফরাস প্রণালীর হাওয়া এসে কপালে লাগছে। বুক ভরে বাতাস নিন -- হাওয়ায় টার্কিশ কফির টাটকা গন্ধ, আঙুরপাতার গন্ধ। কান পেতে শুনুন দেখি, স্পষ্ট শুনতে পাবেন ভুমধ্য সাগরের নীলচে সবুজ জল পাথরে আছড়ে পড়ছে আর সুলতানি পাকশালায় মস্ত মস্ত পাত্রে ঠোকাঠুকি লেগে ঠংঠাং শব্দ উঠছে। ঐ সুলতান দ্বিতীয় মেহেমেতের ভোজঘরের দরজা খুলে গেলো, ঐ যে সার বেঁধে এগিয়ে আসছে তেরোশো পাচকের শিল্পে রসিয়ে ওঠা তেরোশো থালি। কী? পাচ্ছেন না?