এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  টুকরো খাবার

  • সাদার্ন সানডে

    নিয়ামৎ খান লেখকের গ্রাহক হোন
    টুকরো খাবার | ১৯ জানুয়ারি ২০১১ | ১২৪১ বার পঠিত
  • সাদার্ন সানডে : জাম্বালায়া

    আমাদের কুলিনারী ভ্রমণ শেষ হয়ে আসছে। আজ তো রবিবার,ছুটির দিন। দেশ বিদেশ ঘুরে ঘুরে ক্লান্তও হয়েছি কম নয়। তাই বরং এ যাবৎকাল যেখানে আমি রয়েছি আজ সেই অঞ্চলের খাবারের কথা বলা যাক। কুইজিনের অভিধানে একটা বিশেষ জায়গা দখল করে 'সাদার্ণ ফুড'। অর্থাৎ কিনা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ দিককার রাজ্যগুলো, এই কেন্টাকী, নর্থ আর সাউথ ক্যারোলাইনা, টেনেসী, অ্যালাবামা, জর্জিয়া, লুইসিয়ানাতে যেসব রান্নাবান্না হয় সেই।এককালে এই অঞ্চলে নানাদেশের লোক এসে আদি আমেরিকার মূলস্রোতে মিশে গেছিলো। এখানের খাবারেও দেখতে পাবেন সেই নানান দেশের স্বাদের মিশেল। একটা বিশাল হাঁড়িতে ফরাসী, স্কট, আইরিশ,স্প্যানিশ, ইংলিশ,আফ্রিকান স্থানীয় আমেরিকান উপজাতি সব্বার কুইজিন বেশ অল্প আঁচে অনেকক্ষণ ধরে ফুটে গাঢ় হয়ে এই সাদার্ণ ফুডের স্বর্গীয় স্বাদ তৈরী করেছে জানেন তো? যেমন তেমন ব্যপার নয় এই সাদার্ণ খাবার। খাবারের মধ্যেই ঐ সব দেশের সংস্কৃতি ধরা আছে। আর আছে মুঠো মুঠো আন্তরিকতা। মা ঠাকুমারা যেমন ভরপুর ভালোবাসা দিয়ে রান্না করতেন সেই স্বাদ হুবহু পাবেন এই খাবারে। সত্যি বলতে কি সাদার্ণ ফুডের এক একটা রেসিপি দিদিমা ঠকুমারা যত্ন করে উত্তরাধিকারীদের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন, অনেক জেনারেশন ধরে।

    এ অঞ্চলের খাবারে শুয়োরের মাংস আর ভুট্টার ব্যবহার খুব। শুরুতে যেসব দল এখানে উপনিবেশ গড়েছিলো তাদের সাথেই এসেছে। সে যুগে এখানের রেড ইন্ডিয়ানরা ওদের শিখিয়েছিলো কেমন করে খোলা আগুনে রান্না করতে হয়। সেই বার্বিকিউয়ের ট্র্যাডিশন তো আজও দাপটে রাজত্ব করছে এখানে। শুধু কি তাই? বার্বিকিউকে আরো সুস্বাদু করার জন্য তৈরী হয়েছে কত রকম স্যস, তরল ম্যারিনেড, শুকনো ম্যারিনেড। 'শুকনো ম্যারিনেড' শুনতে একটু অবাক লাগছে, না? জিনিষটা আসলে নানা রকম মশলা গুঁড়োর মিশেল, এরা বলে 'ড্রাই রাব'। মাংসের গায়ে বেশ করে মালিশ করে রেখে দিতে হয়। তরল ম্যারিনেডের থেকে স্বাদে গন্ধে কম কিছু নয়। এতো গেল ডাঙার খাবার।আবার উপকূলের দিকে মাছ-কাঁকড়া-চিংড়ি-ঝিনুকের রমরমা।আর আমিষ বাদ দিয়ে যদি নিরামিষের দিকে দেখেন, তাহলে বলতেই হবে দক্ষিণের বিখ্যাত মিষ্টি আলু,পীচ ফল, আর বাদামের কথা। শুধু দক্ষিণেই নয়, সারা আমেরিকাতেই দেখতে পাবেন স্যুইটপোটেটো পাই আর পীচ কব্‌লারের মত ডেজার্টের নামডাক। আবার ওদিকে বাদাম রাজ্যে চেনাচেনা চীনা বাদাম থেকে শুরু করে আখরোট বলুন,কাগজি বাদাম বলুন,কাঠবাদাম বলুন, কে নেই? তবে যে বাদাম বলতেই লোকে এক ডাকে দক্ষিণকে চিনে নেবে তা হলো 'পেকান'। 'পিক্যান'ও বলেন কেউ কেউ, ঘোর সাদার্ণ অ্যাকসেন্টে।

    শুধু খাবারের কথা বলে ছেড়ে দিলে একটু অন্যায় হবে। পানীয়র দিক থেকেও সাদার্ণ কুইজিন কম নয়। আমেরিকায় সব থেকে নামকরা হুইস্কী 'বার্বন' কিন্তু এই অঞ্চলেরই খাস বাসিন্দা। আবার ককটেলের খাত যদি দেখেন তো দেখবেন সেখানেও জ্বলজ্বলে নামে আছে 'মিন্ট জুলেপ'। অল্প চিনির সিরাপে পুদিনা পাতা থেঁতো করে বরফ আর খাঁটি বার্বন হুইস্কী ঢেলে দেওয়া। আহা সে যেন সোডা-লেম্নেড সমান।

    তবে আরেকটু এগিয়ে আমরা আজ পাড়ি দেবো দক্ষিণ লুইসিয়ানা রাজ্যে। সেখানে আফ্রিকা, ফ্রান্স আর আমেরিকার স্বাদ মিলেমিশে তৈরী করেছে 'কেজান' নামে এক কুইজিন। এই 'কেজান' কথাটা কোত্থেকে এলো বলুন তো? ক্যানাডার ফরাসী পপুলেশনের এক অংশ এসে এই অঞ্চলে উপনিবেশ গড়েছিলেন। তাঁদের বলা হত 'অ্যাকেডিয়ান'। এবার এই অ্যাকেডিয়ানই লোকের মুখে মুখে প্রাকৃত রূপ পেয়ে হয়ে দাঁড়ালো 'কেজান'।এমনিতে 'ক্রেওল' বলে লুইসিয়ানাতে আরেক রান্নার ধারা রয়েছে। তাতেও ফরাসী প্রভাব প্রচুর। তবে ওতে যেন টমেটোর আধিক্য কিছু বেশি। আমার ঝাল খাওয়া ভারতীয় জিভে ক্রেওলের থেকে কেজান খাবারই বেশি স্বাদু ঠেকে। আসুন আজ আমরা সেই কেজান রান্না করে দেখি। মাছ, মাংস, ডিম, মিষ্টি সবই হয়েছে, আজ একটু ভাত রাঁধলে কেমন হয়? সেই কেজান ভাতের নামই হলো জাম্বালায়া।

    জাম্বালায়াতে সসেজ দেওয়া হয় অনেক সময়, তবে অনেকে চিকেন দিয়েও করেন। তো আমরা চিকেন জাম্বালায়াই করবো, বলাই বাহুল্য। চারশো গ্রাম মত চিকেন বেশ খানিকটা জল দিয়ে সেদ্ধ করতে বসান। ঐ জলেই দিয়ে দিন আধ মুঠো গোটা গোলমরিচ, ৪-৫ কোয়া রসুন থেঁতো আর একটা মাঝারী পেঁয়াজ আদ্ধেক করে কেটে। সেদ্ধ হয়ে গেলে মাংসটা হাড় থেকে ছাড়িয়ে রাখুন। জলটা ফেলে দেবেন না কিন্তু। ছেঁকে তুলে রাখুন। ঐ হলো চিকেন স্টক,একটু পরেই আমাদের কাজে লাগবে।

    এবারে একটা বড় ডেকচি চাপান দেখি উনুনে। এবারে কুচি করে নিন পেঁয়াজ আর ক্যাপসিকাম। আরো লাগবে গাজর কুচি। এখানেও একটু ইম্প্রোভাইজ করেছি। আসলে লাগে সেলেরী। কিন্তু সেলেরী সব জায়গায় পাওয়া যায়না তো, তাই গাজর দিন তার জায়গায়। খুব মন্দ হবেনা,নিশ্চিন্ত থাকুন। সাদা তেল গরম করে দিন এই তিনরকম সব্জির কুচি। একটু ভাজা ভাজা হলেই দুটো টমেটো কুচি করে দিয়ে দিন। খানিকক্ষণ রান্না হোক। টমেটো গলে গেলে এবার দিন মাঝারী মাপের চিংড়ি। চিকেনের টুকরোগুলোও দিয়ে দিন এই সময়। আন্দাজ করে নুন দিন, আর আধ চামচ গোলমরিচ। আরো দিন এক চামচ চিলি স্যস। কেজান রান্না একটু ঝালই হয়। এবারে দেখুন আপনার পাড়ার দোকানটিতে উস্টারশিয়ার স্যস পাওয়া যায় কিনা। ইংরিজিতে এর বানান হলো worcestershire। পাওয়া গেলে সেই দিতে হবে এক চামচ। না পেলেও কুছ পরোয়া নেই। দু চামচ তেঁতুল ভেজানো জল দেবেন তার বদলে। বেশ ভালো করে নেড়ে চেড়ে মিশিয়ে নিন সবটা।

    এবার আপনার লাগবে চাল। ভিজিয়ে রেখেছেন তো আগে থেকে? বেশ, এইবার জলটা ফেলে দিয়ে ঐ চাল দিয়ে দিন ডেকচির মধ্যে। হাতা দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে এইবারে ঐ চিকেন স্টক দিতে হবে। যত চাল দিয়েছেন তার ঠিক দ্বিগুন দেবেন এই স্টক। এবারে একবার নেড়ে নিয়েই ঢাকনা চাপা দিন। কুড়ি থেকে তিরিশ মিনিট লাগে সাধারণত চাল সেদ্ধ হতে, তবে একেক চালে একেক রকম, তাই একটু দেখে নেবেন। তবে বারবার ঢাকনা খুলে নাড়ানাড়ি করলে কিন্তু চাল ভেঙে গলে দলা পাকানো হবে। যখন দেখবেন জলও সব শুষে নিয়েছে, চালও সেদ্ধ হয়ে গেছে তখন নামান। গোটা দুই স্প্রিং অনিয়ন বা পেঁয়াজশাক কুচি করে ওপরে ছড়িয়ে দিতে পারেন ইচ্ছে হলে। এইবার? আপনি এক খানা চামচ নিয়ে আসুন, আর আমি এক্কেবারে সাদার্ণারদের মত গালভরা হাসি হেসে বলি " এন্‌জয় ইয়ল্‌'।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • টুকরো খাবার | ১৯ জানুয়ারি ২০১১ | ১২৪১ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    অশ্রু - Sarthak Das
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন