যাদের ভারতীয় পুরাণের সাথে কিছুমাত্র সংযোগ আছে তারা সবাই জানেন যে ঘোড়ার মাংসের সাথে হিন্দুত্বের যোগাযোগ নিবিড়। অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় ঘোড়াটিকে বলি দেওয়া হত এবং তৎসহ ভোজন। আমি অনেক চেষ্টা করেও সেই মাংস রান্নার রেসিপিটা জোগাড় করতে পারি নি ! নিজে সংস্কৃত না জানার জন্য অন্যের অনুবাদের উপর নির্ভরশীল ছিলাম - তাবড় তাবড় পণ্ডিতরা সমাজব্যবস্থা, নৈতিকতা, অর্থনীতি বা প্রাচীন ভারতে কারিগরীবিদ্যা (যেমন পুষ্পকরথ আসলে উড়োজাহাজেরই পূর্বসুরী ইত্যাদি) নিয়ে আলোচনা করলেও এই মাংস রান্নার রেসিপিটার উল্লখ করতে বেমালুম ভুলে গেছেন! দ্রৌপদী নাকি বিশাল রন্ধনশিল্পী - আরে ভাই তা নিয়ে পাতার পর পাতা না ফেনিয়ে দু-একটা স্যাম্পেল ঝাড়, নিজেরা ট্রাই করে দেখে রায় দিই কে বড় কুক - দ্রৌপদী নাকি জিমি অলিভার! তো ঘোড়ার কারির রেসিপি না জানার জন্য - আমি সেই আদি-অকৃত্রিম মাংস রান্নার পদ্ধতি অবলম্বন করলাম। এই পদ্ধতিতে আমার বিশ্বাস সমস্ত দুপেয়ে, চার পেয়ে বা পা-বিহীন জীবের মাংস সহজে ও মুখরোচক ভাবে রান্না করা যাবে। রেসিপি বাতলাবার জায়গা এটা নয় - মাংস ছোট করে কেটে টক দই, আদা, রসুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি বাটা, পাতিলেবুর রস, একটু তেল, লবণ, লংকা, হলুদ, জিরে গুঁড়া (এবং হাতের কাছে যা যা পাউডার টাইপের আছে) সব দিয়ে মাখিয়ে রেখে দিন ঘন্টা চার-পাঁচ। এরপর মাংসটাকে আচ্ছা করে কষে - ট্যমেটো ইত্যাদি দিয়ে অল্প আঁচে সেদ্ধ হতে দিন। যদি এর পর কোন কিছুর স্বাদ না পান তা হলে একটু ট্যমেটো-চিলি সস্ ঢেলে দিন। ব্যাস চাইনীজ্ স্টাইলে (যেমন সবেতেই সয়াসস্ও ভিনিগার) খাবার তৈরি।
ঘোড়ার কারি আমরা নিয়ে বসলাম বাসমতী চালের ভাতের সাথে। দাদা, নিজের মুখে নিজের প্রশংসা করব না - তবুও বলে রাখি মাংসের পাত্র নিমেষে খালি হয়ে গেল। যোসেফ একাই প্রায় অর্ধেক খেয়ে ঘোষণা করল - এর থেকে ভালো ঘোড়ার মাংস নাকি ও জীবনে খায় নি! রেড-ওয়াইন ইত্যাদি নয় - ঘোড়া রাঁধতে হলে সেটা নাকি কারিই হওয়া উচিত। যোসেফের পিতাশ্রীও সহমত পোষণ করলেন। আসলে মালটার লোকেরা মসলার ব্যবহার জানে না - ওদের কাছে কারি মানে একধরণের পাওডার - তার নামও খুব অদ্ভূত ‘কারি পাওডার’। তাই মালটীজ কারি হল - সেদ্ধ রান্নার উপরে একটুওই পাওডার ছড়ানো ! কেউ জেনে ধোঁকা খায়, কেউবা অজান্তে। তা এই মালটীজরা না জেনে কারি বিষয়ক ধোঁকা খেয়ে আসছে কয়েক দশক ধরে !
অনেকে আবার খাদ্য শিল্পের সাথে অতিরিক্ত খাদ্য প্রীতি ঘুলিয়ে ফেলেন, অনেকে ভাবেন খাবার গল্প করা মানেই যে খাচ্ছে তার মুখ আর যা খাচ্ছে তার বিবরণ। আসলে কিন্তু তা নয়, খাবার গল্প এর থেকেও অনেক বেশি কিছু - আচ্ছা, তবে একটু দেখেই নেওয়া যাক গপগপ করে খাওয়া বলতে আমরা কী বুঝি!
গপগপ ব্যাপারটা ডিফাইন করা খুবই শক্ত। আমার খাওয়া পুতুপুতু জিরো সাইজের কাছে গপগপ - আমেরিকানদের খাওয়া ইউরোপিয়ানদের কাছে গপগপ - মুখের কাছে ছোট্ট বাটিটা ধরে চপস্টিক দিয়ে মুখে ভাত পাচার করা আবার অন্য গপগপের রকমফের। আসলে সবটাই আপেক্ষিক। তবুও সৌন্দর্য্য ব্যখ্যা করার মত গপগপ ব্যখ্যারও একটা চেষ্টা দেওয়া যেতে পারে - ওই ধরণের খাওয়া মোটামুটি চোখে লাগে। মিথ্যা বলব না, ছোটবেলায় বিয়েবাড়িতে খেতে গিয়ে মাঝেমাঝেই আমি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়তাম। মিষ্টির প্রতি আমার বরাবরই একটু ঝোঁক বেশি। তাই পেটপুরে মাংস পর্যন্ত শেষ করে, চাটনি-দইএ একটু বিশ্রাম নিয়ে, মিষ্টি হাজির হলেই আমার পাকস্থলির আয়তন কোন আভ্যন্তরীণ হর্মোন ক্ষয়ের দরুণ স্ফীত হত। ফলতঃ রসগোল্লার সাথে আমার একটা মাখোমাখো গপগপের সম্পর্ক ছিল - গড় ছিল ১৮-২০টার মত।
তবে যারা টিভিতে হট্ডগ ভোজন প্রতিযোগিতা দেখেছেন তাদের আশা করি গপগপ শব্দটার প্রতিশব্দ খুঁজে দিতে হবে না। আমি যবে শেষবার ওটা দেখি - ৫ মিনিটে ৫১টা হটডগ খেয়ে এক জাপানী বিজয়ী হয়েছিল। ওটা খাওয়া ছিল না - গেলা বা আঙুল দিয়ে ঠেলে পাকস্থলিতে পাঠানো বললেই হয় আর কি! ইহা মোটেই ভালো নয়। তবে অন্যদিকে সৌগতর ফিলসফি ফলো করাও আমি মোটেই সমর্থন করি না। একবার আমি সৌগতর সাথে কলেজ থেকে গেছি বিয়েবাড়িতে খেতে - দুপুরের খাওয়া মিস দিয়েছি যথারীতি ভালো করে সাঁটাবো বলে। গেলুম বিয়েবাড়িতে - সবাই হাই-হ্যালো বলে আর খেতে যায়। সৌগত দেখি নড়েই না। ওর আবার হাত তুলে নমস্কার করার একটা ব্যাপার আছে - যেখানে জোড়া হাতটা ঘাড় আর বাম কাঁধের মধ্যের সমকোণটার মাঝামাঝি (অর্থাৎ ৪৫ ডিগ্রী কোণে) উঠবে। সেটা নাকি আদি/অকৃত্রিম কংগ্রেসী স্টাইল! তো যাই হোক আমি খোঁচা মারি সৌগতকে খেতে যাবার জন্য। যতই হোক বিয়েবাড়িতে আসা ওর চেনাশোনার সূত্র ধরেই। তো ঘন্টা দুই পর আমার মাথায় বাজ ফেলে সৌগত ঘোষণা করল - হ্যাংলার মত খেতে যাব মানে? আমরা নাকি জাষ্ট জলযোগ করব! মিষ্টির প্লেট এলে ও একটা মিষ্টি ডাইরেক্ট টাকরায় (ঠোঁটে লিপষ্টিক না থাকা সত্ত্বেও) চালান করে ঘোষণা করল - বাকিগুলো ফেরত নিয়ে যান মাসিমা। বাইরে বেরিয়ে এসে সৌগত আমাকে নিয়ে রেষ্টুরান্টের দিকে রওনা দিল - সেখানে খেয়েই পেট শান্ত করলাম - কারণ বিয়েবাড়িতে খাওয়া সৌগত মতে নাকি প্রায়শই ভালগার।
গপগপ খাবার শেষ উদাহরণ আমার বন্ধু কারকের বাদাম খাওয়া। ইন্ড্রাষ্ট্রিয়াল ট্যুরে যাচ্ছিলাম ট্রেনে করে - বাদাম কিনে সবার মাঝে রাখা হল - গল্প করতে করতে সবাই এক জায়গা থেকে নিয়েই ছাড়িয়ে খাচ্ছিলাম। খানিক পরে কারক অনুধাবন করল বাদামের ঠোঙার আয়তন সসীম। তাই ও খোসা না ছাড়িয়েই বাদাম মুখে ফেলে চিবুতে শুরুকরল। একের পর এক খোসাশুদ্ধ গোটা বাদাম কারকের পাকস্থলিতে চালান হতে লাগল। যতই হোক, মেদনীপুরের ছেলে বলে কথা - হজম শক্তি অনন্যসাধারণ।
গপগপের বিপরীত ধীরেসুস্থে খাওয়ার উদাহরণ কিন্তু আমাদের সকলের চারপাশেই ছড়িয়ে আছে - কারও কারও তো খাবার দুইবার গরম করতে হয় মাঝে! তেমনই এক উদাহরণ ছিল আমার অন্য রুমমেট সাধন - যার সম্পর্কে সৌগত বলত “ছোটবেলায় ভালো দেখতে ছিল, আরো বড় হলে বুদ্ধি হবে”। সাধন খেতে ভালোবাসত, বিশেষ করে মাংস-রুটি। হোষ্টেলে যেদিন মাংস হত সেদিন সাধনকে দেখতাম কোণের দিকে টেবিলে খাচ্ছে চেয়ারের উপর পা গুটিয়ে আয়েশ করে। এখন কলকাতা বাজারে রুমালি রুটির সাইজ কেমন হয়েছে বলতে পারব না - কিন্তু বছর দশেক আগে দুটো বা তিনটে খেলেই স্বাভাবিক পেট ভরে যেত। সাধন সময় নিয়ে খেত ১২ থেকে ১৪টা। একদিন ওর খেয়াল চাপল আমাদের রুমে মাংস রান্না করা হবে। কিছুকরিতকর্মা পাবলিকের দৌলতে আমাদের রুমে ইলেকট্রিক হিটার, কাঁচের নানা সাইজের পাত্র ছিল - যেগুলি সবই কেমেষ্ট্রি ল্যাব থেকে না বলে আপন করে নেওয়া। মাখনদার কাছ থেকে মশালা ইত্যাদি জোগাড় করে সাধন মাংস রান্নায় বসল। আমরা হেলপ অফার করলেও মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটবে বলে আমাদের অংশগ্রহণ কেবল খাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে ঠিক হল। এক সময় নির্দেশ এল স্নান করতে যাবার জন্য কারণ মাংস নাকি সমাপ্ত হবার পথে।
এদিকে হাল্কা পোড়া গন্ধ পাচ্ছিলাম - সাধনের দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করাতে আমি মাংস রান্নার কিছুই বুঝি না প্রতিপন্ন হল! সবার স্নান হয়ে ফিরে এলে ঢাকা দেওয়া মাংস খোলা হল। সে কী রঙ, সে কী গন্ধ - কাঠকয়লা আর বিটুমিন মেশালে যেমন রঙ হয় - আর বারুদ পোড়ার মত গন্ধ। সাধন কাঠের হাতা দিয়ে মাংসটা ঘাঁটতে গেলে হাতা ছিটকে গেল। রান্না যে একধরণের রাসায়নিক বিক্রিয়া মাত্র তা সেদিন প্রথম অনুভব ও প্রত্যক্ষ করলাম। কোন এক অস্বাভাবিক প্রৌকশলে সাধন সমস্ত মাংসটাকে একটা জমাটবদ্ধ লাভায় পরিণত করে ফেলেছিল! বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, সেই মাংসেই অল্প অংশ খেয়ে সাধন ও কারক ঘোষণা করল খুব একটা মন্দ হয় নি - একটু জমাট বেঁধে গেছে এই যা !
এর পরে তাই সাপ রাঁধার সময় বয়-দার পদ্ধতি আমাদের সাধনীয় পদ্ধতির থেকে অনেক এফেক্টিভ মনে হয়েছিল। তবে সাপ রান্নার বিবরণ দেবার আগে বয়-দার পরিচয়টা একটুদিয়ে নিতে হবে.........
[চলবে]