মুজতবা আলী সাহেব খাবার-দাবার বিষয়ে বেশ কিছু রচনা লিখে গেছেন যেগুলো পড়ে বিমলানন্দ লাভ করেছি বা এখনও নির্ভেজাল আনন্দ পাই । সেই সব লেখায় রাঁধুনি থেকে উপকরণ মায় খাদকের পরিপূর্ণ বিবরণ থাকলেও একটা জিনিসের উল্লেখ কিন্তু তিনি বেমালুম উহ্য রেখেছেন যেটা ছাড়া নবযুগের কোন খাবার বিষয়ক লেখাই পরিপূর্ণ হয় না - সেই মহার্ঘ্য বস্তুটি হল, ক্যালোরি। আমি তো এই সেদিন পর্যন্ত জানতাম না যে একটা সিঙারা খেয়ে আমি নাকি ১৪০ ক্যালোরি সঞ্চয় করলাম। বলে কী ব্যাটারা ! আসলে আমার সাথে খাবারের সম্পর্ক ওই জিহ্বা পর্যন্তই - মাল গলা দিয়ে একবার নেমে গেলে সেটা নিয়ে আর ভাবার তাগিদ অনুভব করি না, অবশ্য যদি না সেটা পাকস্থলিজনিত হয়। একবার পার্কস্ট্রীটে মার্কোপোলো নামক রেষ্টুরেন্টে খেয়ে আমাকে তেমনই এক তাগিদ অনুভব করতে হয়েছিল পরের পুরো দিনটাতেই। বাড়িতে ট্যিসু পেপারের চল না থাকায় আমি সারাদিনে যা জল ঘেঁটেছিলাম মার্কো পোলোও মনে হয় খোদ জাহাজে বসে এত জলকেলি করেন নি।
তো যাক - খাবার ব্যাপারে কথা বলার তেমন এক্তিয়ার আমার নেই - ইদানিং শংকর তো রিসার্চ-টিসার্চ করে মোটা মোটা কেতাব ফেঁদে বসেছেন। তার থেকে আর কিছু মনে না থাকলেও এটা মনে আছে যে স্বামীজী জিলিপি খেতে ভালোবাসতেন ! এটা জেনে ফেলার পর আজকাল প্রায়ই রামকৃষ্ণ-দক্ষিণেশ্বর-স্বামীজী সংক্রান্ত আলোচনায় আমি সক্রিয় যোগদান করি। একবার যদি কোন আলোচনাকে আপনি খাবার বিষয়ক খুঁটিনাটিতে ঢুকিয়ে ফেলেন তাহলে আপনি কী করবেন বলতে পারব না, তবে আমাকে থামানো দুষ্কর হবে। নানা অদ্ভূত তথ্য, সত্য-মিথ্যা নির্বিশেষে, বিষয়ে ঢুকিয়ে ঘোঁট পাকিয়ে আমার আজকাল এক ধরণের পৈশাচিক আনন্দ হয়। সেদিন কোথায় যেন পড়লাম ৩৫০০ ক্যালোরি শক্তি শরীরে বাড়তি সঞ্চয় হল গিয়ে ৪৫০ গ্রাম ওজন বাড়তি যোগ করা। অর্থাৎ প্রতিদিন ১০০ ক্যালোরি বাড়তি সষ্ণয় করলে একমাসে ওজন বাড়বে ৪৫০ গ্রাম, বছরে বাড়বে ৬ কিলোর কাছাকাছি। খুবই সুন্দর থিওরি, হয়ত বা সত্যিও - কিন্তু মানতে কষ্ট লাগে। ওই কোয়ান্টাম্ থিওরির মতই আর কি ! বাড়িতে কাকাতো, জ্যেঠতুতো ভাইদের দেখে ক্যালোরি বিষয়ক সকল সমীক্ষাই ভাঁওতা মনে হয়। ভাই আমার সকালে নানাবিধ জিনিস দিয়ে প্রাতরাশ সারল - যার পরিমাণ দেখে টেক্সাসের লোক পর্যন্ত ঘাবড়ে যাবে ! ভাত খেয়ে ৯.৫০ এর ট্রেন ধরে বর্ধমান কম্পিউটার শিখতে গেল - কার্জন গেটের কাছে হাজি নাকি ভালো বিরিয়ানি বানায়, তাই ওখানে টিফিন নিয়মিত। ২.৪০ এর ট্রেনে ফিরে আবার ভাত। সন্ধ্যাবেলা পাশের গ্রামে ছেঁড়াপরোটা-ঘুগনি সহ জলযোগ - রাতে আবার পরিমাণ মত আহার। ভাই আমার সেই চাইনিজ্ অভ্যাস - বারবার খাও, কম কম খাও - এটাকে নিজের মত করে নিয়েছে। যুক্তি খুবই সিম্পিল - কাল যদি কিছু হয়ে যায়, এটা যেন তখন মনে না আসে যে - ইস্ দুটো লুচি খাওয়া হল না ! তা দিনে কত ক্যালোরি ভাই অর্জন করে ঠিক বলতে পারব না দাদা, তবে অনেক। তো কয় - কিছুই তো দেখি হয় না তার - দিব্যি ক্রিকেট, ফুটবল খেলে বেড়াচ্ছে ! ভারতীয় কৃষ্টি সভ্যতার মূল ভিত্তিই হল আনন্দম্, আর ভাই আমার আনন্দে আছে, সুতরাং এর মাঝে ক্যালোরি আসে কোথা হতে ??
আমাদের গ্রামের টিমের গোলকিপার ছিল ডাবা। স্কুল থেকে একবার বর্ধমানের গোলাপবাগের দিকে কী একটা ছোট প্রদর্শনীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল - ওখানে পড়ন্ত দুপুরে পেট-ফুরোনে গেটের সামনের একটা দোকানে খেতে ঢোকা হয়েছিল, ১০.৫০ টাকায় মাছ ভাত। ৬ বার ভাত নেবার পর যথারীতি ডাবা দোকানদারকে অপ্রস্তুতে ফেলে দিয়েছিল - হাঁড়ি ভাত শূন্য করে। ওদিকের হোটেলে পেটফুরোন উঠে যাবার পিছনে ডাবার অবদান সাংঘাতিক। যেটা বলছিলাম - এই ডাবাও প্রতিদিন অনেক ক্যালোরি পাকস্থলিস্থ করে - কিন্তু তারও কিছু হয় না ! ধাঁধা - এমনই এক ধাঁধা হল -
কোন ফলের পুষ্টিগুণ বেশি - আপেল, আঙুর, বেদানা?
হাওড়া বর্ধমান মেনলাইনে যাতায়াত করে আমি পুরো কনফিউজড্। একদিন শুনলাম কোন ডাক্তার নাকি বলেছেন ওটা ন্যাশপাতি হবে। পরে শুনলাম সমীক্ষায় কিছু গলদ আছে। আসল ফল হল গিয়ে পানিফল - যা দরকার ওর মধ্যেই আছে। ট্রেনে পানিফল খাবার হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। কামরায় চলার সময় লোহার মেঝেতে পানিফলের খোসার আবরণ তৈরি হয়ে কেমন একটা কার্পেটের এফেক্ট আসতে লাগল!
তবে এইসব ব্যাপার ডিটেলসে অন্য কোনখানে ডিসকাস করা যাবেখন। এখন আমরা ক্যালোরি ভুলে স্রেফ জিহ্বা জড়িত বিষয়ে না হয় মনোনিবেশ করি। একটা খুবই জুতসই এবং অবাস্তব কথা বাজারে চালু আছে। দুই প্রকারের নাকি মানুষ হয় - একদল যারা বাঁচার জন্য খায় এবং অন্যদল যারা খাবার জন্য বাঁচে ! আমি অন্য অনেক বিষয়ের মত এই ব্যাপারেও মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছি। আমার জিমে যাওয়া, দৌড়ঝাঁপ সবই এই দুই থিওরির সাথেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। আমি খাবার খাবার ভালোবাসলেও ‘ফাইন ডাইনিং’ নৈব নৈব চ। মনে হয় এর থেকে বড় ভাঁওতাবাজি খাদ্য-ভুবনে আর আবিষ্কার হয় নি। ভাই, এ কেমন খাওয়া যেখানে ট্যাঁক খালি করে খেয়ে বেরিয়ে এসে অন্য জায়গায় আবার খেতে হয়! ইয়াব্বড় প্লেট, সুদৃশ্য-দেখনদারি আর তার মাঝে ভগ্নাংশ পরিমাণ খাবার। সেই খাবার নাকি বর্ণে গন্ধে স্বাদে অতুলনীয়! এই ধরণের রেষ্টুরেন্টওয়ালারা মনে হয় এই লাইনটা সম্পর্কে সম্যক অবহিত নয় -‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’। ওই অল্প পরিমাণ খাবার খেয়ে ক্ষুধায় মাথা ঝিমঝিম করলে - পরের পদ যাই হোক না কেন, সে তো অমৃতের মত লাগবেই !
খাবার হবে পরিমাণ মত - তবে হ্যাঁ, পরিমাণ কেমন হবে সেটাকে সরলীকরণেরও বিপদ আছে। যারা আমেরিকান খাদ্য সংস্কৃতির সাথে পরিচিত তাঁরা কথাটির অর্থ আশা করি বুঝতে পারবেন। আমেরিকান রেষ্টুরান্টে ৩-কোর্স ডিনার আমার মত খানেবালার কাছে প্রহসনের মত। স্টার্টার শেষ করেই আমার পেট ভরে যায়, বাকি দুই পদ তো দূর অস্ত। এই প্রসঙ্গে আমার আর এক জ্যেঠতুতো ভাই পিকুলের লাইফের ট্রাজেডির কথাটা বলে নিই। ও তরকারি খেতে এত ভালোবাসে যে আজ পর্যন্ত কোন নিমন্ত্রণ বাড়িতে মাছ-মাংসের পদ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলনা। শাক, ডাল, চচ্চড়ি দিয়েই তার খাবার শেষ। রান্নাঘরে তরকারি হাতড়াতে গিয়ে ও বহুবার ধরা পড়েছে। ওই জন্যই বলে আপ্ রুচি খানা।
আমি আসলে যেটা সবার সাথে ভাগ করে নিতে চাইছি সেটা হল কিছু ঘটনাপ্রবাহ - এই খাদ্য বিষয়েই। পাকচক্রে আমি চার বছর এমন একটা বাড়িতে বাস করেছি যেখানে ২১টা বিভিন্ন দেশের ছাত্র বসবাস করত - কেমন খিচুড়ি সিচুয়েশন ছিল আশা করি বুঝতে পারছেন। এর মাঝেই কিছু ফার্ষ্ট হ্যান্ড জ্ঞান সংগ্রহ করে ফেলেছি অনেক সময় অজান্তেই বা না চাইলেও। এর মধ্যে কোন জল নেই - একেবারে র।
কোথায় শুরু করি বুঝতে পারছি না - ঘোড়ার মাংস রান্না দিয়ে?
কয়েক দশক আগে ইংল্যাণ্ডে ঘোড়ার মাংস নাকি বিয়েবাড়ির ডেলিকেসি ছিল। এখন আর তেমন নেই - চোরাবাজারের কথা বলতে পারব না, কিন্তু খোলা বাজারে ঘোড়ার মাংস পাওয়া যেত না (যদিও উটের খুর সমেত পা পাওয়া যেত)। তাতে অবশ্য কী হয়েছে! ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয় বলে একটা কথা আছে না! যোসেফের বাবা মালটা (‘মালটা’ একটা দেশ, ইতালির ঠিক নীচেই যার অবস্থান; রকের ভাষায় ‘মালে’ ভর্তি) থেকে আসছিল - তা কাকু একটু ঘোড়ার মাংস। তা মাংস নিয়ে উনি যে কী করে কাষ্টমস্ পেরিয়ে এলেন সেটা একটা রহস্য, কারণ সাধারণত কাঁচা মাংস নিয়ে দেশ পারাপার নিষিদ্ধ বেশির ভাগ জায়গাতেই (এ জন্যই মনে হয় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে জীবন্ত গরু পাচার প্রের্ফাড ধরা হয়)। যাইহোক ঠিক হল যোসেফ ট্রাডিশনাল মল্টীজ্ স্টাইলে ঘোড়ার মাংস রাঁধবে প্রথম দিন। সন্ধ্যাবেলা ল্যাব্ থেকে ফিরে প্লাষ্টিকের বাক্স খুলে ঘোড়ার মাংস বেরুল। দেখলাম মাংস টকটকে লাল - মাংস ছোটছোট পিস্ করে একটা পাত্রে দিয়ে গুচ্ছ রেড ওয়াইন্ ডালা হল, তাতে কিছু গাজর সহ অন্য সব্জী, পরিমাণ মত লবণ। সব্জী কেন দেওয়া বুঝলাম না, কারণ আমি বা যোসেফ পারতপক্ষে সবুজ জিনিস ছুঁই না। তারপরে অল্প আঁচে রান্না চলল ঘন্টা দুই। সেই ফাঁকে আমাদের একটা সিনেমা দেখা হয়ে গেল। খেতে বসে সেই মাংসের স্বাদ যোসেফের নিজেরই ভালো লাগল না - আমার মোটামুটি লাগল। ততদিনে যোসেফ ভারতীয় কারির স্বাদ পেয়ে গেছে - তাই ঠিক হল ঘোড়ার বাকি মাংসটা দিয়ে পরের দিন কারি রান্না করব আমি। গরু পর্যন্ত ঠিক আছে, তা বলে ঘোড়া ! হিন্দু ধর্ম এই প্রসঙ্গে কী বলে কে জানে !
(চলবে)