ওয়াসাবি আবার কোন দেশের নাম? আরে না, কোনো দেশের নাম নয়। ওয়াসাবি তো একরকম শেকড়। ঝাঁঝালো। সর্ষের ঝাঁঝ বেশ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিলে যেমন হয় সেইরকম। তা সেই শেকড় যে দেশে পাওয়া যায়, যে দেশের রান্নায় দেওয়া হয় আজ আমাদের সেই দেশেই অভিযান। কোথায় সেটা, বলুন তো? দুনিয়ায় সব থেকে আগে সে দেশে রাত ফিকে হয়। সেখানে সাদা গোলাপী থোপা থোপা চেরী ফুল ফুটে থাকে। সুক্ষ্ম তুলির ছবি আঁকা হাতলবিহীণ পেয়ালায় সবুজ চায়ের গন্ধ ভুরভুর করে। পাখা-ছাতা আর জমকালো কিমোনোয় লালে-সোনালীতে ফুটে ওঠে চমৎকার ওয়াশের কাজ। ঠিক, নিপ্পন। জাপান।
জাপানীরা 'বাঁচার জন্য খাওয়া' কথাটায় একেবারেই বিশ্বাসী নন। ওঁদের কাছে খাবার প্রায় ধর্মের সমতুল্য। খাবারের প্রতি, রান্নার পদ্ধতির প্রতি, এমনকি বাসনপত্রের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা রেখে চলেন ওঁরা। ভুলে যাবেননা জাপানই কিন্তু একটি একমেবাদ্বিতীয়ম স্বাদের আবিষ্কার করেছেন। পুরো জগৎ জানতো বেসিক স্বাদ শুধু চার রকম, নোনতা, মিষ্টি,তেতো আর টক। জাপান আমাদের জানিয়েছিলো যে ''না হে, আরো একটা স্বাদ যে রয়েছে, তার নাম 'উমামী'''।
পুরো জাপানী কুইজিনটাই দাঁড়িয়ে আছে 'জেন' (Zen) বৌদ্ধমতের একটা গাইডিং প্রিন্সিপ্লের ওপরে। তার নাম ওয়াবি-সাবি। ওয়াবি কথাটার মানে হলো ' শান্ত ও সহজ' , সাবি মানে 'অনায়াস আভিজাত্য'। এই ওয়াবিসাবি পথচলা রান্না তাই রান্নাই শুধু নয়। এ ধমওÑ, এ শিল্পও।
জাপান দেশটা চারদিকে সমুদ্র দিয়ে ঘেরা। চীন সাগর, জাপান সাগর আর প্রশান্ত মহাসাগর। তাই মাছ, কাঁকড়া, ঝিনুক, চিংড়ি, স্কুইড, অক্টোপাসের ছড়াছড়ি জাপানী রান্নায়। ওঁরা মনে করেন যে যেকোনো খাবার যত বেশি রান্না করা হয় তার স্বাদ আর খাদ্যগুণ ততই নষ্ট হয়ে যায়, খাবারের মধ্যে তার নিজস্ব স্বাদটাকেই প্রাধান্য দিতে হবে, মশলাপাতি, গুচ্ছের তেলঝাল দিয়ে তার আসল প্রাকৃতিক স্বাদটাকে ঢাকা দেবার কোনো মানে হয়না। তাই জাপানী খাবারের মধ্যে কাঁচা মাছের দেখবেন রমরমা। মাছ মানে শুধু মাছই নয়, ঐ কাঁকড়া, চিংড়ি,ঝিনুক ইত্যাদিরও। সমুদ্রের হাতের আরো ছোঁয়া দেখতে পাবেন জাপানী রান্নায়। নানান সামুদ্রিক আগাছা, শ্যাওলার খুব চল এখানে। কেল্প, কম্বু, নোরি কতরকম নাম তাদের।
মাছ বললেই পরেপরেই ভাতের কথা মনে পড়ে, তাই না? তা পাবেন বৈকি? ভাত এখানের প্রধান খাবারের মধ্যেই রয়েছে। উত্তর দিকটায় যেসব পাহাড়গুলো,তার ঠিক তলাতেই প্রচুর ধানের চাষ হয়। বেঁটে বেঁটে চালের একটু আঠালো ভাত হয় তার থেকে। সুগন্ধী সেদ্ধ ভাত, তার নাম তাকেকোমি গোহান, ভাতের বড়াও হয়, তাকে বলে ওনিগিরি, আর আছে সেকিহান বা লালভাত। সে রান্না হয় পালেপার্বণে। চালের বাড়বাড়ন্তের জন্যই ভাত শুধু খাবারই নয় এখানে, পানীয়ও বটে। জাপানী রাইস ওয়াইন 'সাকে'র নাম কে না শুনেছে? সাকিও বলা চলে। 'মদিরাসুন্দরী'।
জাপানী কুইজিনে কিন্তু চীনের প্রভাব আছে অনেক। চীন থেকে শুধু যে বাটি করে ভাত নিয়ে কাঠি বা চপস্টিক দিয়ে খেতে শিখেছিলেন এঁরা তাইই নয়। চীন থেকেই এসেছিলো চা আর সয়বীন, যা আজ জাপানী খাদ্যধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ। চা শুধু যেকোনো জাপানী 'মিল' এর অংশই নয়, 'চা পান উৎসব' বা 'চা ডৌ'এখানে একটা রীতিমতো বড় উৎসব। এই উৎসবের প্রাণকেন্দ্র হলো গিয়ে 'মাচা' বা সবুজ গুঁড়ো চা। এই চা তৈরী করার পদ্ধতিকে জাপানীরা ললিতকলার স্তরে নিয়ে গেছেন। সেই পদ্ধতি বা 'কাইসেকি রিয়রি'তে চোখ,নাক আর জিভ এই তিন ইন্দ্রিয়ই প্রাণ ভরে সে চা উপভোগ করতে পারে।
আর সয়বীন তো আছেই। সয়বীনের দুধ থেকে তৈরী পনীর টোফু, গেঁজানো সয়বীনের পেস্ট মিসো আর টেম্পেহ্, আর সবার ওপরে সয়স্যস বা শোয়ু, এদের বাদ দিয়ে জাপানী রান্নার কথা ভাবা যায়না।
রান্নার উপকরণের কথা বলতেই দিন কাবার করলাম প্রায়। রান্নার পদ্ধতিরও যে কতরকম নাম! শিয়োয়াকি হলো নুন দিয়ে জরিয়ে ঝলসানো, নিমোনো হলো স্বাদু ঝোলের মধ্যে সেদ্ধ করা, হোরায়ুকি -- মোটা খ্সখসে পাত্রে নুনের পরতের মধ্যে মাছ বা সব্জি ডুবিয়ে রেখে ভাপানো, মুশিয়াকি -- জল ছাড়া ভাপানো,আর টেম্পুরা হলো গোলায় ডুবিয়ে ছাঁকা তেলে ভাজা। আরো অনেক আছে, অনেক আছে ,বলতে গেলে রাতও কাবার হয়ে যাবে।
আচ্ছা, তাহলে এবার দেখা যাক আমরা কি আজ কি রান্না করতে পারি। জাপানী রান্না বলতে প্রথমেই সুশির কথা মনে আসে। এখানে ছোট্ট করে বলে রাখি সুশি বললেই বেশির ভাগ লোক ভাবেন ভাত আর কাঁচা মাছ। কিন্তু তা নয়, আসলে সু-শি মানে হলো গিয়ে ভিনিগারে ভেজানো ভাত। এই সুশিই বোধহয় সবচেয়ে জনপ্রিয় জাপানী খাবার।কিন্তু সে বানানো বিস্তর ঝামেলা। শুনেছি ঠিকমতো সুশির ভাতটুকু বানানো শিখতেই তিরিশ বছর সময় লাগে! কাজেই আসুন আমরা সহজ খাবার বানাই, চিকেন টেরিয়াকি।
'টেরিয়াকি' কথাটার মানে হলো 'ঝিকমিকে রান্না'। শুনতে বেশ, না? আসলে এতে মাছ বা মাংসটাকে মূলত শোয়ু আর মিরিন বলে একরকম জাপানী মদ দিয়ে ম্যারিনেড করে রাখা হয়। পরে রান্না হবার পরে ঐ ম্যারিনেড দিয়েই তৈরী হয় একটা স্যস। সেই স্যস ওপরে মাখিয়ে দিলে মাছ বা মাংসকে দেখায় যেন খানিক চকচকে, গ্লেজি। সেই জন্যই অমনি নাম। শোয়ু আর মিরিন শুনে ঘাবড়ে গেলেন? সেসব এখানে পাওয়া যায় নাকি? ভয় পাবেন না বন্ধু। শোয়ু মানে যে একটু আগেই বললাম সয় স্যস? আর মিরিন আমাদের চাইনা। তার বদলে পোয়াটাক ইম্প্রোভাইজেশন হলেই চলে যাবে।
এর জন্যে ১ কেজি চিকেন লাগবে। বোনলেস মাংস হলে ভালো। নাহলে একটু কষ্ট করে নয় নিজেই ছুরি দিয়ে হাড় বাদ দিয়ে নিন না। ছোট টুকরো করে নিন মাংসটা। এইবারে বানাতে হবে ম্যারিনেড। আধ কাপ সয় স্যস নিন, তার মধ্যে ১/৪ কাপ চিনি দিন। দেখুনতো বাদামী চিনি পাওয়া যাচ্ছে নাকি? নাহলে সাদাই দেবেন, অসুবিধে নেই। আর লাগবে এক বড় চামচ রসুন মিহি করে কুচি করা, আর আদাবাটা, ঐ এক বড় চামচ। খবর্দার, ভুলেও নুন দেবেন না কিন্তু। ঐ সয় স্যসে যে নুন থাকবে তাইই যথেষ্ট। এগুলো সব মিশিয়ে চামচ দিয়ে আচ্ছা করে নাড়ুন যতক্ষণ না চিনি গলে যায়। এবারে এই মিশ্রণে চিকেনের টুকরো ভিজিয়ে রাখুন। সারা রাত রাখতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়,না হলে অন্তত দু ঘন্টা।
ম্যারিনেড হয়ে গেছে তো? এবারে মাঝারী আঁচে একটা তাওয়া বসান দিকি। যতক্ষণ তাওয়া গরম হচ্ছে চিকেনের টুকরো গুলো ম্যারিনেড থেকে তুলে অন্য বাটিতে রাখুন। এবার একটা স্যসপ্যানে ঢেলে নিন সব ম্যারিনেডটুকু। মাঝারী আঁচে বসিয়ে রাখুন যতক্ষণ না কমে যা ছিলো তার অর্ধেক হয়।এই তৈরী হলো আপনার টেরিয়াকি স্যস। ওদিকে তাওয়া গরম হয়ে উঠেছে। সামান্য তেল বুলিয়ে মাংসগুলো সেঁকতে হবে এবার। একেক পিঠ ৪-৫ মিনিট দিলেই হয়। এক পিঠ হলে চামচে করে ঐ ঘন করা টেরিয়াকি স্যস বেশ দরাজ হাতে মাখান মাংসের ওপরে। এবার উল্টে অন্য পিঠটা করুন। একটা কাঁটা ফুটিয়ে দেখে নিন তো, যদি দেখেন ফুটো দিয়ে যে রস বেরিয়ে আসছে তা জলের মত, কোনো লালচে রং নেই,তাহলেই বুঝবেন মাংস কাঁচা নেই আর। এ পিঠেও স্যস মাখান বেশ করে। এই তো হয়ে গেলো আপনার টেরিয়াকি চিকেন। চিনেমাটির ছোট বাটিতে সাদা ভাতের ওপরে রেখে পরিবেশন করুন।আর যে ধোঁয়া উঠছে তার সুঘ্রাণ? উম্ম্ম্, আ:, এইই হলো গিয়ে 'উমামী', বুঝলেন তো?