এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  টুকরো খাবার

  • থাই থার্সডে : খানম ক্রক

    নিয়ামৎ খান লেখকের গ্রাহক হোন
    টুকরো খাবার | ০৮ নভেম্বর ২০১০ | ১১৩২ বার পঠিত
  • দূরপ্রাচ্যে যখন এসেই পড়া গেছে চলুন আজ একটু থাইল্যান্ড থেকে ঘুরে আসা যাক। থাইল্যান্ড বললেই চোখের সামনে একটা ছবি ভেসে ওঠেনা? ধানক্ষেত, হাতি, সারা দেশের শরীর জুড়ে শিরা উপশিরার মত নদী,বেতের টোকা মাথায় দেওয়া মাঝিদের নৌকো। ঐ সব নৌকোয় করে ফেরী হচ্ছে রুপোলী মাছ, লাল-নীল কাঁকড়া, তাজা সব্জি, এই বড় সবুজ কলার কাঁদি, নৌকোয় করে ফেরী হচ্ছে নানা রকম মশলা। দেখতে পাচ্ছেন না? এই ছবির দিকে আরো একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে আস্তে আস্তে চোখ ছাড়িয়ে ছবি নেমে আসে নাকে, জিভে। হাজারাটা রঙীন গন্ধ,রঙীন স্বাদ ছবির টুকরোর মত চারিয়ে যায় সব অনুভুতির মধ্যে। বড় স্বাদু দেশ এই থাইল্যান্ড, বড় সুগন্ধী।

    এদেশের খাবারে প্রথম ছাপ পড়েছিলো চীনদেশের। তা হবে নাই বা কেন? বহুদিন আগে,সেই যে তেরো শতকে দক্ষিণ-পূব চীন থেকে একদল মানুষ পাড়ি জমিয়েছিলেন কাম্বোডিয়ায়, লাওসে,বর্মার শান প্রদেশে, উত্তর-পূব ভিয়েতনামে, তাঁদেরই এক অংশ এসে পৌঁছান "সায়াম' দেশে (বাংলায় আমরা বলি শ্যামদেশ)যার আজকের নাম থাইল্যান্ড। চীনে প্রভাবে এদেশে এলো নুড্‌ল্‌ খাবার চল, বেশি আঁচে চট করে সব্জি মাংস ভাজা করার চল, যাকে পশ্চিমি দুনিয়া স্টারফ্রাই বলে একডাকে চেনে। থাই ভাষায় এই স্টারফ্রাইকে বলে 'ফাদ'। ফাদ থাই বা ভাজা নুড্‌ল্‌ তো আজ সারা পৃথিবীতেই জনপ্রিয় খাবার। চীনের সেজুয়ান প্রদেশের রান্নার সাথেও থাই রান্নার মিল আছে কিছু কিছু। রান্নায় সয়স্যস আর টোফু (সয়বীনের দুধের পনীর) ব্যবহার করার চলও চীনেরই অবদান বৈকি?

    চীন ছাড়াও ভারতীয় রান্নারও অনেক প্রভাব দেখতে পাবেন থাইদেশে। সারা দুনিয়ায় এই যে "থাই কারি'র এত আদর সেই কারি বা"গাং' কিন্তু ভারত থেকেই গেছিলো ওদেশে, ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারকদের সাথে। সেই সঙ্গে গেছিলো ভারতের নানা মশলা। আঠেরো শতকে রাজা প্রথম রামার দরবারে ভারতীয় মশলা আর মুসলিম কারির প্রথম পরিবেশন হয়েছিলো। থাই কুইজিনের বিখ্যাত মাসামান কারিতে দেখবেন নানা শুকনো মশলার মধ্যে দারচিনি আর জায়ফল রয়েছে। আর পেনাং কারি বা হলুদ কারিতে আছে হলুদ গুঁড়ো,জিরে-ধনের গুঁড়ো,লংকা গুঁড়ো। তবে লংকার কথা যদি বলেনই, থাইল্যান্ডের মারকাটারি ঝাল খাবার অভ্যেস কিন্তু এসেছে পর্তুগীজদের সাথে, সে-ই সতেরো শতকে। পর্তুগীজরা অবশ্য শুধু ঝালই আনেননি, ওঁদের মিষ্টিও এসেছিলো রাজা নারাই এর আমলে।

    জাপানী খাবারের সাথেও কিছু কিছু মিল পাবেন এখানে। জাপানীদের মতই এঁরাও ভাত খান তিনবেলা। ধানের চাষ এখানে খুব ভালো হয় কিনা? থাইল্যান্ডের জেসমিন রাইসের তো দুনিয়া জোড়া নাম। ভাতকে ওঁরা বলেন "কাও'।

    আবার জাপানের মতই মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ির রমরমা এখানেও, নদীমাতৃক দেশ যে। অবশ্য মাংসেরও চলন আছে, মুরগি, শুয়োর, গরু, সবই চলে। থাই খাবারের একটা বৈশিষ্ট হচ্ছে যে মাংস কেটে দেওয়া হয় একেবারে ছোট টুকরো করে, যাতে খাবার সময়ে ছুরি ব্যবহার করতে না হয়। আগে আগে চীনের মত এখানেও চপস্টিকের চল ছিলো, কিন্তু আজকের থাইল্যান্ডে কাঁটাচামচ আর এমনি চামচই ব্যবহার হয়।

    ভাত, মাছ ছাড়াও আরেকটা জিনিষের খুব কদর থাইল্যান্ডে। নারকেল। নারকেল তেল দিয়ে রান্না হয়, নারকেলের দুধ (গা তি), নারকেল কোরা খুব চলে সবকিছুতেই। আরো দেখবেন বাদামের ব্যবহার, নোন্তা-মিষ্টি দুরকম খাবারেই; আর স্প্রাউট--কল বেরোনো বীজ,সুস্বাদু তো বটেই, স্বাস্থ্যকরও। আর আছে নানা রকম সুগন্ধী পাতা। এর মধ্যে লেমনগ্রাস আর গারাংগাল একেবারে প্রথম সারিতেই, তাছাড়াও লেবুপাতা, তুলসীপাতা। এই তুলসীপাতা কিন্তু আমাদের দেশের মত নয়। থাই হোলি বেসিলের স্বাদ যে কি ডেলিকেট, কি সুগন্ধী সে যে না খেয়েছে তাকে বোঝানো শক্ত!

    থাই রান্নার মূল মন্ত্র হলো টক-মিষ্টি-নোনতা-তেতো এই চার স্বাদের ব্যালান্স। এখানের যেকোনো খাবারেই দেখবেন এই ব্যালান্স এতটুকু টসকায়না। এর ওপরে আছে ঝালের কারুকার্য্য। এদেশের টিপিক্যাল মিল যদি ধরেন তাতে থাকবেই থাকবে একটা কোন স্যুপ, একটা ঝাল স্যালাড, একটা সব্জির ও মাছ বা মাংসের পদ, ভাত ও শেষপাতে কোনো মিষ্টি। আবার থাইদেশের নিয়ম হলো অনেকে মিলে একসাথে বসে খাবার ভাগ করে খাওয়া। এঁরা মনে করেন একা খাওয়া দুর্ভাগ্য ডেকে আনে। খাবার নিয়ে আরো ধর্মবিশ্বাস আছে এদেশে। থাইরা এও মনে করেন যে একদানা খাবারও নষ্ট হতে দেওয়া পাপ। "ধান্যদেবী' এতে রুষ্ট হন, অভিশাপও দিতে পারেন।

    আচ্ছা বসে বসে কেবল গল্প করে গেলেই কি আমাদের চলবে? বলুন তো? আজকে কি আর রান্নাবান্না নেই? আমরা কিন্তু ভাই আজ "থাই হট'এর দিকে নেই। যাঁরা থাই খাবার বলতেই শুধু রেড বা গ্রীণ কারি কিম্বা ঝাল ঝাল রান্না বোঝেন তাঁদের বলছি কি দেখুন,মাছ-মাংস তো অনেক হলো, আজ একটু মুখ বদলালে হয় না? আসুন, আজ একটু মিষ্টির দিকে যাওয়া যাক। থাইল্যান্ডের খানম-ক্রক হলো নারকেলের প্যানকেক। খাবারের পরে ডেজার্ট হিসেবে মিষ্টি তো খেয়েই থাকেন,এই প্যানকেক সেভাবে না খেয়ে বরং একদিন ব্রেকফাস্টে করে দেখুন না। ঠকবেন না, আমি বলছি!

    নারকেলের প্যানকেক কিনা, তাই শুরুতেই বার করে নিন নারকেলের দুধ, তিন কাপ লাগবে। এবার নারকেল কোরা নিন, এটা লাগবে দু' বড় চামচ । আচ্ছা, এবারে দেড় কাপ ময়দা নিন দেখি একটা বড় বাটিতে। এর মধ্যে বেশ দুই বড় চামচ ভর্তি করে দিন চিনি,এক চামচ বেকিংপাউডার, নারকেল কোরাটুকু দিয়ে দিন আর এক চিমটি নুন। চামচ দিয়ে মিশিয়ে রাখুন সবটা। এবারে অন্য একটা বাটিতে নারকেল দুধটা নিন। এর মধ্যে দিন এক বড় চামচ গলানো মাখন,একটা ডিমও দিন ভেঙে। ভালো করে ফেটিয়ে নিয়ে এই মিশ্রণটা আস্তে আস্তে ঐ ময়দা ইত্যাদির মধ্যে মেশান। দেখবেন যে দলা না পাকায় বেশি। ইচ্ছে হলে আধ খানা গন্ধরাজ লেবুর পাতা খুব মিহি করে কুচিয়ে দিতে পারেন গোলার মধ্যে।

    এইবারে উনুনে বসান একটা ননস্টিক ফ্রাইংপ্যান,কিম্বা তাওয়া। যেমন পাটিসাপ্টা ভাজার আগে বেগুনের বোঁটা দিয়ে তেল বোলানো হয়, অমনি অল্প তেল বুলিয়ে নিন। এবারে একেকটা প্যানকেকের জন্যে হাতায় করে এই ১/৪ কাপ মতো গোলা ঢেলে দিন তাওয়ায়। আঁচ মাঝারী রাখুন। যখনই দেখবেন একটা পিঠের ছোট ছোট বুদবুদের মত হচ্ছে তখনই উল্টে দেবেন। অন্য পিঠটা বেশ হাল্কা বাদামী রং ধরলে নামান। দেখতে হবে খানিক মালপোয়ার মত, তবে আরো নরম ফোলা ফোলা, স্পঞ্জি। এই মাপে হবে প্রায় এক ডজন।

    এর ওপরে নারকেল সিরাপ ঢেলে খেতে হয়। কী করে বানাবেন সেই সিরাপ? কিচ্ছু না, এমনি চিনির রস বানিয়ে তার মধ্যে বেশ খানিক নারকেলের দুধ মিশিয়ে দিলেই হলো। তবে প্যানকেক গুলি এমনিতেই মিষ্টি হয়, আর চমৎকার নারকেলের স্বাদও থাকে, কাজেই সিরাপটুকু না দিলেও ক্ষতি নেই কোনো। তবে গরম গরম খেতে হবে কিন্তু। ঠান্ডা হলেই সব মজা মাটি।

    এবার বলুন তো ভাই, এক একটা নরম গরম টুকরোর সাথে অল্প অল্প করে গলানো থাইল্যান্ড ছড়িয়ে পড়ছেনা আপনার জিভ জুড়ে? আপনার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে?


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • টুকরো খাবার | ০৮ নভেম্বর ২০১০ | ১১৩২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন