

বর্ষশেষ, লন্ডনের আরো বন্ধু ও মামা-মাসীমা
আমাদের বাৎসরিক ক্যালেন্ডারে তিনটে দিন লাল কালিতে চিহ্নিত করা থাকত। সে তিন দিন – ২৫ ডিসেম্বর, ২৬ ডিসেম্বর ও ৩১ ডিসেম্বর। লন্ডন জীবনে এই তিন দিন একই দিনপঞ্জি একই ভাবে আমরা পালন করে এসেছি; কোন ব্যতিক্রম হয় নি যদি না আমরা কখনো লন্ডনের বাইরে থাকতাম। ২৫ ডিসেম্বর, আমাদের বিশেষ বন্ধু শান্তি-মীনুর বাড়ীতে ক্রিসমাস ডিনার। শান্তি, মানে শান্তি চ্যাটার্জী, নিজের হাতে ক্রিসমাস ডিনার তৈরি করে আমাদের খাওয়াত – টার্কি, রোস্ট পটেটো, ব্রাসেলস স্প্রাউট, রেড ক্যাবেজ, ক্রিসমাস পুডিং ও আরও কত কি। উৎকৃষ্ট পানীয় সহযোগে সে ভোজ মনোরম হয়ে উঠত। সে দিন মীনুর ছুটি, মীনু আমাদের মতই অতিথি। আপ্যায়নের সব দায় দায়িত্ব শান্তির। শান্তির দক্ষতায় আমি অবাক হয়ে যেতাম।
লন্ডনে আসার কিছুদিন পরেই শান্তি চ্যাটার্জীর সঙ্গে আমদের আলাপ হয়। লন্ডনে আমাদের যে সব বন্ধু বান্ধব হয়েছে তা প্রায় সবাই অনুর মাধ্যমে। সেটা ১৯৬৭ সাল। আমরা তখন সবে লন্ডনে এসেছি; অর্চারড গ্রোভে অনুর দাদা-বৌদির বাড়িতে থাকি। অনু রাস্তায় বা দোকানে শাড়ী পরা কোন মহিলা দেখলেই বাঙ্গালী ভেবে তার সঙ্গে আলাপ করত। এমনি করে রাস্তায় আলাপ হয় এক বাঙ্গালী ভদ্রমহিলার সঙ্গে, নাম মিসেস ব্যানার্জি, সুনন্দা ওরফে ধোতন ব্যানার্জী; সদ্য বিয়ে করে লন্ডনে এসেছে। স্বামীর নাম জগৎ ওরফে বেনু ব্যানার্জি, ইলেকট্রনিক্স এঞ্জিনিয়ার, এই পাড়াতেই থাকে। ব্যানার্জী দম্পতির সঙ্গে আলাপ হল।

আমেরিকায় জগত ব্যানার্জির বাড়িতে - জগত ও লেখক
অনুর সঙ্গে মিসেস ব্যানার্জীর বন্ধুত্ব গভীর হল। আমার সঙ্গে জগত ব্যানার্জিরও। জগত এখন আমেরিকায়। আমাদের বন্ধুত্ব এখনো অটুট; অনেক দিন দেখা হয়নি, তবে ই-মেল মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ আছে।
জগতই একদিন শান্তি চ্যাটার্জির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। শান্তি রিচমন্ডে একটা হোটেল ঘরে থাকত। জগত ব্যানার্জীর গাড়ি করে আমরা শান্তির সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। তখন আমার গাড়ি ছিল না। একদিন শুনলাম শান্তি দেশে গিয়েছে বিবাহ করতে। বম্বের মেয়ে মীনুকে বিয়ে করে ফিরে এল শান্তি। আমাদের দুই পরিবারের সঙ্গে বন্ধুত্ব আরও গভীর হল। শান্তির কাছে অনু ‘ম্যাডাম’, মীনুর কাছে ‘অনুদি’। অনু আর মীনুর বন্ধুত্ব এক অন্য রূপ নিয়েছিল। অনু বলত “মীনুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক আলাদা”। ওদের প্রয়োজনে আমরা যে অবস্থাতেই থাকি না কেন সর্বদাই সাড়া দিয়েছি। ওদের দুটি ছেলে, রাজা ও মানিক, দুটি রত্ন। বুবাই গৌতমের মতই আমরা ওদের ভালবাসি। শান্তি গান ভালোবাসত। আমাদের বাড়ীতে প্রায়শঃ গান বাজনার আসর বসত। আর সেই আসরে শান্তি মীনু নেই সেটা ভাবাই যায় না।
লন্ডনের সব বন্ধুদের মধ্যে এই দম্পতির সঙ্গে বোধহয় আমাদের অন্তরঙ্গতা বেশী। ওদের মনেও বোধহয় আমাদের জন্য একটা বিশেষ আসন ছিল। রাজা মানিকও অনুমাসী এবং মেসোকে (আমাকে) ওদের আপনজন ভাবত। একটা ঘটনা আমার এই ধারণাকে বদ্ধমূল করেছিল। আমি অভিভূত হয়েছিলাম। রাজা মানিক মীনুর এক বিশেষ জন্মদিনের গোপন পরিকল্পনা করছিল --- মীনুকে চমক দেওয়ার জন্য। লন্ডনের অভিজাত অঞ্চলে এক বিখ্যাত থাই রেস্টুরেন্টে রাজা মানিক এই জন্মদিন পালনের আয়োজন করেছিল। আমরা ছাড়া আর অন্য কোন পরিবার আমন্ত্রিত ছিল না সেই সন্ধ্যায়। নির্দিষ্ট সময়ে কোন এক অজুহাতে শান্তি মীনুকে নিয়ে সেই রেস্টুরেন্টে হাজির হয়েছিল। মীনু এই আয়োজন দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। চোখে আনন্দাশ্রু। কয়েক দিন পরে আমি একটা কবিতা লিখে মীনুকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। কবিতাটি বেশ বড়; তার থেকে শেষের দু’চার লাইন তুলে দিলাম:
মীনুর কথা: মনে মনে।।
চারিদিকে পরিবৃত চেনা মুখগুলো
যেন নামহীন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মত
মিলিয়ে গেল।
অবাক বিস্ময়ে এক অপরূপ শিহরণ
আপ্লুত করল সারা দেহ মন;
এই মুহূর্তে আমার কোন বোধ নেই
কোন অনুভূতি নেই;
আমার পৃথিবী, জীবনের যত আনন্দ বেদনা
যত আকাঙ্ক্ষা যত স্বপ্ন সব একাকার হয়ে গেল।
একেই কি বলে সেই স্বর্গসুখ!
হে ঈশ্বর, এই মুহূর্তকে নিস্পন্দ করে দাও
দোহাই তোমার, একে অনন্ত করে
আমার গলায় মালার মত ঝুলিয়ে দাও।।
এই অনুষ্ঠান শুধু মীনুকেই অবাক করেনি, অবাক করেছিল আমাকেও।

অনু, মীনু, শান্তি, আমি (অন্য এক অনুষ্ঠানে)
শান্তি মীনু লন্ডনের পুরানো বাসিন্দা, অত্যন্ত মিশুকে ও সামাজিক। এ শহরে ওদের বন্ধু অসংখ্য। তাদের সকলের মধ্য থেকে শুধু আমাদেরই বেছে নিয়েছিল চ্যাটার্জী পরিবার সেই বিশেষ দিনে। আমরা ওদের বিশেষ বন্ধু এটা ভেবে ভাল লেগেছিল এবং গর্বও হয়েছিল।
আমার প্রায় সব বন্ধুই, যাদের সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পেতাম, তারা সবাই একে একে চলে গিয়েছে। শান্তিও আর নেই। মীনু এখন একা। মাঝে মাঝে আমাকে মেসেজ পাঠায়, ফোন করে।
২৬ ডিসেম্বর বক্সিং ডে। তিন বোনের তিন ছেলেমেয়ের বসবাস লন্ডন শহরে। বড় বোনের বড় ছেলে গয়াদা, মেজ বোনের বড় মেয়ে শান্তিদি, সেজ বোনের বড় ছেলে আমি।

(দাঁড়িয়ে) দাদা, গয়াদা, তারা, এলবার্টো, সেরা, জেসন, বুবাই, পিকলু, গৌতম, অনু,
(বসে) শান্তিদি, ম্যারিলিন, আমি
প্রতি ২৬শে ডিসেম্বর গয়াদার বাড়ীতে আমাদের তিন মাসতুত ভাই বোনের পরিবারসহ বাৎসরিক মিলন সভা হত। ছোট বড় সকলের জন্য ক্রিসমাস উপহার বিতরণ। সেদিন ম্যারিলিন পুরোপুরি বাঙ্গালী ভোজের ব্যবস্থা করত --- ভাত, ডাল, পাপড় ভাজা, বেগুন ভাজা, আলুর চপ, কপি ও পটলের তরকারি, চিঙড়িমাছের কালিয়া, মুর্গীর মাংস, টোমাটো-প্রুনের চাটনি, এবং পুডিং। বিকালে আবার চা ও আরও খাবার --- মুড়ি চানাচুর, বিস্কুট, তিন চার রকমের কেক। এই সযত্ন আতিথেয়তার পিছনে থাকত ম্যারিলিনের বহু পরিশ্রম ও ভালবাসা। সকাল থেকে রাত্রি পর্য্যন্ত শুধু গল্প আর আড্ডা, দেশের কথা ও স্মৃতিচারণ। খুব ভাল লাগত। সারা বছর এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম।
গয়াদাকে আমি শিশুকাল থেকে দেখে আসছি। গয়াদা আমার বড় মাসিমার ছেলে। আমার থেকে প্রায় আট–দশ বছরের বড়। আমাকে খুব স্নেহ করে ও ভালবাসে। ছুটিতে যখন মামার বাড়ী যেতাম তখন গয়াদাই আমার অন্যতম সঙ্গী। গয়াদার হাত ধরেই আমার কলকাতার সঙ্গে পরিচয়। গয়াদাই আমাকে প্রথম কলকাতার সব দ্রষ্টব্য – চিড়িয়াখানা, যাদুঘর, পরেশনাথ মন্দির ইত্যাদি দেখিয়েছে। গয়াদা রামকৃষ্ণ ভক্ত; হাওড়ার বিখ্যাত বিবেকানন্দ আশ্রমে গয়াদার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি। গয়াদা গান্ধীবাদী কংগ্রেস কর্মী। একদা বিনোভা ভাবের ডাকে ভূদান আন্দোলনে যোগ দিয়ে মাসের পর মাস সারা ভারত ঘুরে বেড়িয়েছে। বড় হয়ে কলেজে পড়ার সময় মামার বাড়ীতে যখন থাকতাম তখন আমাদের ঘনিষ্ঠতা আরো গভীর হয়ে উঠেছিল; বয়ঃজ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃত্বের সীমানা ছাড়িয়ে সখ্যতায় উন্নীত হয়েছিল। মামার বাড়ীতে কিছুদিন আমরা এক ঘরে থাকতাম। মনে পড়ে সে সময় গয়াদার সঙ্গে গল্প করে, তর্ক করে কখন কখন রাত্রি গভীর হয়ে যেত। এ হেন গয়াদা হঠাৎ বিলেত চলে গেল।
গয়াদার বাবা, বড় মেসোমশায়কে আমি দেখিনি। স্বামীহারা বড়মাসীমা পুত্র গয়াদা ও কন্যা তারাদিকে নিয়ে পিত্রালয়ে ফিরে এসেছিল এবং আজীবন পিত্রালয়ে কাটিয়েছিল। বড় মাসীমা আমাকে মায়ের মত ভালবাসত; আমার জন্য চিন্তা করত। মামাবাড়িতে তখন বড় মাসীমার সংসার ছাড়াও সে সংসারে আমি থাকতাম এবং পরে মেজ মাসীমার ছেলে মন্টুও এ বাড়ীতে থেকে ডাক্তারি পড়াশুনা করেছিল।
দাদু (দাদামশায়) গত হওয়ার পর একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে গেল। বড় মামা তার সংসার নিয়ে আলাদা হয়ে গেল। বাকী সংসারে দিদু (দিদিমা) মেজমামা মেজমামীমা ছোটমামা আর আমরা আশ্রিত ক’জন। দিদুর আত্মীয় স্বজন চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। এ বাড়ীতে তাই অতিথির অভাব হতো না; সর্বদাই কারো না কারোর পদার্পণ ঘটত। সংসারে আয়ঃক্ষম মানুষ একজনই। সে আমার মেজমামা, ব্রজেদ্র নাথ রায়; তার উপরেই এই সংসার চালানোর গুরুভার। ছোটমামা, ভুজেন্দ্র নাথ রায়, তখন ডাক্তারি পড়ছে। মেজ মামা বি ই কলেজ স্কুলে (Bengal Engineering College School) শিক্ষকতা করত এবং সন্ধ্যায় টিউশনি করত। মেজমামা চিরদিনই ব্যবসায় উৎসাহী ছিল। নিজে রসায়নের ছাত্র এবং প্রথম জীবনে কিছুদিন রাসায়নিক (Chemist) রূপে কাজ করেছিল।
সেই বিদ্যা ও অভিজ্ঞতা আশ্রয় করে এক রকমের ঠাণ্ডা পানীয়ের (Soft Drink) ব্যবসা শুরু করেছিল মেজমামা। ছোট ছোট প্যাকেটে পাউডার মিশ্রণ থাকত যা ঠান্ডা জলে মেশালে কোকাকোলার মত বুদবুদে এক পানীয় তৈরি হয়ে যেত। এই ব্যবসা মেজমামা বাড়ী থেকেই করত। সমাজসেবীর মত এই কাজের জন্য মামা দুঃস্থ বিধবা মহিলাদের নিয়োগ করত। শিক্ষকতার পাশাপাশি এই ব্যবসা থেকেও মামার কিছু আয় হত। এত বড় সংসার মেজমামার একার রোজগারেই চলত। আমি কখনো সংসারে অভাব অনটন দেখিনি। এখন ভাবলে অবাক হয়ে যাই এত লোকের ভরণ পোষণের ব্যয়ভার মামা একা বহন করত কি করে! এখানেই শেষ নয়। আমার ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ছোটমামার অকালমৃত্যু হল। ছোটমামীমা দুটি নাবালক পুত্র কন্যা, মানু আর মোয়াকে, নিয়ে একেবারে একা। মেজমামা ছোটমামার যৌথ সংসার; ছোটমামার অবর্তমানে সংসারের সব দায়িত্ব আবার মেজমামার হাতে এসে পড়ল।
মেজমামার মত এত উঁচু মনের মানুষ আমি কম দেখেছি। আমি আমার জীবনের মধ্য বয়স পর্যন্ত মামার এই উদারতা ও বদান্যতার ঠিকমত মূল্যায়ন করতে পারিনি। আজ জীবনের অন্তিম কালে এসে, বহুদেশ ও অসংখ্য মানুষ দেখার পর, অনুভব করতে পারছি মেজমামা কত অসাধারণ, কত অনন্য। কত বড় হৃদয়, কত উদার মন! আশ্চর্যের বিষয়, এমন এক পরোপকারী মানুষের শেষ জীবন অতি অশান্তিতে কেটেছে।

আমার বড় মাসীমা নলিনী বালা, মেজো মামা ব্রজেন্দ্রনাথ রায়, মা বিদ্যুৎ লতা
অকালে মেজমামীমার মৃত্যু হল, একমাত্র ছেলে, বাবু, ছন্নছাড়া বাউন্ডুলে হয়ে জীবন কাটাতে লাগল। শেষ বয়সে দিদি অর্থাৎ গয়াদার মা, আমার বড় মাসীমা-ই মেজমামার একমাত্র সঙ্গী ও ভরসা ছিল। বড় মাসীমার পরলোকগমন মামাকে শোকাহত করেছিল। অনু ও আমাকে লেখা মেজমামার সেই হৃদয় বিদারক চিঠি এখানে তুলে দিলাম।
মেজমামার চিঠি

হাওড়া 7.8.99
স্নেহের রণ,
আশা করি ভালই আছো। তোমার গয়াদার কাছ থেকে সব কিছু জানতে পারবে। দিদি চলে গেল আমার খুব ক্ষতি হল - আমি একা অসহায় দেখবার মত কেউ নেই। আমার সংসারে শান্তি বলে কিছু নেই। আমার সব আছে কিন্তু কিছু নেই। শান্তি কি – সারা জীবনে তা জানতে পারলাম না। তোমার মা যাচ্ছে যখন আসবে তার হাতে আমার জন্য একটা মজবুত ছাতা পাঠাবে। পরে চিঠি দেব। অনুপা ও তোমার ছেলেদের নিয়মিত চিঠি দিতে বলো। ইতি মামা

হাওড়া
৭-৮-৯৯
স্নেহের অনুপা –
মনের অবস্থা খুব খারাপ। দিদি ছিল আমার একমাত্র অবলম্বন – এখন একা। বাড়ীতে আর মন বসে না -- কোনরকমে মাটি কামড়ে পড়ে আছি বাবুর জন্য। বাবু আমার থেকে অসহায়। ওর সংসারে শান্তি নেই। তোমরা কবে আসছো? তোমার ছেলেদের বলবে আমাকে নিয়মিত চিঠি দিতে। আমার ভালবাসা রইল –
তোমার মেজমামা --
উপরে মেজমামার দুটো চিঠি। রণ আমার ডাক নাম। আমার আত্মীয় স্বজনের বাইরে এ নামে আমাকে কেউ ডাকে না। অনুপা অনুর আর এক নাম।
লন্ডনের জীবনে ফিরে আসি। আসলে লন্ডনের গয়াদার কথা বলছিলাম। কিন্তু গয়াদার কথা বলতে গেলে মামার বাড়ীর কথা বলতে হয়; আর মেজমামা ছাড়া মামার বাড়ী হয় না। তাই এই স্মৃতি রোমন্থন। আমি যখন আসি তখন গয়াদা একা। আমি আসার পর গয়াদা ম্যারিলিনকে বিয়ে করে লন্ডনের বার্নেট অঞ্চলে বাড়ী কিনে স্থিতি হল।
৩১ ডিসেম্বর – বর্ষশেষ ও বর্ষবরণের আড্ডা আমাদের বাড়ীতে। এর আয়োজন ও পরিকল্পনার সব কৃতিত্ব অনুর। নিমন্ত্রিতদের সংখ্যা প্রায় ত্রিশ চল্লিশ জন হয়ে যেত। এ বছর কোন কোন শিল্পী গান গাইবে, কোন কোন অতিথি আসবে, সে সব অনুই ঠিক করত। শান্তি-মীনুর বা গয়াদা-ম্যারিলিনের বাড়ীতে প্রতি বছর একই খানা। কিন্তু অনুর মেনু বা খাদ্যতালিকা এক এক বছর এক এক রকমের; প্রতি বছরই নতুন কিছুর সংযোজন। তেমনি ছিল আমন্ত্রিতদের তালিকা; পুরানোর সঙ্গে নতুন মুখের মিশ্রণ।
এমনও হয়েছে যে আমার বাড়ীতে আমন্ত্রিত আমারই অচেনা। একবার মনে আছে দরজার বেল শুনে দরজা খুলে দেখি এক ভদ্রমহিলা, হাতে একটা রঙ্গিন কাগজে মোড়া ভারী প্যাকেট। ভদ্রমহিলাকে আমি আগে কখনো দেখিনি। বললাম, “আসুন”। তারপর হাত বাড়িয়ে প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে বললাম, “দিন, আমাকে দিন “। ভদ্রমহিলা আমাকে না দিয়ে বললেন, “ মিসেস বিশ্বাস কোথায়?” ইনি আমকে চিনতেন না। ভেবেছিলেন আমি বুঝি এ বাড়ির কোন অতিথি। পরে অনু আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। ইনি ডঃ (নাম মনে নেই), অনুর নতুন বন্ধু। এ বছরের নিউ ইয়ার্স পার্টিতে নতুন অতিথি। এমনই অনু। আমাকে মাঝে মাঝে ‘সারপ্রাইজ’ দিত। এমনি ভাবে নূতনে পুরনোয় আমাদের বর্ষশেষ বর্ষবরণ আসর ঝলমল প্রাণবন্ত হয়ে উঠত।
এত মানুষের রান্না অনু একা হাতে করত দুতিন দিন ধরে। আমার কাজ অতিথি আপ্যায়ন, স্ন্যাক্স ও পানীয়ের ব্যবস্থা করা। সন্ধ্যা থেকে মধ্য রাত্রি পর্যন্ত গান বাজনা হত। প্রতি বছরই পুরানো শিল্পীর সঙ্গে দু এক জন নতুন শিল্পী থাকত। বিরতিতে খাওয়া দাওয়া সারা হত। সারা দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করার পরও আসরে বসে গান গাইত অনু। কি অপরিসীম জীবনতৃষ্ণা!
মধ্য রাত্রে স্তিমিত আলোয় বিগ বেনের ঘণ্টার শব্দে আমরা পানীয় হাতে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতাম। টিভির পর্দায় টেমসের উপর আতসবাজির প্রদর্শনী আর ‘Auld Lang Syne’ (পুরানো সেই দিনের কথা) গানের সুরে সারা ঘরের আবহাওয়া স্বপ্নময় হয়ে উঠত। চল্লিশ বছর ধরে, মাঝে মধ্যে দুএক বছর বাদ গিয়েছে হয়ত, আমাদের এই বর্ষশেষ ও বর্ষবরণের আড্ডা চলেছিল।

আমাদের বাড়িতে এক নিউ ইয়ার্স পার্টি, গৌতম, অনু ও অতিথিরা।
এছাড়াও প্রায়ই গানের আসর বসত বাড়ীতে। এত বছর ধরে অজস্র মানুষ এসেছে আমাদের সেই আসরে। তাদের মধ্যে বেশীরভাগ মানুষই হারিয়ে গিয়েছে; কারো কারো সঙ্গে মাত্র কিছুদিনের জন্য সম্পর্ক স্থায়ী হয়েছে, কারো কারো সঙ্গে সে বন্ধুত্ব গভীর হয়েছে এবং আজীবন অটুট থেকেছে।
দেবাশিস বিশ্বাস
দেবাশিস বিশ্বাস, যুবক ডাক্তার, কৃতি ছাত্র, সদ্য লন্ডনে এসেছে। কয়েকবার আমাদের বাড়ীতে আসার পর আমাদের আপন করে নিল, আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে গেল। অচিরে অনু ডাক্তার দেবাশিসের ডাক্তারি পারদর্শিতার ভক্ত হয়ে পড়ল। আমাদের কেউ সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়লে অনু আমাদের পারিবারিক ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে দেবাশিসের সঙ্গে পরামর্শ করত। আমরা যেখানেই থাকি না কেন বা দেবাশিস এবং আমাদের অবস্থানের দূরত্ব যতই হোক না কেন অনু বা আমি দেবাশিসের পরামর্শ ছাড়া কোন ওষুধ খেতাম না; বিশেষ করে আমরা যখন দেশে থাকতাম আর দেবাশিস মধ্যপ্রাচ্যে বা ইংল্যান্ডে, তখন দেবাশিসই একমাত্র দূরভাষে মুস্কিল আসান।

নিনি, দেবাশিস, কোলে কন্যা শুভা
দেবাশিস যখন কলকাতায় ফিরে স্থিতি হয়ে বসল তখন ও-ই ছিল সল্টলেকে আমদের পরিবারের উপদেষ্টা ডাক্তার। একসময় দেবাশিস বাবা মাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে এলো। এখানে এসে ওর মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে জানা গেলো। দেবাশিস তখন হারলো হাসপাতালের ডাক্তার। হারলো আমাদের বাড়ী থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে। আমরা নিয়মত ওর মাকে দেখতে যেতাম; অনু ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওর মায়ের রোগশয্যার পাশে বসে থাকত। দেবাশিস-জায়া নিনি, দর্শনের অধ্যাপক, একদা অরিন্দমের ছাত্রী। কোমল স্বভারের, প্রথম আলাপের পরই আমাদের আপন হয়ে গেলো। মধ্যপ্রাচ্যে থাকা পর্য্যন্ত দেবাশিস নিয়মিত ফোন করে আমাদের খবর নিত; দীর্ঘ সময় ধরে গল্প হত। অধুনা দেবাশিস ব্রিটেনে ফিরে এসেছে আবার; ওয়েলসের এক হাসপাতালে কাজ নিয়েছে। দেবাশিসের খবর পাই না আর। তবে প্রতি বছরের মত ৩১শে ডিসেম্বর মধ্যরাত্রে দেবাশিসের ফোন আসে। কোন বছরে এর ব্যতিক্রম হয় নি।
দেবাশিস আমাকে অনেক মানুষ ও পরিবারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম অরিন্দম চক্রবর্তী ও রাণা-তপতী বিশ্বাস। অনুর তিরোধানের খবর পেয়ে ফোন করে সমবেদনা জানিয়েছিল। ফিউনারালের দিন সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে ছিল।
রাণা ও তপতী বিশ্বাস
দেবাশিস আরও এক দম্পতির সঙ্গে আমাদের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল যাদের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা গভীর হয়েছিল এবং সে বন্ধুত্ব আজও অটুট আছে। তারা ডাক্তার রাণা বিশ্বাস ও তপতী বিশ্বাস। রাণা কৃতি ডাক্তার, তপতী বিনম্র, আন্তরিক। রানা-তপতী লন্ডনে বেশীদিন থাকেনি। আমাদের বাড়ীতে ওরা বেশিবার আসেওনি, কিন্তু এই অল্পদিনের মধ্যেই আমদের হৃদ্রতা হয়েছিল এবং তা চিরস্থায়ী হয়ে আছে।
সময়ের মাপকাঠিতে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে না। আমি বহু মানুষের সঙ্গে বহু বছর ধরে মিশেছি কিন্তু কখনো কাছের মানুষ বলে মনে হয় নি; আবার কারো সঙ্গে ক্ষণকালের পরিচয় গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছে। রাণার সহৃদয়তা আমাকে স্পর্শ করেছিল।

ডাঃ রাণা বিশ্বাস (অধুনা সিঙ্গাপুরবাসী) ও অনু, ৯ নর্থউইক এভেন্যু হ্যারোতে
যেখানেই থাকি না কেন আমাদের পারিবারিক চিকিৎসা সমস্যায় রানা অতি আন্তরিকভাবে আমাকে পথ দেখিয়েছে। কিন্তু সর্বোপরি তপতীর উৎসাহ ও আগ্রহ এবং অনুর সকলকে-আপন-করে-নেওয়ার অসাধারণ শক্তি আমাদের দুই পরিবারের সম্পর্ককে জীবিত রাখার মূল কারণ। আরও একটা কারণ আছে হয়ত। তপতী ভাল রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়। আমি সুচিত্রা মিত্রের ভক্ত। সুচিত্রা মিত্র গায়কির সুযোগ্যা উত্তরসূরী পূর্বা দাম। তপতী পূর্বা দামের শিষ্যা।

তপতী বিশ্বাস – অধুনা সিঙ্গাপুরবাসী, ৯ নর্থউইক এভেন্যু হ্যারোতে
তপতীর গান আমার ভাল লাগে; ওর গানে সুচিত্রা গায়কির ছোঁয়া পাই। রাণা লন্ডন ছেড়ে সিঙ্গাপুরে উচ্চপদের কাজ নিয়ে চলে গেল। চোখের আড়াল হলেও মনের আড়াল হয়নি। তপতী ও অনু নিয়মিত ফোন করত একে অন্যকে; সময়ের জ্ঞান থাকত না।
আরও একটা কারণ আছে। তপতী আমার কবিতা পড়ে। পৃথিবীতে যে গুটিকতক পাঠক আছে আমার সাহিত্যের, গল্প, কবিতার, তপতী তাদের অন্যতম। পড়ে ও মতামত জানায় যা যে কোন লেখকের কাছেই পরম পাওয়া। অনু এখন বাকশক্তি রহিত, স্মৃতি লোপ পেয়েছে। অনুর বন্ধুপরিবারবর্গই ছিল আমার বন্ধু। এখন আর কেউ ফোন করে না। শুধু দু জন ব্যতিক্রম। একজন তপতী, অন্যজন নীলাঞ্জনা। একজন সিঙ্গাপুরে, অন্যজন নিউ ইয়র্কে। আমার একমাত্র আশা আমার শেষ দিন পর্যন্ত যেন এদের ফোন পাই।
এই লেখার কিছুদিনের মধ্যেই অনু আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যায়। রাণা তপতী দুঃখ প্রকাশ করে সমবেদনা জানিয়েছিল। তপতী এখনো নিয়মিত ফোন করে ও ইমেলে খবর নেয়।
দীপেন মুখোপাধ্যায়

দীপেন মুখোপাধ্যায়
টেগোর সেন্টারে থাকাকালীন বহু মানুষের সংস্পর্শে এসেছি। তাদের অনেকের কথাই এই আলেখ্যে বলেছি। তারা সবাই রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও স্বনামধন্য। তারা ছাড়াও বহু সংখ্যক সদস্য ও রবীন্দ্রপ্রেমীর সঙ্গে মিশেছি। কিন্তু কেউই সৌজন্য বিনিময় পেরিয়ে বন্ধুত্বের স্তরে পৌঁছয় নি। একমাত্র ব্যতিক্রম দীপেন, ডঃ দীপেন মুখোপাধ্যায়, মেডিকেল ডাক্তার। দীপেন রবীন্দ্র ভক্ত, দীপেন-জায়া রাকাও। এরা দুজনেই স্বতঃস্ফুর্তভাবে টেগোর সেন্টারের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। কালে দীপেন-রাকার সঙ্গে অনু ও আমার সখ্যতা গড়ে উঠে। আমার মনে হয় এই বন্ধুত্ব দৃঢ় করা ও ক্রমবর্ধমান রাখার কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে অনুর। মুখোপাধ্যায় দম্পতির কাছে আমরা অমলেন্দুদা ও অনুদি। ক্রমে রাকার সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে গেলেও দীপেনের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব ঘন থেকে ঘনতর হল। দীপেন প্রায়শঃই আমাদের বাড়ি আসত এবং বহু বিষয়ে আলোচনা হত। দীপেনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অম্লমধুর। এইসময় টেগোর সেন্টারের বিপর্যয়ের দিনে আমরা দুজনেই টেগোর সেন্টার রক্ষার জন্য চেষ্টা করছিলাম। নিয়মিত দীপেনের সঙ্গে এই বিষয়ে কথাবার্তা হত। এই ব্যাপারে আমি একটু বেশি উৎসাহী ছিলাম এবং অনেক উদ্যোগ দেখাচ্ছিলাম। একদিন আমার কোন কাজ নিয়ে দীপেন তীব্র সমালোচনা করলে আমাদের মতানৈক্য ঘটে। আমি আঘাত পাই ও নিজেকে গুটিয়ে নিই। সৌভাগ্যবশতঃ দীপেন তার স্বাভাবিক গুণে আমার অনীহাকে অতিক্রম করে আমাদের বন্ধুত্বকে চিরস্থায়ী করে।
দীপেনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আরো গভীর হয়ে উঠার অন্য একটা কারণ ছিল। দীপেন আমার লেখা, বিশেষ করে কবিতা, মন দিয়ে শুনত ও মাঝে মাঝে প্রশংসা করত। দীপেনের সঙ্গে সাহিত্য শিল্প ও আধুনিক সামাজিক সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে আনন্দ পেতাম। দীপেন অনুর গান ভালবাসত। দীপেনের সঙ্গে অনুর সম্পর্ক পুরানো দিনের বৌদি-দেবরের মত মধুর ছিল – হাসি, আবদার, কপট তিরস্কার ভরা। আমার খুব ভাল লাগত। অনু আর নেই। সে দিনগুলো হারিয়ে গেছে।
ইদানীং দীপেন আর আগের মত প্রতি সপ্তাহে ফোন করে না বা হঠাৎ হঠাৎ বাড়িতে আড্ডা দিতে আসে না। একা হয়ে যাচ্ছি।
ক্রমে ক্রমে কথা বলার মানুষ কমে যাচ্ছে।
ক্রমশঃ