এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • রথ দেখা কলা বেচা:  আমেরিকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা

    PRABIRJIT SARKAR লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৯ এপ্রিল ২০২৫ | ৫৩ বার পঠিত
  • আমার কাঁচা পয়সা নেই যে বিদেশ বেড়াতে যাব। আমার কলা (বিদ্যা) বেচতে এসে আমি যেটুকু রথ দেখতে সুযোগ করে নি তাই নিয়ে আমার বেড়ানোর গল্প।

    স্বপ্নের আর দুঃস্বপ্নের আমেরিকা

    প্রবীরজিৎ সরকার

    আমেরিকার ইন্ডিয়ানা রাজ্যে (ওরা বলে স্টেট) সাউথ বেন্ড বলে একটা এলাকায় নোতরদাম বলে একটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সেখানে এক সিমেস্টার ভিজিট পেলাম। কেলগ ইন্সটিউটে।

    আমেরিকা অনেক রকম ভিসা দেয়। আমার হল J1 । ওরা ব্রিটিশ এয়ারের টিকিট পাঠালো:কলকাতা দিল্লি লন্ডন নিউ ইয়র্ক শিকাগো। নিউ ইয়র্ক ব্রেক অবশ্য আমি চেয়েছিলাম। দু চার দিন আগে রওনা হয়েছিলাম একটু বেড়াবার জন্য। ফেরার সময় ঠান্ডা থাকবে ঘুরতে অসুবিধা হবে।   

    কলকাতা এয়ারপোর্টে ব্রিটিশ এয়ারের over smart কর্মী বলল গ্রীন কার্ড দেখান। আমি বললাম আমার নেই। আমি J1 ভিসায় যাচ্ছি। মনে হল এই ভিসার ব্যাপার কিছুই জানে না। শুধু গ্রীন কার্ড জানে। কাগজ দেখে একটু কিন্তু কিন্তু করে ছেড়ে দিল। লন্ডনে নেমে যেই নিউ ইয়র্কের ফ্লাইট ধরতে লাইন দিয়েছি এক 'কুত্তা' ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এল। প্রভুর বাড়ি ঢুকছো কে তুমি? লাইন থেকে বার করে জেরা শুরু করল। তখনো 911 ঘটেনি। তাতেই এই! সবাই আমার আগে প্লেনে উঠল। আমার কাগজ পত্র দেখে কিছুক্ষন জেরা করে ছেড়ে দিল। সবার শেষে উঠলাম। হ্যান্ড লাগেজ রাখতে বেশ অসুবিধা হয় বলে তড়িঘড়ি লাইন দিয়ে উঠছিলাম। এগুলো যদি racism না হয় তাহলে racism বলে কিছু নেই! পাসপোর্ট ভিসা দেখে বোর্ড পাস দেয়।. আবার প্লেনে ওঠার সময় সাদাদের দেশের পাসপোর্ট না দেখলে লাইন থেকে বার করে জেরা! এটা UKতেই বেশি হয়। এরা বলবে আমরা ডিউটি করছি। হিটলারের গেসটাপো ও ডিউটি করত।

    নিউ ইয়র্কে কিন্তু ইম্মিগ্রেশন অফিসার যথেষ্ট ভদ্র। কাগজপত্র দেখে দ্রুত ছেড়ে দিল। আমার MA ক্লাসের এক বন্ধু এলো। ওর বাড়ি নিয়ে গেল। ওর সঙ্গে নিউ ইয়র্ক ঘুরলাম। হাডসন রিভারে বোট ট্রিপ নিয়ে একদিন ঘুরলাম। পরে অনেকবার এসেছি কিন্তু স্ট্যাচু অফ লিবার্টি আজো দেখা হয়নি।

    শিকাগো এসে ট্যাক্সি করে ক্যাম্পাস এলাম। ওখানে সুন্দর ফ্ল্যাটে থাকার ব্যবস্থা ছিল। ভিতর দিয়ে পথ ছিল আমার অফিস আর কম্পিউটার ঘরে আসার। বিকালে আমার MA ক্লাসের আরেক বন্ধুর সাথে দেখা হল।  ও ছিল হেড বা চেয়ার পারসন অর্থনীতি বিভাগ। ওর সঙ্গে আরো অনেকে ওই বিভাগে heterodox অর্থনীতি চর্চা করত। আমার গবেষণা এই লাইনে। এসেছিলাম এই heterodox অর্থনীতির গবেষণা করতে। ওই এই ফেলোশিপের সন্ধান দিয়ে apply করতে উৎসাহ দিয়েছিল।

    সন্ধ্যাবেলা বন্ধুটি  গাড়ি করে বাজারে নিয়ে গিয়ে যা যা দরকার হতে পারে কেনালো। মাঝে মাঝেই নিয়ে যেত কেনা কাটার জন্য স্থানীয় মলে। একটা হাঁটা পথে স্টোর ছিল সেখানেও গিয়ে বাজার করেছি। কয়েকবার ওর সঙ্গে শিকাগো আর লেক মিশিগানের পারে গেছিলাম। ভারতীয় রেস্টুরেন্টে সাত আট ডলারে বুফে খাওয়াতো। শেষে সিজলার চিকেন আসতো। এত কম দামে এত খাওয়া! শিকাগোতে গাড়ি পার্ক করার বেশ ঝামেলা। প্রচুর খরচ। ওর বেশ গুনাগার যেত।

    আরেকজন আমায় মাঝে মাঝেই শিকাগো নিয়ে যেত শনি রবিবার ছুটির দিনে। ওর নাম আলবার্ট লি মে। খুব ভাল লোক। বেশ কিছুদিন হল মারা গেছেন। আলবার্ট ওর ছেলের ফ্ল্যাটে জানলা দিয়ে কিছু ডলার রাখতো। ও জানত ছেলে একটা শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার লড়াই লড়ছে কিন্তু রোজ খেতে পায় না। বাবার কাছে চাইবে না। বাবার প্রাণ কাঁদত। ওই জন্য আলবার্ট শিকাগো যেত। ছেলের দর্শন পেত না। কিন্তু পিতৃ স্নেহের টানে টাকা রেখে যেত যদি ও নেয়।

    ওখানে আরো এক বাঙালি ছেলের দেখা পেলাম। আমি এক সিমেস্টার ইন্ডিয়ান statistical ইনস্টিটিউটে MSTAT স্টুডেন্টদের ডেভেলপমেন্ট ইকনমিক্স পড়িয়েছিলাম। সেই প্রথম আর শেষ ব্যাচে ও  পড়ত। ওকে এখানে পেয়ে গেলাম। আমার কিছু data ডাউনলোড করার সমস্যা হচ্ছিল। ওর অফিসে শক্তিশালী কম্পিউটার আর ইন্টারনেট ছিল। ওই সব করে দিল।

    ও আগে ব্লুমিংটনে পড়াশুনা করত। ওখানে একটি বাঙালি মেয়ে  গবেষণা করত আর ক্লাস নিত। একদিন আমার ওই প্রাক্তন ছাত্র  ড্রাইভ করে নিয়ে গেল ওখানে। দু দিন ওখানে থাকলাম। আসে পাশের এলাকায় ঘুরলাম। এখন ওরা নিউ ইয়র্কে থাকে। পরে কোন একবার ওদের ফ্ল্যাটে এসে এক রাত কাটিয়েছিলাম।

    এখানে আমেরিকান ফুটবল বলে একধরণের খেলা খুব জনপ্রিয়। এরা একবার বোধ হয় আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। অনেক দোকানে তার স্মৃতিফলক কিনতে পাওয়া যেত। এখানে যেসব ল্যাটিন আমেরিকার ছেলে মেয়েদের চিনতাম তারা ওই খেলাকে ফুটবল বলে জেনে হাসাহাসি করত। ওরা ইন্টারনেট থেকে ওদের দেশের ফুটবল মাঝে মধ্যেই দেখত। একদিন এখানে উনিভার্সিটি স্টেডিয়ামে এই আমেরিকান ফুটবলের আয়োজন হয়েছিল। চারিদিকে হৈ হৈ। আকাশে টিভি ক্যামেরা নিয়ে হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। এক কোরিয়ান অধ্যাপক কোয়ান কে দেখলাম খেলা দেখতে যাচ্ছে। ওর বউ আমেরিকান আর ওকেও শুনেছিলাম এই খেলার মুণ্ডুপাত করতে। বললাম তুমি যাচ্ছ কেন? বলল গৃহশান্তি বজায় রাখতে। বউ এগিয়ে গেছে। তাই আমি ছুটছি। এই কোয়ান খুব রসিক। একদিন বলল আমেরিকায় ছেলে মেয়েরা ক্লাসে টেবিলের উপর পা তুলে বসলেও কিছু বলতে পারবে না। বলল আমার ক্লাসে মেয়েরা অন্তর্বাস না পরে স্কার্ট পরে পা তুলে এমন ভাবে বসে ওদের দিকে তাকালেই যা দেখি! পড়াব কি? সত্যি মিথ্যা জানি না। হয়ত মজা করেই বলেছে।

    আমি যখন গেছিলাম বেশ গরম। ঘরে AC চালাতে হত। ঠান্ডা গরমে শরীর ভাল যেত না। খুঁজে পেতে বিশাল ক্যানে সস্তায় অরেঞ্জ জুস কিনে সেই খেতাম কয়েক গ্লাস করে রোজ। কি ভাবে যেন ইউরিন ইনফেকশন হয়ে জ্বর এল। মেডিকেল ইন্সুরেন্স ওরা দিয়েছিল। আলবার্ট এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে এল। ডাক্তারের ফি দিতে হল তিরিশ ডলার। এটাই নাকি ইন্সুরেন্স কনসেসন দিয়ে rate! ইন্স্যুরেন্সের নিয়ম ছিল প্রথমে নিজে তিনশ ডলার অব্দি খরচ করবে। তারপর লাগলে ইন্সুরেন্স কোম্পানি দেবে। গা কড় কড় করছিল। ডাক্তা্রবাবু ইতালিয়ান আর চৈনিক মিশ্রণ। বেশ রসিক। বললেন একা থাকো? সেক্স পেলে কি কর? আমিও বলে দিলাম হস্ত মৈথুন। হেসে বললেন আমাদের তো এটাই একমাত্র উপায়। বিয়ে করেও তো রেপ কেসে ঝুলতে হয়। এরপর ডাক্তারকে জপালাম যাতে এন্টিবায়োটিক ফিজিয়ান স্যাম্পল দেয়। দিল। ওতেই রোগ সারল। ইউরিন স্যাম্পল নিয়েছিল। কি পেয়েছিল জানি না। আমি আর যাই নি। দেশে ফেরার পর ল্যবরোটরী থেকে বিল আসতো। ওখানে থাকার সময় রিপোর্ট পাঠিয়ে টাকা চাইলে দিতাম।

    দাঁতের ইন্সুরেন্স চাও বলতে হ্যা বলে ফেলেছিলাম। ওটা ফ্রি ছিল না। মাসে মাসে ফালতু কিছু ডলার কাটতো। আলবার্ট বলল ইন্সুরেন্স করেছ যখন একদিন ডাক্তারের কাছে যাও। আগে ভাগে না দেখালে পরে এমারজেন্সি হলে দেখবে না। তাই ওর সঙ্গে গেলাম। ডাক্তারবাবু গুচ্ছের X Ray করে খুঁজে পেলেন একটা দাঁতে সবে গর্ত হতে শুরু করেছে। আমি তো টের পাইনি। সমস্যা ছিল না। ও দেশে ডাক্তারের কথা শুনতে হয়। তাই ফিলিং করাতে হল। চিন চিন ব্যথা হল কদিন। শুধু শুধু সুস্থ শরীর কে ব্যস্ত করা!

    প্রথম থেকেই আলাস্কা যাবার ইচ্ছা হত। শুরুতে গরম ছিল। যাওয়া যেত। কিন্তু বেড়াবার টাকা হাতে আসে নি। পরে যখন কিছু জমালাম তখন বেশ শীত পড়তে শুরু করেছে। তাই আলাস্কা যাবার ইচ্ছা থাকলেও যাবার কথা ভাবিনি। বরং নাতিশীতোষ্ণ ক্যালিফোর্নিয়া গেছিলাম। সান্তা মনিকা আর সান ফ্রান্সিসকো। সেও যাওয়াটা হঠাৎ হল। প্লেনের টিকিটের দাম দেখে সাইট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। একটা অপশন এল কত টাকা হলে যাবে। আমি খুব কম কিছু লিখে সাইট থেকে বেরিয়ে যাই। অনেকদিন বাদে আমায় ইমেল করল একটা বিশেষ দিনে যদি যাও শিকাগো লস এঞ্জেলেস রিটার্ন টিকিট তোমার দামে পাবে। আমি দেখলাম ওই সময় আমার কোন অসুবিধা নেই। তাই বেরিয়ে পড়লাম।

    সান ফ্রান্সিসকো বাসে যাব ভাবলাম। দেখলাম প্লেন বাসের চেয়ে কম টাকায় নিয়ে যাচ্ছে। তাই প্লেনে গেলাম। সব জায়গায় ইয়ুথ হোস্টেলে উঠেছিলাম। ওখান থেকে conducted ট্যুর নিয়ে সান দিয়াগো জু , ডিসনি ল্যান্ড আর Yosemite ন্যাশনাল পার্ক ঘুরেছিলাম।

    লস এঞ্জেলেস শহর শুনেছিলাম খুব বোরিং তাই যাই নি। কাছেই সান্তা মনিকা সমুদ্র তটে নুড়ি কুড়িয়েছি। সানফ্রান্সিস্কো শহরটা ভাল লেগেছে। সমুদ্রের তীরে রোদ পোহাচ্ছে এমন প্রচুর সিলমাছ দেখেছিলাম। লঞ্চে করে Alcatraz দ্বীপ ঘুরেছিলাম। এখানে ম্যাকডোনাল্ডের আসে পাশে প্রচুর ভবঘুরে আর ভিখারি দেখলাম। মনে হল শীতের এলাকা থেকে সবাই এখানে এসে হাজির হয়েছে! ন্যাপা ভ্যালি ওয়াইন কান্ট্রি ট্যুরে আকণ্ঠ মদ্য পান করেছিলাম অনেকে।

    এক উইক এন্ডে MA ক্লাসের আরেক বন্ধুর বাড়ি  বার্মিংহাম গেলাম। মানুষ এত অগোছালো হতে পারে ওকে দেখার আগে ধারণা ছিল না। ভয় হত হয় আমি নয় পাসপোর্ট হারিয়ে যাবে। তখন সদ্য বিয়ে করেছিল। মার্কিন ভিসার কালরাত্রি যাপন করছিল ওরা। তাই ও এখানে আর বউ কলকাতায়।

    একদিন গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখার প্ল্যান করে ফিনিক্স রওয়ানা হলাম। প্লেনে জানলার ধারে বসে ছবি তুলছিলাম। আমায় সহযাত্রী হিসাবে পাশে পেয়ে বিরক্ত এক আমেরিকান একটু প্রসন্ন হয়ে জানতে চাইল কিসের জন্য যাচ্ছ ফিনিক্স? আমি বললাম ওখান থেকে বাসে করে ফ্লাগস্টাফ যাব দুদিন থাকব আর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ট্যুর নেব। এতক্ষন মেক্সিকান ভেবে বিরক্ত ছিল। ভারত থেকে এসে ঘুরছি শুনে খুশি হয়ে বলল সেডোনা ঘুরে যেও। খুব ভাল লাগবে। বললাম ঠিক আছে যাব।

    ফিনিক্স নেমে বাস ধরে ফ্লাগস্টাফ ইউথ হোস্টেলে উঠলাম। চারিদিক মেক্সিকানে ভর্তি আর ওদের খাবার দাবার পাওয়া যাচ্ছে সস্তায়। তাই খেতাম রোজ। একদিন গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন যাবার টুরিস্ট বাসে উঠলাম। যে মহিলা গাইড ছিল সেও মনে হল আমার উপর অপ্রসন্ন। কি একটা দেখিয়ে যেই বলল ওটার নাম ব্রহ্মা আমি বললাম এই নাম কি ভারতের হিন্দু ধর্মের দেবতা ব্রহ্মা থেকে এসেছে? তখন ও বুঝলো আমি ভারতীয়। আমায় বলেই ফেলল তোমায় মেক্সিকান ভেবেছিলাম। বুঝলাম মেক্সিকান ইম্মিগ্রেশন নিয়ে সেই যুগেও এদের ডোনাল্ড ট্রাম্প type মনোভাব। মেক্সিক্যানরা আমায় দেখলে ওদের ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করতো। এখন তো McDonald ও Barito রাখে আর কর্মীরা প্রথমে আমার সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলে তার কিছু প্রথমে বুঝতে পারি না। ভাবি এদের ইংরাজি accent আমার বোধগম্য হচ্ছে না। পরে ইংরাজি বলে। তখন বুঝি প্রথমে মেক্সিকান বলেছিল। Berkley হোক আর ওয়াশিংটন ডিসি একই অভিজ্ঞতা।

    যাই হোক গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখে একদিন সেডোনা গেলাম। লাল পাহাড়ের দেশে। পথে কিছু 'ইন্ডিয়ান' জনপদ বাজার দেখাল।

    ফেরার বাস ধরে ফিনিক্স আসছি। বাসটা এয়ারপোর্ট যাবে। আমি ফিনিক্স ইয়ুথ হোস্টেলে থাকব। তাই ড্রাইভারকে জিগ্যেস করলাম পথে ঠিক জায়গায় নামিয়ে দিও। ড্রাইভার বলল আমি নিজে তোমায় পৌঁছে দেব। আগে এয়ারপোর্ট যাই প্লেনের প্যাসেঞ্জার নামাই। এয়ারপোর্ট পৌঁছে বলল এখান থেকে ট্যাক্সি ধরলে দশ ডলার লাগবে। আমি তোমায় তিন ডলার চার্জ করব। আমি রাজি হলাম। তারপর ওই দৈত্য বাস নিয়ে সোজা ইউথ হোস্টেল! পথে সবাই হতভম্ব। হস্টেলের ম্যানেজার ও ঘাবড়ে গেল। একটা উটকো প্যাসেঞ্জার নিয়ে একটা এয়ারপোর্ট বাস এসেছে!

    লাগেজ রেখে শহরটা চক্কর দিয়ে কিছু খেয়ে ফিরে এলাম হোস্টেল। সবাই গল্প গুজব করছে। সেখানে একজন সিনিয়র আমেরিকান বললেন উনি বিয়ার খেতে যাবেন কেউ কি যাবে? কেউ রাজি নয়। আমি বললাম আমি যাব। আমায় নিয়ে উনি বার থেকে বারে খুঁজলেন ইমপোর্টেড নন আলকোহলিক বিয়ার। কোথাও পাচ্ছেন না। আমি বললাম তুমি বিদেশি খুঁজছ কেন? নন আলকোহলিক বা কেন? উনি বললেন আমেরিকার সব বাজে। আমরা যেমন আমাদের দেশে ফরেন খুঁজি। আর উনি বিয়ারের পুষ্টি চান কিন্তু নেশা চান না। অনেক খুঁজে শেষে পেলেন। স্বল্প বসনা বার ললনা প্রচুর ঘুরে বেড়াচ্ছে এরকম বারে বসে Budweiser বিয়ার খেলাম। উনি আমার সঙ্গ পেয়ে খুশি হয়ে বললেন কাল যখন যাবে আমি তোমায় এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেব। আমি একটা গাড়ি ভাড়া করেছি।

    পরদিন ফ্লাইট ধরতে বেরোচ্ছি। ইয়ুথ হস্টেলের মেয়ে ম্যানেজার চেঁচামেচি করতে লাগলেন। তোমরা কোন সার্ভিস দাও নি। নিয়ম মেনে একটা সার্ভিস দিয়ে যাও। শাওয়ার বাথ এলাকা পরিস্কার করে দাও। আমি একা হলে কেটেই পড়তাম। উনি নিয়ম মেনে পরিষ্কার করতে লাগলেন। আমায়ও সাহায্য করতে হল। তারপর উনি ড্রাইভ করে এয়ারপোর্ট নিয়ে এলেন। আমার ফ্লাইট ধরলাম।

    প্রখ্যাত অধ্যাপক রোনাল্ড জোনসের সঙ্গে কলকাতায় আলাপ হয়েছিল। এখানে এসে যোগাযোগ করে রচেস্টার গেলাম। ওখানে দু দিন রইলাম। একদিন লেকচার দিলাম। সন্ধ্যায় উনি খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। গাড়ি দূরে পার্ক করা ছিল। বেরোতে যাব মুসল ধারে বৃষ্টি। হঠাৎ দেখি রোনাল্ড জোন্স ওই ঠান্ডাতে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বেরিয়ে গেলেন। তারপর দেখি গাড়ি থেকে বড় ছাতা নিয়ে এসেছেন। উনি আমার শিক্ষকদের শিক্ষক! তিনি নিজে ভিজে ছাতা নিয়ে এলেন! কোনদিন ভুলব না। আগে জানলে বারণ করতাম।

    ওখানে পরিচিত এক বাঙালি অধ্যাপক পরিবার নিয়ে থাকত। তার এক বছরের ফেলোশিপ। আমার সঙ্গে ওরা নায়াগ্রা ফলস বেড়াতে গেল। বোটে করে ফলসের কাছে গেছিলাম। কদিন ভালোই কাটল।
    নোটরদাম যখন এসেছিলাম চারিদিক সবুজ। ঠান্ডা পড়তে লাগল আর গাছগুলোর পাতা হলুদ হয়ে গেল।

    তারপরে ভীষণ ঠান্ডা পড়ে গেল। গাছ গুলো ন্যাড়া হয়ে গেল। বরফ পড়ে রাস্তা ঘাট পিচ্ছিল। চলা যায় না। রান্নার সুযোগ থাকলেও বাইরে বেশি খেতাম। কিছু চাল ডাল কেনা ছিল তাই মাঝে মধ্যে রান্না করতাম। সেই যুগে আমার  বাড়িতে ওয়াশিং মেশিন ছিল না। তাই ওই মেশিন কি করে ব্যবহার করতে হয় জানতাম না। একদিন রাতে গিয়ে নির্দেশিকা পড়ে কয়েন ফেলে জামা কাপড় বেড সিট কেচে শুকিয়ে নিলাম।

    একদিন এখানে আমার লেকচারের ব্যবস্থা হল। সেটা দিয়ে আমার কাজ শেষ হল। একটা পেপার ড্রাফ্ট করেছিলাম।

    ডিসেম্বর আসতেই দেখি ক্যাম্পাস ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আমার বন্ধুও   সপরিবারে কলকাতা চলে গেল। আমার টিকিট 24 ডিসেম্বর ছিল। আমি ভেবেছিলাম এক সিমেস্টার মানে অত দিন থাকতে হবে। পরে বুঝলাম অতদিন শুন শান ক্যাম্পাসে একা ভুতের মত থাকলে পাগল হয়ে যাব। টিকিট পরিবর্তন করে 18 ডিসেম্বর করলাম। শেষের দু চারদিন কোন ক্যান্টিন খোলা পেলাম না। ভাতে সিদ্ধ ভাত খেতে হল। কয়েকবার বন্ধ ক্যান্টিনের বাইরে মেশিনে কয়েন ফেলে স্যান্ড উইচ খেয়েছিলাম। একদিন তো ডলার জলে গেল। স্যান্ড উইচ বেরোল না।

    ফেরার টিকিট ছিল সাউথ বেন্ড ডেট্রয়েট লন্ডন কলকাতা। সাউথ বেন্ড থেকে হ্যান্ড লাগেজ কেড়ে লাগেজে দিয়ে দিল। এটা আমেরিকায় হামেশাই করে। লাগেজে চাকা থাকলে সেটা ভাঙবেই। ছুঁড়ে ছুঁড়ে ছোট লাগেজ রাখে বিশেষ করে যেটা শেষ মুহূর্তে কেড়ে লাগেজে পাঠায়। এরকম একটা নতুন লাগেজ কেমব্রিজে আমার অফিসে পড়ে আছে। কর্নেল যাবার স্মৃতি।

    ডেট্রয়েট এসে ফাঁপড়ে পড়লাম। সব লাগেজ নিয়ে কোথায় লন্ডন যাবার ফ্লাইট পাব কিছু বুঝছি না। একজন বলল অন্য কোথাও যেতে হবে। বাইরে এসে বাসের খোঁজ করলাম। দিল্লির মত ডোমেস্টিক থেকে ইন্টারন্যাশনাল যাবার বাস নেই। একটা বাস আসে পার্কিং থেকে এয়ারপোর্ট। ওই বাসের ড্রাইভারকে বললাম। সেই ড্রাইভার করুণা করে তার বাসে করে নিয়ে গেল। আমায় বলল তুমি সেই কলকাতা থেকে এসেছ আমাদের ভাষা ঠিক ঠাক বলছ আর দেখ আমি এক বর্ণও বাংলা বলতে পারি না। সেই জন্য তোমায় পৌঁছে দিচ্ছি ফ্রি। উনি আমার কাছে দেবদূত হয়ে দেখা দিয়েছিলেন।

    লন্ডন পৌঁছে বহুক্ষণ - বারো থেকে চোদ্দ ঘন্টা - এয়ারপোর্টে থাকতে হয়েছিল। ফুড কুপন হোটেল কিছুই দেয় নি। সে যুগে দিত। এমন কি Aeroflot ও দিত। এমিরেটস তো দুবাইতে ভিসা করে লিমুসিনে করে হোটেলে পাঠায় ফ্রি।

    ফ্লাইটে আমার পাশে এক বাঙালি পরিবার বসেছিল। ওদের বাচ্চাটা মাঝে মাঝে মজা করে চিৎকার করে উঠছিল আর পিছনে এক ডিসপেপ্সিয়ার রুগী সিটে ঠ্যালা মারছিল। খিঁচ খিঁচ করছিল কেন সিট হেলিয়ে দিয়েছি। ওনার টা সোজা রাখবেন তাই আমাকেও সোজা রাখতে হবে। কপাল। যখনই যাই এরকম উৎপাত সহ্য করতে হয়। পাশের বাঙালি পরিবার সিট হেলিয়ে দিয়েছেন ওদের পিছনের লোক উৎপাত করেনি। এর পরেও অনেকবার এই ধরণের খিটকেল লোক পেয়েছিলাম। যাই হোক দু রাত জেগে বাড়ি এলাম। প্রথম আমেরিকা ভ্রমণ সাঙ্গ হল।

    প্রথম আমেরিকা আসার পর এক দশক আর আমেরিকা যাওয়া হয়নি। প্যারিস কেন্দ্রিক ইউরোপ ঘুড়ছিলাম। পরে কেমব্রিজে নতুন ধরনের গবেষণায় যুক্ত হলাম। আইনের অধ্যাপক-গবেষকরা নানা অর্থনৈতিক বিষয়ের আইনকে সংখ্যায় পরিণত করছিলেন আর আমি সেই ডাটা নিয়ে আইনের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে গবেষণা করতাম। এই বিষয়ে আমেরিকাতে অনেক সেমিনার হত। প্রথমে কোর্টল্যান্ড (SUNY Cortland) যাবার দরকার হল। কলকাতায় ভিসা নেবার সময় হল না। লন্ডন থেকে চেষ্টা করলাম। এক দেশে থেকে অন্য দেশে ভিজিট ভিসায় গেলে আরেক দেশের ভিসা দিতে চায় না। আমি দুবার UK একবার সুইজারল্যান্ড একবার ফ্রান্সের ভিসা অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে পেয়েছিলাম। এবার দেখি কি হয়? US এমবাসীতে ফোন লাগালাম। সব খুলে বললাম। ওরা আমার কেমব্রিজ কানেক্সন ডিটেলে দিতে বললো। কলকাতার খুঁটিনাটি চাইল। তারপর অন লাইনে টাকা নিয়ে একদিন সকালে আটটায় আসতে বলল।

    সকাল সাতটায় এমবাসী এসে দেখি কয়েক হাজার লোককে আসতে বলেছে। বিশাল লাইন। বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা আনতে বারণ। ফাইল ব্যাগ আনতে বারণ। তাই আমি কোথাও বসে আটটায় এলাম। তখন লাইন চলতে শুরু করেছে। খুব দ্রুত গেটে পৌছালাম। দুজন বীভৎস দর্শন সিকিউরিটি কি যে বলছে কিছু বুঝছি না। জুতো খুলতে বললে প্যান্ট খুলে ফেলছি। যাই হোক শেষে কাউন্টারে ঝড়ো কাকের মত এসে পৌঁছালাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে আবেদন জমা দিয়ে বসতে না বসতেই সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকল। সাক্ষাৎকার যিনি নিচ্ছেন তার কথা ও কিছু বুঝছি না। আসলে তিনি বাংলা বলছিলেন। এত কাল বাইরে থেকে ওনার চেহারা আর ভাষা এমন পাল্টেছে ভাবা যায় না! উনি কলকাতারই লোক। ওরা আমায় বাজাবার জন্য এরকম লোক বেছে ছিল। তিনি আমার জীবনের পুরো ইতিহাস পড়ে নিয়েছিলেন। হঠাৎ বলে বসলেন কলেজ কেটে বিজলিতে কটা সিনেমা দেখেছো? শ্রীহরির কচুরি প্রায়ই খেতে? এই ভাবে আমায় ভালো করে বাজিয়ে নিয়ে দশ বছরের ভিসা দিয়ে দিলেন।

    ভিসা নিয়ে টিকিট কেটে নিউ ইয়র্ক সিরাকিউস হয়ে কোর্টল্যান্ড এলাম। কোন কুত্তা ঘেউ ঘেউ করে নি। কিছু স্থানীয় বাঙালি অধ্যাপকও এসেছিলেন। ওদের গাড়িতে আসে পাশে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম।

    ফেরার সময় সিরাকিউসে এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি মাথা খারাপ করে দিয়েছিল। তখন সিগারেট খেতাম। লাইটার লাগেজে দিয়েছিলাম। সারা লাগেজ ঘেঁটে সেটা বার করা হল। এরকম আরো অনেক ঝামেলা সহ্য করে প্লেনে উঠে নিউ ইয়র্ক লন্ডন হয়ে কেমব্রিজ ফিরলাম।

    পরের বছর কেমব্রিজের টিমের সঙ্গে আমাদের নতুন গবেষণামূলক পেপার পড়তে নিউ ইয়র্ক আসার প্ল্যান হল। আমি তখন প্যারিস থাকতাম। ওখান থেকে কেমব্রিজ এলাম। আমার সাজেশনে স্টানস্টেড এয়ারপোর্ট থেকে ম্যাক্সজেট ধরার পরিকল্পনা হল। কম দামে ওরা সব বিজনেস ক্লাস টিকিট দিচ্ছিল। স্টানস্টেড কেমব্রিজ থেকে ট্যাক্সিতে আধ ঘন্টার পথ। টিমের সবাই বোর্ড পাস পেয়ে গেল। ওরা ব্রিটিশ নাগরিক। আমার পিছনে কুত্তা লাগল। একজন কালা আদমি কেমব্রিজ ভিজিট করে সাদাদের সঙ্গে নিউ ইয়র্কে প্রভুর দেশে পেপার পড়তে যাচ্ছে! একই অনাচার! আমি সঙ্গীদের বললাম তোমরা চলে যাও। আমি পিছনে আসছি। বেশ কিছুক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে তারপর ছাড়ল। আমার অভিশাপে মনে হয় ওই বিমান কোম্পানি কদিন বাদে দেউলিয়া হয়ে গেছিল। নিউ ইয়র্কে ধ্বংস হওয়া টুইন টাওয়ারের কাছে বড় হোটেলে ছিলাম।

    নিউ ইয়র্ক law স্কুলে কনফারেন্স। ঘড়ি ধরে বলতে হবে। আঠারো মিনিট। আইন বিশারদ সাইমন বলল দশ মিনিট তাই আমায় econometric পার্ট বলতে আট মিনিট দিল। ভালোই জমেছিল আমাদের সেমিনার। আমাদের কাজ খুব উৎসাহের সঞ্চার করেছিল। নতুন ধরনের কাজ।

    নিউ ইয়র্কে থাকার সময় একদিন সন্ধ্যায় কনফারেন্স শেষে হোটেল ফিরব ট্যাক্সিতে। রোজ হেঁটে ফিরি। সেদিন বৃষ্টি পড়ছে আর বেশ ঠান্ডা। মনে হল কলকাতায় আছি নয়তো ঢাকায় আছি। কয়েকজন কে বললাম বাংলায় ও দাদা চলুন। ফাঁকা ট্যাক্সি বেরিয়ে যাচ্ছে আর বলছে আমাগো ডিউটি শ্যাষ হইয়া গ্যাসে। শেষে এক টার্কিশ ট্যাক্সি ড্রাইভার নিয়ে গেল।

    এর কয়েক বছর পর কেমব্রিজ থেকে লস এঞ্জেলেস এলাম। UCLA School of Law (University of California at Los Angeles)তে পেপার পড়তে। একাই। এবারে কোন ঝামেলা হয়নি।  কনফারেন্সের পর আলাস্কার উত্তরতম শহর বারো (Barrow) যাবার টিকিট কাটলাম। হোটেল বুক করলাম। প্রথমে Anchorage এসে বারো যাবার ফ্লাইটে উঠলাম। মাঝ পথে এসে প্লেন আর গেল না। বলল আবহাওয়া খারাপ। Fairbanks থেকে Anchorage ফিরে এলাম মাঝ রাতে। ওখানে ইয়ুথ হোস্টেলে থেকে আসে পাশে ঘুরলাম। ট্রেনে করে কয়েকটা এলাকায় গেলাম।

    প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছিল। Anchorage থেকে লস এঞ্জেলেস লন্ডন রুট না নিয়ে নতুন টিকিট কেটে দুদিন আগে সোজা ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে লন্ডন এলাম। কবে আর Barrow যেতে পারব জানি না। যাই হোক হোটেল কোন চার্জ করেনি। আর এয়ারলাইন্সকে লিখতেই ওরা টাকা ফেরত দিল।

    পরের বছর সামারে আবার হার্ভার্ড এলাম একটা কনফারেন্সে। এয়ারপোর্টে ইম্মিগ্রেশন কাউন্টার কয়েকটা মাত্র খোলা আর কয়েক হাজার বিমান যাত্রী। পাক্কা দু ঘন্টা পরে ইম্মিগ্রেশন অফিসারের কাছে আসতে পারলাম। উনি একটু আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করে বললেন এসব মিলছে না। তোমায় অন্য জায়গায় পাঠাচ্ছি নতুন করে হাতের ছাপ চোখের ছবি নিতে হবে। ঘাবড়ে গেলাম। যেখানে পাঠালো ওটা ছিল ডিটেনশন রুম। ওখানে এক ঘন্টা বসে রইলাম। আমার পালা আসতে অফিসার একটু কম্পিউটারে খুট খাট করে বাইরে যেতে দিলেন! বুঝলাম আগের জন দায়িত্ব এড়ালেন। পাক্কা তিন ঘন্টা বাদে ইম্মিগ্রেশন ক্লিয়ার করে বাইরে এলাম। ভাবছিলাম এই আমেরিকানরা হিথ্রো এয়ারপোর্টে এসে একটু দেরী হলে হৈ চৈ লাগিয়ে দেয়। জোর করে ঢুকে যাবার চেষ্টা করে! একটা  হোস্টেল বুক করেছিলাম। ওটা একটু সন্ধ্যা হলে বন্ধ হয়ে যায়। তাই হুড়মুড় করে ট্যাক্সি ধরে হোস্টেলে এলাম।

    কদিন হার্ভার্ড কেমব্রিজ ঘুরে লাগেজ নিয়ে হোস্টেল থেকে এয়ারপোর্ট যাব। হোস্টেল থেকে ট্যাক্সি ডাকা হল। সাদা ড্রাইভার মনে হয় আমায় রং দেখে খুশি হল না। লাগেজ তুলতে কোন সাহায্যই করল না। ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ হলে ট্যাক্সি ড্রাইভার অনেক অমায়িক হয় আর লাগেজ তুলে দেয়। কোন টিপস প্রত্যাশা করে না। ঠিকমত পাই পয়সা ফেরত দেয়। ইনি গাড়ি থেকে নামলেনই না। আমিও ঠিক করলাম টিপ্স দেব না দেখি কি করে! এবার উনি নেমে এসে চোখ পাকাতে লাগলেন। আমি না বোঝার ভান করে বললাম any প্রবলেম? তখন ব্যাটা বলে টিপস কে দেবে? আমি বললাম জানতাম না এসব দিতে হয় কোন এক্সট্রা সার্ভিস না পেয়ে। খুব ক্ষেপে গিয়ে বলল চাইনা তোমার টিপস। হুশ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। আমার পাঁচ ডলার বেচে গেল।

    বেশ কয়েকবার ওয়াশিংটন ডিসি এলাম একটা সস্তা এয়ারলাইন্সের (WOW airlines) ব্রিফ কেস অনলি টিকিট কেটে। ওরা করোনা ক্রাইসিস হবার আগে ভারতেও সার্ভিস শুরু করেছিল। এখন উঠে গেছে। এরা আইসল্যান্ডের রাজধানী রেকিয়াভিক (Reykjavík) হয়ে সব জায়গায় যায়। ওখানে আমায় যথারীতি আলাদা করে পাসপোর্ট ভিসা দেখে ছাড়ে। বেশিরভাগ সময় প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় এয়ারপোর্ট বিল্ডিং থেকে বাইরে লম্বা লাইন দিয়ে প্লেনে উঠতে হয়। সস্তার তিন অবস্থা বলে না! আমার অবশ্য লন্ডনে বেশ কয়েকবার হুরমুরিয়ে দৌড়ে Easyjet এর প্লেনে ওঠার অভিজ্ঞতা আছে। একবার ইউএসএ যাবার পথে রেকিয়াভিক নেমে বাইরে ঘুরে এলাম।

    একটা কনফারেন্স World Bank সংগঠন করেছিল। সেখানে শ্রমিক আইন আর বেকার সমস্যা নিয়ে গবেষণা পত্র পড়ি। ওরা হোটেল দিলেও ভাড়া দেয় নি। তাই সস্তার বিমান WOW ধরেছিলাম। ওরা দূরে বাল্টিমোর নামায়। শাটল পাওয়া যায়। শাটল ড্রাইভার সারাটা রাস্তা ফোনে বক বক করে। খুবই ভয়ের ব্যাপার।

    একবার বার্কলে এসে পেপার পড়ে নিউ অর্লিনস এলাম আরেকটা কনফারেন্সে। মোবাইলে তোলা বার্কলের কিছু ছবি কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে!

    সেবার সানফ্রান্সিস্কো এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি আমায় গা হাত পা প্রচুর টিপে দিয়েছিল। ওদের স্ক্যানার বলছে আমার দেহে কিছু আছে। তিন চারবার স্ক্যান করে শেষে গা ম্যাসাজ করল। কিছু না পেয়েও সন্দেহ যায় না। আমার মনে হয় আফ্রো-আমেরিকানগুলো উগ্র খ্রিস্টান আর তাই আজকাল বেশি বাড়াবাড়ি করছে আমাদের মুসলমান ভেবে।

    বার দুয়েক শিকাগো এসেছিলাম। প্রথমবার গরমের সময়।শেষবার ঠান্ডার মধ্যে এলাম। ব্রিটিশ এয়ারের টিকিট কাটলাম। কিন্তু ওটা ছিল কোড
    shared । আসলে আমেরিকান এয়ার লাইন্সের। বোর্ড পাস দেবার সময় অনেক খুট খুট করে আধ ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। আবার ওঠার সময় হাতে ভারতীয় পাসপোর্ট দেখে প্লেনে উঠতে না দিয়ে এক পাশে নিয়ে গিয়ে জেরা শুরু করল। আমি সব প্যাসেঞ্জারদের শুনিয়ে জোরে বললাম: what kind of racism is this? যেই বলল আমি duty করছি আমি বললাম হিটলারের ফ্যাসিস্টগুলো যেমন ডিউটি করত? অন্য প্যাসেঞ্জাররা ভয়েই হোক আর প্রতিবাদেই হোক প্লেনে উঠলো না। কিছু ভাটের প্রশ্ন করল । আমিও জোরে জোরে কাটা কাটা উত্তর দিলাম। তারপর গজ গজ করতে করতে প্লেনে উঠলাম। একজন বাদামি কর্মী আমায় বকে দিতেই আমি এমন রাগী চাহনি দিলাম চুপ করে গেল।

    ডিসেম্বর মাস। শিকাগো খুব ঠান্ডা। প্রচন্ড হাওয়া হাড় কাঁপিয়ে দেয়। বিরল আচার্য এসেছিল। আলাপ হল। তারপরই মোদির পরামর্শদাতা হয়ে দিল্লি এসেছিল।

    পরের বছর কর্নেল এলাম একটা সেমিনারে। খুব হাঙ্গামা করে যেতে হয়। এলাম নরওয়ের একটা সস্তা এয়ারলাইন্সের বিজনেস ক্লাস টিকিটে। বোস্টন হয়ে গেলাম ফিরলাম নিউ ইয়র্ক হয়ে। বোস্টন যাবার সময় বোর্ড পাশে চারটে S দিয়ে দিল। প্লেনে ওঠার সময় অনেক খোঁজাখুঁজি করল। হাতে কেমিকেল লাগিয়ে ফরেনসিক পরীক্ষা করে দেখল দু একদিনের মধ্যে কোন বিস্ফোরক ঘেঁটেছিলাম কিনা। আমি একটা খবরের কাগজে পড়েছিলাম এই চিহ্ন randomly দেয়। অনেক সাদা ভদ্রলোক ও এই চিহ্ন পেয়েছিল। কাছেই বসে আমি রগড় দেখছিলাম।

    শেষ বার আমেরিকা গেলাম কোলকাতা দিল্লি নিউ ইয়র্ক হয়ে আমহারস্ট। কলকাতা এয়ারপোর্টে আমার চারটে এস পড়েনি। পড়ল গিয়ে বউয়ের বোর্ড পাসে। ওকে আলাদা একটা জায়গায় যেতে হল। পুলিশ লাগেজ বিশেষ চেক করে রিপোর্ট লিখে আমেরিকা পাঠাল। পুলিশ বলল ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। অনেক সময় বাচ্চাদের বোর্ড পাসে এমন চিহ্ন পড়ে। কি জ্বালা!

    নিউ ইয়র্কে নেমে বোস্টনের ফ্লাইট ধরেছিলাম ওখানে দু দিন থাকব ঠিক ছিল। তখন এক আফ্রো আমেরিকান সিকিওরিটিবাবু আমায় খুব ভুগিয়েছিল। আমার নি ক্যাপ ছিল। খুলতে ভুলে গেছিলাম। খুলে এক্স রে করালাম। কিছু পেল না। তবু অফিসার ডেকে অনেক টাল বাহানা করে ছাড়ল। আমার দামি বেল্ট কেউ মনে হয় ঝেড়ে দিল। ওটা আর খুঁজে পাইনি।

    বেশ কিছুদিন Amherst ছিলাম। University of Massachusetts Amherst এ Political Economy Research Institute (PERI) ভিজিট করলাম। Gordon Hall এ অফিস দিল।

    পুরো শীত কাল কাটালাম। অনেক তুষার ঝড় বা blizzard ফেস করলাম। কেমব্রিজে যে সব সুট কোট পরতাম সেসব পরে শীত মানত না। সব ডাবল করে পরতাম। ডাবল জ্যাকেট প্যান্ট মোজা টুপি গ্লাভস। আমার টুপি পরতে ইচ্ছা করত না। কিন্তু খালি মাথায় বাইরে থাকলে কিছুক্ষনের মধ্যে মাথার ঘিলু যেন শুকিয়ে যেত। নোটরদামে অত শীত পাইনি। সেটা বোধ হয় এল নিনোর বছর। এখানে প্রায়ই মাইনাস কুড়ি সেলসিয়াস হত। সঙ্গে উইন্ড চিল (হাওয়ায় ঠান্ডা) মাইনাস ত্রিশ। আমি রোজই বেরোতাম।

    এখানে বেশির ভাগ বাস ফ্রি। কিছু বাস স্কুল কলেজ উনিভারসিটি খোলা থাকার সময়ে (term time এ) ফ্রি। তবে identity card দেখিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তুমি কলেজ টলেজের সঙ্গে কোন ভাবে যুক্ত। ব্যাপারটা আমার বেশ ভাল লেগেছিল। আমার ছাত্র জীবনে দেশে যদি এমন থাকতো!্ মনে হয় অত ঠান্ডায় মেটাবলিজম বেড়ে গিয়ে রোগা হয়ে গেছিলাম।

    এক সময় শীত কমে গেল। সব বরফ গলে গেল। চারিদিক সবুজ। ফুলে ভরা। পাখিরা আসতে লাগলো। আমার বাড়ি ফেরার সময় ঘনিয়ে এল।
    Amherst থেকে Lyft ট্যাক্সি ভাড়া করলাম। ওদের গাড়ি বেশ বড়। ওতে সব লাগেজ তুলে নিউইয়র্ক JFK এয়ারপোর্টের কাছে একটা হোটেলে একরাত কাটিয়ে এয়ারপোর্ট এলাম।

    বেশ রোগা হয়ে গেছিলাম বলে ফ্যাসাদে পড়লাম। এয়ারপোর্ট সিকিউরিটিতে বেল্ট খুলে দু হাত তুলে দাঁড়ালে প্যান্ট খুলে যাচ্ছিল। নিউ ইয়র্কে আবার সেই আফ্রো-আমেরিকান সিকিউরিটি। সন্দেহ করতে লাগল oversized জামা প্যান্ট কেন পরেছি। বললাম রোগা হয়ে গেছি। তবু সন্দেহ যায় না। জামা প্যান্ট চটকে চটকে দেখল কিছু আছে কিনা। স্ক্যানার যন্ত্র তো কিছু পাচ্ছে না। এরা কিছু বিস্ফোরক পেতে চাইছে। detain করতে চাইছে। এদের দেখে ওই লাইনটা মনে পড়ে: বাবু যত বলে পরিষদ দলে বলে তার শত গুণ। শেষ পর্যন্ত ফ্লাইট ধরে দিল্লি হয়ে কলকাতা ফিরলাম।

    ফেসবুক লিঙ্কে কিছু ফটো:
    https://www.facebook.com/share/p/1999JDN6MC/
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন