বিয়াট্রিক্স পার্কটা আলমের শহরের বুক চিরে প্রায় কয়েক কিলোমিটার বিস্তৃত। শহরের ইঁট কাঠের মাঝে হঠাৎ একটা সবুজে ঘেরা খোলা প্রান্তর। ব্যস্ততার মাঝে এক বুক নীরব সজীবতা। এক মুঠো অবকাশ।
আমার মেয়ে তখন বেশ ছোট। গরম কালে ওকে নিয়ে বেড়াতে বেরোলে প্রায়ই ওই পার্কে গিয়ে সময় কাটাতাম আমরা দুজনে। অন্ধকার থেকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছি যাকে সেই সদ্যজাতটিকে নিজের করে নেওয়ার জন্য একজন নতুন মায়ের যে অধ্যাবসায় এবং সাধনার প্রয়োজন সেটা সেই সবুজে ঘেরা খোলা প্রান্তরের নিবিড় ছায়ানীড়ে আমি আমার মতো করে অভ্যাস করতাম। একান্তে! সে সময়টায়, আমাদের দুজনেরই যে একে অপরকে চেনা এবং জানার প্রয়োজন ছিল। ঘাসের ওপরে একটা কাপড় বিছিয়ে শুইয়ে দিতাম ওকে। প্র্যামের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ও আনন্দে আত্মহারা হয়ে খেলা করতো আপন মনে হাত পা ছুঁড়ে। মাঝে মাঝে কয়েকটা প্রজাপতি উড়ে বেড়াতো ওকে ঘিরে। আর অস্তরাগে রাঙিয়ে ওঠা আকাশের গায়ে পাতার আলপনার ফাঁক দিয়ে নিভে যাওয়া সূর্যের অলস রশ্মি যেন লুকোচুরি খেলতো ওর সঙ্গে। এই আকাশ, বাতাস, ঘাস, ফুল, পাখি, কীট পতঙ্গ, এই সবকিছুর সঙ্গে একটি নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন হয়েছিল আমার মেয়ের। আমার সঙ্গেও বটে। তাই তো ফাঁক পেলেই এখানে দৌড়ে চলে আসতাম। কি যেন একটা খুঁজতে। কি জানি? হয়তো বা নিজেকে?
একদিন আনমনা হয়ে বসে আছি গাছের ছায়ায়। হঠাৎ তখনই অদূরে একজন বৃদ্ধা এসে কাঠের একটি বেঞ্চিতে বসলেন। লোলচর্ম, সাদা সিল্কের মতো ফিনফিনে চুল। লাল রঙের স্কার্ট আর সাদা লেসের শার্ট পরনে। পায়ে সাদা মোজা আর সাদা রঙের ব্যালেরিনা। একটা ওয়াকারে ভর করে কোনভাবে হেঁটে এসে কাঠের বেঞ্চিটায় বসে কেমন যেন আনমনা হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমাদের দিকে। মনে হল কিছু যেন বলতে চান আমায়।
আমার কি একটা মনে হল। অপরিচিতের কাছে অযাচিত ভাবে এগিয়ে গিয়ে তার মনের অবস্থা জিজ্ঞেস করার চল নেই এই দেশে, তবুও নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ওনার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "আমি কি কোন সাহায্য করতে পারি?" আমার কথা শুনে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ তারপর হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমিও কোন কথা না বলে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। বুঝলাম অনেকদিনের অনেক অব্যক্ত বেদনার বাঁধ যেন ভেঙে পড়েছে আজ। একজন ভিনদেশি অপরিজ্ঞাত মানুষের সামনে আবেগের এমন করুন বিস্ফোরণ আমায় কেমন যেন আনমনা করে তুলেছিল। আমি ওনাকে কিছুটা আস্বস্ত করার জন্য আবারও জিজ্ঞেস করলাম, "আমি কি কোন সাহায্য করতে পারি?" বৃদ্ধা কাতর, ক্লান্ত, অবসন্ন কণ্ঠে বলে উঠলেন, "আমায় আমার বাড়ি নিয়ে যাবে? আমি আমার বাড়িটা হারিয়ে ফেলেছি, আমায় আমার বাড়ি নিয়ে যাবে?"
তৎক্ষণাৎ কি করা উচিৎ আমি বুঝতে পারলাম না। পাশের একটি বৃদ্ধাশ্রম থেকে অনেকেই নিজ নিজ কেয়ারটেকারদের সঙ্গে নিয়ে এই সময়টায় পার্কে বেড়াতে আসেন, আমি তেমন কোনো কেয়ারটেকারও দেখতে পেলাম না আসে পাশে। হঠাৎ মনে হল ঘাসের ওপরে আমার মেয়েটা একা শুয়ে আছে। আমি ছুটে গেলাম ওর কাছে। ওকে কোলে তুলে নিয়ে নিজেকে কিছুটা সামলে নেবার চেষ্টা করলাম। ওই এক মুহূর্তে হঠাৎ মনে হল আমার মেয়েটাকে বুঝিবা আমি হারিয়ে ফেলেছি। পরমুহূর্তে বৃদ্ধার কাছে ফিরে যাবো বলে যখন ফিরে তাকালাম উনি ততক্ষণে ওয়াকারে ভর করে উঠে পড়েছেন এবং হাঁটতেও শুরু করেছেন। ফাঁকা বেঞ্চটার ওপরে একটা রুমাল আর একটা ডায়রি পরে রয়েছে কেবল।
আমি চাইলে সেদিনই ওঁকে ডেকে ওই দুটো জিনিস ফেরৎ দিয়ে দিয়ে আস্তে পারতাম, কিন্তু কেন জানি না মনে হল, এগুলো থাক আমার কাছে। ওনাকে পিছু ডাকবো না। কে বলতে পারে? হয়তো বা হারিয়ে যাওয়া বাড়ির ঠিকানা হঠাৎ মনে পরে গেছে আর সেই ঠিকানার উদ্দেশ্যেই রওনা দিয়েছেন উনি?
কদিন টানা বৃষ্টি হল। আমাদের পার্কে যাওয়া মুলতুবি রইলো রোদের প্রত্যাশায়। সপ্তাহখানেক পরে আবার একদিন ঝলমলে রোদে পার্কে গিয়ে দেখি বৃদ্ধা সেই একই জায়গায়, সেই বেঞ্চটায় বসে আছেন। আমি ওনার কাছাকাছি যেমন ঘাসের ওপরে গিয়ে বসি তেমনি বসলাম। উনি কিন্তু আমায় চিনতে পারলেন না। খানিক পরে ওয়াকারে ভর করে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমায় জিজ্ঞেস করলেন, "আচ্ছা? আমার ছেলেমেয়েদের দেখেছো? ওদের খুঁজে পাচ্ছি না।" আমি কিছু বলার আগেই মাথাটা হেঁট করে ওয়াকারটা ঘুরিয়ে হেঁটে চলে গেলেন। মনে হল যেন ওনার ছেলেমেয়েরা চিরতরে হারিয়ে গেছে। আমি কিন্তু সেদিনও ওঁর রুমাল আর ডায়রিটা ফেরৎ দিলাম না। মনে মনে ভাবলাম, যদি উনি একদিন ওনার হারানো রুমাল আর ডায়রির খোঁজ করতে আসেন আমার কাছে সেদিন না হয় তুলে দেব ওনার হাতে জিনিসগুলো?
সেদিনের পরে বৃদ্ধার সঙ্গে আমার আর কখনও দেখা হয়নি। আমার প্রাত্যহিকতা আর ব্যস্ততার মাঝে ওনার সাদা কালো স্থবির স্তব্ধ জীবনটা বেমানান হলেও ওনাকে কেন জানি না ভুলতে পারিনি আমি। ওনার মতো আমিও যে শিকড় খুঁজে বেড়াচ্ছি এ পরবাসে। কেমন করে সেই বৃদ্ধা নিজের অগোচরেই যে আমার ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠলেন টেরও পেলাম না।
আমার মেয়ের তখন ৪ বছর বয়েস। স্কুল যেতে শুরু করেছে। আমিও আরেকবার নিজেকে আর নিজের সদ্যজাত গৌরবময় মাতৃসত্তাকে আলাদা করার প্রবল প্রচেষ্টায় আবার কাজ করতে শুরু করেছি। একটু আধটু ছাই পাস্ যা মনে হয় লিখছিও। একদিন লিখতে বসেই হঠাৎ মনে হল সেই বৃদ্ধার ডায়রির কথা। মনে হল সেটা এবারে ফেরৎ দেবার সময় এসেছে বুঝি। ছায়াকে কি আর মুঠি ভরে নিজের করে আগলে রাখা যায়? সে যে কুলকুল করে নদীর মত বয়ে যাবেই।
কিন্তু ওনার নাম তো জানি না আমি। ডায়রির কোন এক পাতায় নিশ্চয় নাম লেখা থাকবে? এই ভরসাতেই বৃদ্ধাশ্রমে ফোন করে একটা এপয়েন্টমেন্ট নিলাম। রিসেপশনে একজন রাশভারী মাঝবয়সী মহিলা আমায় ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন বৃদ্ধাশ্রমের একতলার একটি ছোট্ট ঘরে। এখানেই আবাসিকদের আত্মীয় পরিজন আসলে তাদের সঙ্গে কতৃপক্ষ কথা বলে। মহিলার বয়েস পঞ্চাশ অনুর্দ্ধ।৬ ফুট লম্বা। একটা কালো শর্ট স্কার্ট আর সাদা রঙের শার্ট আর ওপরে একটা একটা কালো ব্লেজার পড়েছেন ভদ্রমহিলা। এই দেশে ফর্মাল পড়ার চল নেই খুব একটা তাই দেখলে নিজের অজান্তেই কেমন একটা সম্ভ্রম হল। কাঠের মেঝেতে খট খট শব্দ তুলে তিনি আমায় বসিয়ে ঘর থেকে বেরোলেন এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা ফাইল আর এক কাপ কফি নিয়ে ঘরে ঢুকে বললেন, "যার জিনিস দিতে এসেছেন তার নাম?" আমি অবললাম, "নাম তো জানি না, এই ডায়রিটা থেকে যদি কিছু তথ্য জানা যায়?"
গত ৪ বছর একদনিও আমি ডায়রিটা খুলে দেখিনি। ওই ঘরে বসে প্রথম পাতা ওল্টাতেই একটা ছবি নজর কাড়লো। নাৎজি সাইন। হলদে হয়ে যাওয়া ঝুর ঝুরে পাতার ওপরে লাল কালীতে এখনও যেন জ্বল জ্বল করছে। আর নীচে জার্মান ভাষায় লেখা, "arbeit macht frei " অর্থাৎ ওয়ার্ক মেক্স ইউ ফ্রি।
ডায়রির এই প্রথম পাতাটা দেখেই মনের মধ্যে জমে থাকা অনেক প্রশ্নের উত্তর মিললো। সঙ্গে সঙ্গে একটা আধ জ্বলন্ত পোড়া মানুষের গন্ধ যেন নাকে এসে লাগলো। কিন্তু কোন পাতার ওপরে নাম তো ঠিক চোখে পড়লো না আপাত ভাবে? আমি ওই মহিলাকে অনুরোধ করলাম, "আমায় একবার ছবিও যদি দেখান এখানকার সকল আবাসিকদের আমি ঠিক চিনে নিতে পারবো, আমার সঙ্গে যে ওনার বেশ কয়েকবার কথাও হয়েছে।" ওই দু দিনের সমস্ত কাহিনী সবিস্তারে বললাম ভদ্রমহিলাকে। গলাটা ভারী হয়ে উঠলো। এই দেশে আবেগতাড়িত হয়ে কথা বলে বিশেষ লাভ হয়না। এক্ষেত্রেও যে হবে না সেটা জেনেই নিজেকে সংযত করে আবারও যখন কথা বলতে যাবো, মহিলা বলে উঠলেন, "সরি, আমি সত্যি কোন সাহায্য করতে পারবো না। প্রাইভেসি রেগুলেশন্স! আমি কারুর ছবি আপনাকে দেখাতে পারবো না। তবে যাঁরা এই বছর এই হোম থেকে চলে গেছেন তাঁদের ছবি বাইরের করিডোরে লাগানো আছে। খুঁজে দেখুন তাদের মধ্যে কেউ কিনা।"
জীবনের রৌদ্র ছায়ায় অনন্ত জাগ্রত হয় বারে বারে। মৃত্যু অবসম্ভাবী, একজন পথভ্রষ্ট পথিকের কাছে মৃত্যুই তো সেই উত্তর যা অমৃত সমান। কিন্তু কেন জানি না সেই অশীতিপর অপরিচিত, অপরিজ্ঞাতর জন্যে হঠাৎ চোখটা ছল ছল করে উঠলো। ভয় পেলাম, তবুও ভীত পায়ে এগিয়ে গেলাম বোর্ডটার দিকে। ছবিগুলো পর পর দেওয়ালে টাঙানো। নিচে নাম আর জন্ম আর মৃত্যু সাল লেখা। এক একটা ছবি এক একটি জীবন কথা। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হল এরা ভিনদেশি, এঁদের জীবনগাঁথার আমি কিছু জানি না, এঁদের সঙ্গে আমার কোনোদিন আলাপ হয়নি তবুও যেন এরা আমার বহু দিনের চেনা। আমার বড় আপন। এই করিডোরটি বেশ খানিকটা লম্বা। শেষ দিকটায় একটা ঘোরানো লোহার সিঁড়ি উঠে গেছে। ল্যামিনেটটা চক চক করছে। সদ্য পালিশ করা যেন। প্রতিটি ছবির ওপরে একটা করে ফোকাস লাইট। এছাড়া করিডোরে আর কোন আলো নেই। কিন্তু তবুও যেন ঝলমল করছে গোটা করিডোরটা। একটা সুন্দর গন্ধ। "মৃত্যু অমৃত করে দান।"
এই করিডোরের ছবিগুলোর মধ্যে বৃদ্ধার ছবি খুঁজে পেলাম না। আমি নিজেকে কেন জানি না আর সামলে রাখতে পারলাম না। দৌড়ে গিয়ে রিসেপশনে বললাম, " না না উনি নেই ওখানে!"
ডায়রিটা নিয়ে আবার বসলাম। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল, যে এই ডায়রিটার মধ্যে নিহিত আছে বৃদ্ধার অতীত যা হয়তো ওনার কাছে প্রতিদিন যাপন করা একটা নিস্তরঙ্গ থমকে যাওয়া সময়। তার ভবিষ্যৎ নেই, বর্তমান নেই, কালের প্রবাহকে অস্বীকার করার মতো সাহসী কয়েকটা মুহূর্ত যা বৃদ্ধার মনের কোথাও অন্ধকারে জমাট বেঁধে আছে।
ডায়রির প্রথম কয়েকটা পাতায় কেবল কালো পেনের আঁচড়। তারপর কয়েকটা পাতা খালি। তারপর জার্মান কিছু শব্দ। আর তার পাশে কয়েকটি বাচ্চার ছবি আঁকা। কয়েকটা তারিখ। ১৯৪০, ১৯৪২। কোন কোন পাতায় শুধু "কিন্ড" শব্দটা লেখা, কোথাও কিছু হিসেব লেখা, কোথাও কোথাও আবার বাজারের ফর্দ।
কদিন যাবৎ কেবল নাড়াচাড়া করেছি ডায়রিটা নিয়ে, কিন্তু দুর্বোদ্ধ মনে হয়েছে।শুধু শেষের একটা পাতায় আমস্টারডাম শহরের একটা ঠিকানা খুঁজে পেয়ে খানিকটা হলেও নিজেকে আশ্বস্ত করেছি।
গুগল ম্যাপের দৌলতে এই দেশে সহেজেই "ডেস্টিনেশনে" পৌঁছে যাওয়া যায়। ম্যাপে দেখলাম আমার বাড়ি থেকে এই ঠিকানার দূরত্ব ঠিক ৩৫ কিলোমিটার। আর অফিস থেকে মিনিট পাঁচেক।
একদিন দুপুরবেলা অফিস থেকে বেরিয়ে গেলাম শহরের পশ্চিমে সেই ঠিকানায়।রো হাউসেস, যেমনটা হয় এই দেশে। তবে এলাকাটা বেশ পুরোনো এবং বিকেলের পর থেকে খুব নিরাপদও নয় হয়তো বা। বাড়িগুলো বেশ ভাঙাচোরা। কোন কোন বাড়ির জানলার কাঁচও নেই, খবরের কাগজ সাঁটা। সামনে যে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে সেগুলো এই নেবারহুডের গাড়ি বলা বাহুল্য, কিন্তু সব যেন জং ধরা মান্ধাতা আমলের। ডাচ পাড়ায় এমনটা দেখা যায় না। সুতরাং বুঝতে বাকি রইলো না যে এলাকাটা নয় টার্কিশ না হলে মরোক্কন অধ্যুষিত।
নাম্বার ৩০। দরজার বেল বাজাতে একজন বৃদ্ধা দরজা খুললেন। গায়ে ভুর ভুর করছে সিগারেটের গন্ধ। একটা খড় খড়ে, ভাঙা কণ্ঠে বললেন, " খুদে মিড্ দাগ" "গুড আফটারনুন", আমি হেসে উত্তর দিলাম। কিন্তু তৎক্ষনাৎ বুঝতে পারলাম, এনার সঙ্গে ইংরিজি ভাষায় কথা বলে খুব একটা লাভ হবে না।
এখানে একটু পূর্ব কথা বলা প্রয়োজন। ওই ডায়রিটা নিয়ে আমি আমার পড়শী, একজন বৃদ্ধ ডাচ ভদ্রলোক, পিটারের কাছে গিয়েছিলাম। উনি জার্মান জানেন বলে মনে হয়েছিল ওই হাতে লেখা জার্মান শব্দের লিটারাল গুগল ট্রান্সলেশন করলে আমি কিছুই পাঠোদ্ধার করতে পারবো না। তাই পিটারের সাহায্য নিতেই হত আমাকে। ওঁর থেকেই জানতে পারি যে আমস্টারডামের ওই ঠিকানা বৃদ্ধার প্রথম ফস্টার হোম। জার্মানি থেকে এই দেশে আসার পরে প্রথম ১০ বছর আমস্টারডামের ওই বাড়িতে উনি ছিলেন।তারপর একের পর এক ঠিকানা পাল্টেছে। পরিবারের ছায়া বদলেছে। জীবনের রূপ রস গন্ধ সবটা পাল্টেছে। পিটারের থেকে জানতে পারি ওই বৃদ্ধার গোটা ছোটবেলাটা অর্থাৎ ১৮ বছর বয়েস অবধি আমস্টারডাম শহরের কোন না কোন ফস্টার হোমে কেটেছে।
যিনি দরজা খুললেন তিনি ভেতরে যেতে বললেন না আমায়। আমি বাইরে থেকেই ওনাকে ঘটনাটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম। এও বললাম বৃদ্ধাকে আমি চিনি না কেবল দু দিনই দেখেছি। ওনার জিনিসগুলো শুধু ওনাকে ফেরৎ দিতে চাই। আমিও যে ওনারই মতো বৃন্তচ্যুত।
পেছন থেকে বেশ কয়েকটা বেড়াল দরজা ঠেলে বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করছিল। তাদের সমবেত কণ্ঠস্বরে এই বৃদ্ধার কথা যেন একটা বেতালা যুগলবন্দীর মতো শুনতে লাগছিল। সেই সঙ্গে ওই গৃহপালিত চতুস্পদ মার্জার জাতির সমবেত গোঁতানোর শক্তির সঙ্গেও এই বৃদ্ধা পাল্লা দিতে পারছিলেন না। অগত্যা, আমায় ভেতরে আসতে বলে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
সময় যেন থমকে গেছে বাড়িটার চার দেওয়ালের মধ্যেই। ঘরের প্রতিটি কোণায় ধুলোর আস্তরণ। একটা বহু পুরোন লেদারের সোফা, শত ছিদ্র। পাশে একটা পায়া ভাঙা কাঠের টেবিলে একটা ল্যাম্প। সেটিও মুখ থুবড়ে পরে আছে। জানলায় বেলজিয়ান লেসের পর্দার রং বোঝা ভার। ভেতরের নিস্তরঙ্গ, রূঢ় সময়টাকে বাইরের গোটা জগৎটা থেকে ঢেকে রাখতে রাখতে তার রঙও ধূসর হয়ে গেছে। চারিদিকে ওয়াইনের খালি গ্লাস আর খালি বোতল ছড়ানো। বেড়ালের খাবারের জায়গায় জল রাখা। সাদা, কালো, হলুদ বেড়াল মিলিয়ে মোট ৬ খানা বেড়াল বাড়িটাতে। আমস্টারডাম শহরে ইঁদুর দংশনের জন্য বেড়াল পোষা হয়ে থাকে এই কথা শুনেছি বটে তবে এরকম ডজন খানেক বেড়াল যে কেবল মাত্র মূষিক বংশ ধ্বংস করবার জন্য সেটা সত্যি আমার ভাবনাতীত।
৬ খানা বেড়ালের মধ্যে যে এগুলো একটু বেশি মোটাসোটা সেগুলো সোফায়, বা জানলার কার্নিশে, বা টেবিলের ওপরে কুন্ডলি পাকিয়ে রয়েছে। আর যেগুলো একটু ক্ষিপ্র বা চঞ্চল সেগুলো বৃদ্ধার পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘরের মধ্যে সিগারেট, ওয়াইন মানুষ এবং চতুষ্পদের গন্ধ মিলিয়ে কেমন যেন একটা দম বন্ধ করা অদ্ভুত কনককশন। ঘরে ঢোকা মাত্র গন্ধের তীব্রতা কেমন যেন নাকে এসে লাগে। একটা এলোমেলো, ভগ্ন, অগোছালো জীবনের ভগ্নস্তূপের ছবিটা হয়তো বা এরকমই হয়।
আমি বৃদ্ধার হাতে ডায়রিটা দিয়ে বললাম, "আমি এনারই খোঁজ করতে করতে আপনার বাড়ি এসে পৌঁছেছি। এই ডায়রীটাই ওনাকে ফেরৎ দিতে চাই। মনে পরে এমন কাউকে যিনি এই বাড়িতে দুই কি তিন বছর বয়েসে এসেছিলেন ফস্টার চাইল্ড হিসেবে?"
বৃদ্ধার চোখের দৃষ্টি আর রুক্ষ চেহারা দেখে ওনার স্মৃতিশক্তি বা অন্যকে সাহায্য করার ইচ্ছে কোনোটার প্রতিই তেমন আস্থা জন্মায় নি আমার। কিন্তু বাড়িটা দেখে এইটুকু বুঝেছি ততক্ষণে যে অতীত এখানে বটবৃক্ষের মতো শিকড় বিস্তার করেছে আর তার প্রতিটি ডাল পালায় ইতিহাস তার বাসা বেঁধেছে।
ডায়রিটা হাতে নিয়ে খানিক নেড়ে চেড়ে বৃদ্ধা পাশের টেবিলে রাখা রেড ওয়াইনের বোতল থেকে একটু ওয়াইন গ্লাসে ঢেলে আমায় বললেন, "ওর নাম ফ্রেয়া!" তার পর বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ বললেন, "তোমার কাছে সিগারেট হবে?"
আমি লেশ মাত্র বিস্মিত না হয়ে বললাম, "আমার কাছে তো নেই, কিন্তু আমি এনে দিতে পারি। যদি আপনি ফ্রেয়া সম্পর্কে আমায় আরেকটু কিছু বলেন, আমি সিগারেট ওয়াইন দুটোই এনে দেব!"
বৃদ্ধা এক গাল হেসে, এক অদ্ভুত অকুন্ঠ এবং তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, আমার তখন ২ বছর বয়েস যখন আমার বাবা ওকে নিয়ে আসে এই বাড়িতে। আমি ওকে কোনোদিন পছন্দ করতাম না। ও আসার পর থেকেই বাড়িতে নানা অশান্তি শুরু হয়। ওর যখন ৬ বছর বয়েস তখন থেকেই ওকে আমার বাবা প্রায়ই ওপরের একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে সন্ধ্যে বেলা দরজা বন্ধ করে দিত। ও চিৎকার করলে ওর মুখ বেঁধে দিত। আমিও তখন ছোট। তেমন কিছু বুঝতাম না। কিন্তু ওর চিৎকার করলে আমার ভালো লাগতো। আমার যখন ৯ বছর বয়েস তখন আমার মা মারা যায়। বাবা আবার বিয়ে করে। সেই বছরই। আর সেই বছরই, ওর তখন নয় কি দশ হবে, ও আমাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়।" একটা অদ্ভুত নিষ্ঠুর হাসির রেখা ফুটে ওঠে বৃদ্ধার মুখে, চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে।
আমার চোখদুটো জ্বালা করে ওঠে হঠাৎ। একটি দশ বছরের শিশু কোথায় যাবে পালিয়ে? কেমন করে জীবনধারণ করবে? আমার সমস্ত গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।
বৃদ্ধাকে দু প্যাকেট সিগারেট আর এক বোতল ইটালিয়ান ওয়াইন কিনে দিয়ে ভারাক্রান্ত মনে আমি বাড়ি ফিরলাম সেদিন। ফ্রেয়ার এই ক্ষুদ্র অতীতটা একটা কালো প্রতিচ্ছায়া হয়ে আমার পিছু পিছু ফিরে এলো যেন আমার সঙ্গে।
আমি গেলাম আবার সেই বিয়াট্রিক্স পার্কার বৃদ্ধাশ্রমে। রিসেপশনের সেই মহিলা আমায় রেজিস্টার দেখে জানালেন ফ্রেয়া নামে কেউ সেই বৃদ্ধাশ্রমে কোনোদিন ছিল না।
এও সম্ভব? এতো ক্রমশ রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে। আমি যে অন্ধকারে আর পথ খুঁজে পাচ্ছি না।
মরিয়া হয়ে গেলাম মিউনিসিপালিটি। সেখানে গিয়ে জানতে চাইলাম এরকম একজন নিখোঁজ মানুষের খোঁজ পেতে গেলে কি করা উচিত? কোথায় যাওয়া উচিৎ। সেখান থেকে আমায় জানানো হলো একমাত্র কেয়ার হোম-ই ভরসা। আর যদি সেখানে একান্ত না খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটি বা রেড ক্রেসেন্ট সোসাইটি - এই ধরণের মিসিং লিংক নিয়ে কাজ করে।
রেড ক্রসের অফিস ডেন হাগে। আলমের শহর থেকে ঘন্টা খানেক লাগে ট্রেনে। ৭৫ কিলোমিটার দূরত্ব। অনেকগুলো এপয়েন্টমেন্ট, অনেকগুলো ঘন্টা, অনেকগুলো দিন। এদের এখানে ওয়ার ভিকটিমদের সব কিছু নথিভুক্ত। এদের সেই আর্কাইভকে যে আমি কোন বিশেষণে ভূষিত করবো ঠিক জানা নেই আমার। এই খাতাতেই, "ফ" অক্ষরের তালিকায় ১৯৪৩ সালে জার্মানি নাৎজি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাওয়া ফ্রেয়া বেনহাইম এবং তার মা মার্গারেট বেনহাইমের সমস্ত ইতিবৃত্ত জানতে পারলাম।
ফ্রেয়া! সবাই তাকে ফ্রে বলে সম্বোধন করতো। ২০ বছর বয়েস অবধি সব মিলিয়ে সে ১০ টি ফস্টার হোমে থেকেছে। কোথাও থেকে নিজে পালিয়েছে, কোথাও থেকে তাকে বিতাড়িত করা হয়েছে। অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা, নির্যাতন, অপমান কত কিনা সহ্য করেছে সে ওই ২০ বছরের সময়টুকুর মধ্যে। যখন ফস্টার হোম থেকে পালিয়েছে রাস্তায় পুলিশ তাকে নিয়ে গেছে। জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে যখন ফ্রে বলেছে সে আর ওই বাড়িগুলোতে ফিরে যেতে চায় না তখন অর্ফানেজে রাখা হয়েছে ওকে। কিন্তু তারপর আবার কয়েকমাস পরে আরেকটা ফস্টার হোম। কোথাও ১ মাস কোথাও ১ বছর, কোথাও ৬ মাস এই ভাবে ২০ টা বছর কেটে গেছে।
শেষের যে হোমে ফ্রে ঠাঁই পেয়েছিলো সেটি একজন ব্যালেট ডান্সারের বাড়ি। ১৮ বছর বয়েসে ফ্রেকে নিয়ে গিয়ে সেই ডান্সার ব্যালেট ক্লাসে ভর্তি করে দেন। সেই থেকে নাচ-ই যেন হয়ে ওঠে ফ্রের বেঁচে থাকবার রসদ। শুধু নাচকে ভালোবেসে ফ্রে তার যৌবন ফিরে পায়, নিজেকে ভালোবাসতে শেখে। ধীরে ধীরে স্টেজ পারফর্মেন্স করতে শুরু করে। ২১ বছর বয়েসে ভিভিয়ান বলে একজন ডাচ পিয়ানো বাদকের সঙ্গে আলাপ হয় এক কনসার্টে। গভীর প্রেম হয় দুজনের। বিয়ে করে ওরা। ২২ বছর বয়েসে ২ সন্তান হয় পর পর।
রেড ক্রসের জার্নালিস্ট আমায় তারপরে জানিয়েছিল ফ্রেয়া বেনহাইম বিয়ে হবার পরে নাম পাল্টে নতুন নাম রাখে প্যাট্রিসিয়া ভ্যান ডেল্ফট। হয়তো সেই কারণেই আলমেরেরের কেয়ার হোম তাকে খুঁজে পায়নি তাদের রেজিস্টারে।
একদিন যখন এপয়েন্টমেন্টের শেষে সেই জার্নালিস্ট ফাইল বন্ধ করে দিয়ে আমায় বললো, "প্যাট্রিসিয়া এখন আলজাইমার এর পেসেন্ট।"
আমি সে কথাটা শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম তা নয়। তবুও কেন জানি না শান্তি পেলাম শুনে। অন্তত সে আছে। তার অতীতের যতটুকু আমার কাছে গচ্ছিত আছে, তার সবটা তাকে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে হয়তো বা স্মৃতি আর বিস্মৃতির মাঝে আমি কোন একটা আলোর সন্ধান দিতে পারবো?
জার্নালিস্ট ভদ্রমহিলাকে বললাম, "এই ডায়রিটা ওনার। এটাই ওকে আমি ফেরৎ দিতে চাই।"
প্যাট্রিসিয়া আজ আর আলমের শহরের কেয়ার হোমটায় নেই। ২০১৪ সালের ১০ই জুন উনি মারা গেছেন। জীবন সায়াহ্নে এসে যে শৈশবকে তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন এতকাল কে বলতে পারে সমস্ত চরাচর তার দুবাহু বিস্তার করে তাঁকে সেই শৈশবই হয়তো বা ফিরিয়ে দিয়েছে?
অনেকদিন পরে একদিন কাজ থেকে ফিরে চায়ের কাপ হাতে আনমনা হয়ে বসে প্যাট্রিসিয়ার কথা ভাবছি, তখনই হঠাৎ আমার মেয়ে আমার কোলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমার গলা জড়িয়ে ধরে আমায় জিজ্ঞেস করলো, "কোথায় গেছিলে মা আমায় ছেড়ে? আর কখনো আমায় ছেড়ে যাবে না তো ?" আমি ক্লান্ত কণ্ঠে বললাম, "না! মা যাবো না! কখনও যাবো না!"