একজন লেখকের সাথে কাজের কথা হচ্ছিল। প্রাসঙ্গিকভাবেই তাঁর গল্পের কথা এলো। গল্পবিষয়ক সেই দু চারটে কথা যে নেহায়েত ‘অকাজ’ এর ছিল না, সেটা টের পাওয়া গেল কয়েকদিন পর। পাখির কথা বলছিলাম। সেই গল্পে পাখি মৃত্যুর প্রতীক ছিল আমার কাছে। সেটা বলার আগেই লেখক পাখিকে জীবনের প্রতিচ্ছায়া বললেন। ভীষণ চমকে উঠলাম। যৎসামান্য যা পড়ি নিষ্ঠাটুকু থাকে। লেখকের পুরোটা হয়তো ধরতে পারি না। সম্ভবও না। তাই ব’লে জীবনকে মৃত্যু? জীবন ‘কেনো’? এর উত্তরে গল্পের চরিত্র ধরে ধরে জীবন দেখালেন। এবার আমি মৃত্যুর কথা বললাম। এমন ভাবনাজনিত কারণগুলোও বিশ্লেষণ করলাঁম। উনি অমত করলেন না। হয়তো কিছু ভাবলেন। যেন বহুদূর থেকে তাঁকে শুনতে পেলাম- অবচেতনে কার কী যে থাকে!
সেই স্মৃতি ফিরে এলো রলাঁ বার্ত এর প্রবন্ধ ‘দ্য ডেথ অফ দি অথর’ পড়তে গিয়ে। লেখক মরে যাচ্ছে আর লেখা জন্মাচ্ছে। একই সাথে দুটো ব্যাপার ঘটছে। লেখা এমন হতে পারে যেটা প্রতীকবিহীন কিংবা সরাসরি বাস্তব ঘটনার সাথে যুক্ত নয়। এমন লেখা বর্ণিত হতে থাকলে লেখকের সাথে লেখার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। রলাঁ বার্ত বলেছেন- সমালোচকরা সাহিত্যে ঢালাওভাবে লেখকের সত্তাকেই খুঁজে পায়। বোদলেয়ারের সাহিত্য ব্যক্তি বোদলেয়ারের ব্যর্থতা, ভ্যান গখের কাজ ব্যক্তি ভ্যান গখের পাগলামি, চায়কোভ্স্কির (Tchaikovsky) কাজ তাঁর অসততা। যে কোন কাজের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যেন সেই কাজটার মধ্যে নির্মাতাকেই দাবী করে বসে। এর পেছনে কারণ হিসেবে বলা হয়েছে- এই সমাজ মধ্যযুগীয় ইংরেজী অভিজ্ঞতাবাদ/প্রয়োগবাদ (Empiricism), ফরাসী যুক্তিবাদ (Rationalism) আর রিফর্মেশনের ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে ব্যক্তির ‘গৌরব’কেই আবিষ্কার করতে চেয়েছে। তাই সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এই দৃষ্টবাদ পুঁজিবাদের আদর্শ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। তাই এমনটা ধরে নেয়া হয় গল্পে বা উপন্যাসে কম আর বেশি যে কোনো রূপকে সেই একই ব্যক্তির স্বর শোনা যায়, যিনি এর লেখক। লেখাটিতে যেন শেষ পর্যন্ত শুধু লেখকই।
অনেক সময় লেখক নিজের বিপরীত অবস্থানে গিয়েও তো আখ্যান লিখতে পারে। সেক্ষেত্রে লেখকের স্বর আর চরিত্রের স্বর কখনোই এক হবে না। একজন পুরুষ লেখকের কলম যখন নারীর জবানীতে আখ্যান লেখে কিংবা একজন নারী লেখকের কলমে পুরুষ যখন গল্পকথক (প্রোটাগোনিস্ট) হয়ে ওঠে তখন আলাদা করে লেখকের স্বর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। লেখক অভিজ্ঞতা, রুচি, আবেগ, পর্যবেক্ষণ, দর্শন, ইতিহাসসহ সংস্কৃতির অগণন সূত্র মিলিয়ে বিপরীত লিঙ্গের চরিত্রটিকে তৈরি করে। চরিত্রটি লেখকের স্বরে নয় ভিন্নস্বরে কথা বলে। আসলে তখন ভাষা কথা বলে। লেখক না। অটো রাইটিং বা স্বতোলিখনে যা রচিত হয় সেটাই টেক্সট হয়ে ওঠে। ভাষা পারফর্ম করতে থাকে, লেখা তৈরি হতে থাকে। অটোম্যাটিক রাইটিং শব্দটা পড়ে মনে হলো- সব লেখাই আসলে অটো রাইটিং। লিখতে লিখতে শেষটা লেখাই নির্ধারণ করে দেয়। অনেক সময় শেষের আগেই লেখক জেনে যান পরিণতিতে কী হতে যাচ্ছে। বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনার আখ্যান হলে আগে থেকেই লেখকের শেষটুকু জানা থাকে। একেবারেই কল্পনা আশ্রিত লেখাগুলোর ক্ষেত্রে কী ঘটে? কিংবা যে আখ্যানের বেশিটাই কল্পনাশ্রয়ী? তেমন হলে লেখাটা নিজ থেকে বয়ে যায়। এগিয়ে যায়। ঘটনা এবং চরিত্র স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের পরিণতিতে পৌঁছে যায়। একবার একজন লেখক জানালেন বেশিরভাগ গল্পের শেষটা তিনি কখনই জানেন না। লেখাই টেনে নিয়ে যায়। আরেকজনের লেখকের অভিজ্ঞতা বলছে- তিনি জানেন গল্পের শেষে কী হবে। শতভাগ কল্পনাশ্রয়ী গল্পে তিনি শেষটা জেনে ফেলেছেন আসলে কল্পনাতেই। দৃশ্যত লেখক না লিখলেও অদৃশ্য কালিতে অবিরাম যিনি লিখে চলেছে। নিজের অজান্তে সেই লেখা পরিণতিতে পৌঁছে গেছে। এবার কাগজে কলমে অক্ষরে লেখার প্রকাশ ঘটার পালা। পরিণতি বলতে ক্লোজ এন্ডেড উপসংহার বা পূর্ণতা নয় লেখার শেষাং বোঝানো হয়েছে। লেখার শেষটুকু অনিশ্চিতিরও হতে পারে।
এবার প্রসঙ্গে ফিরি। লেখক যখন লেখেন কোনো তত্ত্ব না ভেবেই লেখেন। নিয়মের বাইরে গিয়ে লেখা হচ্ছে নাকি নিয়ম অনুসারে- এসব হিসাব করে লেখা যায় না। লেখক নিজ গরজে লেখে। লেখা বিশ্লেষণ করা অধ্যাপক বা গবেষকের বিবেচ্য ব্যাপার। লেখক অসাধারণ কৌশলে লেখক আর চরিত্রের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে। পরাবাস্তববতা এর একটা উপায় হতে পারে। পরাবাস্তব ঘোর লেখা থেকে লেখকের ছায়া মুছে দেয়। আরেকটি ব্যাপার হতে পারে, যেখানে শুধু একজন ব্যক্তিই কথাগুলো বলছে না। লেখায় বহুস্বর এসেছে। এমনও হতে পারে নির্দিষ্ট কোনো উৎস বা ব্যক্তি নয় কোনো বস্তু বা অনুভবকে লেখক ব্যক্তি রূপে প্রকাশ করছে। এর ফলে লেখায় শুধুই লেখককে আবিষ্কার করে লেখাটিকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা যায় না। চূড়ান্ত ব্যাখ্যা বা পরিনতির কথা বলা যায় না। প্রতিটি স্তরে লেখাটির প্রসারিত হবার সুযোগ থাকে।
অনেক সময় অজান্তেই লেখক লেখার মধ্যে ঢুকে পড়ে। ঢুকে না পড়াটাই কৃতিত্ব। লেখার মধ্যে লেখক নর্ম্যাটিভ হয়ে উঠলে সেটা সাহিত্যের শিল্পগুণ নষ্ট করে। বরং চরিত্র সৃষ্টি আর ঘটনা বর্ণনায় লেখক শিল্পিতভাবে আদর্শটিকে ফুটিয়ে তুলতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে- একটি লেখার কতটুকু লেখকের উদ্ভাবন? আর কতটুকুই বা কল্পনা? শুধু কল্পনা করে করেই কি লেখায় চরিত্র আর ঘটনা নির্মিত হয়? নাকি জীবন ও সমকালের দিকে তাকিয়ে অভিজ্ঞতায় জারিত হয়ে গড়ে ওঠে লেখার অবয়ব? উত্তর যাই হো্ক, সে অর্থে কোনো লেখাই আদপে মৌলিক নয়। লেখা এগিয়ে যায় বিভিন্ন ঘটনাস্রোতের মিশেলে এবং সংঘর্ষে।
লেখার শুরুতেই লেখকের অবচেতন মনের কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম পাঠকের ভাবনার কথা। একজন লেখকের লেখানির্মাণ প্রক্রিয়া ঘটে অবচেতনে। দৈনন্দিন জীবনে একজন লেখক পারিবারিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এমনকি রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে অভিজ্ঞতা লাভ করে। এই অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ এবং বদলে যাওয়া পরিস্থিতি অবচেতনে সংশ্লেষিত হয়। সময়ের সাথে উপাদানগুলো জারিত হয় অসংখ্য অনুভূতির সাথে। তারপর লেখকের দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে কল্পনা মিলে অবচেতন মন চলতে থাকে এ প্রক্রিয়া। একজন লেখক তাই সব সময় লেখক। যখন লিখছেন না তখনো লিখছেন। কাগজে কিংবা মগজে। সজ্ঞানে কিংবা অজান্তে। লেখাটি প্রকাশ পেতে থাকে ভাষার মাধ্যমে। ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে রলাঁ বার্ত বলেছেন- লেখক ওই লেখার সময়টির বাইরে আর কিছু নন। যতক্ষণ লিখছেন ততক্ষণ তিনি ওই টেক্সটের অধিকর্তা। যেমন- ‘আমি’ আসলে ওই মানুষটির বেশি কিছু নয়, যে ‘আমি’ শব্দটি উচ্চারণ করল।। ভাষা ‘ব্যক্তি’ চেনে না, চেনে বিষয়। বিষয়টি উচ্চারিত হওয়াই ভাষার জন্য যথেষ্ট। আগে বলা হতো লেখকের অস্তিত্ব থেকে বইয়ের জন্ম। অনেকটা জন্মদাতা-জন্মিত এর সম্পর্কের মতো। কিন্তু আধুনিক লেখায় টেক্সটের সাথে সাথেই লেখক জন্মান। লেখার আগেপরের কোনো সত্তা লেখকের নেই। উচ্চারণের মুহূর্তটুকুতেই সে লেখক। লেখকের এই অপসারণ বা সরে যাবার ধারণাটিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল পাঠক।
পাঠক যখন পড়ছে সামগ্রিকভাবে একটি লেখার অস্তিত্ব উন্মোচিত হচ্ছে। কত কিছু নিয়েই একটা লেখা গড়ে ওঠে। বিভিন্ন সংস্কৃতি থেকে উদ্ভুত হয়ে ঢুকে যায় সংলাপে, প্যারোডিতে, বিরোধে। লেখার এই অনুষঙ্গগুলো কোথাও না কোথাও গিয়ে সংগৃহীত হয়। যুক্ত হয়। সে জায়গাটা কিন্তু লেখকের অবচেতনে নয়। পাঠকের অবচেতনে। সেখানে কিছুই হারায় না। থেকে যায়। লেখাটি উৎস মুছে দিয়ে গন্তব্যের সাথে ঐক্য গড়ে। লেখকের থেকে পাঠকের হয়ে যায়। সুসান সনটাগের পড়া জেমস জয়েসের ‘ফিনেগানস্ ওয়েক’ এর পৃষ্ঠাটি দেখে তাই স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। লাল আর কালো কালির অসংখ্য দাগ, কাটাকুটি, অজস্র নোট, অ্যানোটেড যেন বইটির আত্মাকে খুঁজে পেতে চাইছে। সাদা জায়গাগুলো ভরে যাচ্ছে। এমনকি দুটো লাইনের মাঝখানের সাদা অংশটিও বাদ নেই। সুসান যেন দৃশ্যানুভূতিকে চৈতন্যে অনুভব করতে চাইছে। পাঠক লেখকের সমান্তরালে লেখক হয়ে উঠছে। একটি লেখার সমান্তরালে তৈরি হচ্ছে আরেক লেখা।
তাই একই পাখি লেখক আর পাঠকের কাছে জীবন আর মৃত্যুর প্রতীক হয়ে ওঠে। পাঠক আমি যেমন চমকে উঠেছিলাম জীবনের কথা শুনে। লেখকও বিস্মিত হয়েছিলেন মৃত্যুর কথা শুনে। অবচেতন নাকি সত্যের দিকে যায়। এভাবেই একটি লেখা উৎস থেকে ধাবিত হয়। পূর্ণতার গন্তব্যে পৌঁছে যায়।
…